বব গেলডফ—একটি নাম যা কেবল সংগীত বা বিনোদনের জগতে নয়, মানবতাবাদ এবং বিশ্বব্যাপী সেবার জন্যও গভীর শ্রদ্ধা অর্জন করেছে। তাঁর নাম শুনলেই প্রথমে মাথায় আসে ‘Live Aid’-এর মতো আন্তর্জাতিক দাতব্য কনসার্টের কথা, যা লাখো মানুষের জীবন বদলাতে সহায়ক হয়েছে। কিন্তু বব গেলডফের পরিচয় কেবল একজন দাতব্য উদ্যোগকারী হিসেবে সীমাবদ্ধ নয়; তিনি একজন প্রতিভাবান সংগীতশিল্পী, গীতিকার এবং রাজনীতিক হিসেবেও প্রশংসিত। তাঁর জীবনের বিভিন্ন দিক এবং সংগীতের মাধ্যমে সামাজিক বার্তা ছড়ানোর চেষ্টা তাঁকে আধুনিক সময়ের অন্যতম মানবিক নেতায় পরিণত করেছে।
বব গেলডফের জন্ম ১৯৫১ সালের ৫ অক্টোবর আয়ারল্যান্ডের ডাবলিনে। তিনি বড় হয়েছেন একটি মধ্যবিত্ত পরিবারে। তাঁর প্রাথমিক জীবনের একটি গুরুত্বপূর্ণ দিক হলো, কৈশোরকালেই তিনি সমাজের বঞ্চিত এবং অবহেলিত মানুষের প্রতি সহানুভূতিশীল হয়ে ওঠেন। গেলডফ সংগীত জগতের প্রতি ঝোঁক শুরু করেন ষাটের দশকে, যখন তিনি মার্কিন রক অ্যান্ড রোল এবং ব্রিটিশ মিউজিকের প্রভাবের মধ্যে বেড়ে ওঠেন। ১৯৭৫ সালে তিনি 'দ্য বুমটাউন র্যাটস' (The Boomtown Rats) নামে একটি পাঙ্ক রক ব্যান্ড গঠন করেন, যা পরবর্তীতে তাঁকে খ্যাতির শীর্ষে নিয়ে যায়।
'দ্য বুমটাউন র্যাটস'-এর অন্যতম জনপ্রিয় গান "I Don't Like Mondays" ছিল একটি সামাজিক বার্তা সংবলিত গান। ১৯৭৯ সালে মুক্তি পাওয়া এই গানটি যুক্তরাষ্ট্রের একটি ঘটনার প্রতিক্রিয়া হিসেবে লেখা হয়েছিল। গানের কথাগুলি ছিল হতাশা এবং নিরাশার গভীর চিত্র। গানটির কয়েকটি লাইন এমন ছিল:
"The silicon chip inside her head gets switched to overload,
And nobody's gonna go to school today,
She's gonna make them stay at home."
এই গানের মাধ্যমে গেলডফ এমন একটি কঠিন বাস্তবতাকে তুলে ধরেছিলেন যা সমাজের দৃষ্টিভঙ্গিকে নাড়া দিয়েছিল। গানটি প্রমাণ করে যে গেলডফ কেবল বিনোদনের জন্য গান করেননি, বরং তাঁর প্রতিটি সৃষ্টিতে সামাজিক বার্তা দেওয়ার চেষ্টা করেছেন।
গেলডফের সবচেয়ে বড় কৃতিত্ব সম্ভবত ১৯৮৫ সালের Live Aid কনসার্ট, যা তাঁকে বিশ্বজুড়ে মানবতাবাদী কর্মী হিসেবে প্রতিষ্ঠিত করেছে। এই কনসার্টটি ছিল ইথিওপিয়ার দুর্ভিক্ষ-পীড়িত মানুষের জন্য অর্থ সংগ্রহের এক বিশাল উদ্যোগ। গেলডফ কনসার্টটি সংগঠিত করতে বিশ্বজুড়ে শিল্পীদের একত্রিত করেন, যার মধ্যে ছিল এলটন জন, ডেভিড বোই, পল ম্যাককার্টনি এবং কুইন-এর মতো বিখ্যাত শিল্পীরা। কনসার্টটি একযোগে লন্ডনের ওয়েম্বলি স্টেডিয়াম এবং যুক্তরাষ্ট্রের ফিলাডেলফিয়ায় অনুষ্ঠিত হয়, যা টেলিভিশন এবং রেডিওর মাধ্যমে বিশ্বব্যাপী দেখানো হয়। প্রায় ১.৫ বিলিয়ন মানুষ এই কনসার্টটি উপভোগ করেন, যা প্রায় ১২৭ মিলিয়ন ডলার সংগ্রহে সহায়ক হয়।
"Do They Know It's Christmas?"—এটি সেই গান যা গেলডফ এবং মিডগ উরে দাতব্য কনসার্টের আগে প্রকাশ করেছিলেন। এই গানটি ছিল তৎকালীন সময়ে যুক্তরাজ্যের সবচেয়ে বেশি বিক্রিত গান এবং এখনো ক্রিসমাসের সময় বিশ্বজুড়ে শোনা যায়। গানটির কিছু গুরুত্বপূর্ণ লাইন এমন ছিল:
"It's Christmas time, there's no need to be afraid,
At Christmas time, we let in light and we banish shade."
এই গানটি মানুষকে ভাবতে শেখায় যে বিশ্বের বিভিন্ন প্রান্তে এমন অনেক মানুষ রয়েছে, যাদের জীবনে উৎসবের কোন রঙ নেই। গেলডফ এই গানের মাধ্যমে সেই মানবিক দৃষ্টিভঙ্গি তুলে ধরেছিলেন, যা মানুষকে অন্যদের সাহায্য করতে উদ্বুদ্ধ করেছে।
লাইভ এইডের পর, গেলডফ আরও বহু দাতব্য উদ্যোগে সম্পৃক্ত হন। ২০০৫ সালে তিনি Live 8 নামে আরেকটি কনসার্ট আয়োজন করেন, যার মূল লক্ষ্য ছিল আফ্রিকার ঋণ মওকুফ এবং দরিদ্র দেশগুলোর সাহায্য। এ কনসার্টে তিনি বিশ্বনেতাদের উপর চাপ সৃষ্টি করেন যাতে তারা দরিদ্র দেশগুলোর উন্নতির জন্য আরও কার্যকর পদক্ষেপ নেন।
গেলডফের মানবিক কর্মকাণ্ড কেবল দাতব্য কনসার্টেই সীমাবদ্ধ ছিল না। তিনি উন্নয়নশীল দেশগুলোতে উন্নতি এবং দরিদ্রদের জীবনযাত্রার মান উন্নয়নের লক্ষ্যে রাজনৈতিক কর্মকাণ্ডেও সক্রিয় ভূমিকা পালন করেছেন। তাঁকে ১৯৮৬ সালে নাইটহুড দেওয়া হয় এবং তাঁর এই কর্মকাণ্ডের জন্য তিনি আন্তর্জাতিকভাবে বিভিন্ন পুরস্কার অর্জন করেছেন।
যদিও গেলডফের দাতব্য উদ্যোগগুলো সর্বজনীন প্রশংসা পেয়েছে, তবে সমালোচনার মুখেও পড়তে হয়েছে তাঁকে। কিছু সমালোচক মনে করেন যে তাঁর উদ্যোগগুলো সবসময় কার্যকর ছিল না বা অর্থ সঠিকভাবে বিতরণ করা হয়নি। তবে গেলডফ এসব সমালোচনা দৃঢ়ভাবে অস্বীকার করেছেন এবং বলেছেন যে, তাঁর উদ্দেশ্য ছিল মানুষের দৃষ্টি আকর্ষণ করা এবং নেতাদের দায়িত্বের প্রতি সচেতন করা।
বব গেলডফের ব্যক্তিগত জীবনও কম চ্যালেঞ্জিং ছিল না। তাঁর প্রথম স্ত্রী পাউলা ইয়েটসের সাথে তাঁর সম্পর্ক ছিল আলোচিত, এবং তাঁদের বিচ্ছেদ ও পাউলার আকস্মিক মৃত্যু তাঁকে গভীরভাবে প্রভাবিত করে। কিন্তু তাঁর সংগ্রামী মনোভাব এবং অবিরাম কাজের উৎসাহ তাঁকে জীবনের সব বাধা অতিক্রম করতে সাহায্য করেছে।
বব গেলডফ কেবল একজন সংগীতশিল্পী নন, তিনি মানবতার প্রতীক। তাঁর গান এবং দাতব্য কাজের মাধ্যমে তিনি প্রমাণ করেছেন যে একজন শিল্পী কীভাবে সমাজে ইতিবাচক পরিবর্তন আনতে পারেন। তাঁর জীবনের প্রতিটি অধ্যায় থেকে শেখার মতো অনেক কিছু আছে। তিনি কেবল বিনোদন বা আনন্দের জন্য গান করেননি; তিনি তাঁর প্রতিটি সৃষ্টিতে মানবিক বার্তা দিয়েছেন এবং আমাদের সকলের জন্য একটি উদাহরণ সৃষ্টি করেছেন। গেলডফের জীবন ও কাজ বিশ্বজুড়ে লাখো মানুষের অনুপ্রেরণার উৎস, এবং তাঁর দৃষ্টিভঙ্গি আজও সমানভাবে প্রাসঙ্গিক।