ইমরান মাহফুজের লালব্রিজ গণহত্যা বিষয়ক গবেষণামূলক বইটি লেখক খুব সচেতনভাবে কয়েকটি খণ্ড খণ্ড অংশে বর্ণনা করেছেন। লেখক গণহত্যার বর্ণনার আগে ঐ অঞ্চলের ভৌগোলিক অবস্থান, স্থানটির তৎকালিন অবস্থা, পারিপাশ্বিক পরিবেশ সুনিপুনভবে তুলে ধরেছেন। লেখক ভৌগোলিক অবস্থানের বর্ণনা দিতে গিয়ে এভাবে লিখিছেন-
চুয়াডাঙ্গার সর্ব উত্তরের উপজেলা আলমডাঙ্গা। কথিত আছে, একদা আলম ফকির নামে একজন কামেল সাধক ইতিহাস প্রসিদ্ধ কুমার নদী সাঁতরিয়ে ডাঙ্গায় উঠে আলমডাঙ্গার উপকন্ঠে আস্তানা গড়ে তোলে; সেই থেকে ঐ সাধকের নামনুসারে এই অঞ্চলের নাম রাখা হয় আলমডাঙ্গা
লেখক আরও তুলে ধরেছেন কয়েকজন গুনি মানুষের নাম মরমী কবি খোদাবক্স এবং ব্যারিষ্টার বাদল রশিদ; যাদের নাম ছাড়া এই অঞ্চলের ইতিহাস অসমপূর্ণ থেকে যায়। লেখকের লেখায় উঠে আসে গঙ্গারিডাই রাজ্যের কথা। যা অনেকের কাছে এটা এক অজনা তথ্য। তিনি আরও তুলে ধরেছেন এই অঞ্চলের নীল বিদ্রোহের কথা। ব্রিটিশ শাসনাধীন সময়ের এই জনপদের যোগাযোগ ব্যাবস্থা, ব্যাবসা বানিজ্যে জনজীবনসহ ঐতিহাসিক লালব্রিজ গণহত্যার কথা। বই জুড়ে আছে মুক্তিযুদ্ধের সময় ঘটে যাওয়া লোমহর্ষক নানা ঘটনা। যা একজন সচেতন পাঠকের গায়ের লোম শিউরে উঠার সাথে সাথে পাকবাহিনীসহ কুলাঙ্গার রাজাকারদের উপর নতুন করে ক্রোদ ও ঘৃণা জন্মাবে।
লেখক বইটির কভার করেছেন ‘লালব্রিজ গণহত্যা’ নামে। এই নামকরণ থেকে ধারণা করা যায় কতখানি ভয়ংকর তথ্য লুকিয়ে আছে বইটিতে।
১৯৭০ সাল যখন ঢাকাসহ সারা বাংলাদেশ তোলপাড়। তখন চুয়াডাঙ্গা-আলমডাঙ্গা বেশ সরগরম হয়ে উঠেছিলো। যখন বঙ্গবন্ধুর ছয় দফার উপরে জনগণ এককভাবে আওয়ামীলীগ তথা বঙ্গবন্ধুকে সতঃস্ফূর্ত ভাবে ভোট দিয়েছিল সেটাকে গণভোট হিসেবে বলা হয়। সাধারণ জনগণ পাকিস্থানি হায়নার হাত থেকে বাঁচতে বঙ্গবন্ধুই ছিলো একমাত্র আশ্রয়। সাড়াদেশের মতো আলমডাঙ্গাতেও বিপুল ভোটে জয়ী হয় বঙ্গবন্ধুর আস্থাভাজন তৎকালিন কৃষকলীগের কেন্দ্রীয় সভাপতি ব্যারিষ্টার বাদল রশিদ। তবে আওয়ামীলীগ বিপুল ভোটে বিজয়ী হলেও সুষ্ঠুভাবে ক্ষমতা হস্তন্তর হলো না। সেটা আমাদের সকলের জানা। ইয়াহিয়া খান ৩ মার্চ জাতীয় পরিষদে অধিবেশন আহ্বান করে তবে ১ মার্চ অধিবেশন স্থগিত করে। তখন সাড়দেশের ন্যায় চুয়াডাঙ্গাতে আলোড়ন সৃষ্টি হয়। সেই সাথে আলমডাঙ্গাতেও স্বতঃস্ফুর্তভাবে হরতাল পালিত হয়। বঙ্গবন্ধুর নির্দেশে ৩ মার্চ থেকে ৬ মার্চ ধর্মঘট হয়। ৭ মার্চ বঙ্গবন্ধুর ঐতিহাসিক ভাষণের পর ছাত্রজনতা সংগ্রামী হয়ে ওঠে। চুয়াডাঙ্গাসহ আলমডঙ্গার সংগ্রামী ছাত্র-জনতা ও সেচ্ছাসেবক বাহিনী প্রস্তুতি শুরু করেন এবং ৮ মার্চ অসহযোগ আন্দোলন শুরু হয়। সে সময় অফিস আদালত বন্ধ থাকে।
ইমরান মাহফুজ ‘লালব্রিজ গণহত্যা’ বিষয়ক বইটিতে লেখক মুক্তিযুদ্ধের পূ্র্ববর্তী এই অঞ্চলের রাজনীতি পরিস্থিতির বেশ বিস্তারিত আলোচনা করেছেন। যা একজন পাঠক খুব সহজেই অনুমান করতে পারবে, এই বিশাল গণহত্যার যোগসূত্র আসলে কোথায়। সেই সময়ে এই অঞ্চলের রাজনীতিক অবস্থানসহ মুক্তিযুদ্ধ ও মুক্তযুদ্ধ পূর্ববর্তীকালীন সময়ে চুয়াডাঙ্গা-আলমডাঙ্গা কতখানি গুরুত্বপুর্ণ অঞ্চল ছিলো তা ধারণা করতে পারবে। লেখক মুক্তিযুদ্ধকালীন সময়ের বর্ণনার আগে মুক্তিযুদ্ধের পূর্ববর্তীতে এই অঞ্চলের যে বিষদ বর্ণনা করেছেন। তা লেখক সচেতনতার পরিচয় দিয়েছেন।
লেখক এই অঞ্চলের যুদ্ধ শুরুর বর্ণনা দিতে গিয়ে এভাবে লিখেছেন-
আলমডাঙ্গার মুক্তিযোদ্ধারা প্রস্তুতি নিয়ে মাঠে নেমে যায়।অন্যদিকে পাকিস্থান বাহীনির লক্ষ্য যে কুষ্টিয়াকে কাবু করার পর বাংলাদেশের প্রথম রাজধানীকে হাতে নেওয়ার কূটকৌশলে সদাব্যস্ত।সেই কৌশলে আলমডাঙ্গা ওয়াপদা ডিফিশনের বাংলাকে পাকিস্থান সেনা অফিসাররা ক্যাম্প হিসেবে দখল করে নেয়।একে একে শুরু করে তান্ডবলীলা।অমানুষিক নির্যাতন শুরু হয়।এ জনপদের মানুষসহ অন্য এলাকা থেকে এ এলাকা দিয়ে যাতায়াতের সময় ধরা পড়ে যায় পশুদের হাতে।অন্যদিকে এলাকাকে নিয়ন্ত্রণ করা ছাড়া পাকিস্থান বাহিনী দখলদারিত্বের মনোভাব সম্পূর্ণ করতে পারছিল না। এ জেলাকে বাংলাদেশের প্রথম রাজধানি ঘোষণা করে সরকার গঠন করার প্রক্রিয়া শুরু করলে এ অঞ্চলটি পাকিস্থানী বাহিনীর টার্গেট পয়েন্টে পরিণত হয়
উল্লেখ্য যে, ১৯৭১ সালে ১০ এপ্রিল চুয়াডাঙ্গাকে বাংলাদেশের রাজধানী হিসেবে ঘোষণা করা হয় এবং ১৪ এপ্রিল মন্ত্রীসভার আনুষ্ঠানিক শপথগ্রহণ এখানে হওয়ার কথা ছিলো কিন্তু পাকিস্থানবাহীনি জানতে পারলে সাংঘাতিকভাবে বোমা ফেলতে শুরু করে চুয়াডাঙ্গার উপর।
সাড়াদেশে যখন তুমুল যুদ্ধ লেগে তখন সাধারণ মানুষ ট্রেনযোগে নিরাপদ আশ্রয় এবং দেশ পাড়ি দিয়ে ভারতে চলে যাওয়ার সময় আলমডাঙ্গার লালব্রীজে এসে ধরা পড়ে। ঠিক এভাবে বলা যেতে পারে বাঁচতে গিয়ে মৃত্যুর খুব কাছাকাছি হওয়া।
লেখকের লেখায় উল্লেখ আছে তৎকালিন সময়ে রাজশাহী, নাটোর, রংপুর, কুষ্টিয়ার লোকজন যাতায়াত করত চুয়াডাঙ্গার আলমডাঙ্গা হয়ে।
লেখক গণহত্যা-নির্যাতনের বর্ণনা দিতে গিয়ে এভাবে লিখেছন-
আলমডাঙ্গা উপজেলা শহরের পার্শ্বে আলমডাঙ্গা রেলব্রিজ (লালব্রিজ নামে পরিচিত) আলমডাঙ্গা রেলওয়ে স্টেশন থেকে প্রায় আধা কিলোমিটার পূর্বে ব্রিজটির পশ্চিম প্রান্তে ছিল পাকিস্থান হানাদার বাহিনীর ক্যাম্প। পানি উন্নয়ন বোর্ডের সেচ গেইট কিপারশেড ছিল নারী নির্যাতনের স্থান। ব্রিজটির উপর গাড়ি থামিয়ে নারী, শিশু যুবক যুবতীদের নির্যাতন করে শেডের আশেপাশে বিরাট গর্ত করে মাটি চাপা দেওয়া হতো। এইভাবে জুন থেকে ৭ ডিসেম্বর পর্যন্ত প্রায় দুই হাজার মানুষ হত্যা করে এখানে চাপা দেওয়া হয়’
কী বিবর্ষতা। ভাবলেই শরীরের পশম শিউরে ওঠে। কি ভয়ানক ছিলো সে সময়। পাকিস্থানি জানোয়ারদের হাত থেকে বাঁচতে মানুষ যে পথকে সবচেয়ে নিরাপদ ভেবেছিলো। পাকিস্থানিরা সে পথেই তৈরি করেছিলো ভয়ানক মৃত্যুর ফাঁদ।
ইমরান মাহফুজ ‘লালব্রিজ গণহত্যা ‘ বইটিতে এভাবে উল্লেখ করেছেন-
চেকি-তল্লাসি নামে পাকিস্থান হানাদার সৈন্যরা আলমডাঙ্গা লালব্রিজে চেকপোষ্ট বসিয়ে উত্তরবঙ্গের পার্বতীপুর ও রাজশাহী এবং রাজধানী ঢাকা ও চট্রগ্রাম থেকে রাজবাড়ী হয়ে আগত দর্শনা,যশোর ও খুলনাগামী যাত্রীবাহী ট্রেন সমূহে বিশেষ করে যুবক-যুবতী ও হিন্দুসহ নারী যাত্রীদেরকে জোর পূর্বক নামিয়ে ক্যাম্পে নিয়ে সম্ভ্রমহানিসহ অনুরূপ অত্যাচার-নির্যাতন চালিয়ে হত্যা শেষে একই স্থানে মাটি চাপা দিয়ে রাখত।
লেখক বইটিতে উল্লেখ করছেন গণহত্যার প্রত্যক্ষদর্শীসহ বীর যোদ্ধাদের সাক্ষাতকার। তাদের মধ্যে একজন কামালপুরের আবুল হোসেন জানান- তার জমিতে প্রায় এক হাজার নারী-পুরুষকে খানসেনারা হত্যা করে পুঁতে রেখেছ।
বীর মুক্তিযোদ্ধা সবেদ আলী বলেন- এভাবে প্রতিদিন চলন্ত ট্রেন দাড় করানো হতো লালব্রীজের উপর। দু’পাশে অবস্থিত মিলশিয়া ক্যাম্পের পাক সৈন্য ও রাজাকারের দু’পাশ আটকে রেখে ট্রেন তল্লাশি করতো। ট্রেনের সকল নারী পুরুষকে খুটিয়ে খুটিয়ে পরীক্ষা করা হতো। সন্দেহ হলে নামিয়ে নেয়া হতো। সুন্দরী মহিলা হলে আর রক্ষা ছিলো না। সবাইকে কলেমা পড়তে বলা হতো। বলতো ‘শালা বানচোৎ, হিন্দু, মুক্তি হ্যায়’। প্রতিদিন এই রেলপথের অসংখ্য যাত্রীকে অবর্ণনীয় অত্যাচার করে হত্যার পর লাল ব্রীজের অদূরে সাইড ক্যানেলে পাড়ে ওয়াপদা কোয়ার্টারের আশেপাশে ও লাল ব্রিজের একেবারে পাশে গণকবর দেয়া হতো।
আলমডাঙ্গা বধ্যভূমি হলো মুক্তিযুদ্ধের ইতিহাসে এক বিভীষিকাময় চিত্র। ঘুরতে আসা দর্শনার্থীরা বধ্যভূমিতে কিছুক্ষণের জন্য থ হয়ে যায়। কল্পনা করতে থাকে বিভীষিকাময় দিনগুলোর কথা। বধ্যভূমি গেলে কানের কছে বাজতে থাকে নারীর সন্মান রক্ষার আহাজারি। যুবকের বেঁচে থাকার আকুতি- মিনতি। মৃত্যুর কাছে ঢলে পড়া কোন তৃষ্ণার্ত ব্যাক্তির পানি পানি বলে চিৎকার। আঃহ সেসব বর্বর দিন। সন্ধা নামলে লালব্রিজ- বধ্যভূমি হয়ে ওঠে নিঃসঙ্গময় এক প্রতিচ্ছায়া।
ইমরান মাহফুজের ‘লালব্রিজ গণহত্যা’ বইটি সবদিকে স্বার্থক মনে হয়েছে। বইটি যেমন বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধের এক গুরুত্বপূর্ণ পাঠ, তেমনিভাবে আলমডাঙ্গার মানুষের কাছে বইটি এক সংরক্ষিত দলিল। বাংলাদেশের ছোট্র এক জনপদ আলমডাঙ্গা- এর বুকের উপর দিয়ে কতখানি রক্তের স্রোত বয়ে গেছে তা বইটি পাঠে জানা যাবে।
- শাহরিয়ার জাহাঙ্গীর