ত্রিভুবন জিৎ মুখার্জী

তির্যক

আমার গল্পের নায়িকা খুব উচ্চ মধ্যবিত্ত ঘরের এক মহিলা। তিনি সর্ব গুণসম্পন্না এক ভারতীয় নারী। শিক্ষিতা,ক্লাসিকাল সঙ্গীত এবং ওড়িসি  নৃত্যেও পারদর্শী  । বলতে-গেলে  প্রতিভাসম্পন্ন নারী । তা সেই মেয়েটকে নিয়ে আমার গল্প লেখা কেন?  তার মধ্যে প্রেম প্রীতির যে ছবি আমি দেখেছিলাম সেটাই আমার গল্প লেখার কারণ।

ঘটনাটা এইরকম -

পায়েল তখন ইংরেজীতে অনার্স নিয়ে স্কটিশে পড়ছে । এমনিতে পায়েল ভাল ছাত্রী ছিল তাই ওর অনার্স পেতে অসুবিধে হল না। একজন স্কচ লেডী হেড অফ দি ডিপার্টমেন্ট ছিলেন ।  ম্যাডাম এডিনা সেদিন উইলিয়াম্ শেক্সপিয়ারের ‘ওথেলোর‘ ক্লাস্ নিচ্ছিলেন সুস্পষ্ট উচ্চারণ ।

পিন ড্রপ সাইলেন্স । সকলে মন্ত্রমুগ্ধর মতন শুনছিল । পায়েল , ম্যাডাম এর ট্যুটোরিয়াল ক্লাসে কিছু প্রশ্ন করে , কবে এবং কোথায় প্রথম ওথেলো স্টেজে দেখানো হয় । ইত্যাদি । 

কলেজের ঘণ্টা বাজে । ছেলে মেয়েরা ক্লাস থেকে বেরোয় । পায়েল তখনও  ঘোরে রয়েছে , শুধু দেসডেমনার কথা ভাবছে । এই সময় ওর প্রতীকের সঙ্গে দেখা হয় ।

প্রতীক খুব সাধারণ ছেলে । কিছুটা ভাবুক ভাবুক কবি কবি ভাব । না তবে ছন্দের অভাব আছে কিনা জানিনা। পরনে পায়জামা পাঞ্জাবি কাঁধে ব্যাগ । প্রতীক আ্যপ্লায়েড ইকনমিক্স নিয়ে  ইউনিভার্সিটীতে এম.এ. ফাইনাল ইয়ারে । নিজের পড়ার খর্চা টিউশনি করে মেটায় । বাবা  একটা প্রাইভাট ফার্মে কাজ করেন । যৎসামান্য রোজগারে সংসার কষ্টেই চলে । এসব ছেলেদের জীবনে অনেক সংগ্রাম করে বড় হতে হয় । এরা সাধারণত খুব একটা মেয়েদের সঙ্গে মেলামেশা করে না। বা করতে চায় না।

- আজ কোথায় যাবে ? পায়েলের প্রশ্নতে প্রতীক বিব্রত হয়ে পড়ে !  

ও ! হ্যাঁ তুমি !! না তেমন  কোথাও  নয় । সন্ধ্যে বেলায় টিউশন আছে । লোকালে যেতে ২৫  থেকে ৩০ মিনিট্ । কথাগুলো অন্যমনস্কভাবে প্রতীক বলে ।

আজ ভিক্টোরিয়া যাবে ?

না । আমার অন্য কাজ আছে । কলেজস্ট্রিট কিছু পুরন বই কিনতে যাব।  

- চল না আমিও যাই সঙ্গে, আমার তো ওই দিকেই বাড়ি ।  

প্রতীক পকেটে হাত ঢুকিয়ে দেখল কিছু খুচরো টাকা আছে । একটা সিগারেট্ খেলে বাকি থাকছে ৫৫ টাকার মতন। ...। বইটার দাম ৫০ টাকা তো হবেই ...!

- কি ভাবছো অত ?  চল তো , বাস এসে গেল।

- ওটা তো কলেজস্ট্রিট যাবে । 

- হ্যাঁ আমিও ওই দিকেই যাব । নাও উঠে পড় ।

মন্ত্রমুগ্ধের মতন উঠে পড়লো প্রতীক ।  

বাস ভাড়াটা প্রতীক দিতে যাচ্ছিল কন্ডাক্টার পেছনে ইশারা করে কিছু বোঝাতে চেষ্টা করল।

বাস ভাড়াটা কেন ও দিল ? আত্মসন্মানে বাধে । খুব খারাপ লাগলো ।  

কলেজ স্ট্রিট বাটার কাছে নেমে দুজনে হাঁটা দিল ।

-      তুমি কিন্তু এটা ভারি অন্যায় করলে ! প্রতীক খুব অপ্রস্তুতে পড়ার মতন বলল !

-      ছাড় তো । ও আমাকে পরে পুষিয়ে দেবেখন, তুমি কি যেন বইয়ের কথা বলছিলে না?  

-      প্রোডাকশন ইকনমিক্সের বই।

-      আজকাল ইন্টারনেট থেকে অনেকে বই ডাউনলোড করে পড়ে ।

-      হ্যাঁ তা করে তবে আমার কিছু অন্য প্রয়োজন আছে ।

-      কাউকে কি গিফট্ দেবে ?

-      হ্যাঁ !

-      কাকে ?

-      আমার এক ছাত্রী কে ।

মুখটা লাল হয়ে গেল পায়েলের । খুব অপমান বোধ হল। আসলে প্রায় মেয়েরাই ওই এক ই রোগে ভোগে । মোটেই অন্য মেয়ের সংস্পর্শে তার প্রিয়তম কে আসতে দেয় না। সে ছাত্রী ই  হোক কিম্বা অন্য কেউ হোক । নিছক সন্দেহ বাতিক থেকেই যায় । মনে জাগে অনেক প্রশ্ন । 

ঘটনা চক্রে বলে বসে প্রতীক , ও কিন্তু আমার মামাতো বোন । ওর বইটা দরকার । আমাকে আসার সময় বলেছিল আনতে । ও আমার জন্যই ইকনমিক্স অনার্স নিয়েছে।

এবার পায়েলকে যেন  কেউ ঠাস্ করে একটা চড় মারল বলে মনে হল।

প্রসঙ্গ বদলানোর  জন্য বললো, না না আমি এমনি জিজ্ঞাসা করছিলাম।

ব্যাপারটা ঠাওরাতে প্রতীকের খুব একটা অসুবিধে হল না !

ও আসলে জানতো এই কথায় পায়েল একটু রাগ অভিমান করবে আর মিথ্যে সন্দেহ করবে যেটার মজা ও নেবে।

- তোমার কিন্তু এটা ভারি অন্যায় । আমাকে বলবে ত !

- কি বলবো ? ...ও ওহ্... !! হেসে ফেলে প্রতীক ।

- খুঊব না ! চোখে জল আসে পায়েলের। আমাকে রাগাতে আর অপমান করতে তোমার এতটুকু খারাপ লাগে না, না ?

- এতে অপমানের কি হল ? পিয়ালি আমার ছোট বোন ।

-  কই আমাকে তো কোনদিন বলনি ওর কথা।

-  কি মুশকিল । সব কথা কি বলা যায় ?  না প্রয়োজন আছে বলার !

মিথ্যে অভিমানে পায়েল আলতো করে চাটি মারে প্রতীকের বাঁ হাতে ।

দুজনের কথোপকথনে পথচারির দৃষ্টি আকর্ষণ করে । প্রতীক অপ্রস্তুত হয়ে বলে , এখন  থেকেই শাসন করবে তুমি ?

- হ্যাঁ কারণ তুমি শুধু আমার .... আর কারুর নও .....।  

- ওকে বস্। ..... আমার বাস এসে গেছে ,বাই ।

এরকম অপ্রস্তুত মুহূর্তে পায়েল পড়বে ভাবতে পারেনি।  

২য় পর্ব

কয়েকদিন পরে কফিহাউসে কফির পেয়ালায় মুখ দিয়ে বসে আছে প্রতীক সঙ্গে বন্ধু রণবীর   আরো দুজন।

রাজনীতি  আর খেলার কথাই বেশি হয় এখানে । হঠাৎ পায়েলের নম্বর থেকে কল এলো  প্রতীকের মোবাইলে ।

- কোথায় আছো ?

- কেন?

- এখুনি এস আউট্ ট্ট্রাম ঘাটে । খুব দরকার । আমার হাতে সময় নেই একদম।

প্রতীক কিছু জিজ্ঞাসা করার আগেই ফোন কেটে গেল।

বাসে যেতে হলে এক ঘণ্টা লেগে যাবে, তাও বেরিয়ে পড়ল । কি হতে পারে ভেবে   কূলকিনারা পেল না। মধ্যেখানে আবার ফোন ।

- কি তুমি বেরিয়েছ ?

- হ্যাঁ রে বাবা । কি হয়েছে বোলবে ত !

- এলেই জানবে ।

আউট ট্রাম ঘাট্ আসতেই বাস থেকে নেবে পূর্ব পরিচিত স্থানে পৌঁছে দেখে পায়েল একটা   বেঞ্চে বসে গঙ্গা দেখছে । জোড়ায় জোডায় তরুণ তরুণীরা বসে আছে । সকলে মশগুল   নিজের  প্রেমিক/প্রেমিকার সাথে গল্প করতে ।

প্রতীককে দেখে হাতে স্বর্গ পাওয়ার মতো লাগলো পায়েলের  । দৌড়ে এসে প্রতীককে জড়িয়ে ধরে কান্নায় ভেঙ্গে পড়ল ।

- একি ছেলেমানুষি হচ্ছে ! ছাড় । কি হয়েছে বল ?

- একটু অপ্রস্তুত বোধ করে বলে ; কি না হয়েছে বল ! বাপী আমার বিয়ের ঠিক করেছেন এক সফটওয়্যার ইঞ্জিনিয়ারের সঙ্গে ।

- কংগ্রাচুলেসন।

- তোমার বলতে লজ্জা করেনা ? শালা বাঁদর , আমাকে নিয়ে ছেলেখেলা !

মহিলার মুখে ‘শালা’ শব্দ টা শুনে চমকে গেলেও আশ্চর্য হল না কারণ এর আগেও একবার  শুনেছে । কথাটার গুরুত্ব  উপলব্ধি করে প্রতীক বলল- রিলেক্স্ বেবি , রিলেক্স্ ।

- চল আমরা বিয়ে সেরে ফেলি কোথাও । আমরা দুজনেই আ্যাডাল্ট । আইনের দিক  থেকে কোন অসুবিধে নেই।

- ক্ষেপেছ ! আমি একটা বেকার ছেলে, তার ওপর আমার মা-বাবা আমাকে তেজ্যপুত্র  করে দেবেন । তাছাড়া আমার নিচে বোন আছে তাদের ভবিষ্যৎ ?  মাথা ঠাণ্ডা রেখে  কাজ করতে হবে । আমি তোমাকে জীবনসঙ্গিনী করার কোন বাধা নেই । কিন্তু পালিয়ে বিয়ে করাকে আমি কাপুরুষতার পর্যায়ে ফেলি । ওটা ভীরুতার লক্ষণ । খুব  বাজে ব্যাপার । আমি তোমার বাবার সঙ্গে কথা বলতে চাই।

- ওরে আমার বীরপুরুষ রে ! হুঁ ! আমার বাপীকে তো চেনো না ! উনি বাপীর সঙ্গে দেখা করবেন তার আগে বাপী তোমাকে লকআপে ভরে দিন আর আমি ওই ভোঁদাইয়ের সঙ্গে ... । ফটোটা দেখেছি । কি বিচ্ছিরি ম্যাগো । আমি পারবোনা ওই ভোঁদাইয়ের সঙ্গে থাকতে । তুমি এক্ষুনি কিছু কর ।তুমি না পুরুষ মানুষ ?

এই ! এটাই মহিলাদের প্রধান অস্ত্র !  প্রতীক জানে মহিলারা পুরুষদের পৌরুষত্বে আঘাৎ দিয়ে কথা বলে , যখন কিনা, তারা কোন বিশেষ কাজ সহজে তাদের দিয়ে  হাসিল করাতে  চায় ।  কিম্বা যখন বেপাকে পড়ে । প্রতীক ভাবে ,এখন ও কোন কথা শোনার মুডে নেই  । কারণ  ওকে  ডক্টরেট  করতে গেলে এসব  কথায় মন দিলে ওর লক্ষ্যপুরণ হবে না । 

কথা  বলার সঙ্গে সঙ্গে একটা সাদা রঙের স্করপিও এসে থামল । পায়েল গাড়িটা দেখেই  আঁতকে ওঠে । ও সঙ্গে সঙ্গে প্রতীকের হাত ধরে এক হ্যাঁচকা টান দেয় । প্রতীক কিছু বোঝার  আগেই এক বলিষ্ঠ ব্যাক্তিত্বের সুটেড-বুটেড মাঝবয়েসী ভদ্রলোক এসে ওকে বলে , আপনি কি প্রতীক চৌধুরী ?

- আজ্ঞে হ্যাঁ । কিছু প্রয়োজন আছে ?

- প্রয়োজন না থাকলে কি এখানে আপনার কাছে আসি । আপনি কি করেন ?

- আমি ক্যালকাটা ইউনিভার্সিটির ছাত্র ; এই বছর আ্যপ্লায়েড ইকনমিক্সে মাস্টার ডিগ্রির ফাইনাল দেব ।  

- ও বেকার ছেলে! ইন্টেরেস্টিং । বাবা কি করেন?

- আপনার পরিচয় ? আপনি আমাকে এত সব প্রশ্ন করছেন কেন?

-  আমি ! আমি পায়েলের  বাবা , নৃসিংহ চক্রবর্তী , আই.পি.এস্ । আপনি আমার নাম শোনেননি  ?  আমি কমিশনার, ইন্টেলিজেন্স্ , কলকাতা পুলিশ । শোনেন নি আমার  নাম ? স্ট্রেঞ্জ্ ।  একটা বিদ্রূপের হাঁসি মুখে নিয়ে ভদ্রলোক বললেন । আপনার জানা উচিত ছিল ।  

- আমি অর্থনীতির ছাত্র । পুলিশের খবর রেখে কি হবে আমার ?  আপনি আমাকে  শুধু শুধু বেকার কেন বলছেন ? আমার তো পড়া শেষ হয়নি এখনও  । পড়া শেষ করে ডক্টরেট্ করবো । আমি   ইউনিভারসিটিতে ফার্স্ট হয়ে ছিলাম অনার্সে ।  আপনি আমার বাবাকে টানছেন কেন এর মধ্যে ! নিজের পায়ে না দাঁড়ানো অবধি  আমি আমার  কোন ব্যাপারে সিদ্ধান্ত নেব না  ।     

- ইয়ং ম্যান,  প্রেম করার আগে আপনার যাচাই করা উচিত ছিল আপনার আর্থিক স্বচ্ছলতা আছে কিনা ! আমার মেয়ের সঙ্গে বন্ধুত্ব করতে পারেন , কিন্তু বিয়ে ?  ইম্পসিবল্ । আপনি তো অর্থনীতির ছাত্র এটুকু আপনার কাছ থেকে আশা করেছিলাম।  ওয়েল্ মাই বয়, মাইন্ড ইওর স্টাডিজ । ফার্স্ট এস্টাব্লিস্ ইয়োরসেলফ্ ইন দি সোসাইটি,  দেন থিংক অফ্ মেরেজ্। ওকে। ফরগেট্ হার । সি ইজ এ বেবি । স্টিল   এ বেবি মাই বয় । গুড লাক্ ।

পায়েল থর থর করে কাঁপছিল ওর বাবা ওকে কাছে ডেকে বললেন , আয় মা আমার কাছে আয়। শুনলি তো সব  ।

পায়েলের মুখ দিয়ে একটা কথাই বেরুল প্রতীকের উদেশ্যে .... কাওয়ার্ড.... কাপুরুষ । আমার  সঙ্গে প্রতারণা । কান্নায় ভেঙ্গে পড়ে পায়েল । বাবার সঙ্গে গাড়িতে গিয়ে ওঠে ।

প্রতীক একটা সিগারেটে অগ্নিসংযোগ করে উদাস মনে আকাশের দিকে তাকায় আর এক রাশ ধোঁয়া মুখে নিয়ে একটা দীর্ঘনিঃশ্বাস নেয় । নিজেকে সামলে নেয় । 

এরপর প্রতীকের সঙ্গে আর পায়েলের দেখা হয় নি ।  

৩য় পর্ব

ইতিমধ্যে প্রায় পনেরো বছর কেটে গেছে । প্রতীক এখন  ইউনিভারসিটির এপ্পলাএড্ ইকনমিক্সের প্রফেসার । ডক্টর প্রতীক চৌধুরী । ওর ছাত্র ছাত্রীরা ওকে সম্মান করে । ওর কিন্তু ওই এক সাদা মাটা মাষ্টারী পোশাক , পায়জামা-পাঞ্জাবি ,ফ্রেঞ্চকাট দাড়ি , ঠোঁটে সিগারেট্  আর ভাবুক ভাবুক চেহারা । ওর বিয়ে হয় ওরই এক ছাত্রীর সঙ্গে নাম মধুমিতা সান্যাল ।

পায়েল জীবনে সুখী কিনা জানা যায় না  ।  ওর বিয়ে হয়ে যায় সেই সফট্ওয়ার ইঞ্জিনিয়ারের  সঙ্গে , ওর অমতে।পায়েলের কথায় সেই ভোঁদাইয়ের সঙ্গে।একদমই পছন্দ  করে না ওকে স্বামী হিসেবে । রাতদিন খটাখটী লেগেই থাকে ।

এরমধ্যে ওর মা মারা যান । বাপীর রিটায়ারমেন্টের পর দুটো স্ট্রোক্ হয়ে শয্যাশায়ী হয়ে পড়েন । পায়েল দেখাশোনা করে । বাপী বুঝতে পারেন  মেয়ের মনের ব্যাথা । দু’ চোখ বেয়ে  জল গড়ায় । বোঝেন পুরনো দিনের স্মৃতি রোমন্থনে আর কোন  লাভ নেই । একমাত্র মেয়ে , এতো টাকা-পয়সা থেকেও শান্তিতে নেই তার কারণ তার মনের মতন বর পায়নি ।

যাকে  পেল সে গ্রহণযোগ্য নয় পাঁড় মাতাল এক উচ্ছৃঙ্খল যুবক। তার আরেকটি মেয়ের  সঙ্গে দৈহিক সম্পর্ক যেনে স্বামীকে ঘৃণা করে পায়েল। কিছু উপায় নেই। নিয়তির নিয়ম। বাধ্য হয়ে  মেনে নেয় সবকিছু । আজও প্রতীকের কথা মনে পড়ে । সেই রোগা লম্বা  চেহারার ভাবুক ভাবুক লোকটি কাঁধে ব্যাগ আর ঠোঁটে সিগারেট্ । সবসময় অন্যমনস্ক হয়ে কি যেন ভাবে !

এখন প্রতীক কি করছে ? ও কেমন আছে জানতে ইচ্ছে হয় । ওকে কি মনে রেখেছে ? মনটা ডুকরে কেঁদে ওঠে । কি হবে ওর কথা ভেবে ?

কলেজ স্ট্রীটে বইয়ের দোকানে নতুন মারুতি ডিজায়ার গাড়ি থেকে নেমে হঠাৎ এক পায়জামা  পাঞ্জাবী পরা ভদ্রলোককে দেখে চিনে ফেলে পায়েল । নিজের মনের মানুষকে চিনবে না ! এ কখন হয় ! বেশ কদিন আমেরিকার ডালাসে ছিল  ওর স্বামীর সঙ্গে । অনেক দিন  কলেজ স্ট্রীটে আসা হয় নি । হঠাৎ চোখে পড়ে ফ্রেঞ্চকাট দাড়ি , চোখে মোটা ফ্রেমের চশমা আর মন  দিয়ে  দেখছে  কিছু পুরনো বই যে ভদ্রলোক ; সে যে প্রতীক তা ঠাওরাতে অসুবিধে হলনা পায়েলের। কাছে যাওয়ার সাহস হলনা ।

আবার মনে মনে লোকটার প্রতি আবেগ এলেও  সেটা  চেপে রাখল । মনের ভেতরটা হাহাকার করে উঠলো। মনে হল ঠাস্ করে গিয়ে গালে একটা চাড় মারি।অপদার্থ কাপুরুষ !!  আবার নিজেকে সামলে নিল এ কি ভাবছে সে ? এঁর জন্যই তো বসে আছে পথ চেয়ে , কবে হবে তার সঙ্গে দেখা? ও-ই তো তার মনের মানুষ !! আজ সেই ভ্যালেন্টাইন ডে । কিন্তু প্রতীক ওই সব একদম পছন্দ করতো না ! 

সে কি যাবে ওর কাছে ? ও কি চিনবে? যদি না চেনে ? চিনেও না চেনার ভান করে তাহলে লজ্জা ঘেন্নায় নিজেকে ছোট করবে ওর কাছে ? ওর প্রেম-প্রীতি ভালবাসার কি কোন দাম নেই?  

রাবণের হাথে নিজেকে সঁপে দিয়েছে পায়েল । সে যখন পশুর মতন তার শরীরটাকে

ছিঁড়ে খায় মনে হয় যেন ড্রাকুলা তার ধারল দাঁত দিয়ে ছিন্ন ভিন্ন করছে তার শরীরটাকে । কি নিয়ে দাঁড়াবে প্রতীকের কাছে ? বলবে প্রতীক আমি তোমাকে এখনো ভালবাসি । বলে কি লাভ ? ও কি এখন আর  মূল্য দেবে সেই ভালবাসার ? ও কি জানে নারীর মনে যে প্রথম  পুরুষ আসে সেই তার মনে গভীর আঁচড় দিয়ে যায় , যার ক্ষত ; ক্ষত বিক্ষত করলেও সে  সেটাকেই  আঁকড়ে ধরে । স্মৃতিটুকু তার মনে সান্ত্বনা দেয় । তাই পায়েল  সেই স্মৃতি নিয়েই  ফিরে এল নিজের ঘরে ।

ভারতীয় রমণীর এটাই বৈশিষ্ট্য , সে বহ্নি শিখায় জ্বলে পুড়ে মরে কিন্তু কাউকে বুঝতে দেয়না তার মনের  ব্যাথা । মনের ব্যাথা মনেই থাক নাইবা তুমি জানলে ...।   ভগবান তির্জক দৃষ্টিতে দেখেও দেখেন না । ওরা তাকেই মেনে নেয় অদৃষ্ট বলে । আমরা পুরুষরা ওদের পুড়তে দেখেও না দেখার  ভান করি । 

- ত্রিভুবনজিৎ মুখার্জী 
ত্রিভুবন জিৎ মুখার্জী
ত্রিভুবন জিৎ মুখার্জী পশ্চিম বঙ্গের ৭৭,রামকান্ত বোস ষ্ট্রীট বাগবাজার কলকাতা ৭০০ ০০৩ তে বসবাস করেন। তিন মূলত একজন গল্পকার। তিনি বিভিন্ন অনলাইন ম্যাগাজিনসহ লিটলম্যাগে লেখালেখি করেন।
বার পড়া হয়েছে
প্রকাশিত :
জুন ৪, ২০১৯
শেয়ার :
পয়স্তিতে যারা লিখেছেননির্দেশিকাশর্তাবলী
১০ দিনে জনপ্রিয় লেখক
magnifiercrossmenu