পিন্টু রহমান

বিহারীলাল ও তার পৃথিবী

মহল্লা না, পরগনা না, দেশ না- পৃথিবী; তিনজন মাত্র বিহারী পুরো একটা পৃথিবীতে দখলদারিত্ব কায়েম করেছে! উফ, চিন্তা করা যায়! নিজেদের মধ্যে ঝগড়াঝাঁটি হট্টগোল মারামারি যা’ই হোক না কেনো দখলদারিত্ব বজায় রাখতে তারা একাট্টা। রাজা-প্রজা উজির-নাজির সম্পর্কে বিহারিরা ভিন্নমত পোষণ করলে আমি পরিব্রাজক হতে আগ্রহী হই, সমস্ত পৃথিবী পরিভ্রমণ করি- কিন্তু সবুজ, আগুন ও লাল ব্যতীত অন্য কাউকে দৃষ্টিগোচর হয় না। মনের মধ্যে খটকা লাগে তখন- আমার সাথে তামাশা করছে না তো!

কী জানি বাপু, ঠিকঠাক বুঝতে পারি না। সবুজ কিংবা আগুন বিহারী হলে ভিন্ন কথা, বয়সের ভারে নুয়ে পড়া লাল বিহারী (বিহারীলাল) তো তামাশা করার পাত্র নয়; তাহলে! মুখে হাসির রেখা টেনে বয়সী মানুষটা ভুল শুধরে দেয়- দেখুন বাবুছাব, কার দেছে (দেশ) কে রাজত্ব করবে এ লিয়ে হামাদের মাথাব্যথা লাই। ওছব দেছে ধণরত্ন ভি পড়ে থাকলেও ছুঁয়ে দেখবো লাই। বিহারীলাল ফকির হবার পারে মাগার চোর লয়।

তাইতো, বিহারীলাল চোর নয়! চোর হলেও হয়ত এরূপ দুরাবস্থার সম্মুখীন হতো না, বানের জলে ঘাটে-ঘাটে ভেসে বেড়াতো না কিংবা একমুঠো অন্নের জন্য কারও কাছে হাত পাততে হতো না! নিজেই নিজেকে প্রশ্ন করি- তাহলে কী ওরা! দেশ বিষয়ে ওদের অভিজ্ঞতা খুবই তিক্ত। বুড়ো বিহারীলালের মন পড়ে আছে ভারতের বিহার রাজ্যে; ছেলে আগুন বিহারী দিবানিশি পাকিস্তান নামের জপমালা উচ্চারণ করে; নাতি সবুজ বিহারী লাল-সবুজের পতাকায় মুক্তির পথ খোঁজে। তবে তারা যে বিহারী এ নিয়ে কোনো বিতর্ক নেই। বিহারিদের ইতিহাস খুবই করুণ এবং অমানবিক। সাতচল্লিশের দেশভাগের ফলে বিহারের মুসলমানদের উপর কেয়ামতের বিভীষিকা নাজিল হয়েছিল। পূর্ব পাকিস্তানের নোয়াখালীতে দাঙ্গা আরম্ভ হলে তার রেশ গিয়ে পড়ে বিহারে। সংখ্যাগরিষ্ঠ হিন্দু সম্প্রদায় মুসলমানদের নির্বিচারে হত্যা করে, বাড়িঘরে আগুন লাগিয়ে দেয়। বিহারীলালের তখন সবেমাত্র কৈশোরকাল। দাঙ্গায় আক্রান্ত হয়ে পরিবারের সদস্যদের সাথে পাটনা থেকে বিতাড়িত হন। বেঁচে থাকার তাগিদে কখনো কাটিহার কখনো ভাগলপুরে ঠাঁই নেয়। কিন্তু তাতেও শেষরক্ষা হয় না, দাঙ্গাবাজদের হাতে বাবা-মা খুন হয়, পরিবারের সদস্যরা একে-একে বিভিন্ন প্রান্তে ছিটকে পড়ে। বিহারীলাল তখন একা! কী করবে সে! চোখের জল মুছতে-মুছতে এক স্মরণার্থী দলের সাথে পূর্ব পাকিস্তানে রওনা হয়। জীবনের ওই দুস্মৃতির কথা বলে গিয়ে বেচারা বিহারীলাল হাউমাউ করে কাঁদে- হামাক ওরা কেনে খুন করলো লাই! হামাক ওরা কেনে খুন করলো লাই! সেদিন খুন ভি করলে ভালো হতো।

আস্তে-আস্তে জিজ্ঞেস করি- কী এমন ভালো হতো, শুনি?

লোকটি প্রচণ্ড অভিমানে দু’হাত দিয়ে মুখ ঢাকে তারপর ফুঁপিয়ে ওঠে- আমার মা বাবুছাব, আমার মা...

কথা শেষ হয় না, কণ্ঠনালি রোধ হয়ে আসে। নিবিড়ভাবে আমরা যদি বাতাসের বুকে কান পাতি তবে অসংখ্য বিহারির ক্রন্দনধ্বণী শুনতে পাবো! কথিত আছে সাতচল্লিশের আগে-পরে বিহার, উড়িষ্যা, আসাম, পশ্চিম বাংলা ও উত্তর প্রদেশ থেকে প্রায় ত্রিশ লক্ষ বিহারী উদ্বাস্তু হিসেবে পুর্ব-পাকিস্থানে প্রবেশ করেছে! বিহারীলালের কান্নায় নাতি সবুজ বিহারী বিরক্ত হয়ে মুখ খিঁচিয়ে ওঠে- এ ছালে (শালা) বুড্ডা, কান্দিস কিল্লাই! যা লা যা, তু ইন্ডিয়া যা!

একাত্তরের পরে সন্তানদের সাথে রাগারাগি করে বিহারীলাল একদা ভারতে রওনা হয়েছিল কিন্তু সীমান্তরক্ষীরা তার পথ রোধ করেছিল, ভিসা-পাসপোর্ট দেখতে চেয়েছিল। এই নিয়ে নাকি বিএসএফের সাথে হাতাহাতি পর্যন্ত হয়েছিল। বিহারীলাল অনুনয় করে বুঝিয়েছিল, নিজের দেশে ফিরে যেতে এতসব নিয়মকানুন থাকবে কেনো! সীমান্তরক্ষীদের হাতে লাঞ্ছিত এবং প্রত্যাখাত হওয়ার পরে নিশ্চিত হয়েছিল দুনিয়াটা আসলেই মগের মুল্লুক। মগদের পরিত্যক্ত ভূমির তিক্ত অভিজ্ঞতায় দুনিয়া বিষয়ক তার ভাবনা আমূল বদলে গেছে! সীমান্ত লঙ্ঘনের অপরাধে বিহারীলাল ছয় মাসের কারাদণ্ডে দণ্ডিত হয়েছিল। সাজার মেয়াদ শেষ হলে পুনরায় ফিরে এসেছিল; ফিরেছিল পরিবারের কাছে, সন্তানদের কাছে, আটকে পড়া পাকিস্তানিদের বিহারী ক্যাম্পে! কারাভোগ না করলে লোকটি হয়ত কখনোই জানতো না, বিহারী ক্যাম্প অপেক্ষা কারাগার কত উত্তম! উত্তম ঠিকানায় ফিরে যাওয়ার জন্য মাঝে মাঝে ভাবিত হয়। প্রয়োজনে খুন করবে সে! ইতোমধ্যে শক্ত-সামর্থ্য প্রতিপক্ষও জুটে গেছে! কারাগার থেকে ফিরে এলে বাবাকে নিয়ে আগুন বিহারী হাসি-তামাশা করেছিল, ভারত সম্পর্কে কটূক্তি করেছিল- ছালা মালায়ুন! মালায়ুনের বাচ্চা! জব্বর তেজ দেহায়! মাজা এক্কেবারে ভাইঙ্গা দিম। ইছ (ইস), পাকিস্তানের লগে গাদ্দারী!

পাকিস্তানের সাথে কথিত গাদ্দারীর ভাবনা পুরাতন নয় সাম্প্রতিক। সাম্প্রতিক সময়ে দেশটির প্রতি বিরূপ মনোভাব জন্মিয়েছে; খবর নিয়ে জেনেছে বৈধ-অবৈধভাবে যারা পাকিস্তানে পাড়ি জমিয়েছেন সেখানে তারা ভালো নেই, জাতিগত হামলার সম্মুখীন, সিন্ধি জাতির লোকেরা নিষ্ঠুর আচরণ করে। নাতি সবুজ বিহারী তার পিতাকে স্পষ্ট করে জানিয়ে দেয়- বাজান, পাকিস্তানের লগে এতো পিরিতি কিল্লাই! এতোই যহন পিরিতি তয় বাঙলাদেছে পইড়া আছো ক্যান, যাও, তোমার পিয়ারের পাকিস্তান চাইলা যাও!

পাকিস্তানে যাওয়ার উতগ্র বাসনায় লোকটি জীবনের এক-একটি দিন পার করছে। বুঝতে পারে না, সেই মাহেন্দ্রক্ষণ কবে আসবে! কিংবা আদৌও কী আসবে! একাত্তরের মুক্তিযুদ্ধ শেষ হলে জাতিসংঘের সহায়তায় প্রায় দশ লক্ষ বিহারী নিবন্ধিত হয়েছিল; নাগরিকত্ব বেছে নেওয়ার সুযোগ দেওয়া হয়েছিল। পাঁচ লক্ষ বিহারী বাংলাদেশের নাগরিকত্ব গ্রহণ করলেও বাকি পাঁচ লক্ষ পাকিস্তানে যাওয়ার প্রস্তাব গ্রহণ করে। বহু বছর পেরিয়ে গেছে অথচ পাকিস্তানের দুয়ার তাদের জন্য আজও উন্মুক্ত হয়নি। আটকে পড়া পাকিস্থানীরা দেশের ৭০ টি বিহারী ক্যাম্পে মানবেতর জীবনযাপন করছে। বেঁচে থাকার ন্যূনতম মৌলিক অধিকার থেকে বঞ্চিত তারা।

দুই.

বিহার ছেড়ে পুর্ব-পাকিস্থানে এসে বিহারীলাল মন্দ ছিল না, চেষ্টা-তদ্বীর করে রেলের শ্রমিক হিসেবে চাকুরি নিয়েছিল; সচ্ছল জীবনের মুখ দেখেছিল; বিয়েশাদি করে ঈশ্বরদী রেল কলোনীতে থিতু হয়েছিল। আগুন বিহারির জন্ম ওই কলোনীতেই। একেকটি সন্তান জন্মালে বাস্তুচ্যুত মানুষটি উচ্ছ্বাস তরঙ্গে দু’হাত বাড়িয়ে দিতো; সৃষ্টিকর্তার প্রতি কৃতজ্ঞতায় ‘আল্লাহু আকবার’ ধ্বনিতে সেজদায় অবনত হতো, দু’হাত তুলে মোনাজাত করতো! পরিবারের সুখ কামনায় আল্লাহর দরবারে একাগ্রচিত্তে কান্না-কাটি করতো। সন্তানগুলো শুধু সন্তান নয় যেন তার শিকড়! মাটির গভীরে শিকড় যত প্রথিত হবে বিহারের বাস্তুভিটার কথা ভুলে থাকতে ততো সহজ হবে। কিন্তু একাত্তরের মুক্তিযুদ্ধ আরম্ভ হলে বিহারীলালের জীবনের সরল সমীকরণ ক্রমশ জটিল হতে শুরু হয়। একদিকে বাঙালি মুক্তিযোদ্ধা অন্যদিকে হানাদার পাকিস্তানি বাহিনী- বিহারিরা পাকিস্তানিদের পক্ষ অবলম্বন করেছিল, ১৯৭০ সালের নির্বাচনে নৌকা প্রতিকের বিপক্ষে ভোট দিয়েছিল। পাকিস্তানিদের সাথে বিহারিদের সম্পর্ক যতোটা না আত্মিক তার চাইতে বেশি ভাষাকেন্দ্রিক। বিহারিদের ভাষা উর্দু। ভাষার দাবিতে ১৯৫২ সালে আন্দোলন-সঙগ্রাম সংঘটিত হলে বিহারিরা স্বভাবতই বাঙলার বিপক্ষে অবস্থান নেয়। ভাষাগত ঐক্যের কারণে পরবর্তীতে পাকিস্তানিদের সাথে সম্পর্ক আরো বেশি দৃঢ় হয়। ফলে একাত্তরের মুক্তিযুদ্ধে পাকিস্তানিদের পক্ষ অবলম্বন করতে দ্বিধা হয়নি। অন্তরঙ্গ মুহূর্তে বিহারীলালকে একদিন জিজ্ঞেস করেছিলাম- আপনাদের ওই সিদ্ধান্ত কি সঠিক ছিল?

ভ্রু-জোড়া কুঞ্চিত করে আমার পানে তীব্র দৃষ্টি হেনে জানায়- কেনো লাই, বাবুছাব! যুদ্ধটা ছালা মালায়ুনদের ছড়যন্ত্র! ওদের জন্য একবার বাপদাদার ভিটা ছাড়লাম আবার পাকিস্তানও ছাড়বো! নাহ, এ হবার পারে না, পাকিস্তানি ছাহেবরা আমাদের মেনে লিলো, ছামছ (আল-সামস) বাহিনী গঠন করে দিলো।

অনুতপ্ত হওয়ার ভঙ্গিতে বিহারীলাল পুনরায় বলে- পারি লাই বাবুছাব, পাকিস্তানকে হামরা রক্ষা করবার পারি লাই। বাঙালি মুছলমানরা কিছুতেই বুঝলো লা, ওরা আপন ভায়ের সাথে যুদ্ধ বাঁধালো; দেছটাকে ভেঙে হিন্দুস্থান বানিয়ে ফেললো!

সত্যি কি হিন্দুস্থান!

লয় তো কী!

বিহারীলালের ধারণা ভুল প্রমাণ করতে বিভিন্ন তথ্যের অবতারণা করি, লোকটি তবু মানতে নারাজ; বারবার সাতচল্লিশের দেশভাগ, সাম্প্রদায়িক দাঙ্গা, পৈত্রিক ভিটেমাটি হারানোর যন্ত্রণা মনে করিয়ে দেয়। এতোদিনে তাঁর মাঝে যে পরিবর্তন তা হলো, পাকিস্তানের পরিবর্তে ভারতে ফিরতে চায়, পৈত্রিক ভিটায় যেতে চায়। বিহারীলালের স্মৃতিতে যেদিন যুদ্ধের দৃশ্য ধরা পড়ে লোকটিকে সেদিন আতঙ্কগ্রস্ত মনে হয়, একাত্তরের দিনগুলোতে ফিরে যায়- সে কী দৃছ্য বাবুছাব! ছুধু রক্ত আর রক্ত! ঘরবাড়ি হারিয়ে ছবাই রাস্তায় লামলাম! হামার বড় বিটাক (ছেলে) মুক্তিরা ছেই যে লিয়ে গেলো আর দিল লাই! দু-দিন বাদে লাছ (লাশ) মিললো!

নিঃশব্দে কাঁদে লোকটি। যুদ্ধকালীন সময়ে বিহারী ও বাঙালি একে-অন্যের হামলার লক্ষ্যবস্তুতে পরিণত হয়েছিল। বেসরকারি হিসেব অনুযায়ী একাত্তরের যুদ্ধ ও যুদ্ধ পরবর্তী সময়ে আনুমানিক দেড় লক্ষ বিহারী বিক্ষুব্ধ জনতার হাতে নিহত হয়েছে। যুদ্ধের শেষ পর্যায়ে বিহারিদের উপর হামলা বহুগুণে বৃদ্ধি পেয়েছিল। উর্দুভাষী বিহারিদের রক্ষা করার উদ্দেশ্যে আন্তর্জাতিক রেডক্রস দেশের বিভিন্ন স্থানে ক্যাম্প স্থাপন করে। উত্তরাঞ্চলের বড় ক্যাম্প সৈয়দপুরে। দিনাজপুর, ঠাকুরগাঁসহ আশেপাশের জেলা থেকে বিহারিরা নীলফামারীর সৈয়দপুরে ভীড় জমায়। বেঁচে থাকার তাগিদে বিহারীলাল ও তার পরিবার নির্জন রাতের সঙ্গী হয়ে সৈয়দপুরে উপস্থিত হয়েছিল। ভেবেছিল পাকিস্তানি সৈন্যরা তাদের জানমালের নিরাপত্তা নিশ্চিত করবে। কিন্তু বিধিবাম, রাতে অন্ধকারে সৈন্যসামন্ত রংপুর সেনানিবাসে পলায়ন করলে সুখস্বপ্নসমুহ নাগালের বাইরে স্থানান্তরিত হয়। নতুন করে সূচনা হয় অনিশ্চিত জীবনের পথচলা।

তিন.

বিহারী ক্যাম্পের পাঁশ ঘেঁষে ঠাঁই দাঁড়িয়ে থাকা বৃক্ষটিকে কেন্দ্র করেই তাদের নিজস্ব পৃথিবী। দারুণ পরিকল্পনা! পুরো বটগাছটি যেন একটি পৃথিবী; আর প্রশস্ত ডালগুলো একেকটি দেশ! সবুজ, আগুন ও বিহারীলাল ভিন্ন-ভিন্ন তিনটি ডালের নিয়ন্ত্রণ নিয়ে যথাক্রমে বাংলাদেশ, পাকিস্তান ও ভারতের প্রতিনিধিত্ব করছে! ডালের সাথে এমনভাবে দোলনা স্থাপন করেছে যে ইচ্ছেমতো দোল খাওয়া, আয়েশ করা এবং সংসার যাপন করা সম্ভব! সংসারের খুঁটিনাটি জিনিস সেখানে থরে থরে সাজানো রয়েছে। কাজকর্ম না থাকলে নিজেদের মধ্যে কখনো গল্পগুজব গালাগালি কখনো-বা মারামারি করে! ওদের পৃথিবীতে আমি সম্ভবত চতুর্থ ব্যক্তি। এক বিকেলে সৈয়দপুর রেলস্টেশনে বিহারীলালের সাথে পরিচয়; ছাতার নিচে বসে বেচারা জুতা কালি করছিল আর ট্রেন যাত্রীদের জুতার পানে তাকাচ্ছিল। এমন বয়সী মানুষকে কাজ করতে দেখে মনে মনে ব্যথিত হয়েছিলাম- আহা, বেচারির কী কেউ নেই! তা না হলে এই বয়সে পরিশ্রম করতে হবে কেনো!

বিহারী ক্যাম্পে গিয়ে বিহারীলালের পরিবার-পরিজনের সাথে একদিন পরিচিত হয়েছিলাম। সাধ করে দোলনায় বসতে দিয়েছিল! দোলনায় বসাটা পাকিস্তানের প্রতিনিধি আগুন বিহারী মেনে নিতে পারে না; মুখ খেচিয়ে ওঠে- ও, এই বয়ছেও পিরিতি! এতো পিরিতি ভালো লাই। তাও আবার বাঙালি বাবু!

মনে মনে লজ্জিত হই, কী জবাব দেবো বুঝতে পারি না। আমার হয়ে সবুজ বিহারী মুখ খোলে- এতো চিল্লাও কিল্লাই! বাঙালী তো কী হইছে, বাঙালীর দেছে থাকতে ছরম (শরম) হয় লা?

এই না হলে দেশপ্রেম! বাঙালির প্রতি সবুজের আন্তরিকতা দেখে মুগ্ধ হই। বাংলাদেশের নাগরিকত্ব গ্রহণ করার সিদ্ধান্ত নিয়ে ছেলেটি সুবুদ্ধির পরিচয় দিয়েছে। আমার যদি স্বক্ষমতা থাকতো নাগরিকত্ব প্রদান ও ক্যাম্প জীবনের বন্দিদশা থেকে মুক্তি দিতে বিলম্ব করতাম না। ক্যাম্পের ওই ঘুপচি, নোংরা বস্তি বসবাসের অনুপযোগী। কোনো সুস্থ মানুষ সেখানে বসবাস করতে পারে না। আট ফুট বাই আট ফুট একটি ঘরে ন্যূনতম দশজন মানুষের আবাসন; আশিটি পরিবারের জন্য একটি ল্যাট্রিন বরাদ্দ; সঙস্কারের অভাবে জরাজীর্ণ অবস্থা। গাছের ডালে দোলনা টাঙিয়ে নিজস্ব পৃথিবী রচনা না করলে বোধহয় একজনমে ওদের পক্ষে মুক্তির সাধ গ্রহণ করা সম্ভব হতো না! আমি আর নির্দিষ্ট সীমারেখায় আবদ্ধ নয়, সীমারেখা লঙ্ঘন করে ইচ্ছেমতো ভারত-পাকিস্থান-বাংলাদেশে যাতায়াত করতে পারি। কেমন করে ওই বিহারী পরিবারটির সাথে যেন ভাব হয়ে গেছে। কাজকর্ম না থাকলে ওদের সাথে আড্ডা দিই, গল্পগুজব করি, ভবিষ্যৎ বিষয়ে পরিকল্পনা আঁটি। বড়রাস্তার মোড়ে যে ছোট্ট চায়ের দোকান সেখানে বসে চা পান করি। পিরিচের উপর গরম চা ঢেলে লালবিহারী যখন শব্দ করে চুমুক দিয়ে পান করে আমি তন্ময় হয়ে মুখের দিকে চেয়ে থাকি। কখনো চোখাচোখি হলে হাতের লাঠিতে ভর দিয়ে বাম হাতে কপালের ঘাম মুছতে মুছতে জানায়- বাবুছাব ঋণী কল্লেন লাই তো!

কেনো, ঋণ কীসের!

এই যে দয়া করে চা পিয়ালেন!

লোকটির স্বভাবই এমন- দীনহীন হয়ে কথা বলে যা শুনতে আমার ঘোর আপত্তি। অভিমান ঝরিয়ে বলি- না না এভাবে বলা অনুচিত, আমি আপনার বন্ধু না! আবার কখনো যদি বলেন, তাহলে আর আসবো না, আপনার মুখোমুখি হবো না!

অভিমান করে থাকতে পারি না, গুটি গুটি পায়ে আগুন বিহারির পাকিস্তানে আশ্রয় নিই। বাইরে থেকে লোকটাকে যতটা একরোখা এবং মেজাজি মনে হয় আসলে ততোটা অমানবিক সে নয়; নরম সুরে আক্ষেপ করে- এ কেমন লিয়তি, ছাব! যেই দেছের (দেশের) নাগরিক আমি ছেই দেছটা কি একবারের জন্যও দেখবার পারবো লাই!

তাইতো, এ তো ভারি অন্যায় কথা! বিস্বাদে মন ভরে ওঠে। জানি না পাকিস্তান সরকারের কবে সুমতি হবে! সবুজ বিহারির স্বপ্ন নাকি হাত-ছোঁয়া দূরত্বে; সরকার আন্তরিক হলেই লাল-সবুজের পতাকার সাথে তার পার্থক্য ঘুঁচে যাবে; অন্য দশজন বাংলাদেশির মতো ক্ষেতে-খামারে কাজ করবে, সংসারে সচ্ছলতা আসবে! স্বচ্ছলতার প্রশ্নে ক্যাম্পের অধিকাংশ মানুষই আর পাকিস্তানে ফিরতে চায় না। বিহারীলাল স্মৃতিকাতর; গল্পে গল্পে অতীত স্মৃতির মুখরতা ছড়ায়- বুঝলেন ছাব, এই রেললাইন হামাদের হাতে গড়া! এখানে কাজ করতে হামাদের বিহার থেকে ৭০০০ লেবার এসেছিল!

এসেছিল না, ব্রিটিশ সরকার তাদের আসতে বাধ্য করেছিল। সৈয়দপুরে রেলওয়ের ওয়ার্কশপ তৈরি হলে বিহারিদের শ্রমিক হিসেবে নিয়োগ দিয়েছিল।

চার.

সময়ের সাথে পাল্লা দিয়ে মানুষ বদলায়, পৃথিবী বদলায়, বদলে যায় সম্পর্কসূত্র- বৃদ্ধ বিহারীলালের সাথে যে সম্পর্ক তা আরো বেশি জীবনঘনিষ্ট। পদে পদে টান অনুভব করি। এক রাতে আমার অনুভূতি ভোঁতা হওয়ার উপক্রম! বৃক্ষের জীবনে সেদিন ঝড় উঠেছিল- ঘূর্ণিঝড়! একটা বিশালাকায় দৈত্য যেন পৃথিবীতে হাতের মুঠোয় নিয়ে নাড়া দিচ্ছে, কখনো ছাড়বে কেউ জানে না। ঝড়ের তাণ্ডবে ঘর-বাড়ি, বৃক্ষ-লতা কেঁপে ওঠে। আমার বুঁকের মধ্যেও কাঁপুনি, বাকী রাতটুকুন ঘুম হয় না, অস্থিরতায় ছটফট করি। ভোরের আলোয় পায়ে পায়ে ফিরে ক্যাম্পের পাশে গিয়ে দাঁড়াই। হায়, মানুষের সে কী অবর্ণনীয় দুর্ভোগ! ঘরবাড়ি হারিয়ে খোলা আকাশের নিচে ঠাঁই নিয়েছে। ঝড়ের তাণ্ডবে বিহারীলালের পৃথিবী উপড়ে গেছে। উপড়ে যাওয়া গাছের নিকটে গিয়ে বিহারিদের অনুসন্ধান করি, নাম ধারে ডাকাডাকি করি। নাহ, নেই! গেলো কোথায়! দোলনার খণ্ডাংশ যত্রতত্র ছড়িয়ে ছিটিয়ে। অজানা আশঙ্কায় খোলা আকাশের নিচে আশ্রয় নেওয়া মানুষের মধ্যে যাই, ঊর্ধ্বশ্বাসে সৈয়দপর রেলস্টেশনে ছুটি, বাস টার্মিনাল, হাসপাতাল, পুলিশ স্টেশন- নাহ, কোথাও তারা নেই! পুনরায় উপড়ে যাওয়া বৃক্ষের সান্নিধ্যে অবনত মস্তকে দাঁড়াই। বুকের মধ্যে হাহাকার, দূর থেকে ভসে আসে মিহি সুরের কান্না! এ কান্না বৃক্ষের নাকি মানুষের- ঠিক বুঝতে পারি না। মনে হয় নিয়তি; নিয়তির নিষ্ঠুরতায় তিন বিহারী হয়ত তিন দিকে ছিটকে গেছে; এমনও হতে পারে, এ-জনমে আর কারো সাথে দেখা হবে না; আমৃত্যু হয়ত দহনের বিষবাষ্প ঝরাবে! আমার চোখের কোণ বেয়ে ফোঁটায়-ফোঁটায় জল নামে। কণ্ঠনালীতে একখণ্ড ব্যথা কুণ্ডলী পাকিয়ে ওঠানামা করে। মনে মনে ভাবি- একজীবনে মানুষটি আর কতবার শিকড়চ্যূত হবে!

পিন্টু রহমান
গল্পকার। গল্পের ছলে ভাষার আঞ্চলিকাতায় চিত্রায়ণ করেন বাঙাল জনপদের বহুমাত্রিক জীবনাচার। ১৩ অক্টোবর চুয়াডাঙ্গা জেলার কুমারী গ্রামে, পৈত্রিক ঘর-বসতি কুষ্টিয়ার বাজিতপুরে। মাতা: জিন্নাতুন নেছা ও পিতা: আজিবর রহমান (বীর মুক্তিযোদ্ধা)। প্রকাশিত গ্রস্থ: গল্প- পাললিক ঘ্রাণ, পরানপাখি, হাওরপাড়ের কইন্যা, উপন্যাস- কমরেড। সম্পাদদিক কাগজ: জয়ত্রি।
বার পড়া হয়েছে
প্রকাশিত :
আগস্ট ৩১, ২০২৪
শেয়ার :
পয়স্তিতে যারা লিখেছেননির্দেশিকাশর্তাবলী
১০ দিনে জনপ্রিয় লেখক
magnifiercrossmenu