ত্রিভুবন জিৎ মুখার্জী

স্বয়ংসিদ্ধা

অভিজিৎ ও সুদেষ্ণা দেবীর কোলে যখন স্বয়ংসিদ্ধা এলো, ওদের সকলের মনে আনন্দের জোয়ার বয়ে গেল, এক সুদেষ্ণা দেবী ছাড়া।
এখানে বলে রাখি, অভিজিৎ ব্যানার্জী হাই স্কুলের অংকের শিক্ষক এবং সুদেষ্ণা দেবী বিজ্ঞানের শিক্ষিকা। দুজনেই একই স্কুলে পড়াতেন। অভিজিৎ বাবু অঙ্ক নিয়ে কলকাতা ইউনিভার্সিটি থেকে মাস্টার্স করেন এবং গোল্ড মেডেল পান। ডক্টরেট করতে পারেননি নানান কারণে তাই সুদেষ্ণা দেবীর সঙ্গে বি.এড পাস করেন এবং এক স্কুলে শিক্ষকতা করেন। সুদেষ্ণা দেবী বোটানি অনার্স নিয়ে ইউনিভার্সিটিতে দ্বিতীয় হন। দুজনেই প্রেসিডেন্সির ছাত্র-ছাত্রী ছিলেন। সুদেষ্ণা দেবী বি.এড করেন। অভিজিৎ বাবু ইচ্ছে করলেই সহকারী প্রফেসার এর অফার পেতেন, কিন্তু সুদেষ্ণা দেবীকে জীবন সাথী করার পর ঐ স্কুল সার্ভিস দিয়ে মাষ্টার হন।
সংসার দেখার জন্য এবং সুদেষ্ণা দেবী মা হওয়ার পর চাকরি ছেড়ে সম্পূর্ণ সময় মেয়েকে মানুষ করার পেছনে সময় দেন। কিন্তু তাঁর মেয়ে বাপের মতন উজ্জ্বল শ্যাম বর্ণের, তাই তার বিয়ে নিয়ে তিনি খুব চিন্তায় ছিলেন। মেয়েকে একদম নার্সারি থেকে ১২ ক্লাস অবধি উনি পড়া দেখেছেন। অভিজিৎ বাবু মেয়েকে ফিজিক্স এবং অঙ্ক পড়াতেন। মেয়ে স্বয়ংসিদ্ধা শিশু শ্রেণী থেকে প্রথম হত। ক্রমে মেয়ে ইলেকট্রিকাল ইঞ্জিনিয়ারিং পড়ে এবং এমবিএ করে।
মেয়ে চাকরি করার পর স্টেটসে যায়। সেখানে দু'বছর কাটিয়ে দেশে ফেরে। খুব কম সময়ে উচ্চ পদে যায় এবং মোটা মাইনে পায়। তবুও ওর মায়ের চিন্তা মেয়ের বিয়ে নিয়ে। সব ভালো মেয়ের কিন্তু বড্ড জেদি। বিয়ের ব্যাপারে বললেই তেলে বেগুনে জ্বলে ওঠে। তার কোন ছেলেকে পছন্দ হয় না। স্বভিমানী অহংকারী মেয়েদের বিবাহ নিয়ে মা-বাবার চিন্তার শেষ থাকে না। মা বলেন, "তুই তোর লাইফ পার্টনার নিজেই ঠিক কর।" সেটিও হবার নয়। কোন ছেলের কাছে মাথা নত করবে না। স্বয়ংসিদ্ধার যুক্তি, মেয়েদের ব্যক্তি স্বাধীনতা এখন পর্যন্ত কোন পুরুষ স্বীকার করতে পারেনা। কোন না কোন বিষয়ে পুরুষ নারীর মধ্যে এই বিভেদ আছে। এটা যে পুরুষের কাছে দেখবে, সে তাকে কিছুতেই নিজের স্বামী হিসেবে গ্রহণ করবে না। এইতো বেশ আছে সে। তাকে কেন তার মা বিয়ের জন্য উঠপীড়ন করছে ভেবে উঠতে পারেনা। যাই হোক পাত্রপক্ষ এলে হয় সে মোটা ময়দার বস্তা, নয় ঠ্যাংরা কাঠি রোগা। কারুর নাম প্যাঙ্কাটি তো কাউকে আলুভাতে, আবার কাউকে ডিব্বা বলে। মা বিরক্ত হন কিন্তু মেয়েকে কখনোই বুঝতে দেন না তাঁর মেয়ের কি খামতি আছে বলে।
নারীর আর্থিক স্বাধীনতা, স্বাবলম্বিতা, আত্মনির্ভরশীলতা, এই সবগুলোকেই আমি সম্পূর্ণ সমর্থন করি এবং সম্মান দিই কিন্তু কর্মজীবী মহিলারা কি তাঁর সংসারের প্রতি পুত্র-কন্যার এবং স্বামীর প্রতি সঠিকভাবে সময় দিতে পারেন? অনেক ক্ষেত্রে দেখা যায় ছোট্ট শিশুটিকে আয়ার কাছে কিম্বা বুড়ো বাবা-মার কাছে রেখে স্বচ্ছন্দে অফিসে চলে গেলেন তার মা। কিন্তু শিশুটির প্রয়োজন তার মা'কে। সে কি পায় তার মা 'কে? বোধহয় হয় না।
আমি চাই তুমি গৃহকত্রী হও, গৃহিণী নয়। তুমি এমন সংসার গড়বে যেখানে স্বয়ং মা লক্ষ্মী বিরাজমান হবেন। স্নেহের বন্ধনে তুমি তোমার সন্তানকে যত্নের সহকারে তোমার নিজের তত্বাবধানে মানুষ করবে। সে মা 'কে পাবে, গৃহ পরিচারিকাকে নয়। তোমার জ্ঞান, তোমার বুদ্ধিমত্তার পরিচয় তোমার সন্তানের মধ্যে প্রস্ফুটিত হবে, এটাকি তুমি চাও না? আমার মনে হয় প্রত্যেক নারী সন্তানকে শিশু অবস্থা থেকে তার আদর্শে মানুষ করুক যাতে সে সমাজে মাথা উঁচু করে বলতে পারে, "আমার মা আমার জন্মদাত্রী, সেই আমাকে পরিপূর্ণ করেছেন তাঁর শিক্ষা এবং বুদ্ধিতে।" এটাকি কম প্রাপ্তি? নারীর পূর্ণতা আমার মনে হয় এতেই বিকশিত হবে। সমাজে সু নাগরিক তৈরির জন্য নারীর ভূমিকা সর্বশ্রেষ্ঠ। তুমি কি অস্বীকার কর?
এবার আসি আর্থিক আত্মনির্ভরশীলতা। হ্যাঁ, বিষয়টা সম্পূর্ণ স্বচ্ছ হওয়া দরকার বিয়ের আগে। আমি তোমাকে পূর্ণ স্বাধীনতা দেব তোমার ইচ্ছানুসারে খরচ করার কারণ রোজগারটা আমার একার নয়, আমাদের।
আমি আমার জন্য কেবল জীবন সাথী নয়, আমি চাই একজন সম্পূর্ণ নারী, যে আমার সংসারকে মন্দির করে তুলবে।
কথাগুলো স্বয়ংসিদ্ধা মন দিয়ে শুনছিল। তার মনে একটাই দ্বন্দ্ব, চাকরি ছাড়াটা কি ঠিক সিদ্ধান্ত হবে? চাকরি ছাড়লে এই বয়সে আর চাকরি পাবে না। যদিও পায়, এখন যা পাচ্ছে সেই পরিমাণ নাও পেতে পারে। তার যা জমানো টাকা আছে, সেটা এখন কোটি ছোঁয় নি। ৩০% আয়কর দিয়ে যা থাকে তা এ যুগে অনেক টাকা। আগে গাড়ির লোন, বাড়ির লোন সব শোধ হওয়ার পর খুব একটা বেশি পরিমাণ টাকা থাকতো না। এ ছাড়া তার নিজের মেডি ক্লেম আছে, লাইফ ইনস্যুরেন্সের নমিনি তার মা-বাবা। তার মা-বাবা ছাড়া অন্য কাউকে সে সেই টাকার ভাগীদার হতে দেবে না। তার জন্য তার মা স্কুলের চাকরি ছেড়েছিলেন, কিন্তু সে দেখেছে তার মায়ের ব্যক্তি স্বাধীনতা তাতে ক্ষুণ্ণ হয়েছে। যদিও অর্থনৈতিক সচ্ছলতা ছিল, কিন্তু সেটা সীমিত, কারণ প্রয়োজনের অধিক খরচা করা মায়ের অভ্যাসের বাইরে। সে দেখেছে তার মা নিজের জন্য শাড়ি না কিনে মেয়ের জন্য ভালো ড্রেস কিনে দিয়েছেন, যাতে মেয়ে এতটুকু না ভাবে তার মা তার প্রতি যত্নশীল নন বলে। স্কুল কলেজের সমস্ত খরচা এবং উচ্চ শিক্ষার জন্য যথেষ্ট স্বার্থ ত্যাগ মা-বাবা দুজনেরই ছিল। আজ সে যা হয়েছে তার জন্য তার মা-বাবা উভয়ের কাছে কৃতজ্ঞ। এখানে প্রশ্ন উঠছে, সংসারে ত্যাগ শুধু নারী করবে, পুরুষ না? এটা তো সে মানতে পারে না। দুজনের সমান স্বার্থ ত্যাগ থাকা প্রয়োজন।
তার বাবা একটি সরকারি স্কুলের হেড স্যার হয়ে রিটায়ার করেন। বাবা তার উচ্চ শিক্ষার জন্য যথেষ্ট চিন্তা ভাবনা করতেন। মেয়েকে ডাক্তারি পড়ানোর চেষ্টা করেছিলেন কিন্তু মা বাধা দেন। মেয়ে ডাক্তার হোক কেন জানি না মা চাইতেন না। তাই ইঞ্জিনিয়ারিং পড়ে। পরে ভালো ইন্সটিটিউট থেকে এমবিএ করে ফিনান্সে। মার্কেটিং লাইনটা স্বয়ংসিদ্ধার পছন্দ ছিল না, তাই ফিনান্সিয়াল ম্যানেজমেন্টে এমবিএ করে। খুব কম বয়সেই ভালো অফার পায়। অন সাইটে যায় আমেরিকা। সে সর্বদাই একরোখা এবং একটু জেদি টাইপের মেয়ে। সেইজন্য কোন পুরুষ বন্ধু টিকত না তার জীবনে। মা চাইছিলেন তার মেয়ে নিজের পছন্দের জীবন সঙ্গী খুঁজে নেবে। কিন্তু সেরকম কিছুই হত না। রাতে ভিডিও কল করতেন কিন্তু সে ঐ সপ্তাহে একবার। মায়ের বিবাহ সংক্রান্ত কিম্বা পছন্দের ছেলে সংক্রান্ত কোন প্রশ্নের উত্তর দিত না। একটাই কথা সে বিয়ে করবে না।
প্রত্যেক বাঙ্গালী মা চান তার সন্তান সন্ততিরা ভালো লাইফ পার্টনার বা জীবন সঙ্গী বেছে নিন এবং সুখে স্বচ্ছন্দে সংসার করুক।
রূপম শুরু করে, "আমি যদি কোন ভুল রাস্তায় যাই আমাকে ঠিক রাস্তায় আনা তোমার দায়িত্ব।"

চমকে ওঠে স্বয়ংসিদ্ধা, "ভুল রাস্তা? মানে পরকীয়া না নেশা করেন আপনি?"

"আমাকে দেখে কি মনে হয় ঐ কোন একটা আমি করতে পারি?"

"মানুষকে দেখে স্বয়ং নারায়ণও চিনতে পারবেন না তার আসল রূপ কি!"

"নিশ্চিন্ত থাকতে পারেন আপনি। আমি সিগারেটও খাই না, মদিরাও সেবন নয়। নারী আমার জীবনে আসেনি বললে ভুল হবে তবে কাউকেই আমার পছন্দ হয়নি এবং সেগুলি ঐ বান্ধবীর পর্যায়ে থেকে গিয়েছে। প্রত্যেকেই আত্মকেন্দ্রিক, গর্বী, অহংএ ভরা। তাদের মধ্যে রূপ আছে ঠিক, কিন্তু মানবিকতার অভাব। সামান্য চাকরি করে ধরা কে সরা মনে করা মহিলাদের আমি ঠিক পছন্দ করি না। অনেকেই আমাকে নিয়ে করতে চেয়েছে, কিন্তু চাকরি ছাড়তে রাজি হয়নি। তাই আমি কাউকেই পাত্তা দিইনি।"
হোটেলের বয় খাবারগুলো সাজিয়ে দেয়। স্বয়ংসিদ্ধা খাবার খেতে রাজি হয় না। তার একটাই যুক্তি হোটেলের খাবার তার পছন্দ নয়। যদিও সে রাঁধতে জানে না, মা শেখাননি নয়, মা ওকে রাঁধতে দেননি কখনো। সে ম্যাগি আর কফি বানাতে পারে।

"স্টেটসে থাকার সময় কি করতেন?"

"ওই বান্ধবীদের সঙ্গে থাকতাম, তারাই প্রায় মাইক্রোতে কি সব করতো। সব সিদ্ধ আর হেলদি ডায়েট। অপছন্দ ছিল না তার একটাই কারণ আমি কুকি জানিনা।"

"একদম করেননি?"

"না।"

"চিন্তায় ফেললেন।"

"কেন, আপনি কি ভেবেছিলেন আমি আপনার ঘরে গিয়ে রান্না করে সকলকে খাওয়াবো বলে!"

"না, তা নয়।"

"তবে তবে কি?"

"যা বাবা, এতো ভারি মুশকিল। আমি সেরকম কিছু মনে করিনি। In fact, আমাদের ঘরে রান্নার মহিলা আছেন। তিনি সব রান্নাই করেন তবে ওই সব নিরামিষ রান্না। কারণ বিধবা ভদ্র মহিলা। খুব বাতিকগ্রস্ত মহিলা। আমার ইচ্ছে হলে অনলাইনে এনে খাই, তাও আমার রুমে। ডাইনিং টেবিলে মানা।"

"ভালোই তো, নিরামিষ খাবেন। পারবেন না?"

"আপনি বললে খাবো তবে ওই সপ্তাহে একদিন চিকেন কিম্বা মটন বিরিয়ানি না হলে কি চলে, বলুন?"

"উইকএন্ডে না হয় বাইরে ঘুরতে গিয়ে খাবো। সেটাই তো ভালো। উনি যখন চান না ঘরে মাছ-মাংস, কি লাভ সেগুলো করে ওনাকে ব্যস্ত করা?"

"আমার মা ও তাই বলেন।"

"না মা লোকনাথ বাবার ভক্ত। উনি পেঁয়াজ রসুনও খান না।"

"সে কি?"

"আর বলছেন কেন। আমি তাই…."

"আপনি চাইছেন আপনার বৌ রান্না করে মাছ-মাংস মুরগী খাওয়াবে!"

"কি মুশকিল। তা কেন হবে?"

"বাড়িতে যা রান্না হবে তাই খেতে হবে। আপনি বলেছেন আমি বাড়ির কর্ত্রী গৃহিনী নয়। ঠিক তো! না পরে পাল্টি খাবেন?"

"হ্যাঁ, তাই হবে। আপনি বিয়েতে রাজি?"

"ভেবে দেখবো। কিছু বলতে পারছি না।"

"ঠিক আছে। ওই শ্রীনগরের ফ্লাইট আর হোটেল রিজার্ভেশনগুলো তাহলে সেরে ফেলি। হনিমুনে কাশ্মীরে যেতে আপনার আপত্তি নেই তো!"

"আমি সুইজারল্যান্ড দেখিনি, তাই ওখানেই যাবো গেলে।"

"বেশ তো, পাসপোর্ট ভিসা!"

"সব আছে তবে না, কাশ্মীর আমাদের দেশের ভূস্বর্গ, সেটাই দেখতে যাবো। বিদেশে অনেক ঘুরেছি।"

"তার মানে আপনি বিয়েতে রাজি!"

একটু মুচকি হেঁসে স্বয়ংসিদ্ধা মাথা নাড়িয়ে বলে, "এতো উতলা হওয়ার কি আছে। একটু তো ভাবতে হবে, যাচাই করতে হবে। শুধু ছেলেরাই মেয়েদের বিষয় খোঁজ নেবে, মেয়েরা কি সেটা করতে পারেনা?"

"অবশ্যই খোঁজ নিন।"

"আপনি কি করে ভাবলেন সে কথা?"

"এই তো আপনি বললেন।"

"বিবাহ বন্ধন বিশ্বাসের বন্ধন। সেখানে সন্দেহের কোন স্থান নেই।"

"আমি দেখেই ভেবেছিলাম আপনি আমার সঠিক লাইফ পার্টনার হওয়ার যোগ্যতা রাখেন।"
দুজনে দুজনের দিকে অপলক নয়নে তাকাল। তবে কি শুভ দৃষ্টি হয়ে গেলো স্বয়ংসিদ্ধার রূপমের সঙ্গে? আপনারা কি ভাবছেন…?

ত্রিভুবন জিৎ মুখার্জী
ত্রিভুবন জিৎ মুখার্জী পশ্চিম বঙ্গের ৭৭,রামকান্ত বোস ষ্ট্রীট বাগবাজার কলকাতা ৭০০ ০০৩ তে বসবাস করেন। তিন মূলত একজন গল্পকার। তিনি বিভিন্ন অনলাইন ম্যাগাজিনসহ লিটলম্যাগে লেখালেখি করেন।
বার পড়া হয়েছে
প্রকাশিত :
জুন ৬, ২০২৪
শেয়ার :
পয়স্তিতে যারা লিখেছেননির্দেশিকাশর্তাবলী
১০ দিনে জনপ্রিয় লেখক
magnifiercrossmenu