টান

এক

আমাদের ঘিরে ছিলো পায়রার ওড়াউড়ি, আমাদের চোখে ছিলো ঘোরলাগা ঢেউ! ভাসলাম, ডুবলাম, চোখ বন্ধ করে ঘুরে এলাম রঙের সমুদ্দুর!

প্রেম কাকে বলে জানে নাই কেউ, মানুষ দেখে শুধু দেহের বাহার! মৃত্যুর মতো ছোট্ট অধ্যায় নাকি টেনে দেয় জীবনের সমাপ্তি! দেহের পর্শে মজেছিলো যাঁরা-তাঁদের সঙ্গে দ্বিমত বলে, রয়ে গেছি নিঃশ্চুপ।

কোথাও ক্ষয়ে যাচ্ছে ঠোঁট! চুম্বন ছড়িয়েছে মায়াবী তেজস্ক্রিয়তা! চোখের ভিতর চেরনোবিল দুঃখ! পায়রার বন্দরে পড়ে আছে পুরনো নোঙর।

আমি কেবল ঘুরি-ফিরি বন্দরে বন্দরে, জলের স্বভাবে ছুটে যাই বিভ্রমের দেশে; বিমূর্ত সরাইখানায় শরাবের গেলাসে ভেসে থাকা চাঁদ থেকে উপচে পড়ে জ্যোৎস্নার বুদ্বুদ!

দুই

যুদ্ধের মাঠে মানুষের নাম হয় শত্রু! বন্দুকের নলের আগায় থাকলে নাম হয় টার্গেট! গরম বুলেট মাথা ভেদ করে গেলে হয়ে যায় শবদেহ! যাকে বলে ‘ডেডবডি!’ সভ্যতার শুরু থেকেই নাম রাখা শিখেছিলো মানুষ।

বুকের ভিতর তোলপাড়! হৃৎপি-ে রক্তের ভীষণ চাপ! নিঃশ্বাস দীর্ঘ হলে; তার নাম হয় কষ্ট! কম্পিত চোখ চুইয়ে জল গড়ালে লোকে তাকে কান্না বলে! বুকের ভিতর খালি খালি লাগলে তাকে বলে প্রেম!

সূর্যের উত্তাপ গলে পড়ে বিশাল অঞ্চলজুড়ে; বায়ুর শূন্যতা পুরণে চক্রাকারে ধেয়ে আসে বাতাস! মানুষ তার নাম দিলো ঝড়! একেকটা ঝড়ের আবার একেকটা নাম হয়! নার্গিস, ক্যাটরিনা, তিতলী…

একজনকে চিনতাম, অথবা চিনতামই না! তবু মানুষের স্বভাবে তাঁর নাম রেখেছিলাম অরুণিমা। আসলে তাঁকে দেখিনি কোনোদিন, অথবা প্রতিদিনই দেখা হতো! নাম ধরে ডাকবো বলে অপেক্ষা করতাম, কোনো কোনো অপেক্ষায় থাকে নিবিড় প্রেম! মানুষ বোঝে না।

নাম ধরে ডাকলেই ফিরে তাকায় সকলেই! তাকায় নাকি! বৃক্ষ, নদী, পাহাড়… নাহ! সকলেই পারে না ছুটে আসতে, ফিরে তাকাতে। আমাকে তুমি ডেকেছো অবেলায়… অথচ আমি তখন নামহীন, গোত্রহীন… ডেকো না; ধরে নাও আমার কোনো নামই নেই, অথবা তোমাদের নাম দিতে দিতে ভুলে গেছি নিজের নাম!

তিন

চিহ্ন রেখে গেছে কেউ, অথচ সে ছিলো না কখনো, অথবা নেই। চিহ্নের সাথে বোঝাপড়া নেই তেমন, তবুও ভালোবাসাবাসি চলে বেশ!

ফসিলের বয়স থাকে, পাথর এবং বৃক্ষের যেমন; চিহ্নরা বয়সহীন। আজন্মলালিত স্বপ্নের মতো, চিরন্তন সত্যের মতো চিহ্নদের যাতায়াত।

ক্ষয়ে যাওয়া দাঁতের সাথে বদলে যায় হাসির দৃশ্যপট, চোখের নিচের ভাঁজ বয়ে বেড়ায় বিনিদ্র যাপনের গল্প। গল্প একটা মিথ্যার মহল্লা, আজগুবির কানাগলি; সত্য বলে কাউকে পাওয়া যায়নি।

রুপালি লণ্ঠনের সাথে সমাধিফলকের একটা আজন্ম আত্মীয়তা, অথবা মনে করো পৃথিবী একটা কবরস্থান আর রুপালি লণ্ঠন একটা চাঁদ। কিংবা মনে করো তুমি কোন দূর দেশে আর আমি এইখানে… আমাদের মাঝখানে পুরনো প্রাসাদের মতো শূন্য পড়ে আছে অসহায় চিহ্নমালা।

চার

যে গেছে সে আর ফিরে আসে না, অথবা ফিরে এলে আর সে থাকে না, ফিরে আসে অন্য কেউ, একই রূপে। আমরা একদিন এইসব বিশ্বাসের ঊর্ধ্বে যেতে চেয়েছিলাম; আর তখনি ধনুষ্টংকারের মতো বেঁকে গিয়েছিলো আমাদের পথ।

যে যার মতো ছিটকে পাড়ি দিই বিষাদনদী, বাতাসের বৈঠা বেয়ে আগুনের নৌকায় আমাদের একলা যাপন। পিছনে পড়ে থাকে কবিরাজ পাড়া, আমাদের রঙিন আমলকিবন; হরিতকি, থানকুনি, ঘাসফুল… এইসব একদিন আমাদের ছিলো।

এখন আমাদের কোনো পোষা পাখি নেই, আগেও ছিলো না। তবু আমরা খাঁচা পুষে রাখি রোজ; শূন্য, স্মৃতিময়, অলৌকিক।

পাঁচ

ছোটো বেলায় ঝোপে ঝাড়ে দৌঁড়াতে দৌঁড়াতে একদিন জেনেছিলাম ঘুড়ি কেটে গেলেই সবার হয়ে যায়!

সবার হতে পারে ঘুড়ি, বাতাসে গোত্তা খেতে খেতে তাই কেটে যাওয়ার ফন্দিফিকির!

মানুষ পারে না, বার বার জিতে গিয়ে লটকে থাকে নাটাইয়ে!

ছয়

ওরকম তাকালে চুলের মুঠিতে গেঁথে দেবো পাঁচ আঙুল! চোখের ভিতর চালাবো চর দখল! স্বৈরাচার হবো ভীষণ!

ওরকম তাকিও না, নাগাসাকি হয়ে যাবে লোকালয়! আর তোমার হৃদগাঁয়ে ঘটে যাবে হিরোসিমা! ঠোঁটের বারান্দায় ওড়াবো আলতো কুয়াশা! চুমুর নিশানা রেখে যাবো প্রেমের পর্চায়।

ওরকম তাকিয়ো না, ওরকম তাকালে দায়ী থাকবে না নগর পিতা, আমিও নির্দোষ প্রমাণের জন্য মরিয়া হয়ে উঠবো!

সাত

সন্ধ্যার বাসস্টপ, ঘরে ফেরার তাড়া, ফিরি তো প্রতিদিন; কোথায় ফিরি? কেন ফিরি! কীসের সে টান! কর্পোরেশনের ময়লা টানা গাড়ি যে চালায়, সেও তো ফেরে! তারও টান থাকে! আর সকালবেলার ঝাড়–দার, টোকাই, পেপারওয়ালা, সকলেই ফেরে।

মেয়েরা ডিভোর্স নিয়ে যেমন স্বাবলম্বী হয়ে ওঠে, ওইরকম বেঁচে থাকার তাড়না তাড়া করে প্রতিদিন; গোপনে কাউকে ভালোবাসা যেমন স্বাস্থ্যকর, তেমনি অস্বাস্থ্যকর-কাউকে ঘৃণা করা।

মোটা মাইনের আশায় মোটা টাকায় পাওয়া মোটা চাকরি করা আর গলায় টাই ঝুলিয়ে খবরের কাগজে মন বসানো সমান কাজ নয় বটে! বউয়ের ফর্দটা বড় হয় দিন দিন, নতুন রাস্তা কেটে যায় বুলডোজার, প্রয়োজন খাবি খায় দরোজায়! একদিন গাছ কেটে নেওয়ার মতো আমাদের উন্নতি খুলে নেবে হৃদপিণ্ড!

বাসস্টপেজেরও বাড়ি আছে, ঘর আছে; ভাসমান মানুষেরা টার্মিনালে, ফুটপাতে শুয়ে পড়ে বেশ! ঘুম কোনো বাঁধা মানে না। কন্ডাক্টর ঘুমের মধ্যে গলা হাঁকে অভ্যাসবশে।

আট

চাইলেই কাউকে ঘৃণা করা যায় না বলে ভালোবাসাই থাকে সম্বল! ভালোবাসতে কোনো উপলক্ষ্য লাগে না, অথবা খুব ছোট্ট কারণেই ভালোবেসে ফেলা যায় কাউকে। এই যেমন তোমাকে অনায়াসেই ভালোবেসে গেলাম চিরকাল।

খুব ছোট্ট কারণে কাউকে ঘৃণা করতে চেয়েছিলো যাঁরা, তাঁদের ঝুলিতে ব্যর্থতার গল্প! মানুষ নিজেকে হত্যা করার পূর্বে অন্য যাঁকে হত্যা করতে চেয়েছিলো, তাঁর জন্য ছিলো ভালোবাসার টান! অদ্ভুত টানে সঙ্গে করে নিয়ে যেতে চেয়েছিলো তাঁকে!

অথচ কী অদ্ভুত! ঘৃণিত শত্রুকে হত্যা করে, মানুষ আত্মহত্যার কথা ভাবতে পারেনি কোনোদিন।

নয়

তুমি বললে অসম্ভব! আর তখনই সকল সম্ভাবনারা হাঁটু গেড়ে বসে গাইলো ব্যার্থতার গান। তুমি বললে মেঘ হবো, আর অমনিই নক্ষত্ররা ঝাপসা হতে লাগলো। তুমি নদীর দিকে হেঁটে গেলেই আমার কণ্ঠে মরুতৃষ্ণা!

তুমি মুখ ফিরিয়ে নিলে-পাতারা অবনত; চোখ থেকে চিবুকে হেঁটে যায় পিলগ্রিম, দীর্ঘায়িত হয় প্রার্থনা। একটা বিকট চিৎকার চেপে রেখে, চায়ের কাপে ঠোঁট ছোঁয়ানোর পারঙ্গমতায়-বেঁচে যাই হয়তো।

টান, একটা শব্দ মাত্র; বৃষ্টি কিংবা জলের মতো অতি সাধারণ। কেবল চোখ থেকে জল গড়ালেই আগুনের নাম হয় হিমবাহ।

দশ

পায়রারা সবুজ হলে বেশ হতো! টিয়েরা লাল! আর কাকগুলো হলুদ হলে মানাতো বেশ! মেঘগুলো নেমে এলো নাশতার টেবিলে! পিরিচে, কাপে ও গেলাশে! ওমলেটের কমলা কুসুমকে উদিত সূর্য ভেবে সুখী হবো!

এরকম অনেক কিছুই ভেবে নেওয়া যায় নিজের ভিতর, অনেক কিছুই গড়ে নেওয়া যায় কল্পলোকে।

যেরকম আমি অথবা দান্তে, দান্তে অলিঘিয়েরি অথবা আহমেদ শিপলু;

যেরকম তুমি অথবা বেয়াত্রিস।

মনে করো আমরা ডিভাইন কমেডি, অথবা এসবই আমাদের সম্মিলিত অপেক্ষা।

এগারো

একটা আশ্চর্য প্রদীপের অপেক্ষায় কেটে গেছে দিন। অথবা মধুর চৌম্বকীয় টান কী ভীষণ প্রতীক্ষায় বসিয়ে রাখে! ত্বকের পর্শে বিদ্যুৎ, চোখের চারপাশে রঙিন বাগান, বুকের খাঁচায় অস্থিরতা! এইসব ছিলো একদিন।

প্রদীপের আশ্চর্য ক্ষমতায় প্রগাঢ় বিশ্বাস; একটা গোলাপ কিংবা ছোট্ট চিরকুটের ওপর কী অগাধ আস্থা! টেলিপ্যাথি চলে দিনরাত, আমাদের কথোপকথন বাতাসে বাতাসে কাটাঘুড়ি।

বিশ্বাসের দৈত্যকে ডেকেছিলাম একদিন। অলৌকিক আস্থায় পথ হেঁটে তোমাকে ছুঁয়ে দেওয়ার বাসনায় কাটানো দিন শেষে জেনেছি তিলবতীরা ছিলো না কোথাও কোনোদিন।

চোখ বন্ধ করে চুমু খাওয়ার মতো একটা অদৃশ্যকে ভালোবেসে অপেক্ষা করা যায় হয়তো; নইলে পৃথিবীজুড়ে এত এত বিশ্বাসের চেরাগ!

বারো

চেনা পথঘাট অচেনা মনে হলে বুঝে নিই গন্তব্য; এরকম হেঁটে যাওয়া দিনগুলো রাখা যায় না ঘুমের ব্যালকনিতে। সেখানে যার ছায়া আসে যায়, সে থাকে অন্য ঘরে।

চোখের চুল্লিতে ঝাঁপ দিতে গিয়ে আগুনের কথা মনে রাখা কোনো বুদ্ধির কাজ নয়; অথচ নির্বোধেরা প্রেমিক হয় না কখনো।

এইসব ছায়া ছায়া সঙ্গীরা আজকাল ভিড় করে খুব; মুখস্থ পথে যারা আসে যায়, তাঁরা কেউ আমার নয়। আমিও কারো পথের দিকে হেঁটে যাইনি হয়তো; অথবা পথেরা বেড়াতে গেছে অন্য কোথাও।

তের

অভিমানের আয়নায় নিজেকে দেখার মতো এই বৃষ্টি কিংবা পলাতক সূর্যের দুপুর স্থির হলো বারান্দায়। আমাদের নাক্ষত্রিক পরিভ্রমণের দিনগুলো একদিন সোনালি হতে চেয়েছিলো!

সোনালিদুঃখ অথবা সোনালিরা দুঃখের বার্তা রেখে গেছে মেঘের পালঙ্কে; এখন শুধুই অপেক্ষার কাল। পরিচিত গ্রহ ছেড়ে একদিন চলে যাবো… এইসব ভাবনারা আজকাল খুব করে ঘিরে ধরলে একটি মুখচ্ছবি আঁকার চেষ্টা করি।

চোখ বুজলেই নক্ষত্ররা ঝাঁকবেঁধে নৃত্য করে! যেনো ছুড়ে দেওয়া জালে আটকা পড়া প্রাণপণ ঝাপটানো রূপালি মৎস্য! নাকি মৎস্যকন্যাদের অবিরাম যাতায়াত! কতো কিছুই তো জানা হলো না।

ঝড়ে নিহত পাখিদের জন্য কোনো শোকগাথা নেই, তবু শহরজুড়ে হাওয়াদের দূতিয়ালি চলে সারারাত। নরম নরম ভোর প্রতিনিয়ত আসে আর যায়; কেবল একটা বারান্দা হয়ে ওঠে মহাজাগতিক নীলাদ্রিচূড়া।

চৌদ্দ

সেইসব অস্পষ্টতা চোখের কক্ষপথে এখনো চলমান, যাঁদের কথা বলবো বলে আসরে বসে থাকি; অথচ আসরের লোকেরা পরনিন্দায় মশগুল!

দূর গ্রহের দিকে তাকিয়ে থাকার স্বভাবে দেখি একটা মায়াময় মুখমণ্ডল; একটা নাতিশীতোষ্ণ বিকেলের উদ্যানে আলো নিভে যাওয়া পর্যন্ত-আঙুলের স্পর্শ নেওয়ার অপেক্ষা…

আমাদের কিছুই ছিলো না কোনোদিন, যেরকম থাকে না একজন নিঃসঙ্গ রাখালের; তবু সে বাঁশি বাজিয়ে পৌঁছাতে চায় তুমুল ঠিকানায়।

তোমাকে দেখার অভ্যাসে কাটানো দিন শেষে একদিন ঠিকই উঠে যাবো আসর থেকে, আড্ডার লোকেরাও ফিরে যাবে ঘরে। মেনে নেবো এইসব যাপনের দিন; বিদ্যুৎ পরিবাহী বাদুড়ের মতো তড়িতাহত অথবা নিহতের তালিকায় লেখা হবে নাম।

পনের

শব্দকে জঞ্জাল বানাবো না বলে অহেতুক টেনে আনি তোমাকে। বাক্যে বাক্যে মনুমেন্ট গড়া যায় বটে, হারের লকেটের মতো শূন্যতা বোধে তবু তোমাকেই ডেকে আনি ফের।

আকাশে মেঘ ঘন হলে গাছেরা রং বদলায়, হাইরাইজ শহরকে অচেনা লাগে খুব। এংজাইটি, এসিডিটি, জ্যাম, ফুটপাত, ফুচকা, ব্লুলাইট, সব তখন জাদুবাস্তবের অনন্ত রেস্তোরাঁ।

আমরা বসে ছিলাম একটা ফাটলের সামনে, অথবা অদৃশ্য দাগ কেটে গেছে কেউ আমাদের যাতায়াতের মাঝখানে। এখন অপেক্ষা ছাড়া আর কোনো সীমান্ত নেই চিন্তার ভূচিত্রে।

চলতি সংখ্যা