শীর্ষেন্দু মুখোপাধ্যায় বাংলা ভাষার অত্যুজ্জ্বল কথাশিল্পী। জন্ম ২ নভেম্বর ১৯৩৫-এ, বাংলাদেশের ময়মনসিংহে। মানুষের জীবন- জীবনের গভীরতম, সূহ্ম উপলব্ধি ও ভেতরের কান্না-হাসি-ক্লেদ রূপায়িত হয় তাঁর সাহিত্যে, অপূর্ব সৃষ্টির দ্যোতনায়। তাঁর প্রথম উপন্যাস ঘুণপোকা বের হয় ১৯৬৭-তে শারদীয় দেশ পত্রিকায়। উল্লেখযোগ্য গ্রন্থ : মানবজমিন, দুরবিন, যাও পাখি, চক্র, উজান, পার্থিব, মনোজদের অদ্ভুত বাড়ি প্রভৃতি। শিক্ষকতা দিয়ে কর্মজীবন শুরু হলেও পরে সাংবাদিকতায় ঢুকে পড়েন। বর্তমানে দেশ পত্রিকার সঙ্গে যুক্ত। শীর্ষেন্দু মুখোপাধ্যায় ঢাকায় এসেছিলেন ২০১২ সালের এপ্রিলে, এইচএসবিসি-কালি ও কলম পুরস্কার প্রদান অনুষ্ঠানে যোগ দিতে, বিশেষ অতিথি হয়ে। ৮ এপ্রিল রোববার ঢাকার আকাশজুড়ে ছিল হালকা আর তুমুল বৃষ্টি। পুরান ঢাকার ঠাঠারিবাজারে, শ্রীঅনুকুল ঠাকুরের আবাসনে সেই বৃষ্টিস্নাত সন্ধ্যায় বরেণ্য এই কথাসাহিত্যিকের সাক্ষাৎকার গ্রহণ করেন তরুণ গল্পকার মাসউদ আহমাদ
মাসউদ আহমাদ : বাবার চাকরির সুবাদে আপনার বাল্যকাল কেটেছে বিভিন্ন জায়গায়। সেই সময়ে দেখা ব্রহ্মপুত্র নদ, দাদুর মৃত্যু, ভবানীপুরের জমিদার বাড়ি, পুকুর, বাগান প্রভৃতি আপনার কলমে বারবার এসেছে...
শীর্ষেন্দু মুখোপাধ্যায় : ভবানীপুরের জমিদার বাড়ি আমাদের পাশে ছিল বটে, কিন্তু তাদের সঙ্গে আমাদের খুব একটা যোগাযোগ ছিল না। গৌরবপুরের সঙ্গে আমাদের খানিকটা যোগাযোগ ছিল। এই দুটো জমিদার বাড়ির মাঝখানে আমরা থাকতাম। আমাদের বাড়ি ছিল কাঁচা, এখনকার মতো দালান নয়, দালানকোঠা নয়। তবে মাটির ভিটি ছিল বেশির ভাগ ঘরে। দাদু বাড়ি করেছিলেন ময়মনসিংহের দুর্গাবাড়িতে, বিরাট বড় বাড়ি। সেই বাড়িতে আমাদের থাকা হয়নি, ওটা ভাড়া দেওয়া হয়েছিল। এগুলো আমার খুব মধুর স্মৃতি, প্রিয় স্মৃতি। কাজেই এসব কথা আমার লেখায় মাঝেমধ্যেই আসে।
ছেলেবেলার প্রতি সব মানুষেরই মুগ্ধতা থাকে আপনার লেখাতেও ছেলেবেলার স্মৃতি বাদ যায়নি...
শীর্ষেন্দু মুখোপাধ্যায় : এটা মানুষের স্বভাব। মানুষ তার শৈশবকালকে সহজে ভুলতে পারে না, যদি সেই শৈশবকাল কোনো মধুর স্মৃতির বাহক হয়। কারও শৈশব খুব তিক্ততার মধ্যে কেটে থাকে- সবার শৈশব তো একই রকম হয় না। অনেক মানুষ তিক্ততা ও মর্মান্তিক অভিজ্ঞতার মধ্য দিয়ে শৈশব কাটায়। তাদের শৈশবস্মৃতি মধুর হয় না। কিন্তু বেশির ভাগ মানুষেরই শৈশবে মা-বাবার ভালোবাসা ও তাদের কেয়ারিং, ভাইবোন, যৌথ পরিবারের স্মৃতিÑ এসব কাজ করে। কিন্তু মনে রাখতে হবে, আমাদের দেশে যারা অনাথ, শৈশব-কৈশোরে মা-বাবাকে হারিয়েছে, তাদের শৈশব মধুর নয়।
এই বিচিত্র শৈশব-কৈশোরের স্মৃতি আপনার লেখকজীবনে বিশেষ কোনো ভূমিকা রেখেছে কিনা?
শীর্ষেন্দু মুখোপাধ্যায় : হ্যাঁ, কেবল ভূমিকা রেখেছে তা-ই নয়, আমাকে এখনো প্রভাবিত করে। আমি তো মাঝেমধ্যে বলি, আমার শৈশবের আমি আমার সঙ্গে এখনো হাত ধরে চলছি।
‘দুরবিন’ উপন্যাসের আখ্যানভূমির পেছনে আপনার দাদুর জীবন, তাঁর বেঁচে থাকার অভিজ্ঞতার নির্যাস বোধহয় নিবিড়ভাবে মিশে আছে...
শীর্ষেন্দু মুখোপাধ্যায় : তা খানিকটা বলা যায়। এটা উজান-এ বেশি আছে। হয়ত এ-রকম ছোট ছোট প্রক্ষেপ কিছু ঘটে। সবটাই কিন্তু রিয়েলিটি নয়, ওর মধ্যে কল্পনার মিশেল আছে। এক ব্যক্তির মধ্যে অন্য ব্যক্তির সংমিশ্রণ আছে।
আপনার দাদু তো জমিদার বাড়ির ছেলেকে পড়াতেন, তাঁর জীবনদর্শন কতটুকু প্রভাব ফেলেছে আপনার জীবনে?
শীর্ষেন্দু মুখোপাধ্যায় : জীবনদর্শন নয়- আমাদের পুরো পরিবারটাই খুব সৎ প্রকৃতির বলতে পারো। তাঁরা সাধু প্রকৃতির মানুষ ছিলেন। অন্যায্য টাকা তাঁরা অর্জন করতেন না। কতগুলো ম্যরালিটির ব্যাপার ছিল। দাদুকে আমি খুব কম বয়সে হারিয়েছি, সাত বছর বয়সে। সুতরাং, দাদুর প্রত্যক্ষ বা আগ্রাসী ভালোবাসা ছিল আমার প্রতি, সেটি আমার জীবনে এখনো পরম সম্পদের মতো রয়েছে। তবে জীবনদর্শনের কথা যদি বলো, সেটা তো আমার জীবনে প্রত্যক্ষভাবে কাজ করছে না। কারণ, তখন আমি এত ছোটÑ। তবে তিনি খুব সৎ মানুষ ছিলেন, এটুকু মনে আছে।
আপনার লেখায়, এমনকি বিভিন্ন বইয়ের উৎসর্গপত্রে ঠাকুর অনুকূল চন্দ্রের কথা খুঁজে পাই। এ বিষয়ে কিছু বলুন?
শীর্ষেন্দু মুখোপাধ্যায় : ঠাকুর তো আমার গুরু, কাজেই ঠাকুরের কথা তো থাকবেই। ঠাকুরের স্মারক বা চিহ্ন আমার সব বই-ই বহন করে। ২০ বছর আদ্যক্ষর থাকে। ঠাকুরের একটা বর্ণনা থাকে। এটাকে আমি ব্যবহার করি। কারণ, আমার জীবনে সবচেয়ে বেশি প্রভাব হচ্ছে ঠাকুরের।
তাঁকে প্রথম খুঁজে পেলেন কীভাবে?
শীর্ষেন্দু মুখোপাধ্যায় : আমি একটা সংকটে পড়েÑ মানসিক সংকটে পড়ে তাঁকে খুঁজে পাই। তিনি আমাকে সংকট থেকে রক্ষা করেন। তারপর থেকেই তাঁর জীবনদর্শন বা অনুশাসনবাদ আমাকে প্রভাবিত করে রেখেছে এবং হানড্রেড পারসেন্ট তাঁকে অবলম্বন করে জীবনের পথে চলি। আমার যা কিছু, সব ঠাকুরের।
তিনি, ঠাকুর আমাদের পাবনার, ঠিক বললাম কি?
শীর্ষেন্দু মুখোপাধ্যায় : হ্যাঁ, ঠিক ধরেছ। সেখানে আমি অনেকবার এসেছি। পাবনা আশ্রমে।
রবীন্দ্রনাথকে আপনি কীভাবে অনুভব বা বিবেচনা করেন?
শীর্ষেন্দু মুখোপাধ্যায় : ওহ্ বাবা, রবীন্দ্রনাথের প্রভাব তো সর্বব্যাপী। আমার ঘুণপোকা উপন্যাসে তাঁকে নিয়ে লিখেছি প্রায় আড়াই পৃষ্ঠার মতো। রবীন্দ্রনাথ সম্পর্কে আমার অত্যধিক ভালোবাসা ও শ্রদ্ধাবোধ আছে। রবীন্দ্রনাথ প্রত্যক্ষভাবে হয়ত আমাকে প্রভাবিত করেননি, কিন্তু আমার মানসিকতা, অ্যাটিচিউডকে প্রভাবিত করেন।
আপনি একবার বলেছিলেন, ছোটগল্পের জন্য তাঁকে আর একবার নোবেল পুরস্কার দেওয়া যেত?
শীর্ষেন্দু মুখোপাধ্যায় : হ্যাঁ, তাঁর ছোটগল্প অসাধারণ। রবীন্দ্রনাথের ছোটগল্পের কোনো তুলনা হয় না।
১৯৪১ সালে রবীন্দ্রনাথ যেদিন মারা গেলেন, আপনার বাবা অফিস থেকে ফিরে মাথায় হাত দিয়ে বসে পড়লেন। দিদি স্কুল থেকে ফিরে বলল, ‘রবীন্দ্রনাথ মারা গেছেন।’ মনে পড়ে সেই দিনটির কথা?
শীর্ষেন্দু মুখোপাধ্যায় : খুব মনে পড়ে। মা কেঁদেছিল খুব। মায়ের চোখে জল এসেছিল।
লেখালেখির মানসিক প্রস্তুতি শুরুরও আগে প্রথম বই পড়া, বিশেষ করে সাহিত্যপাঠ কীভাবে আরম্ভ হলো?
শীর্ষেন্দু মুখোপাধ্যায় : অনেক বই ছিল আমাদের বাড়িতে। বই পড়ার অভ্যাসটা ছিল পরিবারের সবার। আমাদের দেশের বাড়িতেও দুই আলমারি বই ছিল। সেসব বই আমি অকাতরে পড়তাম, কেউ বাধা দিত না। বই পড়ার অভ্যাসটা বংশগত বলতে পারো। দাদু, ঠাকুমা বই পড়তেন। বাবা তো ভীষণ পড়ুয়া ছিলেন। মা বই পড়তে ভালোবাসতেন।
প্রথম প্রকাশিত লেখা?
শীর্ষেন্দু মুখোপাধ্যায় : প্রথম লেখা বলতে যদি বলো, প্রকাশিত প্রথম লেখা, সেটা স্কুল ম্যাগাজিনে প্রথম ছাপা হয়। তখন আমি ক্লাস টেনে পড়ি।
প্রথম দিকে আপনার লেখা তেমন ছাপা হতো না, কলেজ ম্যাগাজিনে এলো দ্বিতীয়বারের চেষ্টায়?
শীর্ষেন্দু মুখোপাধ্যায় : তখন তো আমার ছোট বয়স, ১৪-১৫ বছর বয়স। সেসব লেখা কি আর ছাপে বড় কাগজ?
‘দেশ’ পত্রিকায় আপনার গল্প- ‘জলতরঙ্গ’ প্রকাশিত হয় তৃতীয়বারের চেষ্টায়, প্রথম দুবার গল্প ফেরত দিয়েছিল?
শীর্ষেন্দু মুখোপাধ্যায় : হ্যাঁ, তার আগে আমি দুটো গল্প জমা দিয়েছিলাম, সেসব ছাপা হয়নি। থার্ড গল্পটি ছাপা হয়েছিল। আমি সিদ্ধান্ত নিয়েছিলাম, এই গল্প প্রকাশিত না হলে আর লিখব না।
লেখালেখির উন্মেষ পর্বে আপনার বন্ধু ছিলেন কারা?
শীর্ষেন্দু মুখোপাধ্যায় : যাঁরা ছিলেন, তাঁরা এখন কেউ নেই, মারা গেছেন। আমার এক সহপাঠী ছিলেন বিভূতি রায়, তারপর নির্মল চট্টোপাধ্যায় নামে এক বন্ধু ছিলেন। প্রথম যুগে তাঁরা আমাকে খানিকটা সাহচর্য দিয়েছিলেন।
আপনি বলেন- জনপ্রিয় না হওয়ার জন্য আপনার কোনো কষ্ট ছিল না। কিন্তু এখন তো আপনি ঈর্ষণীয় জনপ্রিয়!
শীর্ষেন্দু মুখোপাধ্যায় : আমি যখন লেখা শুরু করি, তখন আমার পাঠকপ্রিয়তা ছিল না। অনেকে আমার লেখা বুঝতে পারত না। আমি বুঝতাম পারতাম, আমার সঙ্গে পাঠকের কমিউনিকেশনের একটা অভাব হচ্ছে। কিন্তু আমি লিখে গেছি পাঠকের মুখের দিকে না তাকিয়ে। এখনকার পাঠক আমার সেই লেখাগুলো বুঝতে পারে। কাজেই এখন আর সেই দুঃখ নেই। দুঃখ ছিলও না আমার। আমি তো পাঠকের জন্য লিখিনি কখনো। পাঠককে খুশি করার জন্য লিখিনি। পাঠক আমার লেখা নিলে নিল, না নিলে ফেলে দিল। কিন্তু পাঠককে খুশি করব এমন অ্যাটিচিউড আমার কখনো ছিল না।
‘ঘুণপোকা’ তো আপনার প্রথম উপন্যাস, এটি দেশ শারদীয় সংখ্যা ১৯৬৭-তে বেরোয়। ঘুণপোকা-র জন্মকথা নিয়ে কিছু বলুন!
শীর্ষেন্দু মুখোপাধ্যায় : জন্মকথা কিছু নেই। সেই সময় আমি মানসিকভাবে অস্থিরতা বা অস্বস্তিময়তার মধ্যে ছিলাম। আমি লিখব না বলে ঠিক করেছিলাম, কিন্তু জীবনে যখন প্রথম উপন্যাস লেখার আহŸান বা আমন্ত্রণ এসেছে, তখন উপেক্ষা করারও সাধ্য ছিল না। সুতরাং, সেই মানসিক অশান্তির মধ্যে থেকেই আমি উপন্যাসটি লেখা শুরু করি। এবং আল্টিমেটলি শেষও হয়ে যায়। তখন কী লিখেছি, আমি জানি না। সেই সময় অ্যাসেস করার মতো মানসিক অবস্থা আমার ছিল না।
আপনার বইয়ের বিশাল একটি মার্কেট বাংলাদেশের নীলক্ষেত বইয়ের বাজার, সেখানে বিখ্যাত যেকোনো লেখকের বইয়ের পাইরেট কপি বিক্রি হয়। ওখানে কখনো গিয়েছেন? কিংবা পাইরেট বই নিয়ে আপনার বিবেচনা কী?
শীর্ষেন্দু মুখোপাধ্যায় : পাইরেট হওয়া তো একদমই উচিত নয়। কারণ বাংলাদেশে, বিশেষ করে পশ্চিমবঙ্গে আমার বই যা বিক্রি হতো, বাংলাদেশে তার পাঁচ-ছয় গুণ বেশি বিক্রি হতো। আগে ছোট বইগুলো পাইরেট হতো, বড় বইগুলো হতো না। কিন্তু আমার পার্থিব বেরোনোর পর, বছর দুয়েকের মধ্যেই বড় বইগুলোও পাইরেট হতে শুরু করে। এখন পাইরেসিতে বাংলাদেশ ভরে গেছে। এমনকি কলকাতায় বই বেরোনোর আগে এখানে বই বেরিয়ে যায়। এখন অসুবিধা হচ্ছে এই যে, সেসব বইতে আর আমরা রিকগনাইজ করতে পারি না। এটা বন্ধ করার জন্য কিছু একটা তো করা উচিত।
‘মানবজমিন’ কে আপনার অন্যতম প্রতিনিধিত্বশীল কাজ বিবেচনা করেন কি?
শীর্ষেন্দু মুখোপাধ্যায় : সেসব বিচার তো আমার করার কথা নয়, এসব তোমরা করবে। পাঠক বলবে। আমি এটুকু বলতে পারি, আমি সব লেখার মধ্যেই আমার সবটুকু দিতে চেষ্টা করি। ফাঁকি দিই না। তবে সেটা কী হয় না-হয়, ওটা নিয়ে ভাবি না। যে লেখা বেরিয়ে গেছে- মানবজমিন, পার্থিব, কিংবা দুরবিন এগুলো নিয়ে আমি আর নতুন করে কিছু ভাবি না। এমনকি পড়িও না।
‘মানবজমিন’ পড়ে আমি চমকে উঠেছিলামÑ এমনও হয়, হতে পারে? একজন মানুষ বাইরে থেকে যৌনকর্ম করে এসেছে কি না, শ্রীনাথের স্ত্রী তৃষা সূ²-গভীর-নিপুণ কৌশলে বিষয়টি বের করে আনেÑ প্রায় বিচ্ছিন্ন হয়ে যাওয়া সম্পর্কের পরেও...
শীর্ষেন্দু মুখোপাধ্যায় : (মৃদু হেসে) আমি আসলে ভুলে গেছি। মানবজমিন তো অনেককাল আগে লেখা। এখন তুমি যদি আমাকে পুনরাবৃত্তি করতে বলো, আমার কিছু মনে থাকবে না। অনেক চরিত্র, কী লিখেছি এখন বলা মুশকিল। তারপর অনেক উপন্যাস লিখেছি। ভুলে গেছি। সত্য নিশ্চয়ই কিছু ছিল সেই লেখায়।
আপনি একাডেমি পুরস্কার পান এই উপন্যাসের জন্যেই?
শীর্ষেন্দু মুখোপাধ্যায় : হ্যাঁ, ঠিক বলেছ। ১৯৮৯ সালে।
‘মানবজমিন’-এ দীপনাথের মধ্যে আপনার নিজের জীবনের ছায়া থেকে থাকবে হয়ত কিছুটা...
শীর্ষেন্দু মুখোপাধ্যায় : দীপনাথের মধ্যে আমার ছায়াÑ তা একটু থাকতে পারে। তবে সেটা খুব বেশি নয়।
আপনি বেশকিছু প্রেমের গল্প এবং উপন্যাসও লিখেছেন। ব্যক্তিগত জীবনে আপনার প্রেমের অভিজ্ঞতা কেমন?
শীর্ষেন্দু মুখোপাধ্যায় : (লাজুক হেসে) প্রেম-ট্রেম আমি একেবারে করিনি। ছেলেবেলা থেকেই আমাদের মেয়েদের প্রতি একটা শ্রদ্ধাবোধ ছিল। সসম্মানে দূরত্ব বজায় রেখেছি। জীবনে কখনো প্রেমপত্র লিখিনি। তবে হ্যাঁ, আমার বিয়েটা প্রেমভিত্তিক হয়েছিল। কারণ, যাঁকে আমি বিয়ে করেছি, তিনি আমার বাল্যকালের পরিচিত। তিনি আবার আমাকে খুঁজে বের করেন যৌবনকালে। তাঁর সঙ্গেই একটা সম্পর্ক হয় এবং বিয়ে হয়। এটাকেই তুমি বলতে পারো। আমার জীবনের প্রেম, সত্যিকারের প্রেম। তাঁর সঙ্গে আমার বিবাহিত জীবনের অনেক দিন হয়ে গেল।
আপনার ‘খগেন বাবু’ গল্পটি তো প্রেমেরই, এর আখ্যানটি আমাদের অন্যরকম উপলব্ধি এনে দেয়। আচ্ছা, বাস্তবে কি এমন হয়Ñ দ্বিতীয় স্বামীর হাত ধরে প্রথম স্বামীর পথের দিকে এভাবে নির্নিমেষ আকুল হয়ে চেয়ে থাকা...
শীর্ষেন্দু মুখোপাধ্যায় : বাস্তবে এমন হয় কি না, এটা বড় কথা নয়; প্রতিফলন আছে কি না, সেটা তুমি ভাবতে পারো। গল্প আরেকটা সত্যের কথা বলে। এ-রকম একটা সিচুয়েশনে এই জিনিসটা হয় কি নাÑ তার পূর্ব স্বামী, নতুন বউ, এসব কিছু মেয়েদের কাছে একটা কৌতূহলের বিষয়। এই গল্পে সেই কৌতূহলের বিষয়টিই প্রধান। সেসব রিস্ক উপেক্ষা করে তার আগের স্বামীর গমন পথের দিকে তাকিয়ে আছে। তার স্মৃতি কাজ করছে। নস্টালজিয়া কাজ করছে এবং তার পুরোনো প্রেম যেটুকু ছিল, সেটা হয়ত কাজ করছে। সেভাবে দেখো, তাহলে গল্পের সত্যতাকে বুঝতে পারবে। রিয়েলিটিকে গল্পে খুঁজতে হয় তিনটি প্রেজেন্টেশনের ভেতর দিয়েÑ রিয়েলিটিটা ঘটনাপ্রবাহের মধ্যে থাকে না, তার সিদ্ধান্তের মধ্যে থাকে।
একসময় আপনার বড্ড অভাব গেছে : চিনাবাদামের খোসা খেয়েছেন, লঙ্গরখানায় বসে গেছেন, বিয়ের পরপর আপনার গ্যাস্ট্রিক হয়ে গিয়েছিল, দীর্ঘপথ হেঁটে পড়াতে যেতেন। এসব আপনার লেখায়ও এসেছে, বাস্তব অভিজ্ঞতা থেকেই কি?
শীর্ষেন্দু মুখোপাধ্যায় : (দীর্ঘ হেসে) হ্যাঁ, এসেছে। তবে আমার জীবনে যেগুলো কাঁটা ছিল, সেগুলো ফুল হয়ে ফুটেছে। আমি জীবনে ঠাকুরকে পেয়েছিলাম বলে যে কষ্টগুলো করেছি, সেখান থেকে আমার ডিভিডেন্টও এসেছে। সেই কষ্টগুলো আমার জীবনকে একেবারে রিক্ত করে দেয়নি এবং পরবর্তীকালে সেই কষ্ট থেকে জীবনের অনেক বেশি আমি পেয়ে গেছি। অনেক সুফল পেয়েছি।
আপনি পাঠক হিসেবে এখনও কার লেখা মুগ্ধ হয়ে পড়েন?
শীর্ষেন্দু মুখোপাধ্যায় : এখন আর পড়ি কোথায়? পড়ার সময় পাই না। আগে একসময় সারাদিন বই মুখে করে বসে থাকতাম, দিন-রাত বই পড়তাম। এখন বই পড়ার সময় এত কমে গেছে, ঘরে বই কিনে রেখেছি কিন্তু পড়তে পারি না। অনেক বই জমে যাচ্ছে বাড়িতে, ওল্টানোরও সময় পাই না। এত বেশি অনুষ্ঠান থাকে, এক্সিটমেন্ট থাকে, এত লোক দেখা করতে আসেÑ পড়ার সময় আর হয়ে ওঠে না। পড়ি কম এখন। সত্যের সঙ্গে স্বীকার করতে হচ্ছে, পড়াটা কমে গেছে।
আপনার সাহিত্যের নিকুঞ্জে অবগাহন করলে পাঠকের কোন প্রত্যাশা পূরণ হতে পারে?
শীর্ষেন্দু মুখোপাধ্যায় : সেটা পাঠক জানে, আমার পক্ষে তো জানা সম্ভব নয়। কার কী প্রত্যাশা পূরণ হবে, কোনো প্রত্যাশাই পূরণ নাও হতে পারে। তবে এটা ঠিক, আমি অনেক কষ্ট করেছি, লেখার পেছনে আমার অগাধ পরিশ্রম আছে। কিন্তু তা থেকে পাঠকের কী লাভ হয়েছে, তা পাঠকই বলতে পারবে।
আপনি কি তরুণদের লেখা পড়েন? বাংলাদেশের কোনো তরুণ লেখক আপনাকে কখনও মুগ্ধ করেছে?
শীর্ষেন্দু মুখোপাধ্যায় : ওই যে বললাম, পড়াটা কমে গেছে। তবে মাঝেমধ্যে কোনো কোনো তরুণ লেখক হয়ত ফোন করে বলে, আমার লেখাটা পড়বেন, বা আমার এই লেখাটা একটু অ্যাপ্রিশিয়েট করবেন। সেক্ষেত্রে হয়ত লেখাটা আমি পড়ে ফেলি। আর বাংলাদেশের তরুণদের কবিতা আমাকে খুব মুগ্ধ করে। গল্প, উপন্যাসের চেয়েও কবিতা যেহেতু ছোট, পেলেই পড়ি। আমি এখানকার অনেক তরুণের কবিতা পড়ে মুগ্ধ হয়েছি। এখানকার পত্রপত্রিকা আমার কাছে খুব একটা যায় না, ফলে এখন খুব কম পড়া হয়।
‘দেশ’ পত্রিকায় প্রথম গল্প লিখে আপনি সম্মানী পেয়েছিলেন ২০ টাকা। এখন সেটা কত?
শীর্ষেন্দু মুখোপাধ্যায় : হ্যাঁ, ২০ টাকা পেয়েছিলাম। এখন পুজো সংখ্যায় লিখলে পাঁচ হাজার এবং সাধারণ সংখ্যায় লিখলে তিন হাজার টাকা দেয়।
ওখানে বাংলাদেশি তরুণ লেখকদের লেখা কি আপনারা পান এবং প্রকাশের জন্য বিবেচনা করেন?
শীর্ষেন্দু মুখোপাধ্যায় : দেশ পত্রিকায়? যায় নিশ্চয়ই। কিন্তু গল্প দেখেন যাঁরা, তাঁরা তো আলাদা। তাঁদের সঙ্গে আমাদের কোনো পরিচয় নেই। সেখানে প্যানেল তৈরি হয়েছে, তাতে গল্প বিচার হয় আজকাল। কারা দেখেন, কী বিচার করেন, তার নাগাল পাওয়া যায় না।
লেখকের সরাসরি রাজনৈতিক দৃষ্টিভঙ্গি এবং অবস্থান তাঁর লেখায় যদি প্রতিফলিত হয়, তাহলে সার্বিকভাবে মানুষ ও সমাজকে দেখার ক্ষেত্রে কোনো ব্যত্যয় ঘটতে পারে?
শীর্ষেন্দু মুখোপাধ্যায় : নিশ্চয়ই ব্যত্যয় ঘটতে পারে এবং এটি বিপজ্জনক। রাজনৈতিক চশমাটি পরে নিলেই তো মুশকিল। তখন সে আর সমাজকে নিরপেক্ষ দৃষ্টিতে দেখতে পারবে না। ফলে ভেতর থেকে লেখা এবং প্রতিফলন লেখায় থাকা বিপজ্জনক।
আপনি বর্তমানে কী লিখছেন?
শীর্ষেন্দু মুখোপাধ্যায় : এখন তো লেখায় ফাঁকি দিচ্ছি। লিখছি না। গ্যাপ যাচ্ছে। ছোটখাটো ফরমায়েশি লেখা হচ্ছে কিছু।
সামনে কী লিখবেন বলে পরিকল্পনা করছেন?
শীর্ষেন্দু মুখোপাধ্যায় : পরিকল্পনা করে আমি লিখি না। যখন লেখার তাগাদা আসে, লেখাটা না দিলেই নয়, সেই সময় লিখতে বসি। তখন, তাৎক্ষণিক মানসিকতা নিয়ে লিখতে শুরু করি। এভাবে বরাবরই লিখে এসেছি। পরিকল্পনা করে কোনোদিন লিখিনি।
অত্যন্ত ব্যস্ততার মাঝেও দীর্ঘ সময় দিলেন, আপনাকে অসংখ্য ধন্যবাদ। ভালো থাকুন!
শীর্ষেন্দু মুখোপাধ্যায় : তোমাকেও অনেক ধন্যবাদ, আমার ভালোবাসা এবং শুভেচ্ছা রইল। তোমার পত্রিকা, গল্পপত্র আরও ভালো হোক, ভালোই হয়েছে। আরও ভালো হোক এই প্রার্থনা করি।