শুটিং এন এলিফ্যান্ট

শুটিং এন এলিফ্যান্ট
মূল: জর্জ অরওয়েল
বাংলাকরণ: মাহির তাজওয়ার

দক্ষিণ বার্মার মৌলমিতে আমি অধিকাংশ মানুষের কাছে ঘৃণার পাত্র হয়েছিলাম। সেই সময়ে আমার জীবনে খুব গুরুত্বপূর্ণ ঘটনা ঘটেছিল। আমি সেই শহরের সাব ডিভিশনাল পুলিশ অফিসার ছিলাম, ইউরোপিয়ান বিরোধী কিছু অনর্থক কর্মকান্ড আমাকে তিক্ত করে তুলেছিল। কেউ দাঙ্গা হাঙ্গামা করার সাহস পেত না কিন্তু যদি একজন ইউরোপিয়ান মহিলা একা একা বাজারে যায় তবে কেউ না কেউ তার জামায় পানের পিক ছোড়ে। একজন পুলিশ অফিসার হিসেবে যতটুকু সম্ভব আমি সুস্পষ্ট দায়িত্ব পালন করেছি তার শৃংখলা বজায় রাখতে। যখন কোনো চতুর বার্মিজ আমাকে ফুটবল মাঠে ল্যাং মারে তখন রেফারি অন্য দিকে তাকিয়ে থাকে আর উৎসুক জনতা হাসিতে ফেটে পড়ে। আরও কয়েকবার এরকম ঘটনা আমার সাথে ঘটেছে। যখন আমি নিরাপদ দুরুত্বে চলে যায় তখন এক হলদে বর্ণের লোক চেচামেচি করে তা দেখে আমি চরমভাবে অপমানিত বোধ করি। তাদের মধ্যে তরুণ বৌদ্ধ ভিক্ষুরা ছিল সব চাইতে খারাপ। তাদের মধ্যে কয়েক হাজার বৌদ্ধ ভিক্ষু ছিল যাদের কাজ রাস্তার মোড়ে মোড়ে দাড়িয়ে ইউরোপিয়ান বিদ্রুপ করা ছাড়া আর অন্য কোনো কিছু ছিল না।

পুরো বিষয়টা ছিল খুবই বিব্রতকর এবং দুঃখজনক। সেই সময়ে আমি মন স্থির করলাম, সাম্রাজ্যবাদের মতো খারাপ আর কিছু হয়না এবং ভাবলাম খুব শিঘ্রই আমি চাকরি ছেড়ে দিয়ে চলে যাবো। বলতে গেলে আমি গোপনে গোপনে সব বার্মিজদের পক্ষে ছিলাম আর ব্রিটিশ অত্যাচারিদের বিরু্দ্ধে ছিলাম। চাকরি করতে হয় তাই করছিলাম। আমার এই চাকরিটা এতটাই খারাপ লাগতো যা বলে বোঝাতে পারবো না। এই চাকরিতে কোয়ার্টরের কাছেই সম্রাটদের নোংড়া কাজকর্ম, দুর্দাশাগ্রস্ত কারাবন্দীদের লক আপে গাদাগাদি করে রাখা, অনেকদিন আটকে থাকা মলিন চেহারার অপরাধী, তাদেরকে বেতের আঘাতে ক্ষত বিক্ষত করে দেওয়ার দৃষ্য আপনি প্রতিনিয়ত দেখতে পাবেন। এই ধরনের অত্যচারগুলো দেখে নিজেকে খুব অপরাধী মনে হচ্ছিল। কিন্তু আমার কিছুই করার ছিল না। আমি অল্প শিক্ষিতি যুবক ইংরেজরা আমাকে যা করতে দেয় আমাকে নিরবে তা মেনেও নিতে হয়। এমন কী আমি নিজেও জানতাম না যে ব্রিটিশ রাজ্যের পতন ঘনিয়ে আসছে। আমি শুধু এইটুকু জানতাম কেউ কিছুর ঘটানোর আগে বা কেউ পদচ্যুত হওয়ার আগেই আমার দায়িত্ব আমাকে পালন করতে হবে। আমি শুধু এইটুকু জানতাম ব্রিটিশ রাজ বিদ্রোহ ও আমার কিছু শত্রু আছে যারা আমার কাজটাকে আরও কঠিন করে তুলেছে এবং এই দুই জায়গাতেই আমি আটকে আছি। মাঝে মাঝে মনে হয় এই ব্রিটিশ রাজ্যটার কেউ বিভাজন করতে পারবে না যা আমার কাছে এক স্থানে বন্দী থাকার মতো লাগতো। আরেক জায়গায় মনে হতো বৌদ্ধ ভিক্ষুদের শুল দৃষ্টির উপর বেনোয়াট দিয়ে আঘাত করতে পারলে সবচেয়ে বেশি আনন্দ পেতাম। হয়তো সাম্রাজ্যবাদের ধরণটা হলো এরকম কোন এংলো ইন্ডিয়ান কর্মকর্তাকে যদি অবসরে ধরতে পারো তাদের কে খুচিয়ে খুচিয়ে জানার চেষ্টা কর তাদের এ ব্যাপারে কি মত?

একদিন খুব চমৎকার একটা ঘটনা ঘটে গেল। ঘটনার দিক দিয়ে এটি ছিল তুচ্ছ কিন্তু সাম্রাজ্যবাদ নিয়ে এটি দারুন বড় একটা ধারনা পেলাম। বাজারে নাকি একটি হাতি তুলকালাম করে ফেলেছে জানিয়ে পুলিশ স্টেশনের সাব ইন্সপেক্টর খুব সকালে আমাকে ফোন করে জানালো এবং বিষয়টা আমাকে দেখতে বলল- আমি কিছু করতে পারি কিনা? যদিও আমি নিজেই জানতাম না কি করতে হবে কিন্তু ঘটনাটা আমার সামনে থেকে দেখার খুব ইচ্ছে ছিল। আমি আমার পুরানো ক্ষুদ্র রাইফেলটি ৪৪ উইনস্টার হাতে নিলাম যা একটি হাতিকে হত্যা করার জন্য যথেষ্ট ছিল না কিন্তু এর শব্দ হাতিটিকে ভয় লাগানোর জন্য যথেষ্ট ছিল। অনেক বার্মিজ আমাকে রাস্তায় আটকিয়ে হাতির ধ্বংশাত্মক কর্মকান্ডর ব্যাপারে রাস্তায় দাড় করিয়ে বলতে লাগলো। এটা অবশ্যয় বন্য হাতি নয় এটা একটা পোষা হাতি হয়তো কারও হাত থেকে ছুটে গেছে। এটি সচারাচার শিকল দিয়ে বাধা থাকে আর কোন কারণ ছাড়া পোষাহাতি আক্রমন করে না। হাতিটি আগের রাতে শিকল ছিড়ে পালিয়েছিল। এটির মাহুত অর্থ্যাত যিনি হাতিটিকে পুষতেন তিনি হয়তো এটিকে নিয়ন্ত্রণ করতে পারতেন কিন্তু কোন কারণে ভ্রমনে গিয়ে হয়তো রাস্তা ভুল করে ফেলেছে। বারো ঘন্টা হতে চলেছে হাতিটি এখানে রয়েছে। বার্মিজ লোকজনের কোন অস্ত্র ছিল না ফলে কেউ তাকে থামানোর সাহস করেনি। হাতিটি এরই মধ্যে বাঁশ দিয়ে তৈরি কিছু বাড়ি ঘর পিষে ভেঙ্গে দিয়েছে, গরু মেরেছে, ফলের দোকান পিষে দিয়েছে আর ফলমুল গুলো সাবাড় করে দিয়েছে এবং রাস্তার ময়লার গাড়িটাকে দুমড়ে মুছড়ে দিয়েছে।

যেখানে হাতি দেখা গিয়েছিল সেখানে বার্মিজ সাব ইন্সপেক্টর এবং কয়েকজন কনেস্টেবল আমার জন্য কোয়ার্টারে অপেক্ষা করছিল। কোয়ার্টারটি ছিল বাশ দিয়ে তৈরি, তাল পাতার ছাওনি। পাহাড়ের চারপাশ থেকে বাতাশ বয়ে চলছিল। আমার স্পস্ট মনে আছে সেই সকালটা গুমোট মেঘলা ছিল। আমরা লোকজনকে হাতিটির ব্যপারে জিজ্ঞেস করলাম। কিন্তু কেউ সঠিক উত্তর দিতে পারেনি। দুর ঘটনার অনেক কিছুই সঠিক বলে মনে হয় কিন্তু যতই ঘটনার কাছে যাওয়া হয় ততই ঘটনা স্পষ্ট হতে থাকে এবং সত্য বেরিয়ে আসতে থাকে।  একেকজন হাতিটির একেকটি দিক নির্দেশনা দিতে থাকে। কেউ বলে এদিকে, কেউ বলে ওদিকে কেউ বলে হাতির নাম গন্ধও শোনেনি বা দেখেনি। যখনই আমি পুরো ঘটনাকে মিথ্যা বলে ধরে নিতে যাচ্ছিলাম তখনই একটু দুরেই চিৎকার চেচামির আওয়াজ শুনতে পেলাম। কিছু মহিলা জোরে জোরে চিৎকার করছে। মনে ধারণা হলো ওখানে নিশ্চয় কিছু একটা ঘটেছে। কুটিরের পেছনে দেখা গেল একটা মৃত দেহ কাদায় পড়ে আছে মুখ থুবড়ে। সে ইন্ডিয়ান কৃষ্ণাঙ্গ দ্রাবিড় জাতির কুলি। বর্ষাকাল, কাদা মাটি। দেখা গেল মৃত লোকটির মুখ এক ফুট মাটির গভিরে ঢুকে গেছে। মুখ ভর্তি কাদা, দাত বেরিয়ে আছে। দেখে মনেই হচ্ছিল অনেক যন্ত্রণা পেয়ে মরেছে। ( বলবেন না যে তাকে মৃত অবস্থায় অনেক শান্ত দেখাচ্ছিল আমি আমার জীবনে অনেক ডেড বডি দেখেছি। ) তার পায়ের থাবাটা নিষ্ঠুর ভাবে তার পিঠের উপর বসিয়েছে যেন একটা খরগোশের বাচ্চা। হুট করে বন্ধুকে বললাম, তার বাসা থেকে হাতি মারার রাইফেল টা নিয়ে আসতে এবং ছোট রাইফেল টা পাঠিয়ে দিলাম। ভয় নিয়ে হাতির সাথে লড়তে যাওয়া বোকামী।

পাচটি কার্তুজের গুলি সহ কয়েক মিনিটের মধ্যে আর্দালি একটি রাইফেল নিয়ে এল। বার্মিজরা তখন জানালো একশ গজ দুরে নিচের ধান ক্ষেতে হাতিটি আছে। আমি যাওয়া শুরু  করলে আমার পিছে পিছে উৎসুক জনতাও চলতে লাগলো। আমি যখন গুলি করার প্রস্তুতি নিচ্ছিলাম তখন তারা প্রবল উৎসাহে চিৎকার চেচামেচি করছে। হাতির ঘরবাড়ি ভাঙ্গা নিয়ে তাদের কোন মাথা ব্যথা ছিল না তাদের কাছে এই ঘটনায় এখন সবচেয়ে আনন্দের। সবচেয়ে মজার বিষয় এই যে সবাই এখন হাতিটির মাংস নিতে চাইছে। বিষয়টি আমার কাছে খুবই বিব্রতকর লাগল। হাতিটিকে হত্যার কোন উদ্দেশ্যই আমার ছিল না। আমি শুধু নিজেকে রক্ষা করার জন্যই রাইফেল হাতে নিয়েছিলাম। আর একদল লোক অনুসরণ করার ব্যপারটিও আমাকে অসস্তিতে ফেলেছিল। আমি পাহার বেয়ে নিচে নামলাম। তাকিয়ে দেখলাম। নিজেকে তখন খুব বোকা বলে মনে হচ্ছিল আমাকে। আমার কাধে রাইফেল, আর সৈনিকের মত উৎসুক জনতা আমার পিছে পিছে ব্যপার টি আামার কাছে খুবই খাপছাড়া লাগছিল। পাহাড় থেকে পাকা রাস্তা নিচের দিকে নেমে গেছে, তারপর এক হাজার গজের ধানক্ষেত দেখা যায়। সেখানে অনাবাদী কিন্তু প্রথম বৃষ্টির কারণে কর্কশ ঘাসে রুক্ষ ছিল জমিটা। হাতের বাম দিকে হাতিটা আশি গজ দুরেই দাড়িয়ে ছিল। হাতিটা লোকজনের ভিড় খেয়াল করেনি। ঘাস ছিড়ছে, পা দিয়ে থেতলাচ্ছে আর তা মুখে নিচ্ছে।

আমি থামলাম। হাতিটিকে দেখা মাত্রই গুলি না করাটাই বুদ্ধিমানের কাজ। একটি নিরীহ হাতিকে হত্যা করা বুদ্ধিমানের কাজ নয়। এরকম একটা নিরীহ প্রানী হত্যা করা মানে সচল কোন যন্ত্র বা মেশিনকে ধ্বংস করে ফেলা। অতএব হত্যা এড়িয়ে যাওয়াই উত্তম। হাতিটা যখন মুখে ঘাস পুরছিল তাকে একটা নিরীহ গরুর মতন দেখাচ্ছিল। উন্মত্ততার ভাব নেই হাতিটির মধ্যে। ভাবলাম মাহুত না আসা পর্যন্ত হাতিটি এরকমই হয় তো থাকবে। আমি মোটেও প্রাণীটিকে গুলি করতে আগ্রহী ছিলাম না। ভাবছিলাম এখানে দাড়িয়ে থেকে নিশ্চিত হবো এ আর ধ্বংসাত্মক কোন কর্মকান্ড করবে না তারপর বাড়ি ফিরব।

আমার চারপাশে তখন প্রচুর মানুষের ভীড়। কম করেও হাজার দুই তো হবেই এবং প্রতি মিনিটে তা আরও বেড়ে যাচ্ছে ক্রমাগত। রাস্তা পুরো ভরে গেল মানুষে। তাকিয়ে দেখলাম চটকদার হলদেটে মুখগুলো। সবাই আনন্দ হই হুল্লোড় করছে। হাতিটিকে হত্যা করা হবে। সবাই মন্ত্রমুগ্ধের মত তাকিয়ে যেন জাদু দেখছে। যদিও ওরা আমাকে মোটেও পছন্দ করে না তবুও আমার হাতে রাইফেল দেখে ওদের কাছে আমি এখন বেশ গুরুত্বপূর্ণ কেউ। হঠাত খেয়াল হল হাতিটিকে হত্যা করা ছাড়া আমার আর কোন উপায় নেই। সবাই তাই আশা করছে এবং আমাকে তা করতেও হবে। মনে হল দুহাজার লোকই আমাকে এ কাজে বাধ্য করছে। তখন আমি শেতাঙ্গদের ব্যর্থতা এবং অসারতার কথা অনুভব করে রাইফেল তাক করলাম। এই আমি সাদা চামড়ার অস্ত্রধারী একজন মানুষ যেন ফিল্মের নতুন হিরো দাড়িয়ে আছি কোন মিশন নিয়ে আর বার্মিজরা আমাকে ক্রমাগত সামনে ঠেলে দিচ্ছে। ঠিক তখনই অনুভব করলাম একজন শেতাঙ্গ কেমন করে অত্যাচারী হয়ে ওঠে এবং কেমন করে তার স্বাধীনতাকে নষ্ট করে। আর তখন তার বোবা অভিনেতার ভুমিকা পালন করা ছাড়া কিছুই করার থাকে না। এটাই আইন, স্বদেশী স্বার্থ রক্ষায় তার নিজের জীবন উৎসর্গ করে দেবে। স্বদেশী স্বার্থ রক্ষায় যা কিছু করার সব কিছু করবে। এই সাহেবকুল মুখের মাপমত একটা মুখোস পরিধান করে।  আমাকে হাতিটিাকে গুলি করতে হয়েছিল। রাইফেল কাঁধে হাজার মানুষকে সাথে নিয়ে আমি কিছুই করলাম না দেখে মানুষ আমাকে নিয়ে হাসাহাসি করবে আর পুরোটা জীবন আমাকে তা সহ্য করতে হবে। না তা হতে পারে না।

আমি কিন্তু হাতিটিকে গুলি করতে চাইনি। আমি দেখছিলাম তার সুন্দর আচরণ। কেমন করে ঘাসগুলোকে হাটুতে ফেলে ঝাড়ছিল। একে গুলি করা এখন হত্যা হিসেবে গণনা করা হবে। পশু শিকারের বিষয়ে আমি পিছিয়ে থাকার মানুষ নই। আমি কখনো হাতি মারিনি। কখনো মারতেও চাইনি। কোন ভাবেই একে হত্যা করা ঠিক হবে না। অন্যদিকে পশুর মালিকের কথাও আমাকে ভাবতে হচ্ছে। একটা জীবিত হাতির কম করে হলেও একশো পাউন্ড মুল্য। মৃত এই প্রানীটির দাম বড়জোর পাচ পাউন্ড হবে। আমাকে একটা দ্রুত সিদ্ধান্তে আসতে হবে। আমি স্থানীয় বার্মিজদের জিজ্ঞেস করলাম হাতিটি কেমন আচরণ? সবাই একই কথা বলল, যদি তাকে যেতে  দেন তাহলে সে কিছুই করবে না, কিন্তু তার কাছে গেলে হয়তো আক্রমন করতে পারে।

আমি জানি আমার কি করা উচিৎ। আমি পঁচিশ গজ সামনে গেলাম হাতিটির যদি সে তেড়ে আসে আমি গুলি করে দিব। যদি আমার দিকে তেড়ে না আসে তাহলে তাকে এভাবেই রেখে দিব এটির মাহুত না অব্দি। আমি রাইফেল চালানোর ব্যাপারে অতটা দক্ষ ছিলাম না। আমার সামনে কাদায় পা তলিয়ে যাচ্ছিল, হাতিটটি আক্রমন করলে আমার গুলি লক্ষ্যভ্রষ্ট হতে পারতো। তখন আমার অবস্থা স্টিম রোলারের নিচে চাপা পড়া ব্যাঙের মতো হতো হয়তো। কিন্তু তখন পর্যন্ত আমি কিছুই করিনি। চারিদিকে শুধু মানুষ দেখেছি। মানুষের ভিড় দেখেছি। মানুষের ভিড় দেখে আমি ভয় পাইনি। আমি এমনিতেও মোটেই ভিতু নই। শুধু ভাবছিলাম হলুদ মুখো বার্মিজদের কথা। এদের সামনে সাদা চামড়ার সাহেবরা কখনো ভয় পেতে পারে না। আমিও পাইনি। ভাবছিলাম যদি হাতিটা আমাকে আক্রমন করে, আমাকে পায়ে পিষে মারে তাহলে উপস্থিত বার্মিজরা দুঃখ না করে আমাকে নিয়ে হাসাহাসি করবে। মজা পেয়ে হাসবে।

আমি বন্দুকে গুলি ভরলাম। ভাল নিশানা পেতে রাস্তার উপরেই শুয়ে পড়লাম। ভীড় বাড়ছে অথচ সবাই পিনপতন নিরবতা পালন করছে। সবাই উদগ্রীব হয়ে তাকিয়ে আছে। জার্মানীর তৈরি রাইফেল বেশ ভাল কিন্তু দৃষ্টি ফেলার স্থানটি একটু বাকা। আমি হাতিটির কান বরাবর নিশানা করলাম। হাতির মাথাটাকে লক্ষ করে আমি তার কানের একটু উপরে রাইফেল তাক করলাম।

ট্রিগারে চাপ দিতেই কোন বিকট আওয়াজ আমার কানে আসেনি। কানে যা এসেছিল তা হল উৎসুক জনতার অমানবিক উল্লাস। গুলি করতেই আশ্চর্য ব্যপার চোখে পড়ল হাতিটি একটুও নড়ল না, বসেও পড়ল না, পড়েও গেল না। শুধু তার শরীরের পরিবর্তন ঘটল। তাকে তখন ভিতু সঙ্কুচিত বলে মনে হল। গুলির ভয়ে প্রাণীটি অসার। পাচ সেকেন্ড পরেই সে হাটু গেড়ে বসে পড়ল। তার মুখ দিয়ে লালা পড়তে লাগলো। বিশাল এক অসারতা ক্রমেই যেন তাকে ঘিরে ফেলল। তাকে তখন মনে হচ্ছিল হাজার বছরের পুরোনো বৃদ্ধ একটা হাতি। একই লক্ষ্যে আমি আবার গুলি ছুড়লাম। সে কুকড়ে যাওয়ার বদলে আস্তে আস্তে আবার উঠে দাড়ালো। মাথাটা নিচের দিকে ছিলো। পা গুলো কাঁপছিল। তীব্র যন্ত্রণা তাকে কুকড়ে দিয়ে তার দাড়াবার শক্তিটুকু কেড়ে নিল। মাটিতে পড়ে যাওয়ার আগে আরেকবার দাড়ানোর চেষ্টা করে ব্যর্থ হল। তার পাগুলো ক্রমেই টলে টলে যাচ্ছিল মনে হচ্ছিল একটি পাহাড় যেন ধ্বসে পড়ছে আর শুঁড়টা পাহাড়ের মত আকাশ মুখি হয়ে বৃক্ষের মত পড়ে গেল। প্রাণীটা শেষ বারের মত একবার হুংকার ছাড়লো। সেটাই ছিল শেষ ডাক। পেটটা আমার দিকে তাক করে তার পতন ঘটল। পড়ে যাওয়ার সময় মাটি এমন ভাবে কাঁপলো আমার শুয়ে থাকার জায়গা সহ কেঁপে উঠলো।

আমি উঠে দাড়ালাম। মানুষজন কাদামাটি মাড়িয়ে আমার দিকে ছুটে আসতে লাগলো। তখনও টের পেলাম হাতিটি এখনও মরেনি। শ্বাস নিচ্ছিল তখনও। মুখটা হা হয়ে ছিল। আমি কিছুক্ষণ অপেক্ষা করছিলাম তার মরার জন্য কিন্তু তখনও সে শ্বাস নিচ্ছিল। আমি হাতিটার বুক তাক করে আরও দুটো শুট করলাম পর পর। রক্ত বেরিয়ে আসতে লাগলো কিন্তু মরেনি। গুলিতে তার দেহ একটুও নড়ল না। আস্তে আস্তে তার প্রাণ বেরিয়ে যাচ্ছে। সে সেই জগতে পাড়ি দিচ্ছিল যে জগতে কোন বুলেটই তাকে কোন ক্ষতি করতে পাবেনা। আমি ভাবলাম এমন কষ্টদায়ক আর্তনাদ হাতিটির থামিয়ে দেওয়া উচিত। যেন সে মরতেও পারছিল না বাচতেও পারছিল না। আমি ছোট রাইফেল টা এনে হাতিটির গলা এবং বুক বরাবর আরও বেশ কয়েকটা গুলি ছুড়তে লাগলাম। কিন্তু হাতিটটির কোন প্রতিক্রিয়া নড়াচড়া দেখতে পারলাম না। তখনও হয়তো ঘড়ির কাটার মত টিক টিক শব্দে তার শ্বাস ক্রিয়া চলছিল।

পরে আমার সেখানে বেশিক্ষণ দাড়িয়ে থাকতে পারিনি। পরে শুনেছিলাম হাতিটি নাকি মরতে আরও আধাঘন্টার উপরে সময় নিয়েছিল। আমি সে স্থান থেকে সরে যেতে না যেতেই বার্মিজরা দা ঝুড়ি বাটি এনে তার হাড্ডি ছাড়া কিছুই রাখেনি শরীরে।

তারপর হাতিটিকে গুলি করা নিয়ে অনেক ধরনের কথা বার্তা হয়েছে। হাতিটির মালিক খুবই রাগন্বিত হয়েছিল। কিন্তু সে ভারতিয় হওয়ায় কিছুই করতে পারেনি। আমি অবশ্য আইনগত ভাবে ঠিক কাজটিই করেছি, পাগলা হাতিকে ক্ষ্যাপা কুকুরের মতন হত্যা করা হোক এটা সবার চাওয়া। ইউরোপিয়ানদের মধ্যেও এটা নিয়ে মতো বিরোধ দেখা গেল। বয়স্করা বলল আমি ঠিক কাজ করেছি, আর নবীনরা বলল একটা কুলিকে হত্যার জন্য এত বড় পশু হত্যা অন্যায়। অনেক জঘন্য কাজ এত বড় পশু হত্যা করা। তাদের হিসেবে একটি কর্ণাটি কুলির চাইতে এই হাতিটি অনেক বেশি মুল্যবান। আমি খুশি কারণ কুলিটাকে হাতিটি হত্যা করেছিল দেখে আমি হাতিটিকে হত্যা করার বৈধ কারণ দেখাতে পেরেছিলাম। এটা ভেবে মাঝে মাঝে আমি অবাক হই যে আমি অন্যদের কাছ থেকে অপদার্থ অপবাদ থেকে রক্ষা পেতে নিজেই হাতিটিকে গুলি করেছিলাম তাকি কেউ আসলেই বুঝতে পেরেছিল কিনা কে জানে!

চলতি সংখ্যা