আঠারো শিশি চিংড়ি
আঠারো শিশি চিংড়ি

আঠারো শিশি চিংড়ি

ওকে মনে পড়লে কিংবা মনে করার চেষ্টা করলে কুয়াশার মতন মুখটাকে ঘিরে থাকে ধূসর চিংড়ি। সেসব চিংড়ি বরাবর একটানা হেঁটে গেলে মুখোমুখি দাঁড়ায় পুরনো কালো পাথরের ফেরেশতা, ফাটলে তার কবেকার পশলা বৃষ্টি, সেখানে একটা লাল গামছা; গামছায় ঢেকে থাকা অর্ধেকটা মুখ। ঢেকে থাকা অর্ধেক মুখ থেকে উপচে পড়ছে অগুন্তি চিংড়ির লাল আর আকাশ আষাঢ়ের প্রথম বৃষ্টি হয়ে ছড়িয়ে দিচ্ছে ঠান্ডা ছোঁয়া। বৃষ্টিকে তখন হাসপাতালের সিস্টার মনে হয়। কাছে এলেই কেমন অসুখ কমে যায় মনের পাশটায়। 

অথচ যখন বাজার থেকে আনা রান্না করা কিংবা কাঁচা চিংড়ি গুছাই, আজ সকালেও যেমন গুছিয়েছি, তাকে আমার মনে পড়ে না। আমার বরং মনে আসবে তাতানের বাবা, তাতানটা চিংড়ি খেতে ভালোবাসে। চিংড়ি আমার বরফ গলির রোদ দিদিমণি; ‘কিচ্ছুটি মুখে তুলব না’ দিনেও ঠিক রুচির যোগান দেবে। আমার বরং মনে পড়ে তাতানের বাবার সাজানো আক্ষেপ থেকে টুপ করে ঝড়ে পড়া কথা ‘জামাই আদর নেই কপালে। চিংড়ির মালাইকারিও জুটলো না।’ ঝগড়ার সময় আক্ষেপটাই হয়ে যাবে তলোয়ার- ‘রান্নাটাও তো পারো না।‌ কি করেছো আমার জন্য, আমার পরিবারের জন্য?’ কাঠগড়ায় দাঁড়ানো প্রশ্ন বরাবরই শোনার থেকেও বেশি কিছু দাবী করে‌। ওর পরিবার বলতে তখন ওর বাবা, মা, ভাই, বোন, ও বাড়ির ময়না, চার রকম বেড়াল।  তখন ওর পরিবারে তাতানের জন্য আমার খেটে যাওয়া নেই, নিজের একেকটা স্বপ্নকে চুপসে দেয়া নেই। দিন শেষে আছে কিছু ফাঁস লাগানো কথার সংসার, একটা না-পাওয়া বাটি আর ফেসবুকে ঝুলতে থাকা ওর বন্ধুর বউদের রান্নার ছবি- চিংড়ির মালাইকারি, আম চিংড়ি, লাউ চিংড়ি, ভাপা চিংড়ি, কোলাপুরি চিংড়ি, চিংড়ি বিরিয়ানি।

ছোটবেলায় একবার ‌রোশনি মাসি আমাকে নিয়ে‌ মাছ ধরতে গিয়েছিল। মাসির পেটে তখন আলুর মতন শিশু, বরের মারের থেকে বাঁচতে পালিয়ে এসেছিল আমাদের বাড়িতে। ছোট লোটায় চিংড়ি আর আমাকে কোলে নিয়ে বাড়ি ফেরার পথে, কারা যেন ঝাপটে ধরলো। আসলে পালিয়ে কত দূর যেতে পারে মানুষ? পাশের বাড়িতে লুকিয়ে ছিল ওর বর, বরের বন্ধুরা। মাসিকে দু হাতে টেনে, মাটিতে হেঁচড়ে নিয়ে গিয়েছিল মানুষগুলো। ওর‌ শরীরের নিচে চ্যাপ্টা হয়ে, ওর লম্বা চুলে গেঁথে ছিল কত চিংড়ি। বাতাসে ছিল চিৎকার ‘আমারে ছাইড়া দাও, আমি হেঁটে যামু, ছাইড়া দাও।’ না, হেঁটে যেতে ও পারেনি। ছোট্ট আমি তখন কী নির্বিকার, কাঁদা জলে চিংড়ি নিয়ে খেলছি, মুখে নিচ্ছি কাঁচা চিংড়ির স্বাদ! নাহ, কাঁচা চিংড়ি গোছানোর সময় রোশনি মাসিকে মনে পড়ে না আমার। 

মাসির মতন আমার কোথাও পালাতেও ইচ্ছে করে‌ না। আমি বরং আঠারো বার রেসিপি চোখে চর্চা করে, কানে গুলিয়ে একদিন রান্না করে ফেলি চিংড়ির মালাইকারি। ‘আহা, অপূর্ব বউ’- আপেলের মতন টুপ করে ঝড়ে পড়ে তাতানের বাবার প্রশংসা। সেদিনও একবারের জন্যও স্মৃতিকাতর চামচে ওঠে আসে না লাল গামছায় ঢেকে থাকা মুখটা। আমি তখন ভেঙে যাচ্ছি তাতানের গন্ধ চুরির গল্পে। এক গরীব ভালো মানুষ বাড়ির পাশের ময়রার দোকানের গন্ধ ভালবাসতো। প্রতিবেশী গন্ধেই যেন ওর নিজের শুকনো রুটিটা হয়ে উঠতো সুস্বাদু। একদিন কিপটে ময়রা এসে বলে ‘প্রতিদিন তুমি  আমার দোকানের গন্ধ নাও বিনে পয়সায়। এখন থেকে গন্ধের দাম দিতে হবে।’ গন্ধের জন্য দাম দিতে হয় কে কবে শুনেছে। নাছোড় বান্দা ময়রা শেষমেষ গেল হাকিমের কাছে। হাকিম রায় দিলেন ‘চুরি করা অপরাধ, সুতরাং শাস্তি তোমাকে পেতেই হবে, বের করো মোহর।’ বেচারা ভালো মানুষ শেষ সম্বল দুটো মোহর বের করতেই হাকিম হাতে নিয়ে বাজাতে বললেন। তাতান তখন গল্প পেরিয়ে মুখে চিংড়ি নিয়ে ছুটছে ওর ঘরে, আবার ফিরে আসছে গল্পে। এক ঝাঁক পয়সা ওর ছোট্ট হাতের ভেতর হয়ে গেছে ঝুমঝুমি। এইবার আমাদের দিকে ছুঁড়ে দেবে যাদু হাসি- এই নাও ঘ্রাণের দাম‌ এক মুঠো শব্দ- ঝুমঝুম ঝুমঝুম ঝুমঝুম… 

শৈশবও বুঝি এক খেলনা ঝুমঝুমি অথবা এক দিঘল হুহু। সেদিন নিলয়ের সাথে কথা হলো। হঠাৎ বৃষ্টি হলে, ঝড় নামলে আমাদের যেমন কথা হয়ে যায়। ও শোনায়- ছোট্টবেলার গল্প, বড়বেলার বিষন্নতা, হুহু বৃষ্টি, মেঘালয়ের গল্প। ও ফিরতে চায় তুমুল বর্ষায় শৈশবের নদীর ঘাটে, আধ-ডুবা‌ পাথরে পাথরে হেঁটে বাড়ি ফেরার পথে। এই যে ঢেউ, বৃষ্টি, বর্ষা- এসব তো আমাদের জীবন থেকে আদৌ হারায় না। তবু যেন মনে হয় কি যেন নেই। হয়ত সেই ঝুমঝুমিটা আর নেই। ছোটবেলার একটা সিঁড়ি থাকে, যেখানে একটা ভ্রমণ থাকে। আমরা উঠি, নামি। একটা সময় আমাদের অতীত হয়়ে যায় বারান্দা, সেখানে কেবল থেকে যায় পায়চারি। 

সেই পায়চারিতে অস্বস্তিকর চিংড়িওয়ালাকে মনে না পড়াটাই হয়ত স্বাভাবিক। বরং চানাচুরওয়ালা আকবর ভাই একটা ট্রেন হয়ে মনে পড়ার দেশে নিয়ে যায় আমাকে। আমার ভেতর বাজতে থাকে লংকা-তেলে চানাচুর মাখার শব্দ ঝুপুট ঝুপুট। তবু ভীষণ একলা হয়ে শৈশবের খোঁজ করলে ট্রেন বাস ছাপিয়ে একটা তলা থেকে উইপোকা হয়ে বেরিয়ে আসে লাল গামছায় ঢাকা মুখটা। চিংড়ি ছাড়া অন্য মাছ বিক্রি করতে দেখেনি কোনদিন তাকে। তখন ভাবতাম চিংড়িরা ওর জালের গন্ধ চিনে। ও আসতো মহল্লার বাবারা রোদের ম্যাপে পায়ের ছাপ ফেলে অফিসে চলে যাওয়ার পরে। ও এলেই আমাদের কলোনিতে ওর আসার অপেক্ষা টের পেতাম। প্রতিটা বারান্দায় দাঁতে লাল গামছার একপাশটা চেপে দাঁড়াত তার ডাক- ‘চাচী ইছা মাছ রাখবাইন। বিশ টাকা ভাগ।’ বিশ টাকার কমবেশি কখনো হতো না চিংড়ির দাম। তবু দরদামে মায়েরা মুখর থাকতো, তারও বেশি মুখর থাকতো কেমন উঠছে-কমছে নদীতে বর্ষার জল কিংবা নদীর মাছের গল্পে। সে ছিল গিন্নীপাড়ার এক চিলতে স্বাধীনতা। বাবা বাড়ি ফিরে বাটিতে চিংড়ির চচ্চরি দেখে বলতেন, ‘এসেছিল তোমাদের ভাগনে বুঝি? এই পাড়ায় ওর ঢুকা নিষেধ করা উচিত। নদীর ঘাটে এর থেকেও ভালো মাছ পাবে। ও তোমাদের সিমপ্যাথি আদায় করে ঐ মুখটার জন্য।’

আমার অবশ্য মনে হতো ছেলেটার বলিষ্ঠতা, টিকে থাকার চেষ্টার সাথে মানুষের করুণার দরদাম হয় না। ছেলেটার ভেতরে উদ্যম ছিল।  ভিক্ষে করতে দেখিনি কখনও। আরেকটু বড়ো হয়ে দেখেছি চিংড়ির মৌসুম চলে গেলে ওকে রিকশা চালাতে। দাঁতে গামছার একটা কোণ চেপে হু হু করে বয়ে যাচ্ছে শহরের পথে। তার বাকি অর্ধেক মুখ আমি দেখেছি, আবার মনে হয় দেখিনি কোনদিন; আমার আর ওর দৃষ্টির মুখোমুখি একটা লাল গামছা ছিল বরাবরই।  অনেকবার ভেবেছি কি হতো সরে গেলে আড়াল; মানুষের ভালোলাগার মাপে নিজেকে বসাতে না পারলে কেন এত অপাঙক্তেয় লাগে নিজেকে! পৃথিবীকে লবডঙ্কা দেখিয়ে, বিদ্যুৎস্পৃষ্ট হয়ে পুড়ে যাওয়া মুখ নিয়ে হেঁটে যেতে পারেনি সে। কিংবা এভাবেই সে ধরে রেখেছে রহস্য। যে রহস্য তাকে নিয়ে গেছে করুণার গাছ থেকে দূরে… 

তাতানের বাবার আজ রাতেও দেরী হচ্ছে ফিরতে। আজকাল গভীর রাতে আমার ঘুম ছুটে যায়। বাইরে ঝুম বৃষ্টি হতে থাকি। আমি ভাবি বৃষ্টিতে ভিজতে থাকা তাতানের দোলনাটার কথা। ভাবি তাতানের বাবা কতদিন প্রয়োজন ছাড়া হুটপাট চুমু খায় না, এমন উলটপালট বৃষ্টিতে কী হতে পারে না চুমুর যোগ্য দিন অথবা যোগ্য চুমুর দিন! এইসব একাকীত্ব, আকাঙ্ক্ষাতেও কোন কবি কিংবা সম্ভাব্য প্রেমিকের গভীরে ডুবতে আমার সাধ হয় না। আমার বরং ইচ্ছে করে কেউ আমাকে উলটপালট ভয় দেখাক। একেকটা ভয়কে আমি অন্ধকারে দুমড়ে দুমড়ে চেপে ধরতে চাই নিজের ওপর। বাতাসে তাতানের বানানো ঘুড়িটা নড়ে, দেয়ালে ধাক্কা লেগে চমকে ওঠে শব্দ।‌ মনে হয় কুমিরের মতন আমার চারপাশে কেউ হেঁটে চলেছে আর আমার পুরোটা জীবন ভাগ হয়ে গেছে আঠারোটা শিশিতে। ঠিক তখনই খুব কাছে অপরিচিত নিঃশ্বাস জড়ো হয়, আমাকে ডাকে ‘চাচী’! 

চোখের সামনে থেকে সরে যায় পৃথিবীর লাল, অবগুণ্ঠন। কালো পাথরের ফেরেশতার আলোয় আমি দেখি বাকি অর্ধেক মুখ- সারে সারে চিংড়ি বসানো।‌ একটা চোখ থেকে গড়িয়ে নামে এক ঝাঁক চিংড়ি। চিংড়িরা হেঁটে চলে বুক বরাবর, আরো সামনে। শিশুর পায়ের মতো টলমলে তাদের শুয়ো, ঘুম চোখ। আহা অর্ধেক ঠোঁট, সেখানেও লেগে আছে টুকটুকে হরিণা চিংড়ি। নিজেকে ভাঙচুর করা আকাঙ্ক্ষায় আমি হাত বাড়াই চিংড়ি শীতল মুখের দিকে- যে মুখে ভ্রমণ লেগে আছে। আলমারিতে রাখা পুতুলগুলোও তখন অস্থির হয়ে পড়ে।‌ ওরা দেখতে থাকে বৃষ্টিভর্তি হাজার শিশি, ঝিরঝিরে অবিরাম  চিংড়ি…

চলতি সংখ্যা