এই শহরের সুখ

রুবি রেগে আছে। আমার মুখে হাসি। অভিমানে ফোন কেটে দেয়। ভিডিও কলেই কথা বলছিলাম স্ত্রী রুবির সাথে। বিদেশে থাকি কিন্তু মনটা পড়ে আছে দেশেই। মনের সাথে যুদ্ধ করে থাকতে হয় বিদেশের মাটিতে। আবার কল করি, রিসিভ করে অন্য দিকে তাকিয়ে আছে রুবি। কথা বলছে না। হাজারটা অভিযোগ শুধু ছেলের বিরুদ্ধে। আমাদের ছেলে বর্ণ। বয়স সাত বছর, কিন্তু কাজ কর্মে কুড়ি বছরের ভাব। সারাক্ষণ বিরক্ত করে ঘরের সবাইকে। এই বয়সেই নিয়ম ছাড়া চলাফেরা। রুবি যখন বর্ণের দুষ্টুমির কথা বলে কিছুই বলি না, হাসি। আমার চেহারায় মুচকি হাসি দেখে সে আরও রেগে যায়। হাসির কারণ আড়াল রাখি কিভাবে বলব বর্ণ আমার শৈশবকে মনে করিয়ে দেয়। ঠিক আমার সব স্বভাব পেয়েছে বর্ণ। সারাক্ষণ মাতিয়ে রাখতাম ঘর। আমার কোনো কাজেও রুটিন ছিলো না। আব্বুর সাপোর্ট সব সময় আমার সাথে ছিলো। দুষ্টু হলেও সবার প্রিয় ছিলাম।

পাঁচ জনের একটা টিম ছিলো আমাদের, যখন যা ইচ্ছে তাই করতাম। পাঁচ জনের মধ্যে সিনিয়র এক ভাই ছিলেন তিনিই আমাদের সিনিয়র বন্ধু। উনাকে দলে রাখার কারণ ছিলো টাকা। আড্ডায় খরচ, যাত্রা পথে খরচ সবই সিনিয়র বন্ধু দিতেন। এমন কি ঋণ নিলেও ফিরত দিতাম না। উনাকে নিয়েই আমরা মজা করতাম। ভাবতাম উনি সহজ সরল কিন্তু একদিন একান্তে আলাপের সময় বুঝলাম উনি সব বুঝেন কিন্তু আমাদের ছেড়ে যান না। মায়া লেগে গেছে, দুষ্টুমিও ভালো লাগে উনার। অনেক বিপদেই আপনের মতো পাশে পেয়েছি। আজ প্রবাসে বসে সব মিস করি তবুও জীবন যুদ্ধে প্রবাসে থাকতে হবে। শহরের প্রতি অলিগলি, আড্ডার প্রিয় জায়গাগুলো খুব মিস করি। আমার সুখ আমার পরিবার, বন্ধুরা আর প্রিয় শহরের মাটিকে খুব মিস করি।

ছোটবেলার একটা মজার কথা মনে হলে এখনও মনে মনে হাসি। পাশের বাসার দুই বছরের সিনিয়র মিলি আপুর সাথে প্রেম করেছিলাম। আপু জানতেন আমি ক্লাস সেভেনে পড়ি, দেখতে একটু লম্বা আর মোটাসোটা ছিলাম বলেই এই ভাবনা। কিন্তু আমি পঞ্চম শ্রেণিতে পড়তাম আর আপু সেভেনে। নানান কালারের কাগজে ছোট ছোট চিরকুটে মনের কথা লিখতেন সিনিয়র প্রেমিকা মিলি আপু। আমিও ইঁচড়ে পাকার মতোই উত্তর দিতাম। প্রেম দীর্ঘ হয়নি বেশিদিন। পঞ্চম শ্রেণিতে যখন বৃত্তি পেলাম আম্মু সবার বাসায় মিষ্টি বিতরণ করেছিলেন। মিলি আপুদের বাসাও মিষ্টি নিয়ে গেছিলেন। ফাঁস হয়ে গিয়েছিলো জুনিয়র প্রেমিকের ভণ্ডামির কথা। এরপরে অনেক চেষ্টা করে আর যোগাযোগ করতে পারিনি। প্রেম চলাকালীন অল্প সময়ে মিলি আপুর কাছ থেকে অনেক গিফট পেয়েছিলাম।

বর্তমানে সিনিয়র প্রেমিকা মিলি আপু স্কুলের বাচ্চাদের পড়ান। বিয়ে এখনও করেননি। নিজেকে খুবই অপরাধী মনে হয়। আমার ছেলে বর্ণ উনার স্কুলের ছাত্র। স্ত্রী রুবি যেদিন জেনেছিলো সিনিয়র আপুর আর আমার প্রেম কাহিনী সে কি হাসি। মিলি আপুর সামনে রুবি যায় না। উনাকে দেখলে নাকি হাসি পায়। স্বামীর সাবেক প্রেমিকা আজ ছেলের শিক্ষিকা।

কখন যদি কেউ খারাপ ব্যাবহার করত তার পদবী দেয়া হতো আমাদের। তাকে নিয়ে পাড়ায় ট্রল হতো। এই ভয়ে কেউ আমাদের সাথে সহজে খারাপ ব্যাবহার করত না। পাড়ার সকল কাজেই আমাদের প্রয়োজন হতো। সবাই জানত আমাদের ছাড়া সুন্দর আয়োজন বাস্তবায়ন সম্ভব না। একটা একটা সমস্যা হবেই।

আব্বুর একমাত্র সন্তান ছিলাম। আবদারের সাথে সাথে পেয়ে যেতাম সব। মটর’স এর ব্যবসা ছিলো আব্বুর। ব্যবসা প্রতিষ্ঠানের নাম ছিলো – মাজেদ মটর’স। আমার নামেই আব্বু নামকরণ করেছিলেন। আব্বুর ছোট ভাই আমার একমাত্র চাচ্চু কানাডায় পরিবারসহ থাকেন। চাচ্চু আমাকে খুব বেশি ভালোবাসতেন। বলার আগেই পছন্দের সব কিছুই সামনে পেতাম। চাচ্চু বলতেন- বাবা মাজেদ আমার কলিজার টুকরা। একবার রাগ করে পাড়ার এক বড় ভাই ধমক দিয়েছিলেন। সে কি কানড়বা পরে চাচ্চুর কাছে নালিশ। সে কি কাণ্ড পাড়ার ভাইয়াটিকে খুব মেরেছিলেন চাচ্চু। পরে বিচার পর্যন্ত গড়িয়েছিলো। আমাকে ছাড়া খেতেও পারতেন না। চাচ্চু একটা মেয়েকে ভালোবাসতেন, বংশ ভালো না বলে আব্বু মেয়েটিকে চাচ্চুর জন্য মেনে নেননি। আব্বুর সাথে অভিমান করে চাচ্চু দেশ ছেড়েছিলেন। কানাডায় বিয়ে করে ওখানেই থেকে গেলেন। আর দেশে আসেননি কিন্তু আমার সাথে যোগাযোগের চেষ্টা করেছেন আব্বু ভাইয়ের সাথে অভিমানেই যোগাযোগ করতে দেননি। ব্যাংক ঋণ নিয়ে আব্বুর ব্যবসা প্রতিষ্ঠান চালু করেন, ভালোই চলছিলো। দিনরাত পরিশ্রম করে দাড় করিয়েছেন মাজেদ মটর’স। আব্বুর একটাই স্বপ্ন- আমার ভবিষ্যৎ সুন্দর রেখে যাওয়া।

ব্যবসার কাজে আব্বু সকালে বাসা থেকে বের হলে রাতে ফিরতেন। দেখাই পেতাম না। আম্মুকেই বেশি জ্বালানোর সুযোগ পেতাম। আমার জ্বালাতনে অতিষ্ঠ হয়ে আব্বুর কাছে নালিশ করেও কোন লাভ হতো না। বড় হয়ে আরও অগোছাল হয়ে গেলাম। রাত করে বাড়ি ফিরতাম, দুপুর বারোটায় ঘুম থেকে উঠতাম। আম্মুর কাছে এসব অভিযোগ শুনতে শুনতে আব্বু চিন্তা করলেন ছেলেকে বিয়ে করালে হয় তো পরিবারের প্রতি সিরিয়াস হবে, আর নিজেকে নিয়ে ভাববে। সেটাই হলো, আব্বুর পছন্দ করা মেয়েকেই বিয়ে করলাম। কিন্তু আমার কোন পরিবর্তন নেই। ভেবেছিলাম দুদিন পরে হয় তো আমার অবস্থা দেখে বউ পালাবে। কিন্তু না খুবই ধৈর্যশীল মেয়ে রুবি। সে এমনভাবে চলে যেন আমার সব কিছুই সে বুঝে। কখন কি করব, কখন মন ভালো থাকে। কখন কি দরকার সবই রুবি আগেই টের পায়। জন্ম হয় বর্ণের। আব্বু আম্মু আমার চেয়েও বেশি খুশি। আম্মু সবচেয়ে বেশি খুশি সারা দিনই বর্ণকে নিয়ে খেলা। বর্ণের জন্মে পরিবারের আনন্দ যেন দ্বিগুণ বেড়ে গেলো। কিন্তু আমার কোনই পরিবর্তন নেই।

হঠাৎ করে একদিন চাচ্চু দেশে ফিরে আসলেন। আমাদের বাসায় আসেননি আলাদা বাসায় উঠেছেন। আমরাও যোগাযোগের চেষ্টা করিনি। আব্বু বললেন, মাজেদ তোমার চাচ্চু যোগাযোগ করলে খারাপ ব্যাবহার করো না। আশ্বস্ত করলাম আব্বুকে। চাচ্চুর সাথে ভালোভাবেই কথা বলব। এত কিছুর পরেও ভাইয়ের প্রতি আব্বুর দরদ দেখে সত্যি ভালো লাগল।

বন্ধুদের সাথে আড্ডা দিচ্ছিলাম। আম্মু ফোন করে জানাল আব্বু স্টোক করে হাসপাতালে। দ্রুত হাসপাতালে যাই। ডাক্তারের সাথে দেখা করে জানতে পারি স্টোক মারাত্মক ছিলো আলাহ রক্ষা করেছেন। তবে টেশনমুক্ত রেস্ট প্রয়োজন। কয়েকদিন পর বাবাকে বাসায় নিয়ে আসা হলো। মায়ের কাছে জানলতে পারলাম চাচ্চু বাবার সাথে দেখা করেছিলেন আইনি নোটিশ নিয়ে। উনার সম্পত্তির ভাগ চাই। ব্যবসা প্রতিষ্ঠান মাজেদ মটর’স যে জায়গায় অবস্থিত সেই জায়গাটুকুও চাই তার। এসব বিষয়ে তর্ক করেই আব্বুর এই অবস্থা। খুব ঘৃণা হলো চাচ্চুর প্রতি। ব্যবসা প্রতিষ্ঠান মাজেদ মটর’স এর জায়গা দিয়েই ব্যাংক ঋণ তুলা হয়েছে। খুব চিন্তায় পড়ে গেলায়। জীবনের প্রথম এই পরিস্থিতিতে পড়েছি। বাবা অসুস্থ, চাচ্চুর আইনি লড়াই আর ব্যাংক ঋণ সব মিলে দিশেহারা হওয়ার মতো অবস্থা। স্বপ্নের মতোই উলটপালট হয়ে গেলো সাজানো ফুলবাগান।

চাচ্চু মামলায় জয়ী হলেন। উনার সম্পত্তি লিখে দেয়া হলো। ব্যাংক ঋণের টাকা পরিশোধের নোটিশ আসল। বসত ভিটা বিক্রি করে ভাড়া বাসায় উঠলাম। ব্যাংক ঋণ পঞ্চাশ ভাগ পরিশোধ করে ব্যাংক অফিসারের কাছ থেকে মাসিক কিস্তিতে পরিশোধের অনুমতি পেলাম। বাকি টাকার একটা অংশ ব্যাংকে আম্মুর নামে রাখলাম। বাসার কাজে লাগবে। চাকুরির অনেক চেষ্টা করলাম। অনেক জায়গায় ইন্টারভিউ দিলাম কোন জায়গাই চাকুরি হলো না। পরে জানলাম প্রাইভেট কোম্পানিতে লবিং এ চাকুরি হয় সরকারি চাকুরিতে ঘুষ লাগে। চাকুরির আশা ছেড়ে দিয়ে পরিবারের কথা ভেবে মধ্যপ্রাচ্যের ওমান যাওয়ার সিদ্ধান্ত নিলাম। আব্বু আম্মু প্রথমে রাজি না হলেও পরিস্থিতি ভেবে রাজি হলেন। স্ত্রীর মুখের দিকে তাকাতে পারিনি। বর্ণের জন্য কলিজাটা মুচড়ে উঠল। তবুও মনের সাথে যুদ্ধ করে দুঃসম্পর্কের আত্মীয় এক বড় ভাইয়ের মাধ্যমে ওমান আসলাম। নামিদামি ভালো কোম্পানিতে চাকুরিও হলো।

পরিবার, অসুস্থ বাবা, ব্যাংক ঋণ অগুছালো এই আমাকে কত দায়িত্ববান বানিয়ে দিলো। সবাইকে খুব মিস করি কিন্তু কাউকে বুঝতে দেইনি। সবাই যাতে বুঝতে পারে ভালো আছি এভাবে কথা বলি। দিনরাত কাজ করতে শুরু করলাম। মাস শেষে বেতন নিতে গেলে ঝামেলা। সহকর্মীদের কাছে জানতে পারলাম দুই তিন মাস পর পর বেতন দেয়া হয়। মাথা আকাশ ভেঙে পড়লো। কিছু করার নাই পাসপোর্ট কোম্পানির মালিকের হাতে তার কথাই চলতে হবে। দেশে ফিরা সম্ভব না। এত দায়িত্ব। সহকর্মী এক বাংলাদেশির মাধ্যমে ডিউটির বাহিরে আলাদা কাজ শুরু করলাম। কোম্পানিতে ডিউটি টাইম বারো ঘন্টা, পরে আরও ছয় ঘন্টা অতিরিক্ত কষ্ট করে দেশে টাকা পাঠানো শুরু করি। চব্বিশ ঘন্টার মাঝে যোল ঘন্টাই কাজ। শ্রমের বিনিময়ে মজুরি মিলে না। এটা তো দয়ার টাকা না। কঠোর পরিশ্রমের বিনিময়ে উপার্জিত টাকা। এই টাকা দিতেও বাহানা।

অনলাইনে বন্ধুদের সাথেও যোগাযোগ বন্ধ করে দিয়েছি। বন্ধুরা মজা করে নানান কথা বলে। এতোদিন দেশে না আসলে নাকি সুন্দরি স্ত্রী পরকিয়া করবে, পালিয়ে যাবে। সব কথা হজম করছি। যুদ্ধ করছি জীবনের সাথে। ছেলে বর্ণ দিন দিন বড়ো হচ্ছে তাকেও পিতার সেড়বহ থেকে বঞ্চিত হতে হচ্ছে। আত্মীয়-স্বজনের কত দাবি। মাঝে মাঝে মনে হয় এই পরিশ্রম দেশে করলেও ভালো টাকা রুজি করতে পারতাম কিন্তু পরিবারের সবাই এ কাজ করতেও তো দিতো না। এতো বড়ো হয়েছি আম্মু বা আব্বু কখনোই বাজারটা করতেও বলেন নি কিন্তু আজ এই আমি কত বদলে গেছি। নীড়ে ফিরে যাওয়া পাখির মতো ঘরে ফিরার ইচ্ছেকে দাফন দিতে হয়, স্বপ্নে বিভোর হতে পারি না।

প্রিয় শহরের প্রিয় মানুষগুলোর সাথে কাটানো সময় সত্যি আনন্দময়, স্মৃতিময়। আড্ডা, খেলাধুলা, মারামারি কত দুষ্টুমির ফ্রেমে বাধা আছে শৈশব। প্রত্যেক মানুষই মনে হয় তার বেড়ে উঠার শহর, শৈশবের শহরকে প্রিয় শহর বলবে। বড়ো হলে যান্ত্রিকা হয়ে যায় মানুষ, অনেক দায়িত্ব বেড়ে যায়। মানুষ আনন্দের স্মৃতি মনে রাখে, বেদনার অতীত ভুলে যায়। প্রাণের শহরের সুখের কথা কেউ ভুলতে পারে না। বিকেল নেমে এলেই মনে হয় পাড়ার মোড়ে চায়ের আড্ডার কথা। মাসের পরে যখন পরিশ্রমের টাকা হাতে আসে মনে হয় শৈশবে বাবার পকেটের টাকা সরিয়ে বন্ধুদের আড্ডায় টাকা খরচের কথা মনে পড়ে যায়। শৈশবে বেড়ে উঠা শহরেই প্রকৃত সুখ বাঁধা থাকে স্মৃতি আয়নায়।

সারাদিন কোম্পানির কাজ করে পার্ট টাইম কাজে গেলাম। খাবার হোম ডেলিবারি দেয়ার কাজ। খাবার নিয়ে দরজায় দাঁড়িয়ে আছি, অনেক্ষগণ পর দরজা খোলা হলো। দরজা খুলতে চমকে গেলাম চাচ্চু সামনে দাঁড়িয়ে আছেন। আমার হাতে খাবার ব্যাগ। বুঝতে বাকি রইলো না ওমান ঘুরতে বা ব্যবসার কাজে এসেছেন। চাচ্চু বললেন – মাজেদ তুই এখানে ?

কোন উত্তর না দিয়ে চাচ্চুর হাতে খাবার তুলে দিয়ে হাতে রাখা টাকাটা চু মেরে নিয়ে বিপরীতে হাঁটা শুরু করলাম। যে লোকটার জন্য বাবা আজ মৃত্যুর সাথে যুদ্ধ করছেন, আমার প্রবাসে আসা। এত কিছু তার সাথে আবার কি কথা।একটু সামনে এগিয়ে পিছনে তাকালাম। চাচ্চু অবাক দৃষ্টিতে তাকিয়ে আছেন। কেন পিছনে তাকালাম? কথা না বলে চলে আসলাম, তবুও পিছনে তাকানো হয় তো রক্তের টান…

© মিনহাজ ফয়সল

চলতি সংখ্যা