ধূসর পাণ্ডুলিপি

ত্রস্তপায়ে, বোঝা মাথায় নিয়ে স্টেশনের কুলিদের মতোন লোকটি হাঁটছিল- একটানা; সে আসছিল ধানসিড়ির ওপার থেকে, সতর্ক হয়ে আইল মাড়িয়ে! নদী পেরিয়ে যতক্ষণে বামনকাঠির পথ ধরে ততক্ষণে ভোরের সূর্য চোখ মেলে তাকিয়েছে, প্রকৃতি জেগে উঠেছে, পথচলতি মানুষের যাতায়াত বৃদ্ধি পেয়েছে। লোকটি তথাপি আগের মতোই ব্যস্তসমস্ত। লম্বা লম্বা পা ফেলে পথ হাটে। পা এবং শরীরের উপরের অংশের সাথে ছন্দ রেখে বোঝার মতো ওই ট্রাঙ্কটিও সামনে-পিছনে ঈষৎ দুলে ওঠে। দূরের গ্রামগুলোর উপর থেকে যখন দোদুল্যমান বস্তুটিতে আলোকরশ্মি পতিত হয়, তখন বিচ্ছুরণ ছড়িয়ে পড়ে; দেখে মনে হয় কেউ একজন এক টুকরো আলো মাথায় করে হেঁটে আসছে! ফলে পথচলতি মানুষের চোখ সহজেই আটকে যায়, কৌতুহলী হয়ে অপেক্ষা করে, কিন্তু আলো বহনকারী মানুষটি নিকটবর্তী হলে নিজেদের চোখেমুখে আরো বেশি আলোর উপস্থিতি প্রত্যক্ষ করে! গ্রামময় চাউর হয়ে যায়- ফিরে এসেছে, বাবু জীবনানন্দ দাশ ফিরে এসেছে; লাবণ্যর হাত ধরে কবি জীবনানন্দ দাশ তাঁর বাপদাদার বসতভিটায় ফিরে এসেছে!

অবাক হওয়ার মতো সংবাদ! কিন্তু তাদের (গ্রামবাসী) মধ্যে আবেগের প্রাবাল্যতা নেই; বরং এমন একটি সংবাদের জন্যই যেনো এতোদিন অপেক্ষা করছিল! প্রত্যাহিক কাজ ফেলে যে-যার মতো প্রাচীন বৃক্ষের তলায় জড় হয়; নিজেদের মধ্যে শলা-পরামর্শ করে, মিল-অমিল প্রত্যক্ষ্য করে; তাইতো, সেই চোখ, সেই নাক, সেই মুখ- জীবনবাবু ছাড়া এ আর অন্য কেউ হতে পারে না! তাছাড়া ফিরে যে আসবেন তিনি নিজেও তা উল্লেখ করেছেন-

আবার আসিব ফিরে ধানসিড়িটির তীরে- এই বাংলায়
হয়তো মানুষ নয়- হয়তো বা শঙ্খচিল শালিখের বেশে;
হয়তো ভোরের কাক হয়ে এই কার্তিকের নবান্নের দেশে…

কিন্তু বাবু যে মানুষ রুপে উপস্থিত হয়েছেন!
তাতে কী হয়েছে!
আমতা আমতা করে ভীড়ের মধ্যে থেকে কেউ একজন জানায়- না মানে, উনি তো কাক কিংবা শালিখের বেশে আসার কথা বলেছিলেন!
বয়সী লোকটি সবাইকে বুঝিয়ে বলে- কী রুপে ফিরেছেন সেটা বিবেচ্য নয়; ভগবান কী নির্বোধ, উনার মতো বিখ্যাত কবিকে শালিখ কিংবা কাকের বেশে পাঠাবেন! তাছাড়া মানুষ হিসেবে এসে উত্তম হয়েছে, আমাদের দাবি প্রতিষ্ঠা হওয়া সময়ের ব্যাপার মাত্র! এতদিন ধওে দাবী নিয়ে যে বিতর্ক চলছিল নিশ্চয় তার অবসান হবে। সূধীজনরা আসুক, বুঝে-শুনে ফয়সালা দেবেন!
লাবণ্য দেবী প্রতিবাদী হয়ে ওঠে- ফয়সালা দেওয়ার উনি কে?
মানে?
জীবনবাবু ওসব ঝামেলার মধ্যে নেই, নিজেদের সমস্যা নিজেরা সমাধান করুন; উনাকে উনার মতো থাকতে দিন, নিজের মতো করে ঘুরতে দিন, বহুদিন আগে দেখা দৃশ্যের সাথে তাকে মানিয়ে নিতে দিন!
মেয়েটির কথায় লোকজন আহত হলেও আপত্তি করে না। রায়েদের মেয়ে বলে কথা! সুন্দরী। শিক্ষিতা। বাকপটু। এক-আধটু কবিতাও লেখে। গ্রামের অন্য সবার আগে লাবণ্যই নাকি জীবন বাবুকে প্রথম দেখেছে! বাবু যখন পায়ে হেঁটে নদী পার হচ্ছিল মেয়েটি তখন কিনারায়; হাতদুটো হাতের মধ্যে টেেেন নিয়ে বলেছিল- আরে, লাবণ্য যে!
তারপর! তারপর কী হয়েছিল গো!
উৎসুক জনতার কৌতুহল লক্ষ্য করে লজ্জাবনত মস্তকে বার-কয়েক ঢোক গিলে মেয়েটি জানায়- উনি তন্ময় হয়ে আমাকে দেখছিলেন আর আমি ভয় ও লাজে কুঁকড়ে যাচ্ছিলাম।
কলেজ পড়–য়া একটা ছেলে নিশ্চিত হতে পুনরায় জিজ্ঞেস করে- উনি কি সত্যি আপনার হাত ধরেছিলেন!
কাজল চোখের পলক ফেলে, থুতনি এবং মাথায় হ্যাঁ-সূচক ঝাঁকুনি দিয়ে লাবণ্য বলে- হে তো! এতে অবাক হওয়ার কী আছে! এই দেখুন, এইখানে, ঠিক এইখানে ধরেছিল!
পাশে দাঁড়ানো বয়স্ক মহিলাকে উদ্দেশ্য করে মেয়েটি অনুযোগ করে- দেখুন না কাকিমা, আমার আর লাবণ্য বৌদির চেহারায় খুব কী অমিল! নাকি খুব বেশি অসুন্দর আমি!
কপাল! কপাল! এই না হলে কপাল! কবি জীবনানন্দ দাশের ছোঁয়ায় রায়েদের মেয়ে ললিতা রাতারাতি লাবণ্যে রুপান্তরিত হলো! লোকের মুখে মুখে গালগল্প! নদীর ঘাট থেকে মাঠ- সর্বত্র লাবণ্য আর জীবনবাবু, জীবনবাবু আর লাবণ্য! প্রথম দেখায় যদিও ভয়ে ও লাজে কুঁকড়ে গিয়েছিল তথাপি মা-বয়সী কেউ কেউ তার লাজ-শরম নিয়ে আপত্তি তোলে- আরে বাপু, জামায়ের সাথে যা যা ঘটবে তা কী জনসম্মুখে বলে বেড়াতে হবে! কলিকাল; বলি ঘোর কলিকাল এখন! দেখছো না, এক মুহূর্তের জন্য জামাই বাবাজীকে চোখের আড়াল হতে দিচ্ছে না; কেমন সেরে-সামলে রাখছে!
লাবণ্য অবশ্য নিরুপায় হয়ে মুখ খুলেছে! জনতার সহ¯্র প্রশ্নের উত্তরে কবি নির্বাক থাকলে সন্দেহের সৃষ্টি হয়- আমাদের জীবনবাবু তো বোবা ছিলেন না গো! বৌদির গঞ্জণা-বঞ্চণা নিরবে সইতেন বটে মাঝে-মধ্যে প্রতিবাদও করতেন!
তাহলে?
ইনি সম্ভবত অন্য কেউ।
লাবণ্য প্রতিবাদমুখর হয়ে ওঠে- না না, ইনিই আমাদের জীবনবাবু! বহুদিন বাদে গ্রামের ছেলে গ্রামে ফিরে এসেছেন। আমরা যদি অবহেলা করি তো বরিশালবাসী তাকে লুফে নেবে, আমরা যে বিতর্কের মধ্যে ছিলাম কিছুতেই তার পরিত্রাণ মিলবে না!
কারো মতে জীবনানন্দ দাশ স্বয়ং অবতার, ভগবান তাকে অবতার হিসেবে বামনকাঠি গ্রামে প্রেরণ করেছেন; উদ্দেশ্য একটাই- চলমান বিতর্কে ঘিঁ ঢেলে দেওয়া! এমন বিশ্বাসের পালে হাওয়া লাগলে জনতা দুলে ওঠে, কবিকে নিয়ে মেতে ওঠে; মোক্ষম সুযোগ, কিছুতেই হাতছাড়া করা চলবে না! মাঠের কিনারে দাঁড়ালে দূরের পথ মাড়িয়ে ছুঁটে আসা উত্তপ্ত বাতাস তাদের ছুয়ে যায়। অঙ্গুলি নির্দেশ করে যুবক বলে- ওই যে ওইখানে আপনাদের ভিটা ছিল!
১৮৯৯ সালের ১৭ মে ঝালকাঠির বামনকাঠি গ্রামে দাশদের যে ভিটায় কবি জীবনানন্দ দাশের জন্ম সে-ভিটার কোনো অংশই আজ আর অবশিষ্ট নেই। পুর্বপুরুষের বসতি ছিল বিক্রমপুরের বাওগ্রামে। পদ্মার ভাঙণে জমি-জিরাত হারিয়ে নৌকোয় ভেসে-ভেসে ভাটি অঞ্চলে উপস্থিত হয়েছিলেন। ‘বনশ্রি’ নদীকে অবলম্বন করে শুরু হয়েছিল জীবনের নতুন যুদ্ধ, নতুন করে পথচলা! ওই পথের কোনো চিহ্ন সংরক্ষণ করতে না-পারায় বামনকাঠি গ্রামের লোকজন নিজেদের অপরাধী বিবেচনা করে; লজ্জায় মাথা নুয়ে আসে। জীবনানন্দ দাশের উদাস দৃষ্টি সংকুচিত হতে হতে সামনে দাঁড়ানো নেংটো শিশুর প্রতি কিছু সময়ের জন্য স্থির হয়; মনে মনে হয়তো কৈশরের দিনগুলোতে যাত্রা করেন। হায়, দুরন্ত কৈশরে জনপদের মাঠ-ঘাট চষে বেড়াতেন! সন্ধ্যার আলো-আঁধারীতে দাশবাড়ির আঙিনায় কুসুমকুমারী দেবীর কণ্ঠে উচ্চারিত হতো-

আমাদের দেশে হবে সেই ছেলে কবে
কথায় না বড় হয়ে কাজে বড় হবে!

মায়ের কথা অক্ষরে অক্ষরে সত্যি হয়েছে, কবি জীবনানন্দ দাশ বাংলা কবিতাকে নিয়ে গেছেন অনন্য উচ্চতায়; শুধু বামনকাঠি নয় তিনি এখন বাংলা ও বাঙালীর অহংকার।

লোকচক্ষুর আড়াল খোঁজে লোকটি। আলপথ ধরে এগিয়ে চলে; যে পথে হাজার বছর ধরে তার পুর্বসূরীরা যাতায়াত করেছে; পথের শেষে পৌছে গেছে সিংহল সমুদ্র হতে মালয় সাগরে! বাসন্তী সন্ধ্যায় সবুজ ঘাসের উপর শরীর এলিয়ে দেয়। রাত্রির শরীরে আনমনে ছবি আঁকে। কেমন করে যেনো, ওই ছবির কথা রায়েদের মেয়ে আন্দাজ করতে পারে। মনে মনে ভাবে, দু’চোখে বেয়ে ফোঁটায় ফোঁটায় জল নামলে বেশ হতো।
জল কেনো?
জলহীন কান্নার যন্ত্রণা অনেক বেশি যে! দেখছো না, উনি কাঁদছেন!
যুবক প্রশ্ন করে- কান্না কেনো!
যন্ত্রণা; কবি যন্ত্রণাকাতর। আন্দাজ করতে পারেননি প্রিয় রুপসী বাংলার এমন করুণ পরিণতি হবে, প্রকৃতি বদলে যাবে, ডুমুরের বনে আগুন লাগবে, ধানসিড়ির যৌবণ ফুরিয়ে যাবে! নদীর পানে তাকিয়ে বুকের মধ্যে বিরহ জেগেছিল- লাবণ্য, এই তোমাদের ধানসিড়ি!
আমাদের বলছেন কেনো, এ তো সেই ধানসিড়ি; যার প্রেমে একদা ব্যাকুল হয়েছিলেন, মৃত্যুর পরেও ফিরে আসার ইচ্ছে পোষণ করেছিলেন!
ভুল; সব ভুল, আমার দেখা ধানসিড়ি মরে গেছে, তোমরা তাকে হত্যা করেছো।
হত্যার দায় কাঁধে নিয়ে কবিকে অনুসরণ করে; বিস্তর পথ হেঁটে রাস্তার দু’পাশে ভাটফুলের সন্ধ্যান না পেয়ে হতাশায় নিমজ্জিত হয়; অভিযোগ করে- শুধু নদী না বাংলার অপরুপ প্রকৃতিও তোমরা ধ্বংস করেছো।
পরিস্থিতি দ্রুত বদলায়। চারদিকে কানকথার উড়াউড়ি। জীবনানন্দ দাশকে নিয়ে নতুন করে কাঁটা ছেড়া আরম্ভ হয়েছে। লাবণ্যকে নিয়ে অসংখ্য কল্পকাহিনী! বনলতা সেন ও দু’দন্ড শান্তি বিষয়ে কট্টর সমালোচনা; প্রতিপক্ষরা নাটোরের বনলতা সেনকে পতিতা হিসেবে আখ্যায়িত করে। বহুদিন পরে ফিরে আসায় ধারণা করেছিল, কোনো প্রতিপক্ষ থাকবে না; সাদরে গ্রহণ করবে সবাই! কিন্তু বাস্তবে তা হয় না, বরিশালকে যারা জন্মস্থান হিসেবে দাবি করে আসছিলেন, তারা ইতিমধ্যে শক্ত প্রতিপক্ষ হিসেবে আর্বিভুত হয়েছে। কবিকে এলাকাছাড়া করতে তারা তৎপর। কুৎসা রটায়। আর এ সুযোগটাই ব্যবসায়ীরা লুফে নিতে চায়। ঝালকাঠির নির্জন পল্লীতে ব্যবসায়ীদের আনাগোনা চোখে পড়ার মতো! নতুন নতুন ব্যবসার ফন্দি আটে। আর যাই হোক, মৃত জীবনানন্দের চাইতে জীবিত জীবনানন্দকে দিয়ে ঢেঁর ব্যবসা করা যাবে। লোভনীয় অফার- ‘বনলতা সেন মশার কয়েল’ এর বিজ্ঞাপনে অংশ নিলে কোম্পানির তরফ থেকে বিশাল অঙ্কের টাকা! টাকার অভাবে যেহেতু ট্রামের সামনে ঝাঁপ দিয়েছিল, টাকাকেই তারা বড় টোপ হিসেবে বিবেচনা করে। জীবনমার্কা সরিষার তেল, কবি জীবনানন্দ দাশ সেভেন স্টার হোটেল, জীবনানন্দ দাশ বিউটি সোপ, জীবনানন্দ দাশ টুথপেস্ট- হরেক পদের ব্যবসা! বিভিন্ন সাহিত্য সংগঠনের দূত হিসেবে পদক-ব্যবসায়ীরা দফায়-দফায় বৈঠকে বসে। লোভনীয় সব পদকের অফার। ফুলের জলসায় কবি নিরব; নিরুত্তাপ দৃষ্টিতে ব্যবসায়ীদের কথা শ্রবণ করে। কবি সম্প্রদায় আদাজল খেয়ে নামে, জীবনবাবুকে পদক পরাতে না পারলে মান বাঁচানো দায়। লাবণ্য রায়ের দ্বারস্থ হয়, দায়িত্ব পালনের নূন্যতম সুযোগ প্রত্যাশা করে- প্লীজ ম্যাডাম, কিছু একটা করেন! দরকার হলে আপনার জন্যও দামি কোনো পদকের ব্যবস্থা করবো; মাশাল্লাহ, আপনি যা লেখেন তা অতুলনীয়!
লাবণ্য বিক্ষুব্ধ হয়ে ওঠে- চুপ, একদম চুপ! আরেকটা কথা বলবেন না; এক্ষুণি চলে যান! আপনাদের জন্য উনার জীবন বিষিয়ে উঠছে!

দুই

নক্ষত্রের আলোয় সভা বসে- বিদায়সভা! ধানসিড়ির তীরে বামনকাঠির জনগণ সমবেত হয়েছে। চোখের জলে গ্রামের ছেলেকে বিদায় জানাবে। যে পথ ধরে এসেছিল ভোরের কুয়াশা মাড়িয়ে ওই পথে ফিরে যাবে; ফিরে যাবে অচিন ঠিকানায়! তার আগে ট্রাঙ্কে বয়ে আনা পান্ডুলিপি আগুনে পুড়িয়ে ফেলার ইঙ্গিত দেয়। নিরীহ প্রাণ পুড়ে পুড়ে অঙ্গার হয়। বুকের মধ্যে চিনচিনে ব্যথা। উফ এই শেষ, আর কখনো হয়তো উনি ফিরবেন না; হয়তো বাংলাকে দেখার সাধ মিটে গেছে! ফেরানোর চেষ্টা যে হয়নি তা নয়, বয়স্ক মানুষগুলো হাত জোড় করে সম্মুখে দাঁড়িয়েছে, চোখের জলে বুক ভিজিয়েছে- দোহায় বাবু, আমাদের ফেলে কোথাও যাবেন না! অনাদর হবে না, আজন্ম মাথায় করে রাখবো!
লাবণ্যর চোখে বোবা কান্না। সে নিজেও কবির পায়ে মাথা কুটেছিল; অনুনয়-বিনয় করেছিল, কিন্তু জীবনানন্দ দাশের মুখ দিয়ে কথা সরেনি; রাতের নির্জনতায় নক্ষত্রের পানে তাকিয়ে ছিল, বুকের অলিগলি মাড়িয়ে খসে পড়েছিল দীর্ঘশ্বাস। বেচারা বুঝে গেছে সমকালীন বাংলায় অপাজ্ঞেয় সে; নিত্য-নতুন বিড়ম্বনা; জাত-পাতের প্রশ্ন। অতএব যত দ্রুত ফিরবে ততই মঙ্গল। মঙ্গল আলোয় আলোকিত হতে শেষবারের মতো মুখোমুখি দাঁড়ায়। দু’চোখ ভরে দেখে। বুক ভরে শ্বাস নেয়; তারপর নদীর তীর বেয়ে ধীর পায়ে পথ হাঁটে- একপা, দু’পা, তিনপা…

তিন

বামনকাঠির জীবনে শোকের আবহ। সময়ের সাথে সাথে আবহ খানিকটা লঘু হয় বটে নিঃশ্বেষ হয় না। পুরাতন স্মৃতির জাবর কাটে; হ্যাঁ-পিত্যেশ করে। রায়েদের চপলা-চঞ্চলা-বাকপটু মেয়েটি বদলে গেছে। প্রয়োজন ছাড়া কথা বলে না, বাইরে আসে না; সারাক্ষণ একা-একা। বাইরের আলো-বাতাসের চাইতে চার-দেওয়ালের মধ্যে স্বস্তি বোধ করে। জীবনের তরে পান্ডুলিপি রচনায় মনোযোগী; গভির ভাব-তন্ময়তায় জীবনানন্দ বিষয়ক পদ রচনা করে। শহর থেকে কালে-ভদ্রে সাংবাদিক আসে; লাবণ্যর সাক্ষাৎ চায়; জীবনানন্দের বিষয়ে তথ্য চায়; পত্রিকার জন্য কবিতা চায়। কবিতা দিতে নারাজ; সে চায় না তার পান্ডুলিপি আলোর মুখ দেখুক। অন্ধকারের সিঁড়ি বেয়ে গভীর রাতে ধানসিড়ির তীরে গিয়ে দাঁড়ায়; রচিত পদ জলে ভাসিয়ে দেয়। জলের সান্নিধ্যে ঝুপ ধরে বসে থাকে। জলপাখি দেখে অস্থিরতায় ভোগে, বুকের মধ্যে ব্যথা অনুভূত হয়। নিঃশব্দে কাঁদে কখনো। ধানসিড়ির জলে ফোঁটায় ফোটায় নোনাজল গড়িয়ে পড়ে। অপ্রত্যাশিত আচরণ। তার চপল পায়ে অদৃশ্য বেড়ি। লোকজনের ধারণা মেয়েটি পাগল হয়ে গেছে; ডাক্তারের কাছে নিয়ে যাওয়ার পরামর্শ দেয়। নাহ, কোথাও যাবে না সে; কিচ্ছু হয়নি, জিদ ধরে বসে থাকে। লাবণ্যর পৃথিবী ক্রমশ গুটিয়ে আসে, গুটিয়ে নেয় পৃথিবীর কোলাহল হতে- বাড়ি থেকে ঘাট, ঘাট থেকে বাড়ি! এভাবেই চলছিল। তারপর হঠাৎই একদিন খবর এলো- লাবণ্য নেই, তাকে কোথাও খুঁজে পাওয়া যাচ্ছে না!

– পিন্টু রহমান

চলতি সংখ্যা