পানকৌড়ির পৃথিবী

শিশির সিক্ত শুভ্র সকাল। শীতার্ত প্রকৃতি। কুয়াশার ঘোমটায় আবৃত সূর্য। ঘুমের রাজ্যে নিমগ্ন প্রতিটি প্রাণ। কেউ আকাশ ছোঁয়া অট্টালিকায়, কেউবা বস্তিতে। সি.এন.জি ও অটোরিকসাগুলি মূল সড়কের পাশে সারিবদ্ধভাবে সাজানো। নিঃসীম নীরবতায় ছেয়ে আছে পুরো শহর। তবে ব্যতিক্রম কেবল জেলা স্কুল মাঠটি। মাঠটির অবস্থান মহাস্থান শহরের প্রাণকেন্দ্রে। শহরের বিভিন্ন প্রান্ত থেকে ছুটে আসে সবাই এই মাঠে। একেকজনের ঠিকানা ও গন্তব্য একেক রকম। তারুণ্যের বাঁধভাঙা উচ্ছ্বাসে মুক্তির পায়রা ওড়ে এখানে। ক্রিকেটের অমোঘ আকর্ষণ একই বন্ধনে আবদ্ধ করে তাদের। মাঠের বিভিন্ন প্রান্ত জুড়ে চলে ব্যাট-বলের লড়াই। ব্যাট-বলের লড়াইয়ে আজও প্রাণিত হয়ে উঠেছে মাঠটি। শিশিরের সফেদ ফোটার স্পর্শে সজ্জিত সবুজ ঘাসগুলি হারিয়ে ফেলেছে প্রকৃত লাবণ্য। মাঠের পাশ দিয়ে হাঁটছে বিভিন্ন বয়সী মানুষ। কেউ কেউ আবার দৌঁড়োচ্ছে। দক্ষিণ প্রান্তের একটি অংশে খেলছে কিছু তরুণ। এখানেই সুযোগ হয়েছে বাবলুর। ওর গায়ের রংটি ফর্সা। সুঠাম দেহ, এলোমেলো দীর্ঘ কালো চুল, টিকোলো নাক, কান দুটিও বেশ লম্বা। গোঁফ ওঠে নি এখনও। অচিরেই উঠবে বলে অনুমান করা যায়। ঠোঁট দুটিতে লালচের আভা ফুটিত। বয়স পনের কিংবা ষোলো হতে পারে। চেহারা দেখে বোঝার উপায় নেই, এই ছেলেটিই নিয়ত জীবন সংগ্রামে জর্জরিত। শ্রমিক হিসেবে কাজ করে শহরের একটি বস্ত্রালয়ে। রাত্রি যাপন করে বস্ত্রালয়ের পাশেই একটি পুরাতন ঘরে। দারুণ ব্যাটিং করছে। অনবরত চার ছক্কার ফুলঝুরিতে ক্লান্ত করছে বোলারদের। অপর প্রান্তে সঙ্গ দিচ্ছে রাহী। লম্বা নাক, বড় বড় চোখ, লম্বা চুল এবং হালকা পাতলা গড়নের। শারীরিক গঠনটি বিনয়ের সর্বোচ্চ ভাবটিকে প্রকাশ করে। বাবলুর সমবয়সী। পড়াশুনা করে মহাস্থান জেলা স্কুলে। ক্লাস টেনে। মাঠের পাশেই বাসা। ডে শিফটে পড়বার কারণে প্রায়ই সকালে খেলে ও। স্কুল মাঠেই। পরিচয় অল্প কয়েকদিনের। অন্তরঙ্গ ভাব গড়ে ওঠে নি এখনও।
‘দারুণ খেলেছ আজ, কোন স্কুলে পড়ো বাবলু?’ খেলা শেষে আগ্রহভরা জিজ্ঞাসা রাহীর।
‘পড়তাম, পড়তে খুব ভালো লাগতো। এখন আর পড়ি না, কাপড়ের দোকানে কাজ করি।’ বিষণ্নতার বৃষ্টিতে চোখমুখ ভিজে গেল বাবলুর। আড়ষ্ঠতায় কুঞ্চিত হলো ওর যুগল ভ্রু।
উত্তর শুনে নির্বাক হলো রাহী। ছলছল করে উঠলো ওর দুটি চোখ। মুহূর্তেই মিলিয়ে গেল মুখের হাসি।
‘কাল মাঠে দেখা হবে।’ বুকের কোনে ব্যথা নিয়ে বিদায় নিলো বাবলুর কাছ থেকে।

দু’জনের ভেতরেই সাফল্যের সম-সম্ভাবনা। প্রকৃত বাস্তবতা কঠিন প্রাচীর হয়ে দাঁড়িয়েছে ওদের মাঝে। ভিন্ন প্রেক্ষাপটে চিত্রিত হয়েছে দু’জনার দু’রকম পৃথিবী। এই আকাশসম প্রভেদটি অনুধাবন করতে পারে না ওরা। ধীরে ধীরে গড়ে ওঠে বন্ধুত্বের সম্পর্ক। দুজন দুজনকে অনুভব করে জমাট বাঁধা বরফের মতো। সময়ের সাথে সাথে নিবিড় হতে থাকে সম্পর্কটি। স্মৃতির এ্যালবামে যুক্ত হতে থাকে অজ¯্র মুহূর্ত। সকাল ছাড়া কখনই সুযোগ হয় না বাবলুর। অদৃশ্য লোহার শেকলে আবদ্ধ কিশোর বাবলুর বিনোদন বলতে ওই এক টুকরো সকাল। হৃদয় কন্দরে লালিত মৃত স্বপ্ন ও কষ্টের স্রোতে ভেসে বেড়ানো অবুঝ বাবলু প্রশান্তি খুঁজে বেড়ায় ওই ফুটফুটে সকালে। তবে সাপ্তাহিক ছুটির দিনে বিকেল বেলা মিলিত হয় দুজনই। ঘুরে বেড়ায় শহরের এক প্রান্ত থেকে আরেক প্রান্তে। কখনো প্রকা- বৃক্ষ শাখার সুনির্মল ছায়াতলে, কখনোবা কোলাহলময় আড়ম্বর আবহে।
তিন বছর হলো বাবাকে হারিয়েছে বাবলু। সেই সাথে হারিয়েছে চিরচেনা প্রকৃতি, লালিত স্বপ্ন ও কল্পিত পৃথিবী। গৃহস্থ ছিলেন ওর বাবা। গ্রামের মধ্যে সচ্ছল হিসেবে পরিচিতি ছিল ওদের পরিবারটি। এক হাড়িতেই খেতেন সবাই। জীবিত অবস্থায় দাদার আদরের কথা ভুলতে পারে না বাবলু, ¯েœহের আবেশটুকু অনুভব করে এখনও। সুখের নির্মোহ প্রতীক হিসেবেই বিবেচিত হতো ওদের পরিবারটি। কিন্তু ব্রহ্মপুত্রের করাল গ্রাস সেই সুখটিকে ছিঁড়ে টুকরো টুকরো করেছিল। তিন চাচাই যার যার মতো করে খুঁজে নিয়েছিলেন নতুন আশ্রয়। দারিদ্র্যের যাতনা সহ্য করা অসহনীয় হয়ে পড়েছিল ওর বাবার। আর এর পরিসমাপ্তি ঘটেছিল মৃত্যুর মধ্য দিয়ে। স্বামীর আকস্মিক বিদায়ে বাচ্চাদের নিয়ে অথই সাগরে পড়েছিলেন বাবলুর মা। কঠোর পরিশ্রমে সংসারের হাল ধরেছিলেন দীর্ঘদিন। চেষ্টা করেছিলেন ছেলেকে পড়াবার। কিন্তু পারেন নি। বয়স পয়তাল্লিশ উত্তীর্ণ না হলেও সাংসারিক জটিলতায় শরীরের চামড়া ঝুলে পড়েছে। চওড়া কপালের ভাজগুলিও দীর্ঘায়িত হয়েছে। পুরো মাথাজুড়ে একটি কালো চুলও খুঁজে পাওয়া যাবে না। চোয়ালের দু’পাশ গর্তের আকার ধারণ করেছে। থুতনিসহ উভয় গ-দেশের ভাজগুলি স্পষ্ট হয়েছে। চোখ দুটি কোটরে ঢুকে গেছে। চোখের দিকে তাকালেই সীমাবদ্ধতা ও অসহায়ত্বের চাহনিটি সহজেই উপলব্ধ হয়। আগের মতো আর গায়ে শক্তি অনুভব করেন না। একটি বাড়ীতে কাজ করলেই হাঁপিয়ে ওঠেন। তাই বাধ্য হয়েই কাজে পাঠিয়েছিলেন বাবলুকে।
পরিস্থিতি বিবেচনায় শহরে এসেছে বাবলু। এসেই পরিচিত হয়েছে অপরিচিত বাস্তবতার সঙ্গে। সকাল থেকে রাত অবধি সীমাহীন শ্রমের ভারে নুয়ে পড়তে হয় ভেঙে পড়া ডালের মতো। মুক্তির অনির্বার আবেদন বিচলিত করে ওকে। বন্ধুত্ব গড়তে চায় প্রকৃতির সাথে। দুধকুমরের ঢেউ, পালতোলা নৌকো, বিলের পানিতে ভাসমান হালকা নীল রংয়ের কচুরি পানার ফুল, স্কুল মাঠ, প্রকা- বটবৃক্ষ হৃদয়তন্ত্রীতে বেদনার সুর তোলে ওর। কোমল বিহঙ্গের মতো ডানা মেলে হারিয়ে যেতে চায় হারানো শৈশবে। সীমাবদ্ধতার সকল প্রাচীর ভেঙ্গে ছুটতে চায়, ছুটতে চায় গ্রাম থেকে গ্রামান্তরে। ডালের বড়া, টাকি মাছের ভর্তা আর মায়ের আদর গভীরতা ভরা আহ্বান জানায় ওকে। কিন্তু বাস্তবতার নিকষ আঁধারে আবেগের পাপড়িগুলি মলিন হতে হতে এক সময় ঝরে পড়ে। মিশে যায় মাটির সাথে। ‘বাবা, মন দিয়ে কাজ করবি।’ মায়ের এই আকুতিটি ধনুকের তীক্ষè তীরের মতো বিদ্ধ করে ওকে। মুহূর্তেই মানসপটে চিত্রিত হয় পরিবারের ভঙ্গুর চিত্রটি। মুখ থুবড়ে পড়ে ওর সুবর্ণ অতীত। পড়বার সাথে সাথেই যেন আরো দ্বিগুণ শক্তি নিয়ে প্রত্যয়ী হয়ে ওঠে বাবলু। ধৈর্যের প্রাচীর হয়ে হৃদয়ে সঞ্চিত কষ্টপুঞ্জ সঙ্গে নিয়ে অশ্বারোহীর মতো এগিয়ে চলে লক্ষ্যের দিকে। বেতনের পরিমাণ খুব বেশি নয়। সব মিলিয়ে পনেরশ টাকা। সামান্য কিছু রেখে পুরোটাই দেয় মাকে। মাসের ঠিক প্রথম শুক্রবার। বৃহস্পতিবার রাতের ট্রেনেই যাত্রা করে বাড়ীতে। ফিরে আসতে হয় শনিবার সকালেই।
বর্তমানে গ্রামের একটি ধর্নাঢ্য পরিবারে কাজ করছেন বাবলুর মা। গ্রামটির নাম স্রােতস্বিনী। এই গ্রামের অধিকাংশ পরিবারই বন্যায় ক্ষতিগ্রস্থ। সর্বোচ্চ শ্রান্ত পরিবারগুলো কোনোরকমে ঠাঁই নিয়েছে উপজেলা নির্মিত বাঁধে। টিনের চালা আর চতুর্দিকে বাঁশের বেড়া দিয়ে একটি ঘর বানিয়েছেন বাবলুর মা। সেখানেই থাকেন মেয়েকে নিয়ে। ছোট বোন বিজলীর পড়াশুনার ব্যাপারে অত্যন্ত আন্তরিক বাবলু। প্রতি মাসেই বোনের জন্যে প্রয়োজনীয় জিনিসপত্র সঙ্গে নিয়ে যায়। স্রোতস্বিনী প্রাথমিক বিদ্যালয় থেকে পি.এস.সি পাশ করেছে এবার। ভর্তি হয়েছে স্রোতস্বিনী আদর্শ স্কুলে। দুধকুমর নদীর কিছুটা চড়াতে অবস্থিত স্কুলটি। প্রতি বছরই ভয়াল বন্যার মুখোমুখি হতে হয়। এ পর্যন্ত চারবার পরিবর্তিত হয়েছে স্কুলটির অবস্থান। স্থায়ী সমাধানের পরিবর্তে ত্রাণ নির্ভরতাই গ্রামটির পিছিয়ে পড়ার মূল কারণ। এখনও স্কুলের পোশাক তৈরী করা হয় নি বিজলীর। এ মাসেই বাড়ী যাওয়ার পূর্বে তৈরী করতে হবে-ভেবে রেখেছে বাবলু।
দুই
সূর্যের ঘুম ভাঙবার পূর্বেই আজ ঘুম ভেঙেছে বাবলুর। চোখ মেলে শুয়ে আছে বিছানায়। মশারির বিভিন্ন প্রান্তের সেলাই করা ছেঁড়া অংশগুলি অনায়াসেই দৃষ্টিগোচর হচ্ছে ওর। পাশে শুয়ে অনবরত নাক ডেকে চলেছে সহকর্মীরা। দীর্ঘসময় ঘুমোবার ইচ্ছে জাগলেও পূরণ হয় না কারুরই। গভীর রাত অবধি কাজ করে আবার সকাল দশটার মধ্যেই দোকানে বসতে হয়। এক মশারীর নিচে ঘুমোয় তিনজন। বয়সে সবাই বাবলুর বড়। একদম বা প্রান্ত ঘেষে শুয়ে আছে ও। বেশ কিছুক্ষণ শুয়ে থাকবার পর উঠে বসলো। দু’হাত দিয়ে চোখ দুটি রগড়ালো। ডান হাত দিয়ে মশারীর এক প্রান্তের নিম্নাংশ টেনে নিয়ে বাম হাতে খানিকটা উপরে তুলে বের হয়ে আসলো। রুমটি অত্যন্ত সংকীর্ণ। মশারি টানানো অবস্থায় স্বাভাবিকভাবে চলাচল করা যায় না। শব্দ না করে সবুজ টি-শার্টটি পড়ে নিলো বাবলু। ভীষণ উচ্ছ্বসিত আজ ও। গুরুত্বপূর্ণ খেলা রয়েছে। অনুষ্ঠিত হবে ভিন্ন দুটি টিমের মধ্যে। জেলা স্কুল মাঠেই। সকাল ন’টার মধ্যে শেষ হবে বিধায় আগ্রহ ছিল ওর। বাবলুর খেলার মান নিয়ে অবগত সবাই। তাই রাহী যখন বাবলুকে খেলানোর সুপারিশ করেছিল অবলীলায় রাজী হয়েছিল দলনায়ক। নতুন পাতা টিমের হয়ে খেলবে ও। রাস্তায় আসতেই আনন্দের ঢেউ বইতে থাকলো ওর অন্তর্জগতে। হলুদ রঙের স্পোর্টস ড্রেস পড়ে দাঁড়িয়ে ছিলো রাহী। ‘ওকে নিতে আসছে।’ বুঝতে পারলো বাবলু। নিবিড়ভাবে জড়িয়ে ধরলো দুজন দুজনকে। সাদা শাপলার মতো হাসি ঝরলো দ্জুনারই মুখ থেকে। ঘড়ির কাঁটা সাতটার দিকে এগিয়ে চলেছে। দ্রুততার সাথে হাঁটতে থাকলো ওরা মাঠের দিকে।
খেলায় ভালো করতে পারলে আকর্ষণীয় পুরস্কার প্রদান করা হবে। এটি আগে থেকেই জানতো বাবলু। এক ধরনের প্রচ্ছন্ন ভালোলাগা কাজ করতে থাকলো ওর হৃদয়ে। মূল একাদশে সুযোগ পায় নি রাহী। বিন্দুমাত্র আক্ষেপ না করে বাবলুকে অনুপ্রেরণা প্রদানের কাজটি করে চলেছে। ইতোমধ্যে ম্যাচ পরিচালনার যাবতীয় প্রক্রিয়া সম্পন্ন হয়েছে। স্কুল মাঠটির বর্ণিল সাজ দেখে অবাক হলো সবাই। বুঝতে পারলো আজ থেকে শুরু হবে বাণিজ্য মেলা। স্কুলে স্কুলে বইমেলা না হলেও বাণিজ্য মেলার ধারাবাহিকতাটি অক্ষুণœ রয়েছে। ঢাকা থেকে সরকারের একজন প্রতিনিধি আসবেন। তাই এত আয়োজন। মাঠের এই নান্দনিক সজ্জা মুহূর্তেই একটি বিশেষ মাত্রা যোগ করলো সবার মাঝে। খেলার জন্য উন্মুখ হলো সবাই। বল হাতে মাঠের দক্ষিণ প্রান্তে প্রস্তুত বোলার। প্রস্তুত উভয় প্রান্তের ব্যাটসম্যানও। আম্পায়ার দু’হাত ইশারা করে নির্দেশ দিলেন বল করার। শুরু হলো ব্যাট বলের শৈল্পিক লড়াই। কুড়ি ওভারের খেলা। ওপেনিংয়ে ব্যাট করছে বাবলু। অত্যন্ত সাবধানে খেলছে প্রতিটি বল। মাঠে দর্শক নেই বললেই চলে। ব্যায়াম করতে আসা কিছু দর্শক বসে রয়েছেন। খেলা দেখছেন নাকি বিশ্রাম নিচ্ছেন বোঝা যাচ্ছে না। বন্ধুর অবিরাম অনুপ্রেরণা ও আত্মবিশ্বাসের দৃপ্ত ডানায় চড়ে অসাধারণ ব্যাটিং করছে বাবলু। পঞ্চাশ রানের কোটা পেরিয়েছে। রাহীসহ দলের সবাই উপভোগ করছে ওর ব্যাটিং। ‘গ্রেট ব্যাটিং বাবলু গ্রেট ব্যাটিং, নট আউট থেকে বের হয়ে আসবে।’ রাহীসহ কয়েকজন বাইরে থেকে করতালির সাথে চিৎকার করে বলতে থাকলো। তাদের এই চিৎকৃত ধ্বনিতে প্রাণিত হলো বাবলু। হাঁপিয়ে ওঠা সত্ত্বেও বোলাররা হন্যে হয়ে চেষ্টা করছে বাবলুর উইকেটটি নেয়ার। একের পর এক পরিকল্পনা গ্রহণ করছেন দলনায়ক। কিন্তু সময়ের সাথে সাথে বাবলুর ব্যাটিং শৈলীর সৌকর্য বৃদ্ধি পেয়েই চলেছে। এ্রই মাঝে হঠাৎ সবাই থমকে দাঁড়ালো। আকস্মিকভাবে ওয়ার্ড কাউন্সিলরসহ মাস্তান গোছের দুজন নেতাকে দেখে বিরক্ত হলো। শীর্ণ গড়নের টানা গোঁফের অধিকারী কাউন্সিলর দ্রুত খেলা বন্ধের নির্দেশ দিলেন। তার কথাকে সমর্থন জানিয়ে নেতারাও ঈঙ্গিত দিলো। ‘আঙ্কেল, আমরা তো কোনো সমস্যা করছি না, আর সাবধানেই খেলছি।’ কাউন্সিলরের কথার প্রত্যুত্তরে কয়েকজন প্রতিবাদ করলে রেগে গিয়ে নেতা দুজনকে স্ট্যাম্প উপড়ে ফেলতে বললেন। ধবধবে ফর্সা মুখটি উত্তেজনায় টকটকে লাল হয়ে গেল কাউন্সিলরের। ‘তোমরা তো মনে হয় আমারই এলাকার।’ ডান হাতের তর্জনী দেখিয়ে কয়েকজনকে বললে দ্বিতীয়বারের মতো একটি শব্দও উচ্চারণ করলো না কেউ। অবস্থা নেতিবাচক দেখে তাকে সরি বলে নিজেরাই স্ট্যাম্প তুলে নিলো। বেশ কিছুক্ষণ চিন্তার পর পাশেই পুলিশ লাইনের একটি অব্যবহৃত ফাঁকা মাঠে খেলার সিদ্ধান্ত নিলো। এবং যাত্রা করলো সেদিকেই।
স্বল্প সময়ের মাঝেই আবারও খেলা শুরু হলো। কিছুক্ষণ পূর্বে ঘটে যাওয়া অনাকাক্সিক্ষত পরিস্থিতিটিও হারিয়ে গেল। অপরাজিত থেকে ব্যাটিং শেষ করলো বাবলু। সময় সংকীর্ণতার কারণে বিশ্রাম নেবার সুযোগ পেল না কোনো দলই। ১৩৮ রানের লক্ষ্য তাড়া করতে ব্যাটিংয়ে নামলো বিপক্ষ দল। ওদের ব্যাটিং শেষ হতে হতে দশটা পেরিয়ে গেল। ২৯ রানের ব্যবধানে জয় পেল বাবলুর দল। সেরা খেলোয়াড়ও নির্বাচিত হলো বাবলু। উল্লাসে ফেটে পড়লো নতুন পাতার সকল ক্রিকেটার। কিন্তু, বাবলুর শরীরী ভাষায় জয়ের চিহ্নটি পুরোপুরি অনুপস্থিত। প্রায় এক ঘণ্টার অপ্রত্যাশিত বিরতি। দোকানে উপস্থিত হবার নির্ধারিত সময় পেরিয়ে গেছে। চিন্তার গভীরতায় চুপসে গেছে ওর মুখখানি। দোকান মালিকের কথা স্মরণ করতেই শিউরে উঠছে। উদগ্রীব হচ্ছে দোকানে যাবার। খেলার কারণে পূর্বেও একবার দেরী হয়েছিল। সেবার ক্ষমা করেছিলেন মালিক। এবার যে কী হবে- ভাবতেই বিষিয়ে উঠলো ওর সমস্ত শরীর। চলে যাবার জন্যে তাড়া দিতে থাকলো রাহীকে।
‘যাবি তো, কিন্তু পুরস্কারটা অন্তত নিয়ে যা।’ সর্বোচ্চ অনুরোধের সুরটি বেজে উঠলো রাহীর গলায়।
‘আমার হয়ে তুইই পুরস্কারটা গ্রহণ করিস, কাল তো দেখা হচ্ছেই।’ কাতর স্বরে বলেই দ্রুত হাঁটতে শুরু করলো বাবলু।
‘কাল কিন্তু শুক্রবার, মনে আছে।’ উচ্ছ্বাসের অনুভূতি নিয়েই হাত উঁচিয়ে দূর থেকে জানালো রাহী।

হাত ইশারা করে আসবার কথা জানিয়ে আবারও দ্রুত হাঁটতে থাকলো বাবলু। হাঁটতে হাঁটতেই গলায় জমে থাকা ঘামগুলি মুছে ফেললো। বাবলুর হয়ে পুরস্কারটি গ্রহণ করলো রাহী। পুরস্কার গ্রহণের সময় মনে পড়লো বাবলুকে। ‘ইস! ও থাকলে কতইনা মজা হতো।’ অবলীলায় ভাবতে থাকলো। পুরস্কারটি গ্রহণের পর রাহীও হাঁটতে থাকলো বাসার দিকে। স্বল্প সময়ে পৌঁছেও গেল। চাকরিজীবী বাবা মায়ের একমাত্র সন্তান রাহী। দু’জনই চাকরি করেন সোনালী ব্যাংকে। একই ব্রাঞ্চে। পরিবারে নেই কোনো আর্থিক সংকট। তবুও সাদামাটা জীবনযাপনে অভ্যস্ত তারা। বাবামায়ের আদর্শটিই রাহীর ভেতর অন্তরিত। মহাস্থান জেলা স্কুলের সেকেন্ড বয় ও। কিন্তু নেই বিন্দুমাত্র অহংকার। আচরণের মুগ্ধতা ছড়িয়ে প্রিয়ভাজন হয়েছে পরিবার, প্রতিবেশী ও বন্ধুদের। পড়াশুনা ভালো লাগে এ কথাটি বাবলুর মুখ থেকে শুনবার পরই তাকে উপহার দিয়েছিল কিছু বই। বিষয়টি বাবা মায়ের কাছে প্রকাশও করেছিল। সন্তানের ওপর আস্থা থাকায় এ নিয়ে চিন্তিত হন নি তারা। বরং বাবলুকে একদিন বাসায় নিয়ে আসতে বলেছিলেন। বাবামায়ের এই আমন্ত্রণে খুশিতে সূর্যমুখীর অনাবৃত পাপড়ির মতো হলুদ হয়েছিল রাহীর দুটি ঠোঁট। নাস্তা সেরে স্কুলের জন্য প্রস্তুত হলো। জুঁই ফুলের মধ্যে কাজ করা সাদা-কালো রঙের তাঁতের শাড়ী পড়া অবস্থায় দরজায় দাঁড়িয়ে আছেন ওর মা। খুব বেশী স্থুল নয় আবার শীর্ণও নয়। মাঝারি ধরনের। উচ্চতায় মাঝামাঝি। দরজা পার হবে এমন সময় মায়ের কাছে এসে আবদারের সুরে বললো রাহী-
‘কাল সকালের কথা মনে আছে তো আম্মু, ওই যে আমার বন্ধু, বাবলু।’
‘পাগল ছেলে আমার, মনে থাকবে না কেন? খুব মনে আছে। দেরী করলি কেন বাবা!’ অনবরত ছেলের মাথায় হাত বুলাতে থাকলেন মা। মায়ের প্রাণিত আশ্বাসে আকাশের তারার মতো জ্বলে উঠলো রাহীর বাদামী রঙের কোমল মুখখানি। হৃদসরোবরে প্রক্ষিপ্ত তৃপ্তির ঢেউ নিয়ে রওয়ানা হলো স্কুলে। ইতোমধ্যে অফিসে গিয়েছেন রাহীর বাবা। ছেলেকে বিদায় জানিয়ে যাত্রা করলেন রাহীর মাও।
তিন
এখনো পৌঁছায় নি বাবলু। বাধ্য হয়েই রিকশায় উঠেছে। দ্রুতগতিতে এগিয়ে চলেছে রিকশা। তবুও বেড়েই চলেছে ওর ছটফটানি। সাড়ে দশটা পেরিয়েছে। দোকান মালিকের রুদ্রমূর্তির কথা ভাবতেই বুকের ভেতর একটি তীব্র জ্বলুনি অনুভব করলো। ‘চাকরিটা বোধহয় আর থাকলো না!’ এমন দুশ্চিন্তা ছড়িয়ে পড়লো ওর মস্তিস্কের প্রতিটি কোষে। হাপরের মতো ওঠানামা করতে থাকলো শ্বাস-প্রশ্বাস। দোকানে এসেই চারদিকটা দেখে নিলো। দেয়ালের গা ঘেষে সেলফগুলিতে থরে থরে সাজানো রয়েছে বিভিন্ন ডিজাইনের কাপড়। ক্রেতাদের সমাগম সামান্য। সকালবেলা সাধারণত তাই হয়ে থাকে। একজন কর্মচারী নিজের গায়ে শাড়ী জড়িয়ে ক্রেতাকে দেখাচ্ছে। ওর দিকে কেউ খুব একটা আগ্রহ নিয়ে তাকালো না। কাতর মুখখানি ফ্যাকাশে হয়ে এলো। নাস্তার কথা ভুলেই গেল। অত্যন্ত সাবধানী হয়ে নির্ধারিত আসনটিতে বসলো। মনোযোগ দিয়ে কাজও শুরু করলো। কাজ করতে করতে দুপুর গড়িয়ে বিকেল হয়ে এলো। ‘এই বুঝি মালিকের ডাক পড়লো।’ সমুদ্রের উত্তাল ঢেউয়ের মতো বিষয়টি ওর ভাবনার চরাচরে তোলপাড় সৃষ্টি করতে থাকলো। কিন্তু সব ভাবনার যোগ বিয়োগের সমীকরণ বাস্তবে মিললো না। ‘যাক বাবা, এবারের মতোও বুঝি রক্ষা পেলাম, আর জীবনেও খেলবো না।’ মনের গহীনে কাক্সিক্ষত স্বস্তি অনুভব করলেও ক্ষুধার জ্বালায় পেট যে আসমানে উঠেছে সেটি এতক্ষণে বুঝতে পারলো। রুমে গিয়ে দুপুরের ঠা-া হয়ে যাওয়া খাবারটি খেয়ে নিলো। স্বল্প সময়ে খেয়েই নির্ধারিত স্থানে এসে আবারও বসলো। মনে করতে থাকলো ছোট বোন ও মায়ের কথা। বেতন তুলেই বিজলীর জন্য জামার কাপড় কিনে বানাতে দেবে- স্মরণে আসতেই বুকের ভেতর একটি তৃপ্ততার বোধ অনুভব করলো। সীমাহীন সীমাবদ্ধতার মাঝেও শিক্ষা গ্রহণের বিষয়টি সম্পৃক্ত থাকলে মুক্তির উপাদান খুঁজে পাওয়া সম্ভব। হয়ত বিষয়টি এই অল্প বয়সেই অনুধাবন করতে সক্ষম হয়েছে বাবলু। যদিও এই বয়সে সেটি হবার কথা নয়। তাই বিজলীকে পড়াশুনার ব্যাপারে সহায়তা করে আসছে। ‘বাবলু, বাবলু, এই বাবলু, তোকে মালিক ডাকছে।’ এই ভাবনার মাঝেই শুনতে পেল ও। শুনবার সাথে সাথে আঁতকে উঠে চরমভাবে আতঙ্কিত হয়ে উঠলো। হাত পাগুলিও যেন শিথিল হতে থাকলো, একটি নির্দয় হাত এসে ওর কচি ঘাড়টি ধরে ধাক্কা দিয়ে বের করে দিলো ওকে- মনের পর্দায় দেখতে পেল। ‘কেন ডাকছে।’ এতটুকু বলারও সাহস পেলো না।
অতঃপর মালিকের গদিতে যাবার জন্য উঠে দাঁড়ালো। সবাই ওর দিকে তাকিয়ে রইলো। খারাপ কিছু ঘটতে পারে। অনুমান করলো সবাই। ‘যা দেখা করে আয়, কিচ্ছু হবে না।’ বলেই একজন কর্মচারী এসে পিঠে হাত বুলিয়ে সান্ত¦না জানালো। ধীরলয়ে এক একটি সিঁড়ি ভেঙে উপরের দিকে উঠতে থাকলো বাবলু। ওর ভেতরের পৃথিবীটা শূন্য মরুভূমির মতো খাঁ খাঁ করছে। ওর এমন মনোভাব বুঝতে পেরে পায়ের নিচের সিঁড়িগুলিও আর্তনাদ শুরু করলো। গদিতে বসেই ছিলেন মালিক। মাথা নিচু করে মালিকের সামনে দাঁড়িয়ে রইলো বাবলু। দৈত্যের মতো কালো স্থুলকায় চেহারার মালিকের দিকে তাকাতে সাহস পেল না। পাশেই বসে ছিলেন ম্যানেজার। উজ্জ্বল নীল রঙের লুঙ্গির সাথে পড়েছেন সাদা পাঞ্জাবী। সরু গোঁফের ধবধবে ফর্সা ম্যানেজারকে আড় চোখে একবার দেখে নিলো বাবলু। শান্ত স্বভাবের ম্যানেজার কানে কানে কিছু একটা বোঝাতে চাচ্ছেন মালিককে, বুঝতে পারলো ও। এবার আশা নিয়ে তাকালো মালিকের দিকে। কিন্তু কোনো পরিবর্তনই লক্ষ করতে পারলো না তার দৃষ্টির অতলান্তে।
‘ম্যানেজার, বাবলু তো এর আগেও এমন করেছিল। আমি সিদ্ধান্তও নিয়েছিলাম, কিন্তু আপনার অনুরোধেই ও গতকাল পর্যন্ত দায়িত্বে ছিল। তাই নয় কি?’ মালিকের এ কথাটি শেষে কী যেন বলবার উপক্রম করছিলেন ম্যানেজার। বিষয়টি লক্ষ করে ম্যানেজারকে থামিয়ে দিয়ে তিনি সরাসরি আদেশ করলেন, ‘আশা করি আজ আর আপনি কোনো সুপারিশ করবেন না। সাতদিনের বেতন কেটে নিয়ে ওকে দায়িত্ব থেকে অব্যাহতি দিন।’ ক্ষুধার্ত বাঘের গর্জনের রূপ ধারণ করলো মালিকের কণ্ঠস্বরটি। স্ফীত হলো তার গলার শিরাগুলি। পুনরায় অনুরোধের সাহস পেলেন না ম্যানেজার। হরিণের মতো অসহায়ত্বের দৃষ্টি নিয়ে তাকিয়ে রইলেন বাবলুর দিকে। নিস্তেজ দাঁড়িয়েই আছে বাবলু। বিন্দু বিন্দু ঘামে জমে গেছে কপাল। শরীর থেকে মাংসগুলি আলাদা হয়ে যাচ্ছে-মনে হচ্ছে ওর। ম্যানেজারের হাতের ইশারায় নেমে এলো নিচে।
এরই মাঝে বাবলুর সমস্ত কাপড়চোপড় কক্ষ থেকে নিয়ে এসে দরজার পাশে রাখা হয়েছে। নিচে এসে রাখা কাপড়ের সেই ছোট্ট ব্যাগটি দেখে স্তম্ভিত হলো বাবলু। ঠোঁট দুটি ফাঁক হয়ে ্এলো দ্রুতই। মানুষ এতটা নির্দয় হতে পারে জানা ছিল না ওর। ব্যাগটি যাচাই না করেই হাতে নিলো। আর এক মুহূর্ত অপেক্ষার প্রয়োজন মনে করলো না। ন’টা বাজতে এখনও মিনিট বিশেক বাকী। ট্রেন ধরবার জন্য প্রস্তুত হলো। দোকান ত্যাগ করতেই কলজেটি যেন ছিড়ে গেলো-অনুভব করলো ও। ইস্পাতের মতো কঠিন হয়ে হনহন করে হাঁটতে থাকলো ফুলতলা স্টেশনের দিকে। নিয়ন আলোয় মোড়ানো ঝলমলে শহরের কোনো সৌন্দর্যই আকৃষ্ট করতে পারলো না ওর দৃষ্টিকে। বরং দু’চোখ বেয়ে প্রবল বেগে অশ্রু ঝরতে চাইলো। নানা বয়সী মানুষের উন্নত জীবন যাপনের চিত্রগুলি দেখে ক্ষুব্ধও হলো। হেঁটে হেঁটেই চলে আসলো স্টেশনে। সামান্য কিছু লোক দাঁড়িয়ে রয়েছে। বাবলুও তাদের কাছাকাছি এলো। অপেক্ষা করতে থাকলো রাজবিহার লোকাল ট্রেনটির। অপেক্ষার এক পর্যায়ে বিরক্তি বোধ করলো। উপায় না দেখে প্ল্যাটফর্মের পাশে পত্রিকার দোকানটির সামনে দাঁড়ালো। দোকানটি একদম ফাঁকা। বিষণœতা ভরা দৃষ্টি দিয়ে দেখতে থাকলো বিভিন্ন ধরনের পত্রিকা। কোমল গড়নের প্রশান্ত ভাব বিশিষ্ট মধ্যবয়সী দোকান মালিক দৃষ্টি ফেললেন বাবলুর দিকে। তার তাকানোর ভঙ্গিতে একটি মাধুর্য লক্ষ করা গেলো। সামান্য দূরত্বে থেকে আন্তরিকতার সাথে জিজ্ঞেস করলেন, ‘ কী ভাইয়া একা কেন, কোনো সমস্যা?’ কোনো উত্তর প্রদান না করলে বাবলুর আরও কাছাকাছি আসলেন তিনি। বাঁ হাতের লম্বা নখগুলি দিয়ে চুলের ¯িœগ্ধ তলদেশ স্পর্শ করলেন। কিছুক্ষণ মাথায় হাত বুলিয়ে বাবলুর বাঁ কাঁধে হাতটি রাখলেন। এবং ডান হাতটি দিয়ে ডান হাতের পেশীবহুল অংশটি ধরলেন। বাবলুর চোখের উপর চোখ রাখলেন মমত্বভরা দৃষ্টি নিয়ে। সান্ত¦নার স্বরটি বেরিয়ে এলো তার কণ্ঠ থেকে।‘বাবামায়ের সাথে অভিমান হয়েছে বুঝি!’ আমাকে খুলে বলতে পারো। এমন অহরহ ঘটছে স্টেশনে। তোমার যেন কোনো ক্ষতি না হয় সেটিই চাইবো আমি। বিশ্বাস করতে পারো আমাকে। ট্রেন আসতে এখনো অনেক দেরী।’ দোকান মালিকের দৃপ্ততাভরা কণ্ঠস্বরটি শুনে মনে হলো আবৃত্তি চর্চার অভ্যোস থাকতে পারে। তার কথাগুলিতে আশ্বস্ত হয়ে এবার তাকে সব কিছু খুলে বললো বাবলু। ‘ও এই সমস্যা, চিন্তা করো না, সব ঠিক হয়ে যাবে। আর আমার মনে হয় তোমার গ্রামের বাড়ীতে না যাওয়াই ভালো। এখানে থাকলে একটা না একটা কিছু করতে পারবে, সত্যি বলছি।’ রূপোর মতো চকচক করে পরামর্শগুলি বের হতে থাকলো তার চিন্তার গহ্বর থেকে। ‘কত লোক কাজ না পেয়ে স্টেশনেই রাত কাটাচ্ছে, আবার কাজ পেলেই স্টেশন ত্যাগ করছে। সবাই তো আর সোনার চামুচ নিয়ে জন্মায় না, একটু কষ্ট এই আর কী!’ এবার কণ্ঠস্বরটি ভারী হয়ে এলো তার। ‘তো কালকে দেখা হচ্ছে নিশ্চয়ই।’ বাবলুকে শুভ কামনা জানিয়ে দোকানের ঝাঁপি বন্ধ করে ত্যাগ করলেন স্টেশন। এই মুহূর্তে এই মানুষটিকেই কেন জানি বড় আপন মনে হলো বাবুলর। তার স্টেশন ত্যাগের দৃশ্যটি পেছন থেকে দেখতে থাকলো অনুসন্ধিৎসু আবেদন নিয়ে।
আবারও পুরো স্টেশনটি পায়চারি করতে থাকলো বাবলু। দোকান মালিকের কথাগুলি অমোঘ প্রভাব ফেলতে শুরু করলো ওর কাঁচা হৃদয়ে। শীতের কারণে কুয়াশার পরিমাণ বৃদ্ধি পেয়েছে। শিরশিরে বাতাস ঠা-ার মাত্রাটিকে বাড়িয়ে দিচ্ছে। ব্যাগ থেকে ধূসর হয়ে আসা কালো রঙের পুরোনো জ্যাকেটটি বের করে গায়ে দিলো। অনেক কষ্টে মরচে পড়া সোনালি চেনটি লাগিয়ে বুকের ভেতর প্রবেশ করতে থাকা বাতাসের গতি রোধ করলো। স্টেশনে শুয়ে থাকা লোকগুলি ঠা-ার প্রকোপ থেকে বাঁচতে যথাসাথ্য চেষ্টা করছে। প্ল্যাটফর্ম থেকে সামান্য দূরত্বের সারি সারি বৃক্ষগুলিও সেই ঠা-ায় জড়িয়ে যাচ্ছে। তাদের মাথার উপরে থালার মতো চাঁদখানিও হাসতে পারছে না তাদের এই কষ্টকে প্রত্যক্ষ করে। জীর্ণ কোম্বল গায়ে শুয়ে থাকা লোকগুলিকে দেখে দাঁড়ালো বাবলু। সামান্য দূরত্ব বজায় রেখে দেখতেই থাকলো। এরই মাঝে ট্রেনের হুইসেলটি বেজে উঠলো। হুইসেলের কর্কশ শব্দ শুনে দ্রুত ট্রেনটির কাছাকাছি আসলো। ভীড় কম থাকায় সহজেই উঠলো ইঞ্জিনের পাশের বগিটিতে। বসলো জানালার পাশের একটি আসনে। ভাবতে থাকলো বাড়ীর কথা। ছোট বোন ও মায়ের মুখখানি আপনাআপনি ভেসে উঠলো ওর ভাবনার আরশিতে। কিন্তু পুলকিত হবার পরিবর্তে নানা ভাবনায় আচ্ছন্ন হলো। পারিবারিক সমস্যাগুলি এক এক করে ওর মস্তিষ্কে সক্রিয় হতে থাকলো। জানালা দিয়ে নিঃসীম আকাশ আর আবছা সবুজাভ প্রকৃতির দিকে তাকিয়ে থাকতে থাকতে এবার ওর চোখদুটি অশ্রুসিক্ত হয়ে উঠলো। একবার ডান হাত দিয়ে চোখের পানি মুছে আবার অনিমেষ নীলিমার দিকে তাকিয়েই থাকলো। ওর ভেতর স্বপ্ন পূরণ করে বেঁচে থাকবার আকুল আকুতির তোলপাড় যা কেউ কোনোদিন দেখবে না, বুঝতেও পারবে না। কিন্তু এই স্বপ্নটিই কবুতরের মতো পাখা মেলে উড়ে যাবে ঊর্ধ্ব গগনে-মানতে পারছে না ও। এখনও দাঁড়িয়ে আছে ট্রেনটি। ব্যাগটির দিকে তাকাতেই হুইসেল বেজে উঠলো। চলতে শুরু করলো ধীর গতিতে। এবার উঠে দাঁড়ালো বাবলু। গলগল করে বের হয়ে আসা ধোঁয়াগুলি দেখে বাঁ হাত দিয়ে মুখ ও নাকটি ঢাকলো। ডান হাতে ব্যাগটি নিয়ে দ্রুত দরজার কাছে এলো। ঝনঝন করা শব্দের মাঝেই ঝুঁকি নিয়ে নামলো বগি থেকে। ধীরে ধীরে প্ল্যাটফর্ম অতিক্রম করলো ট্রেনটি। উদাস দৃষ্টি নিয়ে ট্রেনটির দিকে তাকিয়ে থাকলো বাবলু। অবচেতনাতেই বাঁ চোখ বেয়ে এক ফোঁটা স্বচ্ছ জল ঝরে পড়লো ওর।

– মনজুরুল ইসলাম

চলতি সংখ্যা