মা, মম, মাম্মী এবং সানজিদা

অধিকাংশ আমরা  মা কে মা বলি। কেউ বলে আম্মা কিংবা আম্মু। বড়লোকেরা ডাকে আম্মী, মম কিংবা খুব আধুনিক হলে মাম্মী। ওরা ডাকে সানজিদা। ওরা পশ্চিম ডাকাতিয়া থানার তারাকান্দা গ্রামের আলমাস উদ্দিন ভূঁইয়ার মরহুমা স্ত্রী উম্মে কুলসুমের দুই ছেলে খালেক আর মালেক। তারাকান্দা গ্রামের বাজার হয়ে একটু ডানে মোড় নিয়ে শিমুলপুর ইউনিয়নে যাওয়ার যে রাস্তা তার বিপরীতে ফোরকানিয়া এতিমখানা সংলগ্ন মাঠে আট নয়  বছর বয়সী যেসব দুষ্ট ছেলেরা ডাংগুলি খেলে তাদের কাছে ওরা হলো খালিক্কা মালিক্কা। কবিতার মতো করে বললে, খালেক মালেক দুই ভাই তাদের কোন আপদ নাই। খালেক বলে হ্যালো, মালেক বলে ঠেলো। বাচ্চারা তারপর অট্টহাসিতে মাখামাখি করে। এদের মধ্যে সিফাত নামের একটা ছেলে দুষ্টু দলের শিরোমণি। নাক মুখ চোখের গড়ন এমন যে, দেখলেই দুষ্টু চেনা যায়। আমরা বিনয়ের সাথে বললাম ভাইয়া তুমি খালেক মালেকদের দেখেছ? হ দেখছি। কোথায়? সিফাত দুই হাত দিয়ে চোখের পাতা মেলে ধরে চোখে ইশারা দিয়ে বলল ওথায়। তারপর হো হো করে হেসে দেয়। আমরা কিঞ্চিত অপমান বোধ করি যখন দেখলাম আশেপাশের বাচ্চারাও ইয়ার্কি করতে থাকলো কবিতার মতো করে।

“আকাশের আব মাটির দুল, আব্দুল
মা কয় খা, বাপে কয় লেক, খালেক
আব্দুল খালেক”।

এরপর ওরা আবারো হো হো করে হাসতে লাগলো। আমরা ভাবলাম উদ্দেশ্য অসফল হলো বুঝি। তাই আবশ্যক স্থান ত্যাগ করলাম কিন্তু থেমে গেলাম না। সানজিদা খালা বলছে তার দুছেলেকে যেখান থেকেই হোক তুলে নিয়ে আসতে হবে। সারাদিন ধরে তারা বাসায় ফিরে নি। ঐ দিকে আজ বিকেল থেকে ঘরের চালার উপর একটা কাক অনেকক্ষণ ধরে ডাকতেছিল দেখে খালার বুকটা অজানা ভয়ে মোচড় দিয়ে উঠলো। খালা রহিমার মার সাথে গল্প করতেছিল, কাল রাতে ঘুমের মধ্যে নাকি তিনি একটা বাজে স্বপ্ন দেখেছেন। একটা লাল কুকুর এসে খালেক মালেককে কামড়িয়ে নিয়ে যাচ্ছিল, কিন্তু সানজিদা খালা কিছু করতে পারেনি। হাত পা মুখ অবশ হয়ে যাচ্ছিল। রহিমার মা জোড়ে শ্বাস নিয়ে বলতে লাগলো ভালোই দেখছ সানজিদা, কারো কাছে আর বইলো না। মঙ্গলবার রাতের স্বপন কাউরে কইতে নাই। অমঙ্গল হয়। আজকাল আমারেও না, রাতে বোবায় ধরে। কন কি মাওঝি? আজকাল কি শুরু হলো বুঝি না। খুব ভয় হচ্ছে মাওঝি, কুলসুম আপার মতো আমিও মনে হয় আর বেশিদিন বাঁচবো না বলে, আস্তে আস্তে কাণেমুখে কি যেনো বিপদের কথা হচ্ছিল সানজিদা খালা আর রহিমার মায়ের মধ্যে। আমি শুনতে পাইনি ঠিকই কিন্তু খালা যে বারবার চোখ মুছতেছিল তা ঠিকই দেখতেছিলাম। মায়া লাগলো খালাকে দেখে।

কাল রাতে ঝড়ে আমাদের পেঁপে গাছের খুঁটিগুলি পড়ে গিয়েছিল, বিকাল ধরে ঐগুলিই ঠিক করতেছিলাম। খালাকে কাঁদতে দেখে তারাতারি কাজ সেরে খালার কাছে এসে জানতে চাইলাম। কিগো খালা কাঁদছ কেনে? বাজান রে! খালেক মালেকরে সকাল থেকে দেখি না, ওদেরকে একটু খুঁজে নিয়া আসবি? প্রথমে একটু আমতা আমতা করতে লাগলাম, কিছুক্ষণ পর সন্ধ্যার আজান পরে যাবে। পেঁপে গাছগুলিতে খুঁটি আজ আর না লাগানো হলে হয়ত আর কখনো লাগানো হবে না। প্রতিরাতে কাল বৈশাখীর ঝড় হয়, পেঁপে গাছ খুঁটি না লাগালে ভেঙে যাবে। কিন্তু মুখের উপর না করতে পারিনি তাই অগত্যা বাধ্য হয়ে চাচাতো ভাই ইলিয়াসকে নিয়ে ওদেরকে খুঁজতে যেতে হলো!

সানজিদা খালা ইলিয়াসের মায়ের চাচাতো বোন। আমাদের নানার বাড়ির পাশে তাদের বাড়ি। ইলিয়াস খালা ডাকে তাই আমরাও খালা ডাকি। সম্পর্কে মূলত ফুফু হয় আমাদের কারণ সানজিদা খালার স্বামীকে ফুফা ডাকি আমরা সানজিদা খালার জীবনটা অনেক দুখের মধ্যে কাটে। শোনা কথা। মাখালারা মাঝে মাঝে সানজিদা খালাকে নিয়ে গল্প করত। শাওন মাসে খালাদের বাড়িতে পানি উঠলে আমাদের বাড়ি চলে আসতো। সারাদিন কোন কাজ নাই মা খালারা গল্প করত। আমরা ছোট মানুষ ছিলাম তখন মায়ের কাছে বসে বসে গল্প শুনতাম। তাড়াকান্দা গ্রামের পাঠ ব্যবসায়ী আক্কাস মোল্লার ছেলের সাথে খালার যখন প্রথম বিয়ে হয়েছিলো আমরা নাকি  তখন মায়ের পেটে  ছিলাম। জমিদার বাড়ির বড় বউ প্রথম সংসার জীবনটা ভালোই কাটছিল, কিন্তু সুখ দীর্ঘস্থায়ী হয়নি। বিয়ের দু আড়াই বছরের মাথায়ও যখন মোল্লা বাড়িতে নতুন অতিথির আগমন হয়নি, তখন মুরুব্বীরা গা টেপাটিপি করতে লাগলো। এ বউ তো অপয়া! কুলটাকে বাড়ি থেকে তাড়িয়ে দেওয়া ভালো! কেউ কেউ বলত, হয়ত তাড়িয়ে দিলেই ভালো হতো। কিন্তু সমাজে  মোল্লাদের উদারতার অনেক গল্প মুখে মুখে প্রচলিত। তাদের খুব মন খারাপ হতো। হয়ত মোল্লার ব্যাটা মুখ খুলে বলতে পারতেছে না, সানজিদা তুমি আমাকে একটা বাচ্চা দাও। আমাদের বাড়িতে একটা ফুটফুটে অতিথি আসা দরকার, আমি বাবা হতে চাই। সানজিদা খালাও মনে মনে অনেক কষ্ট পেতেন। তাই অনেক ভেবেচিন্তে একদিন সকালে বাড়ির চাকরকে নিয়ে বাবার বাড়ি চলে যান। সে যে গেলেন আর ফিরলেন না, ফলশ্রুতিতে মোল্লাদের শুভাকাঙ্ক্ষীরা গ্রাম্যময় রাষ্ট্র করে দিল, মোল্লা বাড়ির বড় বউ চাকরের সাথে পালিয়ে গেছে। এতে মোল্লাদের উপকার না কি অপকার হয়েছে কেউ ঠাওর করতে না পারলেও। মানুষ অবাক হয় মোল্লাদের উদারতা দেখে। মোল্লা বাড়ির সাতপুরুষের সম্মান নষ্ট করেছে যে বধূ তাকে তারা শর্তবিহীন ক্ষমা করে দেন। জমিদার বাড়ির বউ ঘর পালিয়েছে এটা নিঃসন্দেহে শাস্তিযোগ্য অপরাধ ছিল। অপরাধী বউকে ঘরে এনে শালিসি করে শাস্তি দেওয়া উচিৎ ছিল। কিন্তু তারা কিছুই করিনি। তারা শুধু ভালোইবেসেছিল। ভয়ংকর সুন্দর ভালোবাসা।

এরপর প্রায় চার পাঁচ বছর পর তাড়াকান্দা গ্রামের আলমাস ফুফার সাথে খালার বিয়ে হয়। সংসারে দুটা ছেলে ছিল। তিনি তাদের ভালোবাসেন যদিও তিনি তাদের আপন মা নন। তবুও ভালোবাসার অধিকারে তিনি চাইতেন বাচ্চা দুটো তাকে মা ডাকুক। কিন্তু এরা ডাকে সানজিদা। সকাল থেকে রাত পর্যন্ত তাদের নানান প্রয়োজনে দরকার হয় সানজিদাকে। সানজিদা ক্ষুদা লাগছে ভাত দাও, সানজিদা স্কুলে যাব, সানজিদা গোসল করবো গোসল করিয়ে দাও, সানজিদা আপনি কাঁদছেন কেন? সানজিদা আপনার কি মন খারাপ? সানজিদার বুক হুহু করে বুক কেঁপে উঠে কখনো বলার সাহস হয়নি বলতে তোমরা আমরা ডাক। সানজিদা কেবলি কাঁদে তার মা ডাক শোনার আশা কখনো পুরন হয় না। তাও সংসারে সানজিদা অখুশি নয়, ছোটছোট বাচ্চাগুলি তাকে মা না ডাকুক বেয়াদবি অসম্মান তো কখনো করেনি! এই ভেবে নিজেকে সান্ত্বনা দেয়। আমরাও মাঝেমাঝে অবাক হতাম। এই ছেলে দুটো সানজিদাকে মা ডাকে না কেন? অথচ খালাকে নিয়ে তাদের কোন অভিযোগ আছে কি না আমরা জানি না। চার বছর বয়সে মা মরার পর নানার বাড়ি থেকে এসে জমজ বাচ্চাদুটি তাদের বাড়িতে একটা মাঝবয়সী মহিলাকে দেখতে পেলো। তিনি মাথায় হাত বুলিয়ে বাচ্চাদের বুঝাচ্ছিল আজ থেকে ইনি তোমাদের নতুন মা। বাচ্চাদুটি বিশ্বাস করেনি কারণ তারা জানে তাদের মা মরে গেছে।

খালাকে কথা দিয়েছিলাম ওদের নিয়ে বাড়িতে ফিরব। তাই প্রাণপণ তাদের পুরো এলাকা জুড়ে খুঁজতে। মাথায় একবার আসছিল মাইক মেরে বলা দরকার। আবার মনে হচ্ছিল না বিষয়টা এতো সিরিয়াস এখনো হয়নি। ঐ দিকে সন্ধ্যার আজান শুরু হয়েগেছে। খালেক মালেককে খুঁজে পাওয়া যাচ্ছে না। যাদের সাথে প্রতিদিন খেলাধুলা করে আজ তাদের সাথেও নেই- ভেবে নানান চিন্তা মাথায় ঘুরপাক খাচ্ছিল। আমাদের চিন্তার মাত্রাটা আরও বেশি বেড়ে গেলো যখন শুনতে পেলাম তাড়াকান্দা বাজারের পুকুর থেকে না কি দুটো বাচ্চার মৃদেহ ভেসে উঠছে। আমরা দৌড়াতে লাগলাম আর সানজিদা খালার মলিন মুখটা তখন বারবার মুখের সামনে ভাসতে লাগল। চিন্তা হচ্ছিল খালা এত বড় শোক সহ্য করবে কীভাবে? আল্লাহ মাবুদ রহম করো ঝপতে ঝপতে মানুষ ঠেলে ভিতরে প্রবেশ করে দেখলাম ফ্যাকাসে, দুটা মুখমণ্ডল ডানগালে কালো দাগ! এরাই কি খালেক, মালেক? হাত বাড়ালাম ঠিক তখনি একটা ছেলে শার্ট ধরে টেনে বলল শিমুল ভাইয়া। কি ব্যাপার বদমাইশেরা বাড়ি যাচ্ছিস না কেন তোরা? বলে সেকেন্ডের মধ্যে বাসায় ফিরে আসলাম। যেনো দম ফিরে এসেছে খালার!

সারাদিন ছেলেরা বাসায় ফিরেনি তাই বাচ্চাদের মা  রাগ করে তাদের সাথে কথা বলেনি। হয়ত কয়েক ঘা মেরে দেওয়াই উচিৎ ছিল। অন্তত শাস্তি কম পাওয়া যেতো। সেদিন রাতে বাচ্চাদের মা খেতে ডাকেনি, আমার কি? আমি তো আর ওদের কেহ নই। চাকরানি হিসেবে এই বাড়িতে আসছি। আমি যদি ওদের মা হতাম তাহলে তো ওরা আমার কথাই শুনতো! এরপর আরও কী কী যেনো আর বলতে চেয়েছিল খালা। বলা হয়নি আমার রুম  থেকে খালার কান্নার আওয়াজ শোনা যাচ্ছিল।

অভিমান করে ওরাও সেদিন রাতে না খেয়ে ঘুমিয়ে পড়ে। অভিমান হয়েছে ওদের এতবেশি যে পরদিন সকালেও অভিমান কমেনি কারো। সানজিদা খালা আমাদের ঘরের দাওয়ার পাশে বসে দাঁতন করছিল। খালেক মালেক পাশেই বসেছিল। এতদিন এই সময়ে তারা মক্তবে চলে যেতো! খালা এটা সেটা বুঝিয়ে, নানান প্রলোভন দেখিয়ে মক্তবে পাঠাতো। আজ কেউ বলছে না বলে তারা যাবে না। কেন ঠেকছে না কি তারা? অপরাধ না হয় করছে তারা তাই বলে কি ক্ষমা করা যাবে না! খালেক মালেক দাওয়ায় বসে নিমের কচি ডাল চিবুতে চিবুতে এদিক সেদিক তাকায় আর কান খাঁড়া করে রাখে। কখন সানজিদা বলবে, এই তোরা মক্তবে যাচ্ছিস না কেন আর কত জ্বালাবি তোরা আমারে। কিন্তু সানজিদার মন গললো না! নিঠুর ভঙ্গিমায় দাঁতন শেষে পুকুরের দিকে যাওয়ার জন্য খালা উঠে যায়। খালেক মালেক বুঝতে পারে, সানজিদা হয়ত আজ আর কথা বলবে না তাদের সাথে। হয়ত কখনো না! হয়ত কাল রাতের কথাটাই সত্যি ছিল! তোরা কখনো আমার সাথে কথা বলবি না। আমিও বলবনা। তাই তারা উপায় না পেয়ে ছোট মাদুর ছাতার মত মাথার উপর মেলে, পকেটে মুড়ি, গুঁড় আর ছেঁড়া পাঞ্জাবি লুঙ্গি পরে আরবি শেখার জন্য ঘর থেকে বেরিয়ে পরে। এদিকে পুকুর থেকে কাজ সেরে ঘরে এসে বাধ্যপুত্রদ্বয়ে উন্নতি আর তাদের মলিন মুখ দেখে সানজিদা খালা আর নিজেকে সামলাতে না পেরে ছেলে দুটোকে কাছে ডেকে এনে বললেন, যা আজ আর তোদের মক্তবে যেতে হবে না। সুখবর শুনে ছেলেরা তখন হাসতে হাসতে নাচতে নাচতে ঠিক আছে সানজিদা বলে বাড়ি থেকে বেড়িয়ে পড়লো। খালা আদরমাখা চোখে বাচ্চাদের আদুরে চালচলন দেখে হাসতেছিল। বহুদিনের মা ডাক শোনার নেশাটা খালার কেটে গেছে।

© জুয়েল মিয়াজি

চলতি সংখ্যা