মা

মেয়েটির নাম জানিনা। এক পাগলির গর্ভে জন্ম। পাগলী জন্ম দিয়ে পালিয়েছে। শিশু মেয়েটির কান্নায় আকাশ বাতাস ভারি হয়ে ওঠে। কেউ এগিয়ে আসেনা। শুকনো মাটির উপর শিশুটির লাল মুখ কেমন যেন নিলাভ হয়ে যায়। একটি পৌঢ়া আধ বয়সী একজন মহিলা এগিয়ে আসে। কিছুক্ষনের মধ্যেই লোকজনের জটলা বেধে যায়। সবাই ছি ছি করতে থাকে। এমন কামডা কিডা কইরলো? কার পাপের ফসল এই মেয়িডা? সকলের মুখে একই প্রশ্ন। এত সুন্দর মায়িডা ফেলি রেখি গেছে কিডা? হদিস পাই না। পৌঢ়া সকিনা বেগম মেয়েটিকে কোলে জাপটে ধরে। সকিনা নিঃসন্তান। সকিনার আঠাশ বছরের তীব্র প্রতিক্ষার প্রতীক হিসেবে মেয়েটিকে মানুষ করতে চাই। বুকে আগলে রেখে নিজের সন্তানের অভাব পুরণ করতে চায়। সকিনা বলে ওঠে, ওরে আল্লা আমারে দিছে। আমিই মানুষ কইরবো।

সকিনা বেগম যখন মেয়েটিকে নিয়ে ফিরে আসতে চাই ঠিক তখনই একজন বোবা আধবয়সী পাগলী মেয়েটিকে ছো মেরে কেড়ে নেয় তার কাছ থেকে। সকিনা বেগম কিছুৃই বলতে পারে না। পাগলী পরম আদরে মেয়েটিকে বুকে জাপটে ধরে। মেয়েটির কান্না তখনও বন্ধ হয়নি। পাগলি ক্ষেপে যায়। ক্রোধে হাত পা ছুড়তে থাকে? কৌতুহলী দর্শকের মনে তখনও কৌতুহল ভর করে। পাগলীর এরাম সর্বনাশ কইল্লো কিডা? সকিনা দুরে দাড়িয়ে হা হুতাশ করে। কেউ কেউ বলে পাগলীরে ধরে চুল কেটে গ্রাম ছাড়া করে দে। কেউ বলে থাক পাগলী নেড়ে আর কী লাভ হবেনে? কিন্তু মেয়িডার কি গতি হবে? পাগলীর কাছে থাকলি মেয়িডা নির্ঘাত মরি যাবেনে। পাগলী ক্ষেপে যায়। সকিনা বেগম কি করবে কিছু বুঝে উঠতে পারে না। সে একটু দুরে সরে যায়। পাগলী মেয়েটিকে আবার মাটিতে শুয়ে রেখে একটা ইট নিয়ে উৎসুক জনতার উপরে হামলে পড়ে। তাড়া করে। তারপর ঘন্টার পর ঘন্টা পার হয়ে যায় পাগলীর আর খোজ থাকে না। সকিনা বেগম আবারও মেয়েটিকে কোলে তুলে নেই। পাগলি আসার আগেই তাকে এখান থেকে পালাতে হবে। সে প্রাণপনে পা চালায়। তার সমস্ত শক্তি দিয়ে সে দৌড়াতে থাকে।

পাগলীর গোঙানীর আওয়াজ ক্রমেই বাড়তে থাকে। তার গোঙানীর আওয়াজে আকাশ বাতাস ভারি হয়ে ওঠে। কোথাও তার মেয়েকে খুঁজে পাওয়া যায়না। বোবা পাগলী নিজের বুক চাপড়ে কাঁদে। তন্ন তন্ন করে খুঁজতে থাকে তার মেয়েকে। মুখ দিয়ে আও আও আওয়াজ বের হয়। পাগলীর মাতৃত্ববোধ আরও প্রবল হতে থাকে। পাগলী আর নিজেকে সামলাতে পারে না। উদভ্রান্ত হয়ে দিগবিদিক ছুটে বেড়ায়। চোখ বেয়ে অঝোর ধারায় বৃষ্টি নামে। এলোমেলো দৌড়াতে থাকে। হুমড়ি খেয়ে পড়ে যায়। লোকজন হা হা শব্দে হেসে ওঠে। যেন মজার ব্যপার দেখছে সবাই। পাগলী উঠে আবার দৌড়াতে থাকে। পাগলী এখন জীবনের কাছে সম্পূর্ণ পরাজিত । দিনের আলোয় পাগলীকে আর দেখা যায় না। রাতের বেলায় পাগলীর অস্পষ্ট কান্নার আওয়াজ শোনা যায়। কিন্তু তাকে আর খুঁজে পাওয়া যায় না। কেউ বলতে পারে না পাগলী কোথায় গেছে।

যেদিন ফুলমতিকে নিয়ে সকিনা বেগম কুলচারা গ্রামে এসে নতুন বাসা বাধে ঠিক তার উনিশ দিনের মাথায় তার স্বামি মারা যায়। সকিনা বেগম অকুল পাথারে পড়ে মেয়েকে নিয়ে। তার স্বামির রেখে যাওয়ার সম্পত্তির উপর ভর করে বেশ ভালভাবেই তাদের সংসার চলে যায়। মেয়েকে বেশ আদরেই বড় করেছে সকিনা। ফুলমতিকে একটা স্থানীয় স্কুলে ভর্তি করিয়েছে। দেখতে দেখতে বেশ কয়েকটি বছর পার হয়ে যায়। এদিকে ফুলমতিকে নিয়ে কথা ওঠে গ্রামে। কেউ কেউ বলে ফুলমতি সখিনার মেয়ে নয়। পাগলির মেয়ে। এই নিয়ে সখিনার দুশ্চিন্তার শেষ নেই। কেউ কেউ সখিনার মুখের উপরেই এমন কথা বলে। সকিনা রেগে যায়। ফুলমতি বড় হয়েছে। তাকে বিয়ে দিতে হবে। কেউ যদি তার মেয়েকে নিয়ে এমন কথা বলে তার কি বিয়ে হবে? সখিনার গলার আওয়াজ বেড়ে যায়। কোমরে কাপড় পেচিয়ে ঝগড়া করে। তার গলার সমস্ত জোর দিয়ে প্রমান করতে চায় ফুলমতি তারই মেয়ে। ফুলমতি অবাক বিস্ময়ে তাকিয়ে থাকে।

পাগলী এসেছে গ্রামে। পাগলী রাস্তার পাশে দাড়িয়ে থাকে। পাগলীর বয়স হয়েছে। বৃদ্ধা পাগলীর পাগলামী আবার বেড়েছে। সে ছোট ছোট বাচ্চা দেখলে ছুটে গিয়ে জড়িয়ে ধরতে চায়। ছেলেমেয়েরা ভয় পাই। ঘৃণা করে। পাগলীর শরীর দিয়ে তীব্র দুর্গন্ধ বেরয়। ছোট ছোট বাচ্চারা অতীষ্ঠ পাগলীর অত্যাচারে। পাগলীর গলা দিয়ে আও আও আওয়াজ বেরোয়। তার ভেতরে মাতৃত্ববোধ জেগে ওঠে। কিন্তু কেউই তার কাছে যেতে চাই না। গ্রামের লোকজন ক্ষেপে যায় পাগলীর উপর। তার কারণে বাচ্চারা বিদ্যালয়ে যেতে ভয় পায়। শেষ বয়সে পাগলীর মাতৃত্ববোধ চরমে উঠেছে। সে তার সন্তানকে খুঁজে পেতে মরিয়া। সবাইকে তার সন্তান ভেবে আদর করতে চায়। একটু বুকে জড়িয়ে ধরে পূর্ণ তৃপ্তিতে মাতৃত্বের স্বাদ নিতে চায়। কিন্তু লোকজনের মনে শঙ্কা। কেউ কেউ ধারণা করে এ পাগলী হতে পারেনা। এ নিশ্চয় বাচ্চাচোর দলের সদস্য।

বেশ কিছুদিন ধরে ফুলমতিকে লক্ষ্য করছে পাগলী। পাগলীর তীব্র বাসনা ফুলমতিকে একটু জড়িয়ে ধরবে। একদিন আচমকা পাগলী কোথা থেকে ছুটে এসে ফুলমতিকে জড়িয়ে ধরে । ফুলমতি তখন স্কুলে যাচ্ছিল। ফুলমতি ভয়ে চিৎকার চেচামেচি করে । পাগলী ফুলমতির হাত শক্ত করে ধরে রাখতে চায়। ফুলমতি হাত ছাড়িয়ে নেবার তীব্র চেষ্টা করে। কিন্তু পারে না। ফুলমতি কাঁদে আর বলে কিডা? কিডা আপনি? আমারে ছেড়ি দেন। পাগলী হাত ছাড়ে না। পাগলী কেমন কুই কুই আওয়াজ বের করে তার গলা দিয়ে। পাগলীর চোখেও কেন জানি জল চলে আসে। ফুলমতির চেচামেচি আরও বেড়ে যায়। লোকজনের জটলা বেঁধে যায়। সবাই এসে পাগলীকে জাপটে ধরে। পাগলী চুপ হয়ে যায়।

কেউ কেউ বলে ও বোবাও না পাগলীও না ওরে ধরি আইচ্চা করি পিডাও সব সত্যি বেরি আসপেনে। কেউ কেউ বলে ওর মেরে গ্রামতি তাড়ি দেও। গ্রামে তড়িত সালিশ বসে। খবর পেয়ে সকিনা বেগমও ছুটে আসে। যেহেতু ফুলমতিকে কেন্দ্র করে ঘটনা ঘটেছে সেহেতু ফুলমতির মা সকিনা বেগম রাগে দুঃখে ক্ষোভে ফেটে পড়ে। হঠাত এই পাগলীকে দেখে মন খারাপ হয়ে যায় তার। এই ফুলমতিই পাগলীর সন্তান। এই পাগলীর গর্ভেই ফুলমতির জন্ম। সকিনার বুঝতে আর বাকি থাকে না। সকিনাকে দেখে ফের বিগড়ে যায় পাগলী। সে পাগলা কুকুরের মত সকিনার উপরে ঝাপিয়ে পড়ে। সকিনাকে মাটিতে ফেলে চুল ধরে টানতে থাকে। সকলে কেমন হতভম্ব হয়ে যায়। না আর পারা যায় না। সবাই মিলে পাগলীর হাত ছাড়ানোর চেষ্টা করে। পাগলীর গলা দিয়ে আও আও আওয়াজ প্রবল হতে থাকে। সবাই তাকে টেনে হেচড়ে সেখান থেকে নিয়ে এসে একটি রশ্মি দিয়ে তাকে গাছের সাথে বেঁধে ফেলা হয়। ফুলমতি স্তম্ভিত। সে কিছুই বুঝে উঠতে পারে না। কি করবে তার চোখ দিয়ে টপ টপ করে জল গড়িয়ে পড়ে। সে পাগলীর চোখের পানে চেয়ে থাকে। কেমন একটা মায়া জন্মায়। হঠাত ঘৃণায় মনটা রি রি করতে থাকে। যে তার মায়ের উপর এমন হামলে পড়েছে তার উপরে মায়া কেন? বিচারে বলা হয় পাগলীর মাথার চুল সব কেটে ফেলা হবে। পাগলীর উপরে চলে কিল ঘুষি আর লাথি। পাগলী আ উ শব্দ করে কাঁদতে থাকে। লোকজন হো হো শব্দে হেসে ওঠে। যেন সবাই একটা মজার খেলা দেখছে। সবাই মজা পাচ্ছে। কেন জানি ফুলমতির প্রচন্ড মায়া হয়। ইচ্ছে করে এখান থেকে ছাড়িয়ে নিয়ে অন্য কোথাও পাগলীকে রেখে আসতে কিন্তু পারে না। পাগলীর চুল কেটে দড়ি দিয়ে বেধে অনেক দুরের একটি জঙ্গলে ফেলে দেওয়া হয়।

ফুলমতির মন ভীষণ খারাপ। বিয়ের আসর থেকে তার বিয়ে ভেঙ্গে গেছে। এমন রুপবতি মেয়ের বিয়ে ভেঙ্গে যাওয়ার কারণ কী? কারণ একটায় তার নাকি জন্মের ঠিক নেই। তার বাবার পরিচয় নেই। বিয়ে বাড়ি পুরো স্তম্ভিত। কারো মুখে কোন কথা নেই। ফুলমতি কিছুই বুঝে উঠতে পারে না। কি করে যেন বর পক্ষ জেনে গেছে ফুলমতির সকিনার মেয়ে না। সে একটা পাগলীর মেয়ে। সে একটা পাপের ফসল। ফুলমতির রাগে দুঃখে ক্ষোভে আত্মহত্যা করতে ইচ্ছে করে। গ্রামে একটি সালিশ বসবে। গ্রামের মাতব্বর বলে গেছে। আরও বলে গেছে এ গ্রামে কোন অজাত কুজাত জারজের জায়গা নেই। ফুলমতি ফুফিয়ে ফুফিয়ে কাঁদে। আসল সত্যটা তার আজ জানতেই হবে। সত্য জানার জন্য তার মনটা উতলা হয়ে ওঠে। সে একটি ধর্মগ্রন্থের উপর হাত রেখে তার মায়ের কাছে আসল সত্যটা জানতে চায়। সকিনা সত্য জানিয়ে দেয়। আরও জানিয়ে দেয় যে পাগলিকে মেরে অত্যাচার করে এ গ্রাম থেকে তাড়ানো হয়েছে সে তার মা। ফুলমতি হাওমাও করে কাঁদতে থাকে। তার যে বিয়ে ভেঙ্গে গেছে সে জন্য সে কাঁদছে না। এ সমাজে যার বাবার পরিচয় নেই তার কোথাও স্থান হয় না। একটু পরেই তাকে নিয়ে সালিশ বসবে। হয়তো তাকেও তার মায়ের মত এ গ্রাম থেকে তাড়ানো হবে। সে জন্যও কাঁদছে না ফুলমতি। সে জানে আর তার এ গ্রামে জায়গা হবে না। এ গ্রাম কেন কোন গ্রামেই জায়গা হবে না। সে ঠিক করে সে আত্মহত্যায় করবে। নইলে সারা জীবন তাকে অপমান সহ্য করে বেচে থাকতে হবে। না না তা হতে পারে না। তার আগে তার পাগলী মাকে খুঁজে বের করতে হবে। জানতে হবে বাবার পরিচয়। কোন কিছুই ঠিক করতে পারে না ফুলমতি। হঠাতই লোকজনের হৈচৈ শুনতে পায় ফুলমতি। লাশ! লাশ! সবাই একটি লাশকে ঘিরে আহাজারি করতে থাকে। ফুলমতি লোকজনের ভিড় সরিয়ে কাছে গিয়ে দেখেতে চায় কার লাশ। ফুলমতি আর তাকাতে পারে না। এই সেই পাগলীর লাশ! কোথা থেকে এসে আবার এই গ্রামেই মারা গেছে। ফুলমতি আর কিছুই বলতে পারে না। তার মাথাটা কেমন ঘুরে আসে। সে আচমকা মাথা ঘুরে পড়ে যায়।

© মাহির তাজওয়ার

চলতি সংখ্যা