আর্য পূর্ব বাংলা: দুই

প্রকাশিত পর্ব সমূহ
* আর্য পূর্ব বাংলা: সূচনা
* আর্য পূর্ব বাংলা: এক
* আর্য পূর্ব বাংলা: দুই

বাঙালীর মন: কষ্টের কারণ এটুকু হতে পারে যে আমাদের প্রাচীন সভ্যতা, বীরত্ব গাঁথার ইতিকথা, প্রত্ন-তাত্ত্বিক বিষয় বিশ্লেষণে প্রমাণ করতে হচ্ছে, তার অর্থ এই নয় যে বাঙালীর ইতিহাস লজ্জাকর; অগৌরবের যাকে বলা হয় ‘অনার্য’। প্রাগৈতিহাসিক যুগ থেকে যেমন বাংলায় মানুষের বসবাস প্রমাণিত সত্য। তেমনি প্রাপ্ত প্রত্নতাত্ত্বিক নিদর্শন সমূহ থেকে জানা যায় প্রস্তর যুগ, প্রত্ন প্রস্তর যুগ, নব্য প্রস্তর যুগ, তাম্র প্রস্তর যুগ, এবং লৌহ যুগেও বাঙালি সমৃদ্ধ ছিল। মানব উন্নতির যেসব ধারাবাহিক লক্ষণ জানা যায় বাঙালি ঐতিহ্যও সমতালে প্রবাহিত। যেমন আগুন জ্বালানো এর ফলে মাটি দিয়ে নিত্য প্রয়োজনীয় বাসনপত্র তৈরি করে আগুনে পুড়িয়ে ব্যবহারোপযোগি করা। আগুন জ্বালিয়ে খাদ্য দ্রব্য প্রস্তত করণ অর্থাৎ রান্নার প্রচলন করা এবং পদ্ধতিগত চাষাবাদের উদ্ভব করা। সমককালীন ইতিহাস পাঠে এবং উপাদান সমূহ নিরীক্ষে অনুমান করা যায় বাঙালি সেসব আবিস্কার কৃর্তির সমান দাবিদার, এর সপেক্ষে উপাদান অসংখ্য। বাংলাদেশের দক্ষিণ পশ্চিম সীমান্তে দুটো প্রস্তর যুগের হাতিয়ার আবিস্কৃত হয়েছে। হুগলি জেলার গোবিন্দপুরের কুনকুনুতে পাথরে তৈরি কুঠার পাওয়া গেছে। বর্তমানে ফেনী জেলার ছাগলনাইয়ায় পুরাতন প্রস্তর যুগের শেষ দিকের পাথরে পরিনত হাত কুড়াল পাওয়া গেছে। চট্টগ্রামের সীতাকুন্ডেও প্রস্তর যুগের অস্ত্র পাওয়া গেছে।

দক্ষিণ ভারতের মাদ্রাজে প্রত্ন প্রস্তর যুগের যে হাতিয়ার পাওয়া গেছে তার সাথে বাংলাদেশে পাওয়া নিদর্শনগুলোর সাদৃশ্য রয়েছে। আকারগত এবং দুটি অন্ত্র এই জাতের পাথর দিয়ে তৈরি। এ সব পাথর বাংলায় পাওয়া যায় না।

– তোফায়েল আহমদ – পূবোক্ত পৃষ্ঠা, ১৬

এ বক্তব্য থেকে দৃঢ় কন্ঠে উচ্চারণ করা যায় না যে প্রস্তর যুগেও বাঙালি সমূদ্র তীরে আত্ম মগ্নতায় আড়ষ্ঠছিল না। বিশ্ব সভ্যতার সাথে শুধু পরিচয়ই ছিলনা; বাণিজ্যিক সম্পর্কও ছিল সু-গভীর।

দিল্লী বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রত্নতত্ত্ব বিভাগের অধ্যাপক ডাঃ দিলীপ কুমার চক্রবর্তী ১লা জানুয়ারী ১৯৮৯ সালে কুমিল্লার লালমাইর দক্ষিণ পশ্চিম প্রান্তে চণ্ডিমুড়ার কাছে আড়াইশর মতো অশ্নীভূত কাঠের হাতিয়ার পান। তার মধ্যে রয়েছে কুঠারাদি। হাতিয়ার গুলো উচ্চ প্যালিওলিথিক যুগের বিশ হাজার বছরের পুরানো বলে তিনি মনে করেন।

নরসিংদী জেলার উয়ারী বটেশ্বরে প্রন্ত প্রস্তর যুগের হস্ত কুঠার নব্য প্রস্তর যুগের বাটালী, কুঠার প্রভৃতি পাওয়া গেছে। তার থেকে এখানে মানব বসতি একলক্ষ থেকে দশ হাজার বছরের পুরানো বলে অনুমান করা যায়।

– তোফায়েল আহমদ- পূবোক্ত পৃষ্ঠা ১৪

কেউ কেউ মনে করেন নরসিংদীতে প্রাপ্ত হাতিয়ার প্রস্তর যুগের শেষ দিকে এবং লোহা যুগের সুচনা কালের তৈরী। এছাড়াও চব্বিশ পরগনা জেলার ০১ থেকে ৩ লক্ষ বছরের প্রাচীন নিদশর্ন পাওয়া গেছে। বাকুড়া জেলার খাতড়ায় পাওয়া গেছে প্রত্ন প্রস্তর যুগের হাতিয়ার। সভ্যতার বিবর্তনে মানুষ ক্রমশ ধাতুর ব্যবহার আয়ত্ত করে। তামা দিয়ে হাতিয়ার তৈরীতে সার্থকতা লাভ করে এই সময়কে ইতিহাসে তাম্রপ্রস্তর যুগ বলে।

এই তাম্র প্রস্তর যুগের নিদর্শনও বাংলাদেশে আবিষ্কৃত হইয়াছে। ১৯৬২-৬৩ সালে পশ্চিম বঙ্গ সরকারের প্রত্ন বিভাগ কর্তৃক পশ্চিম বঙ্গের বীরভূম ও বর্ধমান জেলায় অজয়, কুনুর ও কোপাই নদীর তীরে প্রত্ন তাত্ত্বিক খনন কার্জের ফলে এই অঞ্চলে তাম্রর-প্রস্তর যুগের নিদর্শন আবিস্কৃত হইয়াছে।

– বাংলাদেশের ইতিহাস- পূবোক্ত পৃঃ ১৬

খ্রিষ্টপূর্ব দেড় হাজার বছর পূর্বের পান্ডুরাজার ডিবিতে প্রাপ্ত নিদর্শনে স্পষ্টতই অনুমান করা যায় বাঙালি পাথর, শীশা, তামা ও লোহার ব্যবহারে ছিল পরাঙ্গম। ব্রোঞ্জ যুগের উন্নত সভ্যতার কথা শোনা যায় বাঙালায় তা দুর্লক্ষ নয়, মহাস্থান গড়ে খ্রিষ্টপূর্ব তৃতীয় শতকের শিলালিপিতে এর প্রমাণ রয়েছে। অতি সম্প্রতি বর্তমান শরিয়তপুর জেলার নড়িয়া উপজেলায় তামার তৈরী একটি বিশাল আকৃতির কামান প্রাপ্ত রয়েছে, এটির নির্মাণ কাল নিরূপিত হলে অনেক তথ্য বেরিয়ে আসবে, যা গবেষকগণের কাজ সহজ করে দিবে ।

আজ অবধী আবিস্কৃত উপকরণের দৃষ্টে বাঙালি সভ্যতার প্রাচীনতা সর্বাংশে লক্ষিত হয়। ভারত বর্ষে যখন আর্য নামক উন্নত সংস্তৃতির বাহকদের আগমন ঘটে। যারা এ উপমহাদেশে সভ্যতার আলোকিত করেছে বলে দাবী করা হয়। বাঙলায় প্রাপ্ত উল্লিখিত কতিপয় প্রত্ন তাত্ত্বিক নিদর্শন মনে করিয়ে দেয় যে, আর্য আগমনের বহু পূর্বেই ধারাবাহিক সভ্যতার সাথে বাঙালির পদচারণা ছিল সচল। এ বিষয়ে পরবর্তীতে আলোচনার প্রয়োজন রয়েছে, তার পূর্বে বাঙালি উন্নত সভ্যতা প্রমাণের আরও কিছু বিষয় উল্লেখ আবশ্যক।

প্রস্তর যুগের মানুষ দলবদ্ধ ভাবে বসবাস করতো। এই দলব্ধতার মাধ্যমে গড়ে উঠে সমাজ জীবনের বিধিবিধান, নেতৃত্বদান ও গ্রহণের প্রয়োজনীয়তা। সমাজিক রীতি নীতি মেনে সুশৃঙ্খল জীবন যাপনের অনুভূতি জাগ্রত হতে শুরু করে। এই যুগেই মানুষের কল্পনা শক্তি প্রেরণা যোগায় নব উদ্ভাবনের এবং সেই চেতনার ফসল সুদৃশ্য এবং সহজ ব্যবহারপযোগী হাতিয়ার। আগুনের আবিস্কার ও ব্যবহার আয়ত্বে এনে মানুষের শিল্পী সত্ত্বার প্রকাশ ঘটে। মৃৎ শিল্পের শুরু তখন থেকেই। মৃৎপাত্র আজও সৌখিন উপকরণ হিসাবে সমাদৃত। প্রস্তরযুগ থেকে শরু করে লৌহযুগ পর্যন্ত বিশ্লেষণে অনুমান করা যায়। এই সময়ের মধ্যে মানুষ আদিম জটিল জীবনের সীমা অতিক্রম করে ক্রম নগর সভ্যতার পত্তন ঘটায়। এ সময় পেশা ভিত্তিক জনধারা বিভাজন ঘটতে থাকে। কৃষক, হাতিয়ার প্রস্ততকারী (কামাড়), মৃৎশীল্পি, (কুমার) পশু শিকারীর পাশাপাশি সূচনা হয়, বণিজ্যের এবং মুদ্রা বিনিময়ের। বোধ করি প্রাচীন পন্য বিনিময় প্রথা থেকে মুদ্রা বিনিময় প্রথায় উন্নত হয়ে মানুষ বিভিন্ন শ্রেণিতে বিভক্ত হয়ে পড়ে। যার ফলে সমাজে উঁচু নীচু ভেদ সৃষ্টি হয় যা পরবর্তী সময় শ্রেণী দ¦ন্ধে রুপ নেয়। সে যা হোক নগর সভ্যতার প্রধান অনুষঙ্গ বণিজ্যিক উৎপাদন এবং বাণিজ্যিক সমৃদ্ধির পরিচয় বহুক্ষেত্রে প্রমাণিত।

পূর্বে উল্লিখিত পান্ডুরাজার ডিবিতে স্টাটাইট (steatite) পাথরের কতগুলো চিহ্ন খোদিত একটি সীল পাওয়া গেছে, ঐতিহাসিকগণ মনে করছেন সীলটির খোদিত চিহ্ন চিত্রাক্ষর এবং ভূমধ্যসাগরীর ক্রীট দ্বীপের এবং এর নির্মাণ কাল প্রায় সাড়ে তিন হাজার বছর পূর্বের। মানব সব্যতার প্রাচীন আবাস স্তল ভূমধ্য সাগরীর ত্রীট দ্বীপের সাথে বাঙালির বাণিজ্যিক সম্পর্কের উৎকৃষ্ট উদাহরণ এটি। প্রাচীন বাঙলায় শিমূল তুলো দিয়ে কাপড় তৈরি করে বিক্রি করা হত। বাঙলায় তৈরী মশৃন কাপড় ব্যবহার তখনকার দুনিয়ায় ছিল আভিজাত্যের বিষয়। ‘খ্রিঃ পূর্ব চতুর্থ শতকে লেখা কৌটিল্যের অস্ত্রশাস্ত্রে বঙ্গ ও পুন্ডে উৎপাদিত বাঙ্গত ও পৌন্ড্রক নামক অত্যন্ত মিহি রেশমী কাপড়ের উল্লেখ আছে। প্রাচীন বাঙলার বস্ত্র শিল্পের প্রমাণ এখানে। রামায়নের অযোদ্ধাকান্ডে ‘কৈকয়ীর বর প্রার্থনা’ অধ্যায় বৃদ্ধ রাজা দশরথ বিষন্ন যুবতি স্ত্রী কৈকয়ীকে তুষ্ট করতে প্রতিশ্রুতি দেন অঙ্গ, বঙ্গের মধ্যে যে দ্রব্য কৈকয়ীর পছন্দ তাই এনে দেবেন। এ থেকে বলা যায় রামায়ন কালের বঙ্গের সভ্যতা জাত শিল্প সামগ্রীর শ্রেষ্ঠত্ব প্রমাণিত সত্য। এছাড়াও সেকালে হাতির দাত, মসলা, গুড়, সোনা, হীরা প্রভৃতি বাঙলার প্রধান বাণিজ্যিক দ্রব্য। বাণিজ্যিক সম্পর্ক ছিল ইন্দোনেশিয়া চীন কম্পোডিয়া, থাইল্যান্ড, মায়ানমার, শ্রীলঙ্কা সহ সমগ্র আরবদেশ এবং ইউরোপের সভ্য অংশের সাথে, প্লিনির ‘ইন্ডিকা’ নামক গ্রন্থ বাঙলার প্রাচীন বাণিজ্যের কথা আছে। টলেমী, দিওদোরাস, কার্টিয়াস, ব্লুতার্ক, সলিনাস, স্টাবো প্রমুখ গ্রীক ও ল্যাটিন লেখকগণের গ্রন্থে এ বিষয়ের উল্লেখ রয়েছে।

‘প্যারিপ্লাস অব দ্যা (ইরিত্রিয়ান) সি’ নামক গ্রন্থ যার রচনা কাল ৪৪ সাল বলে উল্লেখ রয়েছে। এ গ্রন্থে বাঙালির বাণিজ্যক প্রতিষ্ঠার কাহিনী বর্ণিত হয়েছে এভাবে-

‘অত:পর পথ পুনরায় বাঁকনেয় এবং ডানে মুক্ত সমূদ্র এবং বায়ে দূরে উপকুল রেখে জাহাজ চালালে পরে গঙ্গা দেখা যায়, এবং তার কাছেই পূর্ব দিকে সর্বশেষ সূবর্ণ ভূমির নিকটে নদী আছে নাম গঙ্গা এবং এই নদীর উপত্তি এবং বিলয় ঠিক নীল নদের মতো। এই নদীর তীরে এক হাট পত্তন আছে। তার নাম ও নদীর নাম একই গঙ্গা। এইখান দিয়ে আসে তেজপাতা, গাঙ্গেয় সুগন্দি তৈল ও মুক্তা এবং সর্বাধিক উৎকৃষ্ট প্রকারের মসলিস যাকে বলা হয় গাঙ্গেয়। শোনা যায় যে, এই সব স্থানের নিকটে সোনার খনি আছে এবং এক রকম সোনার মোহর চলে যাকে বলে কলতিস।’

– খন্দকার মাহমুদুল হাসান – বাংলার প্রাচীন সভ্যতা ও পুরাকীর্তি, শিখা প্রকাশনি, ১ম প্রকাশ ২০০০, ঢাকা, পৃঃ ২৫

শুধু বাণিজ্যক সাফল্য নয়, বাঙালীর সাহসী অভিযানের সাফল্যের প্রমাণ রয়েছে, বাঙালীর বীর সিংহ বাহুর পুত্র বিজয় সিংহ ৫৪৪ খ্রিষ্ট পূবার্ধে এক অভিযানে প্রাচীন তা¤্রপনী বর্তমান শ্রীলংকা জয় করেন। তার নামানুসারে এর নামকরন হয় সিংহল, শ্রীলংকার ইতিহাসে আজও সে অধ্যায় উজ্জ্বল

‘বিজয় কর্তৃক সিংহল বিজয় বঙ্গ দেশের তদানীন্তন কালের একটি অতিশ্রেষ্ঠ ও স্মরণীয় ঘটনা।… সিংহল বিষয়কেই আমরা বঙ্গদেশের সর্বশ্রেষ্ঠ কীর্তি বলিয়া মনে করি।’

– দীনেশ চন্দ্র সেন – বৃহৎবঙ্গ, ১ম খ-, কলিকাতা ১৯৯৩, পৃঃ ৮৩-৮

© হারিস মিজান

চলতি সংখ্যা