আর্য পূর্ব বাংলা: সূচনা

প্রকাশিত পর্ব সমূহ
* আর্য পূর্ব বাংলা: সূচনা
* আর্য পূর্ব বাংলা: এক
* আর্য পূর্ব বাংলা: দুই

প্রাচীন বাংলা জনপদের প্রাচীনত্ব নিরুপন সহজসাধ্য নয়, সে কারণে আর্য পূর্ব বাংলার অস্থিত্ব অনুভূত হলেও গবেষকগণের বক্তব্য এ ক্ষেত্রে অস্পষ্ট। বরং সর্বাংশে ইতিহাস সম্মত না হলেও

“বাঙালীর আদী অনার্য” পন্ডিতগণের এ সিন্ধান্ত সর্বক্ষেত্রে স্বীকৃত। আর্য নামক সুসভ্য(?) জাতি গোষ্ঠীর আগমনে স্থানীয় অনার্য নামক অসভ্য জাতি ধীরে ধীরে সভ্য হয়ে ওঠে। সত্য হওয়া আর্যত্ব লাভ অর্থে ব্যবহৃত হত। বাঙলা ভাষা এই আর্য আগমনের ফল। বলা হচ্ছে “বাঙলা ভাষার মূল প্রাচীন ভারতীয় আর্য(সংস্কৃত)ভাষা”

ড. সুকুমার সেন- বাঙলা সাহিত্যের ইতিহাস, ১ম খ-, ৪র্থ সংকলন ১৯৬৩ কলিকাতা, পৃঃ ৭

আর্য পূর্ব বাংলার ভাষা স্লেচ্ছ, ভ্রষ্ট, অনাচারী। জাতি হিসেবে বাঙালি ‘দাস’ বা ‘দস্যু।

“ভাষা হিসেবে বাঙলা কিন্তু কুলিন নয়”। হিন্দু-আর্য ভাষার প্রাচ্য শাখা আদৌ কুলীন বলে গন্য হতনা; তার কারন বাঙালী জাতটাও আসলে বড় বেশী কুলীন জাত নয়।”

গোপাল হালদার- বাঙলা সাহিত্যের রূপরেখা, প্রথম খণ্ঢ, মুক্তধারা প্রকাশন ১৯৭৪, ঢাকা, পৃঃ ৩

বাঙলা ভাষা বা বাঙলা ভাষা বা বাঙালি জাতির ঐতিহ্য অনুসন্ধানে আগ্রহী পাঠক বা সচেতন ব্যক্তিবর্গকে বার বার ঠোকর খেতে হয়েছে। পন্ডিতগণের অনুমিত ভাষ্য এবং ইতিহাস পাঠ থেকে ধারণা জন্মেছে বাঙালীর ইতিহাস অগৌরবের, এ জাতির আত্ম মর্যাদা নেই। শুধু তাই নয়; অনার্যদের অবস্থা এতটাই অস্রাব্য ছিল যে,

“এদেশে এলে আর্যদের জাতি যেত, দুঃসাহসিক আর্য যুবকেরা এদেশে যাতায়াত করলে তাদের ভালে ‘ব্রাত্য’ “কলঙ্ক তিলক একেঁ দেয়া হত।”

অসিত কুমার বন্দ্যোপাধ্যয়-বাংলা সাহিত্যের সম্পূর্ণ ইতিবৃত্ত নতুন সংস্করণ ১৯৯৪, ঢাকা, পৃঃ ২

অনার্য শব্দটি আজও অশালীন এক কথার গালি হিসাব প্রচলিত। কিন্তু বাঙালির ইতিহাসে এই বক্তব্য কতটা যুক্তি যুক্ত বা বাঙালির প্রাচীন সভ্যতা কতটা গৌরবময় তা নিরুপন করা প্রয়োজন।

বাংলা জনপদে বারবার বিদেশী বিজাতির আগমন ঘটেছে। বাংলার সভ্যতা এবং সমৃদ্ধিই বিজাতি আগমনের প্রধান কারণ। লক্ষাধিক বছর পূর্বেও এদেশে জনবসতি ছিল উল্লেখযোগ্য পর্যায়। এখানকার আবহাওয়া জলবায়ু তৎকালীন সময়ে জীবন ধারণে ছিল সমজ সাধ্য। শুধু তাই নয়, যুক্তিগ্রাহ্য খুববেশি উপকরণ না থাকলেও অবস্থা বিশ্লেষণে সহজেই অনুমান করা যায় প্রাচীণ যে ক’টি সভ্যতা পৃথিবীতে আজও সাক্ষ বহন করছে বাঙলার অবস্থান ছিল তদরুপ। প্রাপ্ত প্রত্ম-তাত্বিক নির্দশনসমূহ নিরীক্ষণে এবং যুগে যুগে বাংলায় আগত জাতি গোষ্ঠীর নৃ-তাত্ত্বিক বিশ্লেষণে সর্বপরী গ্রীক ও চীন লেখকগণের গ্রন্থ পর্যালোচনা করলে বাঙলার প্রাচীন সভ্যতার সুষ্পষ্ট প্রমাণ পাওয়া যায়। পূর্বে দক্ষিণ ভারত অর্থ্যাৎ বর্তমান বাংলাদেশে ‘আর্য’ আগমন ঘটে খ্রীষ্টীয় প্রথম সনের দিকে, কিন্তু খ্রিষ্টপূর্বে ৫০০ বছর পূর্বে বাংলা একটি স্বাধীন সার্বভৌম রাষ্ট্র ছিল। গ্রীস ব্যতীত গোটা ইউরোপীয় সভ্যতার পূর্বে, বাঙালি সুসভ্য ছিল। বাংলায় জ্ঞান অম্নেষা কেন্দ্র, নগর সভ্যতা, রাজপথ, রাজধানী, প্রতিরক্ষা ব্যবস্থা, শিল্প, বাণিজ্য এবং সাংস্কতিক পরিমন্ডল, বাঙালির বীরত্বগাঁধার প্রমাণ ইতিহাসে, ধর্ম ও রাজনৈতিক বিশ্নেষণাগ্রন্থে উল্লিখিত। এতসত্ত্বেও বাঙালির ইতিহাস ও ঐতিহ্যের সুস্পষ্ট কোনো দলিল না খাবার কারণ রহস্যময়। কেউ কেউ মনে করেন প্রাচীন গ্রীসে ইতিহাস লেখার জন্য যেমন ‘হেরোডেটিসি’ ও ‘যুকিডিডিস’ ছিলেন, বাংলার তেমন কেউ ছিল না। এ বক্তব্য অনুমানও মাত্র। এমন ধারণা অমূলক নয়- বাঙলির যথার্থ ইতিহাস রচিত হয়েছিল। বঙ্গ জনপদের রাজ কবিগণের অনেক সাহিত্য কর্মে তখনকার জীবন ধারা ও মানস চিত্র লিপিবদ্ধ ছিল তা সংরক্ষিত নেই বা ধ্বংস করে ফেলা হয়েছে।

পরবর্তী সময়ে (বাংলা ভাষা প্রতিষ্ঠার পরে যখন বাংলায় গ্রন্থ রচনা শুরু হল) বাঙলার সঠিক ইতিহাস উদঘাটনে বা সংরক্ষণে  উৎসাহহীনতা লক্ষিত হয়। এর কারণ দ্বিবিধ। প্রথমতঃ ধর্মীয় অনুভূতি ঐতিহাসিকগণকে উদার হতে দেয়নি। দ্বিতীয়ঃ বাঙালি জাতীয়তাদের পরিচয় দান ছিল অগৌরবের। সেকারণে আর্য বা অন্য বিজাতি কর্তৃক বাঙালি নিধন ও সভ্যতার বিলুপ্তির প্রমাণ না খুঁজে সমকালীন সচেতন সমাজ আত্মগৌরব প্রতিষ্ঠার তাগিদে কেউ বা আর্যত্ব লাভে প্রতিষ্ঠিত বা তুর্কী বংশজাত বলে নিজ নিজ পরিচয় উদ্ঘাটনে ব্রতী হয়েছেন।

বাঙালী হিন্দু ছিল উত্তর ভারতীয় আর্য গৌরবে এবং রাজপুত মারাঠার ঐতিহ্য গর্বে স্ফীত। আর মুসলমান ছিল আরব ইরানীয় জ্ঞাতিত্ব মোহে অভিভূত

ড. আহমদ শরীফ- ‘বাঙলা ও বাঙালি’ গ্রন্থের ভূমিকাংশে

তা সত্ত্বেও বাংলা সাহিত্য বিশারদগণ, ইতিহাসবিদগণ, ভাষা তাত্ত্বিকগণ অস্কুটাকার হলেও যে সব অনুমিত লক্ষণ উপস্থাপন করেছেন তার সাথে আধুনিক কালের আবিস্কার আর্য পূর্ব বাংলা জনপদের প্রাচীনতার প্রমাণ সুদৃঢ় করেছে।

© হারিস মিজান

চলতি সংখ্যা