অধিবাস্তববাদঃ নাট্যসাহিত্য এবং চিত্রশিল্পেঃ রূপক এবং সংকেতের প্রয়োগ

ধারণামন্ডিত নাট্যগঠনরীতির মৌলিক উৎসমুখ চিরন্তন উপলব্ধিজাত অনুসন্ধিৎসার অনিশ্চিত, অস্থির, অনির্দিষ্ট এবং অলৌকিক একটা কিছু প্রাপ্তির অনির্বচনীয় সুখবোধে আক্রান্ত অতি সূক্ষ্ম অথচ সংহত একটি চরম উত্তেজিত আকাঙ্ক্ষার দূর্লভ সফলতার লক্ষণ বলে এক শ্রেণির নাট্যকার এবং চিত্রশিল্পীরা মনে করে থাকেন। তারা এ ধারণাটিকে সকলের কাছে বিশ্বাস-সিদ্ধ করাতে চান যে, ওই উৎসমুখে সৃষ্ট লক্ষণটি নিরন্তর বিচিত্র ভঙ্গিতে ঋজুতায় এবং দৃঢ়তায় স্বাভাবিকের চাইতে অনেক বেশি উন্নত- এবং যেটিকে বিংশ শতাব্দীর গোড়া থেকে ওই শ্রেণির ব্যক্তিবর্গ অসঙ্কোচে ‘অধিবাস্তববাদ’- বলে প্রতিষ্ঠা করবার চেষ্টা করতে থাকেন।  এবং এই মতবাদটিকে প্রতিষ্ঠার জন্যে সাহিত্যের পরিমন্ডলে আন্দোলনও গড়ে তুলবার উদ্যোগ গ্রহণ করে চলেন।  আর সে কারণে আন্দোলনকারীদের মধ্যে এক ধরণের ‘অহংবোধ’- এর মতো একটি নিশ্চিত স্বপ্ন-বিলাসী অবিমিশ্র সুখবোধেরও উৎপত্তি ঘটতে থাকে।  এ কারণে যে, আন্দোলনকারীরা সাহিত্যের পুরোনো জরায়ুতে ‘অধিবাস্তববাদ’-নামীয় একটি নতুন ভ্রুণের সৃষ্টি করতে যাচ্ছেন-বিশেষতঃ নবতর নাট্যরীতি এবং চিত্ররীতি গঠনের ক্ষেত্রে।  কিন্তু একই সঙ্গে তারা যে তাদের সম্ভাব্য সৃষ্টির বিপরীতে একটি প্রশ্ন উদ্রেককারী চিহ্নেরও অনিবার্য উত্থানকে সম্ভব করে তুলছেন- সে দিকটিকে তারা তাদের গ্রাহ্যতায় আনয়নের মোটেও প্রয়োজনবোধ করেন না। তাদের বিচক্ষণ মেরুকরণের সহজাত প্রবণতাই শুধু তাদের নতুন নির্মিতির অহংবোধ থেকে সহস্র সুবর্ণরেখায় বর্ণিল হয়ে একটি কেন্দ্রীভূত অনধিগত অথচ উচ্চাভিলাষী ভ্রান্ত এবং মেকী বুদ্ধিবৃত্তিক পরিপূর্ণতার (ইনডাকটিভ ইনটেলেকচুয়াল প্লেন্টিচ্যুড)- দিকে অগ্রসরমান থেকেছে- যেখানটিতে তারা তাদের ‘অহংবোধ’-এর মূল শেকড়টি প্রোথিত করেছেন। এবং যথার্থভাবেই এ অগ্রসরমান পদসঞ্চারের অহংকারী চলাচল বর্তমান অধিবাস্তববাদী নাটকের বিষয়বস্তুতে বাস্তবতাহীনতা এবং আঙ্গিকগত নির্মাণের মূল টেকনিক এবং এর সর্বশেষ উত্তরায়ন- কিন্তু যা কখনই সর্বজন গ্রাহ্যতার কাছাকাছি এসে পৌঁছুতে পারেনি। যেহেতু বাস্তবতা বহির্ভূত ‘অধিবাস্তববাদ’ কখনই স্বয়ংসম্পূর্ণ নয়। বরং এক ধরণের আরোপণ। আর সে অর্থে বাস্তবতার শরীরকে ‘অধিবাস্তববাদ’ নামের একটি বিশেষ আবরণে আবৃত করে নবতর তরঙ্গ সৃষ্টির প্রয়াস সর্বার্থেই ব্যর্থতায় নিমজ্জিত।

কালোত্তরণের কালানুক্রমিক ধারায় বিবর্তমান বিশ্বসাহিত্যে নাটকের যে অপ্রতিহত প্রবলতম বেগবান গতিপ্রবাহ সর্বশেষ স্তরে তা ঐ অধিবাস্তববাদী (এ্যাবসার্ডিজম) চিত্তচৈতণ্যভুক্ত অথবা চিত্তচৈতণ্যজাত অসার বুদ্ধিগত ক্ষেত্রজ উপাদান-সমৃদ্ধ প্রাচুর্যের (ইনডাকটিভ ইনটেলেকচুয়াল প্লেনটিচ্যুড)- Tremendous Revelation-কেই বোধের নিগূঢ় অভ্যন্তরে সংস্থাপিত করবার চেষ্টা করে অব্যাহত এবং অনিবার্যভাবে। অথচ এটিকেই তারা গ্রহণ করেছেন তাদের চিন্তাশীলতার অগ্রগামী উৎসের মৌলিকত্ব হিসেবে। এই মৌলিকত্বকে ভিত্তি করে যেখানে বেট্রল্ট ব্রেখটের সুররিয়ালিষ্টিক সচেতনতার বিশ্লেষণাত্মক ক্ষিপ্রতাবোধ ইউজিন ইয়োনেস্কো’র ইথিক্যাল ইনানসিয়েশনের অন্তর্লোকে একটা বিশিষ্ট প্রভাব সম্পাতি সত্ত্বার মতো অতি সূক্ষ্ম ভূমিকা পালনে সক্ষম থেকেই আরো বীর্যবান একটি পৃথক সম্রাজ্য সৃষ্টি সম্ভবের ইঙ্গিতকে সমৃদ্ধ করে তোলে যদিও- কিন্তু সেখানে বোধের গভীরতম তীব্রতাই প্রথম শর্তে অন্বিষ্ট- যা সাধারণভাবে অবশ্যই ইনফিজিব্ল এবং ইনভিজিব্ল- বাস্তবতার নিরিখে যা কোনোভাবেই গ্রহনযোগ্যতার অবকাশ রাখে না। যেহেতু এ তীব্র বোধের ‘পারপাস ওরিয়েন্টেড’- কার্যক্রমের বিস্তৃতি এবং নিবিড় আবেদনের প্রসারমানতা অত্যন্ত সাধারণভাবে দৃষ্টিগ্রাহ্য তো নয়ই বরং দূর্লক্ষ্য। পরিমাণগতভাবে সাধারণ মানুষের কতটা প্রত্যক্ষ-প্রত্যাশা পূরণে সক্ষম সে প্রশ্নটিই এখানে প্রত্যয়সিদ্ধ। আর এ প্রশ্নটিও সঙ্গত কারণ এবং স্বভাবতঃই মূলগতভাবে প্রসঙ্গ বিচ্ছিন্ন নয় অথবা প্রসঙ্গ থেকে দূর-স্থিতিরও কোন প্রমাণ অথবা চিহ্ন বহন করে না।

অধিবাস্তববাদ অর্থাৎ ‘অত্যধিক বাস্তবতা’। ইংরেজিতে যাকে বলা হয় ‘Sur-realism’- আভিধানিক ভাষায় সোজা বাংলায় যার অর্থ দাঁড়ায় ‘মগ্ন চৈতন্যের রূপায়ণ’, ‘স্বপ্নের মতো বানানো খাপছাড়া বস্তুর একত্র সমাবেশ’-ইত্যাদি। ‘অধিবাস্তববাদ’-থিওরীর এই হলো মৌলিক নির্যাস।  নাটক ব্যতীত আর একটি বিশেষ শিল্পের ক্ষেত্রে এই নির্যাসের প্রাবল্য অতিমাত্রিক।  শিল্পটি হলো ‘চিত্রকলা।’  চিত্রশিল্পীরা এই থিওরীটির মৌলিক নির্যাস টুকুকে যথেষ্ট প্রাচুর্যপূর্ণ আগ্রহের সাথে নিজেদের একচ্ছত্র স্বাধীন চিন্তা প্রবাহে স্থাপন করে তাদের সৃজিত চিত্রকর্মে এমনভাবে প্রয়োগ করেন- যাতে শিল্পী চিত্রটির মাধ্যমে যে বার্তাটি সাধারণ মানুষের কাছে পৌঁছে দিতে চান- সে লক্ষ্যটিই অন্তিমে ব্যর্থ হয়ে যায়। অর্থাৎ প্রকারান্তরে সাধারণ মানুষের কাছে ওই চিত্রকর্মটি হয়ে ওঠে চূড়ান্তভাবে অস্পষ্ট এবং দুর্বোধ্য। কোনো আবেদনই সৃষ্টি করতে পারে না সাধারণ মানুষের মননে। এই শ্রেণিভুক্ত চিত্রকরবৃন্দ তাদের চিন্তার পলিতে এ ধরনের একটি ধারণার বীজকে হয়তো রোপন করতে চান যে, Sur-realism’- এর অর্থই হলো ‘Neo-Modernism’. অর্থাৎ ‘মাত্রাধিক আধুনিকতা’। এবং তাদের সৃষ্টিতে এই অত্যাধুনিকতা প্রতিষ্ঠা করে তারা আত্মভাবনার মগ্নতায় নিমজ্জিত থেকে একটি ভিন্ন ধরণের সুখবোধে আপ্লুত হতে চান এই ভেবে যে,- এই অত্যাধুনিক ধরণের চিত্রকর্মগুলিই তাদের এক একজনকে এক একটি ‘মাইলষ্টোন’-এ রূপান্তরিত করে প্রজন্মের পর প্রজন্ম ধরে মানুষের অন্তরের মাঝে বাঁচিয়ে রাখবে অনন্তকাল ব্যাপী। কিন্তু এই অত্যাধুনিক চিত্রকর্ম সৃষ্টি করতে গিয়ে তারা এমন কিছু সৃষ্টি করেন- যা তাদের সৃজন শক্তিকেই প্রশ্নবিদ্ধ করে তোলে এবং তাদের শিল্পী সত্ত্বা সাধারণের দৃষ্টিতে অস্বচ্ছ আরশির ওপর পতিত অতীব অস্পষ্ট ছায়ার আকৃতি নিয়ে তাদের চেতনার গভীরতম প্রদেশে একটি স্থিরীকৃত নেতিবাচক আসনের সৃষ্টিকে অনিবার্য করে তোলে। যা একজন শিল্পীকে নিশ্চিত করেই সাধারণের সান্নিধ্য থেকে অনায়াসে কেড়ে নিয়ে অতিদূর কোনো ভিন্নলোকে স্থাপন করে। সাধারণের মানসলোক এবং শিল্পী মননের মাঝখানে সৃষ্টি করে এক বিশাল ব্যবধানের- যা কোনোভাবেই একজন প্রকৃত শিল্পীর কাক্সক্ষনীয় হতে পারে না।

যে কোনো মহৎ সৃষ্টির মর্মমূলেই তো মানব কল্যাণের অঙ্কুরটির পল্লবায়িত হয়ে উঠবার কথা। মানব কল্যাণ সাধিত হলে বিশাল প্রকৃতির মঙ্গল সাধনও সম্ভব হয়ে ওঠে- এটিই তো স্বতঃসিদ্ধ। কিন্তু স্রােষ্টার কল্পনা প্র¯্রবনের মর্মমূলে যদি সে অঙ্কুরটির পল্লবায়ন না হয় তাহলে তার সৃষ্ট যে কোনো সৃষ্টি মানবকূলের কোনো মঙ্গলই বয়ে আনবে না। এবং তার কালের সীমানা পেরিয়ে পরবর্তী কালে প্রবেশের দরোজাটিও তার জন্যে রুদ্ধ হয়ে যাবে। কালোত্তীর্ণ হবার সুযোগ সে কখনই পাবে না। আর স্রষ্টা যদি তার সৃষ্টির মাধ্যমে কালকে অতিক্রম করতে ব্যর্থ হন তাহলে তার নিজের অস্তিত্বও কোনো কালেই বর্তমান থাকবে না।

এই প্রেক্ষিতকে সামনে রেখে একটি ছোট্ট উদাহারণ দেয়া যেতে পারে। ধরে নেয়া যাক, একজন চিত্রকর এমন একটি ছবি আঁকলেন যে ছবিটিতে লক্ষিত হলো- চিত্রপটের ওপরের দিকের দু’কোণে একটি পূর্ণাঙ্গ চাকার খন্ডিত দু’টি অংশ এবং ওই চিত্রপটের নীচের দিকে আর একটি খন্ডিত অংশ -যা বিক্ষত। অর্থাৎ পুরো চাকাটিই ভগ্ন। ভগ্ন চাকাটির ওই খন্ডিত অংশটির পাশেই একটি পা বিহীন একজন শ্রমিকের ছায়া- যার এক হাতে একটি হাতুড়ি আর অন্য হাতে খুঁচরো কিছু যন্ত্রপাতি- যা দিয়ে শ্রমিকটি ওই খন্ডিত অংশটির ভেঙ্গে যাওয়া অংশটিকে সারিয়ে তুলবার চেষ্টা করছে। এখানে চিত্রটিতে শিল্পী বিভিন্ন রং এর Combination- এর মাধ্যমে তার তুলির নিখুঁত আঁচর টেনে চাকাটির খন্ডিত অংশ গুলির মধ্যে সংযাগ স্থাপন করে বোঝাবার চেষ্টা করেছেন এটি একটি পূর্ণাঙ্গ চাকা। মেরামত শেষে চাকাটির খন্ডিত অংশগুলিকে একত্রিত করা হলে চাকাটি সচল হয়ে উঠবে। বিষয়বস্তু হিসেবে চাকাটিকে তিনি নির্বাচিত করেছেন সম্ভবতঃ এ কারণে যে, একটি সচল ঘূর্ণায়মান চাকা নিশ্চিত গতিময়তার প্রতীক। জীবন চক্রের ঘূর্ণায়মানতা থেমে গেলে জীবন স্থবির হয়ে পড়ে। আর জীবন স্থির হয়ে গেলে প্রকৃতিও তার মাধুর্য হারিয়ে ফেলে এবং প্রকৃতির অপরিমেয় রূপ, রস, গন্ধেরও আর কোনো মূল্য থাকে না। কেননা মূল্যায়নের বস্তুটিই যে মূল্যায়নের আগেই নিঃসার হয়ে পড়েছে। জীবনরোহিত প্রকৃতির মূল্যও তখন আপনা আপনিই তিরোহিত হয়ে যায়।   

এখন এই চিত্রটি যখন একজন সাধারণ দর্শক প্রত্যক্ষ করবেন তখন তিনি কি চাকাটির বিচ্ছিন্ন খন্ডিত অংশ গুলিকে সংযুক্ত করে একটি পূর্ণাঙ্গ সচল চাকার আকৃতিকে তার মানসলোকে প্রতিষ্ঠা করতে পারবেন? তিনি কি শিল্পীর কল্পনাগামীতার স্রােতঃস্বিনী নদীতে অবগাহন করতে সক্ষম হবেন? উত্তরটি অবশ্যই হবে নেতিবাচক। কেননা সাধারণ দর্শকটি বুঝতেই পারবেন না যে শিল্পী চিত্রটিতে কী বোঝাতে চেয়েছেন অথবা চিত্রটির মাধ্যমে তিনি কি কথা বলতে চেয়েছেন সাধারণ মানুষের সাথে। অনেক চেষ্টা করেও যখন তিনি বুঝতে ব্যর্থ হবেন তখন স্বাভাবিকভাবেই চিত্রটির সম্মুখে তিনি আর দাঁড়াবেন না। অন্য কোথাও নিজেকে সরিয়ে নেবেন। অতঃপর তিনি তার পেলবতা মিশ্রিত মসৃণ মনোভূমির আর্দ্রতা থেকে ওই ছবিটির অস্তিত্বটিকে কোনো দ্বিধা না করেই মুছে ফেলবেন চিরদিনের জন্যে। দ্বিতীয়বার আর ছবিটিকে নিয়ে ভাবতে চাইবেন না মোটেই। এই যদি হয় বাস্তবতা তাহলে অধিবাস্তববাদীতার থিওরী প্রয়োগ করে শিল্পী যা সৃষ্টি করলেন সেই সৃষ্টিকে অবলম্বন করে এবং সেই সৃষ্টির মাধ্যমে শিল্পী কি সাধারণ মানুষের মাঝে বেঁচে থাকতে পারবেন অনন্তকাল ধরে? পারবেন না। সাধারণ মানুষের মনের মনিকোঠা থেকে শিল্পীও হারিয়ে যাবেন চিরকালের মতো।

এটি গেল মূলতঃ চিত্রশিল্পে অধিবাস্তববাদী রূপের অতি ক্ষুদ্র একটি উদাহারণ। ঠিক একইভাবে নাট্যশিল্পেও অধিবাস্তববাদী রূপটিকেও বিবেচনা করা যেতে পারে।  যে কোনো ভাবেই হোক একজন মধ্য বয়সী মানুষ একটি জ্বলন্ত অগ্নিকুন্ডে নিক্ষিপ্ত হয়ে জ্বলে যাচ্ছে। কিছুতেই সে সেই অগ্নিকুন্ডের ভেতর থেকে বেরিয়ে আসতে পারছে না।  জ্বলে যেতে যেতে মহাশুণ্য আর পাতালের সর্বশেষ স্তর তোলপাড় করে আর্তনাদ করছে, সবার কাছে বক্ষ দীর্ণ করা বাঁচার আকুতি জানাচ্ছে। কিন্তু হাজার হাজার মানুষ দূরে দাঁড়িয়ে থেকে শুধু লোকটির অনিবার্য মৃত্যু যন্ত্রণা প্রত্যক্ষ করছে, কেউই লোকটিকে বাঁচাবার জন্যে এগিয়ে আসছে না।  লোকগুলির মধ্যে একজনও ওই প্রজ্জ্বলমান অতি হিংস্র অগ্নিশিখার কাছাকাছি আসবার সাহস কুলিয়ে উঠতে পারছে না।  অসহায়ের মতো শুধু লোকটির মৃত্যুক্ষণটির জন্যে অপেক্ষা করছে। এক সময় লোকটি মৃত্যুকাতর যন্ত্রণা নিয়ে নিঃশেষ হয়ে গেল। ওর আর বাঁচা হলো না।  ওর চার পাশে যত তৃণলতা, সবুজ ঘাস, কীট, পতঙ্গ- যা কিছু ছিল সবই পুড়ে ছাই হয়ে গেল। কিছুই রক্ষা পেল না।  

এটি হলো একটি সাধারণ নাটকের অতি সাধারণ একটি বাস্তব দৃশ্য। এই দৃশ্যটিকেই যদি অধিবাস্তববাদী প্রলেপ দিয়ে এভাবে দৃশ্যমান করা হয়- যেখানে দেখা যাবে- মৃত্তিকার কোনো অস্তিত্ব ব্যতীতই মহাশূণ্যের ওপরে গোটা মহাশূণ্য জুড়ে বিশাল বনভূমি। সেই বনভূমিতে প্রচন্ড দাবানলের সৃষ্টি হয়েছে। চোখের পলক না পড়তেই পুড়ে যাচ্ছে সব বৃক্ষকূলের পত্র, পল্লব, শাখা, প্রশাখা, কান্ড সবকিছু। সেই দাবানলে একজন কাঠুরে আটকা পড়ে বৃক্ষরাজির সাথে সে-ও পুড়ে মরছে। তার প্রকট চিৎকারে অস্থির হয়ে স্বর্গ থেকে দেব দেবীরা নেমে এসেও লোকটিকে বাঁচাতে পারলো না। লোকটির জীবন-দীপটি নিভে গেল। এক সময় দাবানল স্তিমিত হতে হতে একেবারে শান্ত হয়ে এলো। দাবানলের চিহ্নমাত্রও আর কোথাও লক্ষিত হলো না। এরপর দেখা গেল যে লোকটি পুড়ে ছাই হয়ে গিয়ে মৃত্যুর কাছে পরাভূত হয়েছিল সেই কাঠুরে লোকটি আবার জীবন্ত হয়ে স্বর্গ থেকে নেমে আসা দেব দেবীদের সঙ্গে দিব্বি দু’পায়ে হেঁটে হেঁটে মহাশূণ্যেই মিলিয়ে গেল। পূর্বের বনভূমিকেও আর মহাশূণ্যে দৃশ্যমান হলো না। সবকিছুই সাধারণ মানুষের দৃষ্টিতে বাস্তবতায় ফিরে এলো।

তুলনামূলক বিচারে প্রথম দৃশ্যটি থেকে দ্বিতীয় দৃশ্যটির চরিত্র একেবারেই আলাদা। সাযুজ্য শুধুমাত্র একটি বিষয়েই। দু’টি দৃশ্যেই একটি মানুষ অগ্নিদগ্ধ হয়ে মৃত্যু বরণ করল- এটুকুই। কিন্তু তারপরেই দ্বিতীয় দৃশ্যে দেখা গেল যে কাঠুরে লোকটি দাবানলের কবলে পড়ে ভয়াবহ মৃত্যুকে আলিঙ্গন করেছিল সেই লোকটিই আবার দাবানল থেমে গেলে পুনরায় জীবন ফিরে পেয়ে পায়ে হেঁটে দেব দেবীদের সঙ্গে স্বর্গের উদ্দেশ্যে যাত্রা করল। অর্থাৎ নাটকের এই দৃশ্যটিতে অধিবাস্তববাদী নাট্যকার যা সৃষ্টি করলেন তা প্রকৃত অর্থে শুধু অবাস্তবই নয় বরং একেবারেই উদ্ভট- যা একজন সাধারণ দর্শকের উপলব্ধি আর অভিজ্ঞানের পুরোপুরি বাইরের এবং বিশ্বাসের সম্পূর্ণই পরিপন্থি। সাধারণ দর্শক এ দৃশ্যটিকে উপলব্ধি করবেন নিতান্তই নিস্ফল আধ্যাত্মিকতার নিছক একটি সান্তনা এবং বাস্তবতার বিপক্ষে একটি চরম ব্যর্থতা আচ্ছাদিত বাস্তবতাহীনতার অবিশ্বাস্য প্রকাশ হিসেবে। আর এ কারণেই দর্শকবৃন্দ এই অধিবাস্তববাদী দৃশ্যটিকে কোনোমতেই তাদের চৈতন্যলোকে স্থাপন করতে পারবেন না। ফলশ্রুতিতে নাট্যকারও কখনই সাধারণ দর্শকের মাঝে তার স্থায়ী আসন গড়ে নিতে কোনোমতেই সক্ষম হবেন না। উদ্ধৃত চিত্রশিল্পীর মতোই তাকেও সাধারণ মানুষের মন থেকে চিরদিনের মতো সময়ের পূর্বেই ‘স্বেচ্ছা-নির্বাসনে’ যেতে হবে। এবং এটিই সবচাইতে বড় বাস্তবতা। এবং এখানে অধিবাস্তবতার কোনো স্থান নেই।

অধিবাস্তববাদীতার Form কে নিয়ে আলোচনা করবার পূর্বে আরও দু’টি বিশেষ Form কে নিয়ে আলোচনা করতে হবে। এবং শুধু আলোচনাই নয় ঋড়ৎস দু’টির চুলচেরা বিশ্লেষণও করতে হবে। ০১. রূপক (Allegory) এবং ০২. প্রতীক অথবা সংকেত (Symbol). প্রথমটি জ্ঞানগত অর্থাৎ Objective, দ্বিতীয়টি ভাবগত অর্থাৎ Subjective.

এখন আমরা Form দু’টিকে বিশ্লেষণ করবার প্রয়োজনেই প্রখ্যাত বি্িরটশ সাংকেতিক কবি ও নাট্যকার W . B Yeats- এর ‘রূপক’ এবং ‘সংকেত’- এর পার্থক্য সম্পর্কিত একটি মন্তব্যকে বিবেচনা করব-

A Symbol is indeed the possible expression of some invisible essence, a transparent lamp about a spiritual flame; while Allegory is one of many possible representation of an embodied thing, or familiar principle, and belongs to fancy, and not to imagination; the one is revelation, the other an amusement. Symbolism said things which could not be said so perfectly in any other way, and needed but a right instinct for its understanding, while Allegory said things which could be said as well, or better, in another way, and needed a right knowledge for its understanding. The one gave dumb things voices, and bodiless things bodies; while the other read a meaning heard or seen, and loved less for the meaning than for its own sake.

(ideas of good and Evil).

রূপকের তাৎপর্য বুদ্ধি-ভিত্তিক। বচন অথবা সংলাপের অর্থ সংলাপের কোন মর্মার্থটিকে ইঙ্গিত করছে- সেটিকে বোঝাতে পারলেই মোটামুটি রূপকের উদ্দেশ্য সিদ্ধ হতে পারে। অর্থাৎ Objective’র বাইরে এর চলাচল সম্ভব হয়ে ওঠে না। এর কার্যক্রমের নির্দিষ্ট অঞ্চল জ্ঞানের ক্ষেত্রজ ভূমিতে। আবার বুদ্ধিবৃত্তিক চেতনার ঘনত্বের মাত্রা সাপেক্ষে এর অর্থের তারতম্যও হতে পারে। সে ক্ষেত্রে রূপকের অর্থ এককের মধ্যে সীমায়িত না থেকে একাধিকেও বিস্তৃত হওয়ার সম্ভাবনাই বেশী থাকে। কিন্তু সংকেতের ঘণিভূত আবেদন মানুষের অনুভূতির অভ্যন্তরে, কল্পনার বহুগামীতায়। যে ভাবানুষঙ্গতা বস্তুজগতকে অতিক্রম করে মানুষের অনুভূতির বিশাল ‘ভাব-সমুদ্রে’ নিয়ত সঞ্চরণশীল সেই সত্যকে উদ্ধার করে একটি বিশেষ রূপের আধারে প্রতিষ্ঠা করবার প্রচেষ্টাই সংকেতের মূল কাজ এবং লক্ষ্য। নাটকের ক্ষেত্রে এর আখ্যানবস্তু, সংলাপ, চরিত্র, ঘটনাবলী ইত্যাদি বিভিন্ন প্রকারের ইঙ্গিত-ব্যঞ্জনার মাধ্যমে বাস্তবাতীত লীলাভূমির, ইন্দ্রিয়াতীত মহাসত্যের প্রচ্ছদকে মানুষের চিত্তলোকে মুদ্রিত করে। সেই অপরূপ ভাব বা সত্য প্রতীকের মাধ্যমে উত্তেজিত কল্পনার অতিবিচিত্র লীলাপথ বেয়ে মানুষের চিন্তা-তরঙ্গের গভীরতম প্রদেশে প্রবেশ করে এক অনির্বচনীয় সুখানুভূতির সৃষ্টিকে সম্ভব করে তোলে। এবং সেই দিব্যানুভূতির ভেতর এর যথার্থ তাৎপর্য এর স্বরূপ-মূর্তিকে অনিন্দ্য-সুন্দর কুসুমের মতো বিকশিত করে তোলে। এই নিখাদ সত্যের যে তাৎপর্য অথবা স্বরূপ তা অবশ্যই এক এবং চিরন্তন। বুদ্ধি-শক্তির কোনো মাত্রাই তাকে ভিন্ন রূপ প্রদান করতে পারে না। সে অর্থে রূপক সীমার ভেতর নিরুদ্ধ থেকেই একটি পরিপূর্ণ বিশেষ রূপ অর্থাৎ জ্ঞানকে উদ্ঘাটনে সচেষ্ট হয়। পক্ষান্তরে সংকেত সীমার অভ্যন্তরে ক্রিয়াশীল থেকেও অসীমের সন্ধানে ব্যাপৃত হয় এবং অসীমের অনুদ্ঘাটিত বিশাল ভাব-সত্য এবং সৌন্দর্যকে উদ্ধার করে মানুষের মনের গহীনে স্থাপন করে। সে দিক থেকে বিবেচনা করলে রূপকে কোনো রহস্যময়তা অথবা স্বাভাবিকতার বাইরে ভিন্ন কিছু সৃষ্টির প্রয়োজন হয় না, নির্দিষ্ট একটি জ্ঞানকে উন্মোচন করতে পারলেই রূপকের উদ্দেশ্য সিদ্ধ হয়। কিন্তু সংকেতের পূর্ণ সফলতা নির্ভর করে তারই সৃষ্ট আবহ অথবা পরিবেশের সুদৃঢ় কাঠামোগত আকৃতি নির্মিতির ওপর।

বিশিষ্ট সংকেত বিশেষজ্ঞ Arthur Symons- এর মতে-

Symbolism- in which art returns to the one pathway, leading through beautiful things to the element. It is an attempt to spiritualise literature, to evade the old bondage of exteriority. Description is banished, that beautiful things may be evoked magically ; the regular beat of verse is broken in order that words may be fly upon subtler wings…..Here, then, in this revolt against exteriority, against rhetoric, against matetialistic tradition, in this endeavour to disengage the ultimate essence, the soul of whatever exists can be realised by the consciousness ; in this dutiful waiting upon every symbol by which the soul of things can be made visible, literature bowed down by so many burdens, may at last attain liberty, and its authentic speech.

(The Symbolist Movement in literature).

উদ্ধৃত মতের আলোকে বিশিষ্ট সাহিত্যিক এবং নাট্য-বিশেষজ্ঞ ড. উপেন্দ্রনাথ ভট্টাচার্যের রচনা থেকে আর একটি উদাহারণ দেয়া যেতে পারে-

‘সাহিত্য ভাষার মারফতে যে-অর্থ ব্যক্ত হয়, সংকেত সেই অর্থকে বিপুল আবেগ এবং গভীর ও অব্যর্থ জ্ঞানের সঙ্গে আমাদের মনে সংক্রামিত করে। সেই সংকেত-মাধ্যমে উপস্থাপিত অর্থকে আমরা নুতন আলোকে, নুতন চেতনায় লাভ করি। সংগীতে আমরা সংকেতের প্রভাব বুঝিতে পারি। গানের কথাকে যখন আমরা সুরের মধ্য দিয়া পাই, তখন তাহার নুতন এক অর্থ, এক অনির্বচনীয় তাৎপর্য হৃদয়ের অন্তঃস্থলে প্রবেশ করে। এই সুর একটা সংকেত। এই সংকেতই আমাদের মনে বিচিত্র অনুভূতির সৃষ্টি করে এবং অসীমের অন্দর-মহলে আমাদের লইয়া যায়।’

    বিখ্যাত সমালোচক A.N. Whitehead- এর সংকেতের কার্যকারিতা সম্পর্কিত ধারণাটি এ রকমের- 

Symbolism is no mere idle fancy or corrupt degeneration; it is inherent in thevery texture of human life. Language itself is a symbolism. Mankind, it seems, has to find a symbol in order to express itself. Indeed ‘expression’ is ‘symbolism’… The function of the symbolic elements in life, is to definite, manageable, reproducible, and also to be charged with their own emotional efficacity; symbolic transference invests their correlative meanings with some or all these attributes of the symbols, and thereby lifts the meanings into an intensity of definite effectivenessÍas elements in knowledge, emotion, and purpose… In every effective symbolism there are certain aesthetic features shared in common. The meaning acquires emotion and feeling directly excited by the symbol. This is the whole basis of the art of literature, namely, that emotions and feelings excited by the words should fitly intensify our emotions and feelings arising from contemplation of the meaning…The same principle holds for all the more artificial sorts of human symbolism; – for example, it’s religious art, Music is particularly adapted for this symbolic transfer of emotions….

এই হলো সংকেতের অতীব মহার্ঘ মূল্যমান এবং কর্মক্ষম শক্তির শেকড়। যে শেকড় থেকে উত্থিত হয় অতি সূক্ষ্ম, জটিলতম এবং অতীন্দ্রিয় ভাব-সত্যের মর্ম-সৌন্দর্যের অনুভূতিটি। এই সৌন্দর্য মন্ডিত ভাবানুভূতিকে একটি শীর্ষ মাত্রায় রূপায়নের লক্ষ্যেই শিল্পী সাহিত্যিকবৃন্দ তাদের সৃষ্টিতে সংকেতের ব্যবহার করে থাকেন। এবং এটিকে সঠিক প্রয়োগের মাধ্যমে তারা সফলতাও লাভ করেন।

এ বিষয়টিকে বিবেচনার জন্যে গ্রহণ করে অগ্রসর হলে বিশ্বখ্যাত নাট্যকার ইবসেনের কয়েকটি নাটক আপনা আপনিই দৃষ্টিসীমায় স্থাপিত হয়ে যায়- ‘A Doll’s House, ‘Hedda gabler’, ‘Rosmersholm’, ‘The Wild Duck’. ‘The Master Builder’- প্রভৃতি নাটকে ইবসেন যথেষ্ট মুন্সীয়ানার সাথে সংকেতের ব্যবহার করেছেন। এবং তিনি উত্তীর্ণ হয়েছেন। ইবসেন ছাড়াও পাশ্চাত্যের অতি আধুনিক নাট্যকার Eugene O’neill-I তার কোনো কোনো নাটকে এই সংকেতের ব্যবহার করেছেন। বিশেষতঃ তার ‘The Hairy Ape’- নাটকের একটি দৃশ্যে নিশ্চল, নিশ্চুপ পুতুল সাদৃশ্য কতগুলি নারী পুরুষের যে আবির্ভাব ঘটিয়েছেন তারা আর কেউই নয় একেক জন যেন একেকটি যান্ত্রিক রোবটের প্রতীক- যাদের মধ্যে রক্ত মাংস নেই, আবেগ নেই, উচ্ছ্বাস বিহীন, প্রাণচঞ্চলতা বিহীন অত্যাধুনিক যান্ত্রিক সভ্যতার জড়ায়ুতে জন্মিত- যারা কতগুলি নিছক পুতুল ব্যতীত আর কিছুই নয়। নাট্যকার অত্যন্ত সচেতনভাবেই যান্ত্রিক সভ্যতাকে মানুষের আবেগ, উচ্ছ্বাস, প্রাণ চাঞ্চল্যকে কেড়ে নেবার হিংস্র দানবীয় শক্তি হিসেবেই বোঝাতে চেয়েছেন এবং এই পুতুল-সাদৃশ্য মানুষগুলিকে তিনি যান্ত্রিক সভ্যতার মর্মান্তিক শিকারের প্রতীক হিসেবে গ্রহণ করে সংকেতার যথার্থতাকে প্রতিষ্ঠা  করেছেন। নাটকটির নামকরনেও নাট্যকার সংকেতের ব্যবহার করেছেন। নাটকটির ‘The Hairy Ape’- অর্থাৎ ‘লোমশ গরিলা’ নামকরনটি সেই সংকেতকেই ধারণ করে। সাধারণতঃ এই প্রজাতির প্রাণীগুলি স্বভাবগত ভাবেই হিংস্র প্রকৃতির হয়ে থাকে। এই নামকরনটি করে Eugene O’neill- গোটা যান্ত্রিক সভ্যতাকেই হিংস্র লোমশ গরিলা হিসেবে Symbolize” করবার প্রয়াস পেয়েছেন। সংকেত প্রদান করেছেন।

ইবসেন তার ‘A Doll’s House’- নাটকে নায়িকা নোরার জীবনের অন্তর্দ্বান্দ্বিকতার ভয়াবহ দূর্ভার যন্ত্রণা, বিভিন্ন কারণে স্বামীর ভালোবাসাকে একান্ত আপনার করে নেবার ক্ষেত্রে প্রবল সন্দেহে সন্দিগ্ধ হওয়া এবং সে ভালোবাসার ওপর কোনোমতেই বিশ্বাস স্থাপন করতে না পারা- যার প্রেক্ষিতে সার্বক্ষণিক একটি অদৃশ্য আতঙ্ক এবং ভীতির তাড়নায় আত্ম-তাড়িত হয়ে উন্মাদ অস্থিরতার কাছে নিজেকে সমর্পণ করা, কখনো কখনো প্রচন্ড আত্মাভিমানে জর্জরিত হয়ে আপন ঘর ত্যাগ করে অনিশ্চিত উদ্দেশ্যের পথে নিরুদ্দেশ হয়ে যাবার স্থির সংকল্প নির্মাণ করা- সবকিছু মিলিয়ে নোরার অন্তর্লোকে যে ভয়ঙ্কর ঘূর্ণিঝড়ের উত্থান তারই সংকেত হিসেবে ‘Tarantella’- নামীয় একটি ‘দ্রুতলয়ের ঘূর্ণি নৃত্যের’ সৃষ্টি করেছেন নাটকটির একটি দৃশ্যে- যা নোরার অন্তর্জগতের উন্মত্ত ঝড়ের আঘাতে আহত, বিধ্বস্ত মানসিক অবস্থার অত্যন্ত আবেগী অবস্থানকে অত্যন্ত নিখুঁতভাবে তুলে এনেছে দর্শকদের সামনে। এই Tarantella’- নামীয় ‘দ্রুতলয়ের ঘুর্ণি নৃত্যটিকেই’ নাট্যকার নোরার মানসিক ভাব-সমুদ্র চিত্রের সংকেত হিসেবে ব্যবহার করেছেন একটি পরিপূর্ণ সফল সংকেত হিসেবে- যা দর্শক, নাট্য-বিশেষজ্ঞ, বিভিন্ন শ্রেণির নাট্যকার এবং সাহিত্যিকদের কাছেও মূল্যায়িত এবং আদৃত হয়েছে যথার্থ হিসেবে। এ ধরণের সংকেতের ব্যবহার ইবসেনের প্রায় সবক’টি নাটকে রয়েছে। আশ্চর্যের বিষয় সংকেত প্রয়োগের ক্ষেত্রে ইবসেন তার কোনো নাটকেই ব্যর্থ হন নি। আর নাট্য-সাহিত্যে সংকেতের সার্থকতা এখানেই।  

যদি ইবসেনের ‘Hedda Gabler’- নাটকের মূল বিষয়ের অতলান্তকে স্পর্শ করা যায় তাহলে সে নাটকটিতেও ‘A Doll’s House’- নাটকের নায়িকা নোরার মতোই ‘Hedda Gabler’-না টকের নায়িকা Hedda- এর মানসলোকের  অতি সূক্ষ্ম একটি বিপর্যস্ত অনুকৃতির সঙ্গে পরিচিত হতে হয়। নোরা যখন তার স্বামীর ভালোবাসার ওপর বিশ্বাস হারিয়ে ফেলে Hedda- ও যেন কতকটা সেভাবেই তার ভালোবাসবার পাত্র, তার একান্ত প্রিয়তম ‘Eilert Lovborg’-কেও একটি শিল্প-সম্মত আনন্দোজ্জ্বল `Vine-Leaves’- সীমাহীন সৌন্দর্যের প্রতীক হিসেবে গ্রহণ করে তার স্বপ্নের সৌন্দর্যের মাত্রাকে কয়েকগুণ বাড়িয়ে তুলতো। এটি করে Hedda- চরম সুখ এবং আত্মতৃপ্তি অনুভব করতো। কারণ `Vine-Leaves’-টি ছিল গ্রীসের সুরা দেবতা ‘Bacchus’ এর গভীর ভাবের অনুষঙ্গের সঙ্গে ওতপ্রোতভাবে জড়িত। কেননা সাধারণতঃ পানভোজন জাতীয় আনন্দ উৎসবের ভেতর দিয়ে যে উচ্ছ্বাস এবং উন্মত্ততা প্রকাশিত হয় তারই প্রকাশিত রূপটি ছিলো `Vine-Leaves’.  

যখ থেকে ‘Eilert Lovborg’-এর সঙ্গে Hedda- এর বন্ধুত্বের সম্পর্কটি ঘণিভূত হতে শুরু করে তখন থেকেই Hedda-‘Eilert Lovborg’-কে তার স্বাপ্নিক অবয়বে মাথার শীর্ষে সেই `Vine-Leaves’- শোভিত এক অনিন্দ্য-সুন্দর, দিব্যকান্তি মহান পুরুষ হিসেবেই প্রতিষ্ঠা করেছিলো। বন্ধুত্বের এক পর্যায়ে Hedda- এর সঙ্গে চরম অন্তরঙ্গ হয়ে এবং Hedda-কে বিশ্বাস করে তার জীবনের অনেক মদ্যপান এবং নারী ঘটিত গোপন কাহিনী অবলীলায় Hedda-কে বলেছিলো। কিন্তু Hedda-র আত্যাশ্চার্য মানসিক গঠন এবং প্রকৃতি সম্পর্কে ‘Eilert Lovborg’- এর সূক্ষ্ম কোনো ধারণাই ছিলো না। যে কারণে Hedda- কর্তৃক সে প্রত্যাখ্যাত হয়। কেননা এই ধরণের জীবন প্রবাহকে Hedda- কর্তৃক সে প্রত্যাখ্যাত হয়। কেননা এই সব সময়ই তীব্র ঘৃণার সাথেই তুলনা করতো। এই ধরণের যাপিত জীবনের ওপর একাধারে তার ছিলো প্রচন্ড বিতৃষ্ণা এবং ভীতি। যে কারণে এক সময় তাদের সম্পর্ক বন্ধুত্বের মাত্রা অতিক্রম করে আরও ঘনিষ্ট হবার পূর্বেই রণের জীবন প্রবাহকে Hedda- অত্যন্ত কৌশলে এবং বিচক্ষণতার সাথে ‘Eilert Lovborg’-কে প্রত্যাখ্যান করেছিলো।

Hedda- যেভাবে স্বর্গীয় সৌন্দর্য, উচ্ছ্বাস এবং আনন্দে বর্ণোজ্জ্বল মস্তকের ওপর `Vine-Leaves’ শোভিত – ‘Eilert Lovborg’-কে নিজের অবচেতন মনের উঠোনে স্থাপন করে নিরবধি এক বিশেষ ধরণের সুখ অনুভব করতো ‘Eilert Lovborg’- তার জীবনের ইন্দ্রিয়জ কামনা, বাসনাকে বাস্তবে রূপায়ণের যে বর্ণনা Hedda-কে দিয়েছিলো তাতে ‘Eilert Lovborg’-কে গ্রহণ করবার সব স্বপ্নই Hedda- র জীবন থেকে মুছে গিয়েছিলো। বিশেষতঃ গায়িকা Diana- এর বাড়ীতে Diana’ র সাথেই যখন ‘Eilert Lovborg’- এর চরম কেলেঙ্কারির কথা Hedda- বিশ্বস্ত সূত্রে জানতে পারলো তখন Hedda’র প্রতিক্রিয়া ছিলো এ রকমের- ‘Then he had no vine-leaves in his hair’. অর্থাৎ Hedda’ র জীবনের মহাপুরুষ হিসেবে- ‘Eilert Lovborg’ র অবস্থান নিমেষেই চিরদিনের মতো তিরোহিত হয়ে গিয়েছিলো।

‘A Doll’s House’- নাটকে যেমন একটি উন্মত্ত ঘূর্ণি নৃত্যকে সংকেত হিসেবে ব্যবহার করে নোরার ‘জীবন-ঝড়ের’ তান্ডবকে প্রকাশ করা হয়েছে ঠিক একইভাবে এ নাটকটিতেও `Vine-Leaves’কে একটি চমৎকার সংকেতকে ব্যবহার করে Hedda’ র মনোলোকের সুচি ¯িœগ্ধতাকে শুভ্রতার আলোকে উপস্থাপন করা হয়েছে।

এ কথা তো সত্যি যে, যদিও সাহিত্য-শিল্পে ভাবের প্রকাশ ঘটে সাধারণভাবে ভাষার মাধ্যমে এবং অপেক্ষাকৃত স্থুলভাবে। কিন্তু এই স্থুলতার বাইরেও যে সুক্ষ্মাতিসূক্ষ্ম, অনিশ্চিত এবং অনির্দিষ্ট ভাব স্থুলতার গভীরাভ্যন্তরে স্থিত থাকে যাকে কেবলমাত্র নিবিড় অনুভবগামীতার মাধ্যমেই উপলব্ধি করা যায়- যে ভাবের অফুরন্ত সমগ্রতাকে অবশ্যই শুধুমাত্র ভাষার মাধ্যমে উদ্ঘাটন করা যায় না। সে ভাবের পরিপূর্ণ আকৃতিগত রূপায়নের জন্যে প্রয়োজন হয় ভাষার বাইরের অন্যকিছুর। এই ‘অন্যকিছুটিই’ হলো ‘সংকেত’ অথবা ‘Symbol’. এই সংকেত মানুষের কল্পনাগামীতার সম্মুখের অযুত নিযুত দূরায়ত্ব বাধার দরোজাকে উন্মুক্ত করে দিয়ে অপার ভাব-সমুদ্রে বিচরণ করবার সুযোগ করে দেয় অনায়াসেই। মানুষ তার চৈতন্যলোকের মগ্নতা দিয়ে এই ভাব-সমুদ্রে নির্বাধ বিচরণে ব্যাপৃত থেকে একটি একটি করে ‘অরূপ-রতন’কে তুলে আনে তার মানসিক আকাক্সক্ষা পূরণের লক্ষ্যে। এটিই হলো সংকেতের স্বার্থকতা। এখানে এই প্রেক্ষিতে আর একটি উদ্ধৃতি নিশ্চিত উল্লেখের দাবী রাখে- “শিল্পীর যথার্থ প্রকাশ স্বার্থকতা লাভ করে সংকেত-প্রয়োগে। সংকেতই অনির্দেশনীয়কে নির্দিষ্ট করে, অব্যক্তকে কৌশলে ব্যক্ত করে, অরূপকে রূপময় আভাসের মধ্যে বন্দী করে।” জার্মান নাট্যকার হাউপট্ম্যান তার শেষ দিকের কয়েকটি নাটক রচনায় এই সংকেতের কাছেই সমর্পিত হয়েছিলেন। প্রথম দিকে যদিও তিনি বাস্তববাদী নাট্যকার হিসেবেই প্রতিষ্ঠিতি পেয়েছিলেন। রুশ নাট্যকার আন্দ্রিভ যখন সাংকেতিকতাকে আশ্রয় করে তার ‘The Life of Man‘-নাটকটি রচনা শেষে মঞ্চস্থ করেছিলেন তখন তার অভিভূত দর্শকরা তাকে প্রশ্ন করেছিলো- ‘কেন তিনি এমন অভিনব পন্থায় নাটকটি লিখলেন? উত্তরে তার মন্তব্যটি ছিলো- “প্রত্যেক সাহিত্য-শিল্পীই তার বক্তব্য যাতে সুন্দর শিল্প-সম্মতভাবে প্রকাশ করা যায়, তারই চেষ্টা করেন। তিনিও তার বক্তব্য এই রীতিতে প্রকাশ করলে যথাযথ এবং ভালোভাবে প্রকাশিত হবে- এই ধারণা এবং বিশ্বাস থেকেই সাংকেতিকতার রীতিটিকে তিনি গ্রহণ করেছিলেন। এই রীতি ব্যতীত অন্য কোনো রীতিতেই তার বক্তব্য তার আকাক্সক্ষা অনুযায়ী যথাযথভাবে প্রকাশ করা সম্ভব হবে না বলেই তিনি এই রীতিটিকে গ্রহণ করেছিলেন।”         

‘Rosmersholm’- নাটকে ইবসেন Foot-bridge- নামের একটি প্রতীকের সৃষ্টি করেছেন। যে Foot-bridge- টি গোটা নাটকটিকে অব্যাহতভাবে প্রভাবিত করেছে প্রতি মূহুর্তে। দর্শকদের কল্পনা-প্রবাহে দারুণ এক মর্মান্তিকতা স্থায়ী এক অনুভবের উপলব্ধিকে প্রতিষ্ঠিত করেছে। কারণ নাটকটির বিষয়বস্তু এমনই যে, Foot-bridge- টি না থাকলেই বরং মনে হতো নাটকটি অসম্পূর্ণই থেকে গেল।

‘The Wild Duck’- নাটকে ইবসেন Wild Duck টিকেই একাধারে রূপক এবং সংকেত হিসেবে ব্যবহার করেছেন। নাটকের কেন্দ্রিয় চরিত্র `Old Ekdal- এর দুঃসহ অস্বাভাবিক, চাঞ্চল্যবিহীন, নিস্তরঙ্গ, নিঃসঙ্গ জীবনের চূড়ান্ত অসহায়ত্বকে তিনি একটি আহত বুনো হাঁসের রূপক হিসেবে গ্রহণ করে সেই বুনো হাঁসটিকেই আবার সংকেতে রূপান্তরিত করে `Old Ekdal’- এর জীবনের সাথে তুলনা করেছেন। যে বুনো হাঁসটিকে আবার ওই নাটকের আর একটি চরিত্র ‘Werle’- এর নির্মমতার ছুরি দিয়ে আহত করা হয়েছে-যা শুধু Old Ekdal- এর জীবনকেই আহত করে নি বরং নাট্যকারের জীবনকেও আহত করেছে বলে ওই নাটকে নাট্যকার ইঙ্গিত করেছেন- যেটি নাট্যকার কোনো প্রশ্নের অবকাশ না রেখেই স্পষ্ট করেছেন। একটি নির্দিষ্ট রূপককে সংকেতে রূপান্তরিত করে সেই সংকেতের মাধ্যমে নাটকের গোটা বিষয়বস্তুর নিগুঢ়তম ভাবকে মানুষের মর্ম মূলে প্রোথিত করেছেন নাট্যকার ইবসেন। যদি ইবসেন সংকেতটি ব্যবহার না করতেন তাহলে হয়তো নাটকটিকে ‘সফলতা-জ্ঞানে’ বিবেচনা করা যেত কি না- প্রশ্নটি থেকেই যেত চিরকালের জন্যে।

‘The Master Builder’- নাটকটিতেও ইবসেন অত্যন্ত বিচক্ষণতার সাথে নিখুঁত এবং অতিসূক্ষ্মভাবে রূপক এবং সাংকেতিকতাকে ব্যবহার করেছেন। নাটকটির প্রতিটি দৃশ্যের পরতে পরতে রূপক এবং সাংকেতিকতার প্রভাব-সম্পাতি ভূমিকা কোনো প্রকার প্রশ্ন ছাড়াই স্পষ্ট। Master Builder Halvard Solness- এর একটি প্রতিশ্রুতিকে কেন্দ্র করে মানুষের অপূর্ব বাসগৃহ, গির্জার চূড়া, শুন্য আকাশে বিশালতম অতুল-মোহনীয় প্রাসাদতুল্য সৌধ নির্মাণ এবং Mrs. Solness- কর্তৃক দীর্ঘকাল ধরে অতীব সৌন্দর্যমন্ডিত নয়টি পুতুলকে আগলে রেখে পরম যত্ন আর মমতায় সিক্ত করে সংরক্ষণ করন- যার মাধ্যমে তার স্ত্রীর মনোবৈকল্যকে একটি রূপকের আকারে তুলে ধরা সবকিছুই ওই নাটকে সংকেত হিসেবেই চিত্রিত। এসব সংকেতের চিত্রায়ন করা হয়েছে কেবলমাত্র Master Builder Halvard Solness- এর গোপন প্রণয়-সঙ্গী Hilda Wangle’কে দশ বছর পর তার নিজ-কল্পিত একটি রাজ্যদান করা এবং তাকে সে রাজ্যের রাজকুমারী বানিয়ে দেবার প্রতিশ্রুতির সার-শুন্যতা প্রমাণ করবার এবং Hilda Wangle’কে সূক্ষ্ম প্রতারনাপূর্ণ মিথ্যে স্বপ্ন-তন্দ্রায় আপাদমস্তক ডুবিয়ে রেখে তাকে নিজের ইচ্ছেমত ব্যবহার করবার পরিপুষ্ট ইঙ্গিত হিসেবে। প্রকৃত অর্থেই যেকোনো মানুষকে যদি কোনো অলৌকিক স্বপ্নের চূড়ায় অধিষ্ঠিত করবার প্রলোভন দেখানো যায় এবং সে যদি এ প্রলোভনে প্রলোভিত হয়ে প্রলোভনটিকে একবার বিশ্বাস করে তাহলে সে শুধু সেই স্বপ্নের শিখরে উঠতেই চাইবে। নীচের দিকে তাঁকাবার কোনো প্রয়োজনই সে মনে করবে না। কিন্তু যে মুহুর্তে তার সে স্বপ্নটি তাসের প্রাসাদের মতো একটি নিঃশ্বাসের আঁচড়েই ভেঙ্গে পড়বে তখন সে আর অক্ষত থাকবে না। সংশ্লিষ্ট নাটকে নাট্যকার রূপক এবং সংকেতের ভেতর দিয়ে সেই প্রখর বাস্তবতাকেই নিপূণভাবে দর্শকদের সামনে মেলে ধরেছেন। নাটকটিতে সংকেতের প্রয়োগ না ঘটালে যা কখনই সম্ভব হতো না। সেদিক থেকে ইবসেন সংকেতাশ্রয়ী নাট্যকার হিসেবে শতভাগ সফল বোধকরি।

এখানে এটি বলা প্রাসঙ্গিক যে, সংকেত-শিল্পের কাজই হলো- জ্ঞানের বাইরে, দৃশ্যমানতার আড়ালে থেকে ভাবের অভ্যন্তরে যে বিশাল অপার্থিব লোকালয়, অদৃশ্য, অজ্ঞেয় জগত, সে জগতের বহুবিচিত্র অনুভূতির অভিজ্ঞানকে একটি বিশেষ রূপের আকারে আকৃতি দিয়ে মানুষের নিস্তব্ধ চৈতন্যকে আলোড়িত করা। রবীন্দ্রনাথের কিছু কিছু নাটকেও এ ধরণের রূপক এবং সংকেতের স্থিতি দৃশ্যমান। বিশেষতঃ ‘প্রকৃতির প্রতিশোধ’, ‘ডাকঘর’, ‘শারোদোৎসব’, ‘রাজা’, ‘অচলায়তন’, ফাল্গুনী’, ‘মুক্তধারা’, রক্তকরবী’, কালের যাত্রা’- প্রভৃতি নাটকে স্বাচ্ছন্দ্যে রূপক এবং সংকেতের ব্যবহার করেছেন রবীন্দ্রনাথ।

‘প্রকৃতির প্রতিশোধ’- নাটকে যে সন্ন্যাসী প্রকৃতির অফুরন্ত রূপ, রস, গন্ধকে অগ্রাহ্য করে প্রকৃতির ওপর প্রতিশোধ নেবার জন্যে প্রকৃতির অসীমতার অতিদূরে অবস্থানের লক্ষ্যকে মোক্ষ জ্ঞানে একটি গুহার নির্দিষ্ট একটি ক্ষুদ্র সীমায়তির ভেতরেই অসীমকে আবদ্ধ করে নিজের অপরিপক্ক চিন্তা-সীমার ক্ষুদ্র আয়োতনে উদ্ধার করতে চেয়েছেন- সেই সন্ন্য্াসীই আবার নিতান্তই একটি অস্পৃশ্য, অসহায়, অন্ত্যজ শ্রেণির নিজ কন্যবৎ বালিকা- যে বালিকাটিকে অস্পৃশ্য বলে, অন্ত্যজ বলে কেউই আশ্রয় দান করে নি সেই বালিকাটিকে নিজে আশ্রয় দিয়ে সন্ন্যাসী একদিকে যেমন কুসংস্কার এবং জাতিভেদ প্রথার বিরুদ্ধে নিজের সংস্কারমুক্ত অবস্থানকে স্পষ্ট করেছেন ঠিক তেমনি বালিকাটির প্রাণ কেঁড়ে নেয়া শ্রদ্ধা, ভালোবাসা আর মমতার কাছে শেষ পর্যন্ত নিজেকে সমর্পণ করে গুহা থেকে বেরিয়ে এসে প্রভাতী সূর্যের বিকীর্ণমান অভূতপূর্ব সৌন্দর্য, স্নিগ্ধ প্রভাতী আলোয় উছলিত প্রকৃতি-রূপের পরিপূর্ণ সুধা-ভান্ড থেকে সে সুধা পান করবার জন্যে উদ্বেলিত হয়ে ওঠেন এবং প্রকৃতি সম্পর্কিত সন্ন্যাসীর ভ্রমাত্মক ধারণা এবং ভ্রান্ত সিদ্ধান্তের বন্দীত্ব থেকে মুক্তি দিয়ে প্রকৃতির অপার সৌন্দর্যকে আলিঙ্গন করবার যে সুযোগ কন্যা-সম ওই অস্পৃশ্য, অসহায় বালিকাটি করে দিয়েছে- কৃতজ্ঞতা জানাবার জন্যে তার কাছেই ছুটে গিয়ে প্রমাণ করেছেন অসীমকে কখনই সীমার ফ্রেমে আবদ্ধ করা যায় না। কিন্তু বালিকাটিকে কৃতজ্ঞতা জানাবার তার এ প্রচেষ্টা সফল হয় না। উর্দ্ধশ্বাসে গুহামুখে ফিরে গিয়ে তিনি প্রত্যক্ষ করেন বালিকাটির প্রাণশুন্য দেহটি গুহা মুখেই পড়ে রয়েছে। গুহার ভেতর প্রবেশ করবার আর কোনো প্রয়োজন হয় না সন্ন্যাসীর। ক্ষুদ্র গুহার ক্ষুদ্রত্বের অভ্যন্তরে আত্মগোপন করবার পথটি চিরদিনের মতো রুদ্ধ করে দিয়ে গেছে বালিকাটির নিস্পাপ মৃতদেহটি। এখানে খুবই সূক্ষ্মভাবে লক্ষ্যণীয়- যে প্রকৃতির ওপর প্রতিশোধ নেবার জন্যে অর্থাৎ প্রকৃতির অসীমত্বকে নিজের মধ্যে ধারণ করে তাকে নিয়ন্ত্রণ করবার জন্যে যে সন্ন্যাসী দৃঢ়-সংকল্পিত ছিলেন সেই প্রকৃতিই সন্ন্যাসীর সংকল্পকে চূর্ণ বিচূর্ণ করে দিয়ে সন্ন্যাসীর ওপরই চূড়ান্ত প্রতিশোধ গ্রহণ করলো। সসীমের মধ্যে অসীমের অনুসন্ধান যে নিস্ফল- এ শিক্ষাই বালিকাটি সন্ন্যাসীকে দিয়ে গেলো। 

কিন্তু যে অসহায়, সকরুণ অশ্রুসজল বালিকাটিকে দেখে ওর অসহায়ত্ব এবং করুণতাকে সহ্য করতে না পেরে যে সন্ন্যাসী বলেছিলেন-

আয় বাছা, বুকে আয়, ঢাল অশ্রুধারা,
ভেঙ্গে যাক্ এ পাষাণ তোর অশ্রুস্রাতে,
আর তোরে ফেলে আমি যাব না বালিকা,
তোরে নিয়ে যাব আমি নুতন জগতে।

এ কথাগুলি বলে বালিকাটিকে আশ্রয় দেবার পর সন্ন্যাসীর মনে দারুণ প্রতিক্রিয়ার সৃষ্টি হয়। সন্ন্যাসীর মনে হয় প্রকৃতির মায়ার বাঁধন থেকে বেরিয়ে এসে আবার তিনি মায়ার বাঁধনেই জড়িয়ে পড়ছেন। এ বোধ থেকে তিনি উচ্চারণ করেন-

রাক্ষসী, পিশাচী, ওরে তুই মায়াবিনী-
দূর হ, এখনি তুই যারে দূর হয়ে।
এত বিষ ছিল তোর ওইটুকু মাঝে
অনন্ত জীবন মোর ধ্বংস ক’রে দিলি।
ওরে তোরে চিনিয়াছি-আজ চিনিয়াছি
প্রকৃতির গুপ্তচর তুই রে রাক্ষসী,
গলায় বাঁধিয়া দিলি লোহার শৃঙ্খল।

সন্ন্য্যাসীর এ ধরণের কথা শুনে বালিকাটি মূর্ছা গেলে, মূর্ছিতা বালিকাটিকে গুহা মুখে ফেলে রেখেই সন্ন্যাসী অরণ্যের মাঝে পালিয়ে যান। অরণ্যে পালিয়ে গিয়েও সন্ন্যাসী বালিকাটির করুণ, কাতর কন্ঠস্বরকে ভুলতে পারেন না। ঝড়, ঝঞ্চা আর চমকিত বিদ্যুতের তান্ডবের মধ্যেও বালিকাটির অসহায় ছোট্ট মুখ খানি যেন বারবার করে সন্ন্যাসীর হৃৎপিন্ডকে দুমড়ে, মুচড়ে দিতে থাকে। পরিবর্তিত হয়ে যায় সন্ন্যাসীর অন্তর্লোক। সন্ন্যাসব্রত ত্যাগ করেন সন্ন্যাসী এই বলে-

যাক্, রসাতলে যাক্ সন্ন্যাসীর ব্রত!
(ছুঁড়িয়া ফেলিয়া) দূর কর, ভেঙ্গে ফেল দন্ড কমন্ডলু
আজ হতে আমি আর নহি রে সন্ন্যাসী!
পাষাণ সংকল্পভার দিয়ে বিসর্জন
আনন্দে নিঃশ্বাস ফেলে বাঁচি একবার।

এ নাটকে সন্ন্যাসীর মানসলোকে তুমুল অন্তর্দ্বন্দ সৃষ্টির মূল উপাদানটিই হলো- রঘু-কন্যা সেই বালিকাটি। যদিও নাটকটিতে বালিকাটির ছায়ার মতো একটি শীর্ণ রেখাচিত্রকেই অঙ্কন করা হয়েছে তারপরেও এই শীর্ণ রেখাচিত্রটিই সন্ন্যাসীর মনোজগতে প্রতিষ্ঠিত সীমা এবং অসীমের দ্বান্দিকতাকে তার শ্রদ্ধা, ভালোবাসা এবং মমতা দিয়ে প্রচন্ডভাবে আঘাতের পর আঘাত করে সেই দ্বান্দিকতার নিরসন ঘটিয়ে সন্ন্যাসীকে চরম সত্যের আসনে প্রতিষ্ঠিত করে। এই আসনে অধিষ্ঠিত হয়েই সন্ন্যাসী বালিকাটির ¯েœহ, প্রেম, ভালোবাসাকে উপেক্ষা করবার আত্ম-যন্ত্রণাকে প্রকাশ করে এভাবে-

বাছা- বাছা-কোথা গেলি। কী করিলি রে-
হায় হায়-একি নিদারুণ প্রতিশোধ।

নাটকটিতে সন্ন্যাসী ‘সীমা’র একটি রূপক মাত্র। আর শীর্ণ রেখাচিত্রে অঙ্কিত ‘বালিকা’টি ওই রূপকটিকে ভেঙ্গে রূপকটির ভেতর থেকে পূর্ণাঙ্গ পরিবর্তিত সন্ন্যাসীকে বের করে এনে সত্যের মুখোমুখি দাঁড় করাবার বিপুল, বিশাল সংকেত অবশ্যই- যাকে কোনোমতেই অস্বীকার অথবা অগ্রাহ্য করা যায় না।

এটি রবীন্দ্রনাথের প্রথম নাটক-যেটিতে তিনি গান অথবা সঙ্গীতের ওপর আশ্রয় গ্রহণ করেন নি। নাটকটি ‘নাট্য-জ্ঞানে’-উত্তীর্ণ কিনা সেটি ভিন্ন বিষয়। তবে তার প্রথম নাটকেই তিনি ‘রূপক’ এবং ‘সংকেত’-এর ব্যবহার করেছেন- এটি অভিনব। এবং এই অভিনব সৃষ্টির অভিনবত্বে তিনি সফল।

রবীন্দ্রনাথের আর একটি নাটক- ‘ডাকঘর’। এ নাটকটিতেও রবীন্দ্রনাথ রূপক এবং সংকেতের ব্যবহার করেছেন অত্যন্ত সচেতনভাবেই। ডাকঘর নাটকের কেন্দ্রীয় চরিত্র একটি শিশু-যার নাম অমল। নাট্যকার শিশুটিকে রুগ্ন বলেছেন, আবার নাটকটির গভীরে প্রবেশ করলে বোঝা যায় প্রকৃত অর্থে শিশুটি রুগ্ন নয়- ওকে রুগ্ন বানানো হয়েছে। অশিক্ষিত, মূর্খ, এক গ্রাম্য কপট শাস্ত্রাচারী কবরেজ ওকে রুগ্ন, অসুস্থ বানিয়ে দিয়েছে। আসলে অমলের কোনো রোগই নেই, সে সম্পূর্ণ সুস্থ। কবরেজ তার মিথ্যে বিদ্যের অহংকার প্রকাশ করবার উদ্দেশ্যে এবং সন্তান হিসেবে শিশুটিকে গ্রহণকারী নিঃসন্তান মাধব দত্তের কাছ থেকে অর্থোপার্জনের লক্ষ্যে শিশুটিকে একটি বদ্ধ ঘরে আটকে রেখে ওকে সুস্থ করে তুলবার যে ব্যবস্থাপত্র প্রদান করে সেটি এ রকমের- শিশুটির শরীরে কোনোভাবেই শরতের আলো, হাওয়া লাগানো যাবে না। বদ্ধ ঘরের বাইরে ওকে কিছুতেই নেয়া যাবে না- এ সব করলে ওকে সুস্থ করে তোলা যাবে না, ওর রোগ বেড়েই চলবে। মধাব দত্ত শিশুটির মঙ্গলাকাক্সক্ষায় কবরেজের কথাই মেনে নেয়। অমলকে বদ্ধ ঘরের চার দেয়ালের ভেতরেই আবদ্ধ করে রাখে। কিন্তু এসব করেও অমলের রোগ সারে না বরং দিন দিন ও আরও দূর্বল হয়ে পড়ে।

অমল ওই ঘরের চার দেয়ালের বাইরে বেরিয়ে আসতে চায়।  ঘরের একটি মাত্র খুব ছোট্ট জানালা দিয়ে ও বাইরে খেলাধুলারত ওর বয়সের ছেলে মেয়েদের খেলাধুলা দেখে, ওদের সঙ্গে কথা বলতে চায়। অমল শুনেছে ওদের বাড়ীর সামনে ডাকঘর বসবে। আরও শুনেছে ওর কাছে রাজার চিঠি আসবে। এসব শুনে ও জানতে চায় রাজার চিঠি কবে আসবে? কোন ডাকহরকরা সে চিঠি বয়ে নিয়ে আসবে, যে বা যারা বয়ে নিয়ে আসবে তাদের নাম কি? ছেলেরা ওকে বলে একজনের নাম বাদল, আর একজনের নাম শরৎ, আরও অনেক আছে। কখনও কখনও ওর ঘরের সম্মুখ দিয়ে হেঁটে চলা দইওয়ালাকে ডেকে বলে-যে রকম করে তুমি ডেকে বলো- ‘দই দই দই- ভালো দই’- এ সুরটি তুমি আমায় শিখিয়ে দাও।’ আবার কখনো বা শশী মালিনীর কন্যা সুধাকে কাছে ডেকে ওর কাছে ফুল চায়। ঘরের বাইরে বহুবিচিত্র কর্মচঞ্চল মানুষজনের কর্মকান্ড ও দেখে। ওই মানুষগুলি যেন ওর প্রাণ কেড়ে নেয়, ওর ছোট্ট এতটুকু মন আকুলি বিকুলি করে। ওদের সঙ্গে মিশতে না পেরে, ওদের সান্নিধ্যে আসতে ব্যর্থ হয়ে অমল উৎকন্ঠিত হয়, বিমর্ষ হয়ে পড়ে। সুদূরের প্রশান্ত নীলাকাশ যেন ওকে হাতছানি দিয়ে ডেকে কাছে নিতে চায় কিন্তু অমল পারে না যেতে। ও জানালার পাশে নিশ্চুপ বসে থেকে দূর পাহাড়ের দৃশ্য অবলোকন করে। ছাতুর পুটলি বাঁধা লাঠি কাঁধে পথচলা পথিকের ঝরনার জলে পা ডুবিয়ে পার হয়ে যাওয়া দেখে অমলও ওদের মতো করে বাইরে বেরিয়ে এসে পথ চলতে চায়। কিন্তু ও কিছুই পারে না। কেবলই বেশী বেশী করে অসুস্থ হয়ে পড়ে। 

এই যে নিস্পাপ শিশু মনের প্রাণ কেড়ে নেয়া, হৃদয় তোলপাড় করা আকুতি, সীমানা ছাড়িয়ে যাওয়া প্রকৃতির অপার সৌন্দর্য-সুধা পান করবার আকাক্সক্ষা, অসীমের মাঝে নিজেকে বার বার নতুন করে আবিস্কার করবার কামনা- এর সবকিছুকেই প্রতারণাপূর্ণ নিষেধাজ্ঞার ঢাকনা দিয়ে রুদ্ধ করা হয়েছে- এর অনিবার্য ফলটি পেয়েছে অমল চিরনিদ্রায় শায়িত হয়ে।

ঠাকুরদা যখন ওকে বলে- ওর কাছে রাজার চিঠি আসবে। শুধু চিঠিই নয় রাজ-কবরেজও আসবে এবং রাজার এ ছোট্ট বন্ধুটিকে দেখবার জন্যে স্বয়ং রাজাও আসবেন- তখন অমল পুলকিত হয়, কী এক অসীম আনন্দে উচ্ছ্বসিত হয়ে ওঠে অমল। কিন্তু রাজার চিঠি আর আসে না, শুধু প্রতীক্ষাই সার হয় অমলের। তবে রাজদূত একদিন আসেন। সেদিনই সন্ধ্যার পর তিনি বদ্ধ ঘরের দরোজা ভেঙ্গে ঘরে প্রবেশ করে সকলকে জানিয়ে দেন- আজ মধ্যরাত্রিতে রাজা আসবেন রাজ কবরেজকে সঙ্গে নিয়ে তার এ বালক বন্ধুটিকে দেখবার জন্যে। এর মধ্যেই রাজকবরেজ গৃহে প্রবেশ করে বদ্ধ ঘরের সব জানালা, দরোজা খুলে দিয়ে অমলের শিয়রের বসে বলেন-‘ওর ঘুম আসছে, প্রদীপের আলো নিভিয়ে দাও, -এখন আকাশের তারাটি থেকে আলো আসুক। ওর ঘুম এসেছে।’ ঠিক তখনই শশী মালিনীর মেয়ে সুধা ফুল নিয়ে এসে ঘুমন্ত অমলকে দেখে কবরেজকে জিজ্ঞাসা করে- ‘ও কখন জাগবে?’ রাজ কবিরেজের উত্তরটি ছিলো-‘এখনি, যখন রাজা এসে ওকে ডাকবেন।’ উত্তরে সুধা কবরেজকে বলেছিলো-‘তখন একটি কথা ওর কানে কানে বলো যে, সুধা ওকে ভোলেনি।’ কী অপূর্ব, অদ্ভুত ভালো লাগা! কিন্তু সুধা জানে না যে, অমল আর কোনোদিনই এই ঘুম থেকে জেগে উঠবে না।

এখন যদি নাটকটিকে অতিব সূক্ষ্মভাবে বিশ্লেষণ করা যায় তাহলে দেখা যাবে- এই ঘুমটিই অমলের মৃত্যুর প্রতীক অর্থাৎ সংকেত। আবার যেহেতু এই মৃত্যুর মাঝেই অমল তার অসীমত্বকে প্রাপ্ত হয়েছে। যেটি তার জীবদ্দশায় সম্ভব হয়ে ওঠে নি মানুষেরই সৃষ্ট কিছু উদ্দেশ্যাশ্রিত নিষেধাজ্ঞার কারণে। সেইহেতু সর্বশেষ বিশ্লেষণে অমলের মৃত্যুই এ নাটকের অসীমতার প্রতীক অথবা সংকেত। ডাকঘরটি বিশ্ব-প্রকৃতির রূপক । আর রাজা স্রােষ্টার প্রতীক। প্রকৃতির এই ডাকঘর থেকে রাজার চিঠি দিবারাত্রি ছয়টি ঋতু ডাকহরকরার রূপক হিসেবে প্রতিটি মানুষের ঘরে ঘরে পৌঁছে দিচ্ছে কালের ক্রমান্বয়িকতার পথ ধরে। সে সূত্র সঙ্গত কারণেই এখন এ কথা নিঃসঙ্কোচে বলা যায় যে, ‘ডাকঘর’- নাটকটি অত্যন্ত নির্জলাভাবে সাংকেতিক নাটকের ক্ষেত্রে একটি মাইলষ্টোন।

রবীন্দ্রনাথের উল্লেখিত অবশিষ্ট নাটকগুলিও রূপক এবং সংকেতাশ্রিত। তবে সেগুলির মধ্যে বিশেষতঃ ‘রাজা’ এবং ‘কালের যাত্রা’- নাটক দু’টিতে বোধকরি সাংকেতিকতা একটি ভিন্ন মাত্রা লাভ করেছে। নাটকের মূল বিষয়বস্তুর পূর্ণাঙ্গ ভাব প্রকাশের ক্ষেত্রে রূপক এবং প্রতীক অথবা সংকেত-এর প্রয়োজন যে অনিবার্য- এটি রবীন্দ্রনাথ অত্যন্ত সফলভাবে প্রমাণ করেছেন। রবীন্দ্রনাথের এ জাতিয় অন্যান্য নাটকগুলি- যেমন, শারোদোৎসব, ফাল্গুনী, অচলায়তন, মুক্তধারা, রক্তকরবী প্রভৃতিতে এ প্রমানের দৃষ্টান্ত উজ্জ্বল। সে কারণে এ নাটকগুলিকে নিয়ে আর বিশদ আলোচনা করা হলো না।

Phenomenal form of creation– এর আভ্যন্তরীক পরিমন্ডলে যে বোধের স্থিতি সীমাহীন সকর্মক শক্তিতে বিশ্বাসী এবং বলবান, অন্ত এবং অনন্তের মধ্যবর্তী অঞ্চলকে নিয়ে মগ্ন চৈতন্যের অন্তরালে আত্মদর্শনের নিজস্ব দর্পনে অতলান্তিক আত্মোদ্ধারের যে প্রবৃত্তি নিচয়ের নিঃসৃত বেগ সঞ্চারী উপস্থিতি – যা শেষ মুহূর্তে ইচ্ছাবিরোধী, একই সাথে রূপক এবং সাংকেতিকতার অন্তর্গত নিজস্বতায় আশ্রয় খোঁজে নিজস্ব নিয়মেই। মনে করা হতে পারে তার প্রভাবাশ্রিত যুগন্ধর বিকাশও স্বাভাবিক পদ্ধতিতে রূপান্তরিত হয়ে যায় অধিবাস্তববাদী ইনফিজিবল এবং ইনভিজিবল জটিলতায়। কিন্তু প্রকৃত অর্থে তা নয়। মূলতঃ অন্ত এবং অনন্তের সীমা এবং অসীমের মৌলিক দ্বিধা দীর্ণতায় প্রতিযোগী প্রেরণা প্রাপ্ত হয়েই এবং সে বিরোধের সূত্র ধরেই শেষ পর্যন্ত creation’ টি আশ্রয় গ্রহণ করে ‘রূপক’ অথবা ‘সাংকেতিকতা’য়। তবে সাংকেতিকতায় আশ্রয় গ্রহণ করবার লক্ষণটিই অধিক মাত্রার। সঙ্গত কারণেই তখন আর এটিকে ‘অধিবাস্তবতা’র মোড়কে আবৃত করে গ্রহন করা যায় না। কেননা ‘বাস্তব’ বাস্তবই। ‘বাস্তব’ শব্দটির সম্মুখে “অধি’- নামীয় আর একটি শব্দকে আরোপ করে, অতি-অবাস্তবকে “অধিবাস্তব’-বানিয়ে দিয়ে বাস্তবতাকে উদ্ধার করা যায় না। করলে সেটি ‘মেকী’- হয়ে যায়। বাস্তব এবং অধিবাস্তবের মাঝে যে ব্যবধান তা কখনই হ্রাসপ্রাপ্ত হয় না। বরং উভয়ই দ্বিধা-দীর্ণ হয়ে যায়।

দেশজ উৎপাদনের বিস্তৃতিতেও সে প্রত্যক্ষ প্রবাহী দ্বিধাদীর্ণিত বিরোধের অনিবার্য আর্বিভাব ন্যূনতম ক্ষীণদেহীতায় উৎকীর্ণিত হলেও বিস্তৃতির সার্বিক পরিধিতে তার উদ্দাম প্রাবল্য যেকোন অর্থেই দূর্লক্ষ্য তো নয়ই বরং অনুপেক্ষণীয়। দেশীয় নাট্যকার সাইদ আহমেদ – ঐ শ্রেণিগত চিত্ত চৈতন্যের প্রখর রৌদ্রালোকে অনন্তর উদ্ভাসিত হয়েছেন তার – ‘কালবেলা’ নাটকে- প্রচন্ডতম বিরোধের প্রচন্ডতম বিস্ফোরণ ঘটিয়ে। কিন্তু তারপরেও তিনি অধিবাস্তবতার ওপর বিশ্বাস স্থাপন করতে না পেরে শেষ পর্যন্ত আশ্রয় গ্রহণ করেছেন সাংকেতিকতার ওপর। যার যথার্থ প্রমাণ পাওয়া যায় তার ‘কালবেলা’-নাটকের ‘লোকটা’- নামীয় একটি চরিত্রের কন্ঠ থেকে উচ্চারিত একটি সংলাপ থেকে। ‘কালবেলা’- নাটকের ‘লোকটা’- নামে চিহ্নিত চরিত্রটির উচ্চারিত সংলাপটি এ রকমের-

‘লোকটাঃ এখানে ঘোরেও না কিছু, হেলেও না কিছু। সবকিছুর উর্দ্ধগতি- এই অন্ধকার গোলক ধাধা থেকে মুক্তির একমাত্র উপায়।’ অস্তিত্বের কেন্দ্রবিন্দু উদ্ধারে মূল্যায়নগতভাবে ইন্দ্রিয়জঃ জ্ঞানের যে বিভিন্নতা স্বতঃসিদ্ধ সে জ্ঞানের পরিধিতে বিচরণ করেই ‘লোকটা’-যখন উচ্চারণ করে- ‘সবকিছুর উর্দ্ধগতি- এই অন্ধকার গোলক ধাধা থেকে মুক্তির একমাত্র উপায়।’ ‘উর্দ্ধগতি’- অর্থাৎ অগ্রগামীতাকেই যখন স্থবিরতা থেকে, গোলক ধাধা থেকে মুক্তির প্রথম এবং সর্ব শেষ পন্থা হিসেবে স্থির করা হয় তখন অন্ধকার থেকে আলোর পৃথিবীতে প্রবেশ করে মুক্তির অপরিমেয় প্রাণভরা আস্বাদ লাভ করবার একমাত্র সংকেত হয়ে দাঁড়ায় ‘অগ্রগামীতা’-যা উর্দ্ধগতির প্রতীক। আর প্রতীক অথবা সংকেতের সার্থকতা এখানেই। এবং কোনোভাবেই যে অধিবাস্তবতা প্রকৃত বাস্তবতা নয়- এটিই চিরন্তণ সত্য।

© সরদার মোহাম্মদ রাজ্জাক

চলতি সংখ্যা