রণগাজি বিশ্বাস: অবিভক্ত বাংলায় বাউল ধারার অন্যতম পথিকৃৎ

রণগাজি বিশ্বাস; প্রকৃত নাম ফরিদ খান গাজি। ১৩৭১ খ্রিষ্টাব্দে পশ্চিমবঙ্গের হুগলি জেলার ত্রিবেনীতে (গঙ্গা, যমুনা ও স্বরসতী নদীর সংযোগস্থল) জন্মগ্রহণ করেন। তিনি ছিলেন বহুমুখী প্রতিভার অধিকারী, যার স্খূরণ তাঁর ব্যক্তিজীবনে পুরোমাত্রায় লক্ষণীয়। আধ্যাত্ব সাধনার পাশাপাশি একজন সমরবীদ ও স্থপতি হিসেবে নিজেকে প্রতিষ্ঠিত করতে স্বক্ষম হয়েছেন। পান্ডুয়ার (পশ্চিমবঙ্গের মালদা জেলায় অবস্থিত) বিখ্যাত সাধক ও দরবেশ শেখ নূর কুতুবউল আলম (র.) এর প্রতিষ্ঠিত মাদ্রাসায় অধ্যয়ণরত অবস্থায় হযরত খানজাহান আলী (র.)’র সাথে তাঁর সখ্যতার সূত্রপাত। একথা ঐতিহাসিকভাবে স্বীকৃত যে, বাবার মৃত্যুর পরে হযরত খানজাহান আলী (র.) কে কর্মসংস্থান করে দেওয়ার জন্য জৈনপুরের (বর্তমানে ভারতের উত্তরপ্রদেশের অংশবিশেষ) সুলতান ইব্রাহীম শর্কীকে শেখ নূর কুতুবউল আলম পত্র প্রেরণ করেছিলেন। উক্ত পত্রের পরিপ্রেক্ষিতে সুলতান ইব্রাহীম শর্কী ১৩৮৯ সালে হযরত খানজাহান আলী (র.)’কে তার বাহিনীতে সৈনিক হিসেবে নিযুক্ত করেন। ধারণা করা হয়, সেনাবাহিনীতে ভর্তির সময় হযরত খানজাহান আলী (র.) তাঁর একান্ত সহচর রণগাজি বিশ্বাসকেও সঙ্গে নিয়েছিলেন। রণক্ষেত্রে তাদের সাফল্যে সুলতান ইব্রাহীম শর্কী অত্যন্ত খুশি হন; ফলে অতি অল্প সময়ের মধ্যে পদোন্নতি লাভ করেন। সাফল্যের ধারাবাহিকতায় ১৩৯৪ সালে হযরত খানজাহান আলী (র.) জৈনপুর প্রদেশের জাবিতান (গর্ভণর) পদে অধিষ্টিত হয়। বাংলায় তখন ইলয়াস শাহী বংশের শাসন চলছিল। কিন্তু দিনাজপুরের হিন্দু জমিদার রাজা গণেশের ষঢ়যন্ত্রের কারণে রাজ্যে সুস্থিরতা ছিল না; ১৪০০-১৪১১ খ্রিষ্টাব্দের মধ্যে গৌড়ের রাজা সাইফুদ্দিন হামযা শাহ’কে হত্যা করে রাজা গণেশ নিজেকে স্বাধীন রাজা হিসেবে দাবি করেন। মুসলমানদের জীবনে তখন চরম দুর্যোগ; গণেশের বাহিনী বাংলা থেকে মুসলমান নির্মুল করতে ব্যাপক হত্যাযজ্ঞ পরিচালনা করেন। মুসলমানদের রক্ষা করতে পান্ডুয়ার দরবেশ শেখ নূর কুতুবউল আলম জৈনপুরের সুলতানকে অনুরোধ করেন। মুসলমানদের দূর্দিনে সুলতান ইব্রাহীম শর্কী সেদিন সাহায্যের হাত প্রসারতি করেছিলেন, হযরত খানজাহান আলী (র.) এর নের্তৃত্বে বাংলায় অভিযান চালাতে বিশাল বাহিনী পাঠিয়েছিলেন। বাহিনীর সাথে কয়েকজন সুফি সাধক ও প্রকৌশলী এসেছিলেন- রণগাজি বিশ্বাস যাদের একজন। হযরত খানজাহান আলী (র.) দুই পর্বে বাংলায় অভিযান চালায়। প্রথম পর্বে অনেকটা বিনাযুদ্ধে রাজা গণেশকে বিতাড়িত করে তার পুত্র যদুকে (ইসলাম ধর্ম গ্রহণ করে জালালুদ্দিন মুহাম্মদ নাম ধারণ করে) বাংলার মসনদে আসীন করেন। হযরত খানজাহান আলী (র.)’র বাহিনী জৈনপুরে ফিরে গেলে কুটকৌশলী রাজা গনেশ তার পুত্রকে ক্ষমতাচ্যূত করে পুনরায় রাজ্যের দখল নেয় এবং নির্বিচারে মুলমানদের হত্যা করে; ফলে নতুন করে বাংলা অভিযান অপরিহার্য হয়ে ওঠে। দ্বিতীয় পর্বে হযরত খানজাহান আলী (র.) চুয়াডাঙ্গার দৌলতগঞ্জ বন্দর দিয়ে ছোট্ট বাহিনী নিয়ে বাংলায় প্রবেশ করেন। উল্লেখ্য চুয়াডাঙ্গার জীবননগর উপজেলায় ভৈরব নদীর তীরে অবস্থিত দৌলতগঞ্জ একসময় গুরুত্বপুর্ণ নদীবন্দর ছিল। খানজাহান আলী’র বাহিনী ঝিনাইদহ জেলার কোটচাঁদপুরের হাকিমপুর হয়ে বারবাজারে প্রবেশ করে। বলার অপেক্ষা রাখে না, রণগাজি বিশ্বাস ছিলেন ওই বাহিনীর বিশেষ সদস্য।

ইতিহাসের পাতায় বারবাজার একটি ঐতিহাসিক নাম। শহরটি প্রথম শতকে গঙ্গারিডি রাজ্যের রাজধানী ছিল। হযরত খানজাহান আলী (র.) ও তাঁর অনুসারীদের আগমনে শহরটি নতুন করে প্রাণ ফিরে পায়; পুরাতন স্থাপনা সংস্কারের পাশাপাশি নতুন-নতুন পুকুর, মসজিদ, মক্তব গড়ে ওঠে। একজন স্থপতি হিসেবে নতুন স্থাপনার সাথে রণগাজি বিশ্বাসের নিবিড় সম্পৃক্ততা রয়েছে। শুধু বারবাজার নয় তৎকালীন সময়ে যশোরের মুরলী এবং বাগেরহাট-খুলনা-সাতক্ষীরায় নির্মিত অসংখ্য স্থাপনার সাথে তাঁর পরোক্ষ বা প্রত্যক্ষ সম্পৃক্ততা বিদ্যমান। ১৪২৯ খ্রিষ্টাব্দে বাগেরহাটের নামকরণ খলিফাতাবাদ হওয়ার পূর্ব-মুহূর্ত পর্যন্ত রণগাজি বিশ্বাস বিস্বস্থ অনুচর হিসেবে হযরত খানজাহান আলী (র.)’র সাথে ছিলেন বলে ধারণা করা হয়; এ সময়ে বাগেরহাট-সাতক্ষীরা অঞ্চলে বেশ কিছু যুদ্ধ সংঘটিত হয়; রাজা কর্ণওয়ালী, রাজা বলভদ্র দেব ও রাজা লালচন্দ্র সম্মিলিতভাবে খানজাহান আলীর রাজ্য প্রতিষ্ঠায় বাঁধা হয়ে দাঁড়ায়। কিন্তু সহচরদের বীরত্বপুর্ণ লাড়াইয়ে কোনো বাঁধাই তাঁর পথ অবরুদ্ধ করতে পারে না; কর্ণপুর, সামান্তাসেনা, রণভূমি রণজিতপুর, পিলজঙ্গ, রণবিজয়পুর, ফতেপুর, বিজয়পুরসহ বিস্তির্ণ এলাকায় মুসলামানদের নিয়ন্ত্রণ প্রতিষ্ঠিত হয়। যুদ্ধে বীরত্বপুর্ণ অবদানের জন্য হযরত খানজাহান আলী (র.) রণগাজি বিশ্বাসকে ‘গাজি’ উপাধীতে ভূষিত করেন। ‘গাজি’ খেতাবের জন্য সরল সমিকরণ এরুপ যে, ইসলাম ধর্মমতে ধর্ম বিষয়ক কোন যুদ্ধে অংশগ্রহণকারী যোদ্ধা মারা গেলে শহীদ এবং বেঁচে থাকলে গাজি হিসেবে পরিচিত হয়। অতএব রণগাজি বিশ্বাসের ‘গাজি’ উপাধি বিষয়ে বিতর্কের কোন সুযোগ নেই!

নিবিড়ভাবে লক্ষ্য করলে দেখতে পাই, হযরত খানজাহান আলী (র.) ও তার অনুসারীরা রাজ্য বিস্তারের চাইতে ইসলাম প্রচারে অধিক মনোযোগী ছিলেন। হয়তো এ কারণেই বাংলার মসনদ থেকে রাজা গণেশকে উৎখাত করে জৈনপুরে ফিরে না গিয়ে বাংলায় ইসলাম প্রচার করেন; ধর্ম প্রচারের জন্য সুলতান ইব্রাহীম শর্কী ও জালালুদ্দিন মুহম্মদ শাহ’র প্রেরণা ও চিশতিয়া তরিকার পীর শেখ নূর কুতুবউল আলমের নির্দেশনা পেয়েছিলেন। নির্দেশনা অনুসারে সদলবলে বাংলার দক্ষিণ অংশে রওনা হয়। বারবাজার থেকে যশোরের মুরলী হয়ে খুলনা-সাতক্ষীরার ভিতর দিয়ে বাগেরহাট পেঁছায়। হযরত খানজাহান আলীর ধর্ম প্রচারের কৌশল পর্যালোচনা করলে দেখা যায়, বিজিত অঞ্চল ছেড়ে নতুন অঞ্চলে যাওয়ার সময় ওই অঞ্চলে ইসলাম প্রচারের জন্য একান্ত কাছের অনুচর বা শিষ্যদের রেখে যেতেন। বারবাজারের দায়িত্ব পেয়েছিলেন বড়গাজি খাঁ ও কালু শাহ, মেহেরপুরের দায়িত্বে পীর মেহেরুল্লা এবং মুরলীর দায়িত্বে শাহ গরিব ও বুরহান শাহ।

১৪২৯ খ্রি. পরবর্তী কোন এক সময়ে হযরত খানজাহান আলী (র.) এর নির্দেশে রণগাজি বিশ্বাস ইসলাম প্রচারের উদ্দেশ্যে আলমডাঙ্গা জনপদে উপস্থিত হয়; এবং আলমডাঙ্গা শহরের অনতিদূরে ফরিদপুর গ্রামের নির্জন পরিবেশে আস্তানা গাড়েন। ফরিদপুরে আস্তানা গাড়ার কারণ হিসেবে নানাজনের নানামত- সুফি-সাধকরা নির্জনতা পছন্দ করেন, এজন্য পাঙ্গাসিয়া খালের ওপারে নির্জন স্থানে অবস্থান নেওয়া! কারও কারও মতে, নতুন জনপদে উপস্থিত হয়ে জীবনের এই বিশেষ অধ্যায় তিনি (রণগাজি বিশ্বাস) নতুনভাবে আরম্ভ করতে চেয়েছিলেন, যেজন্য প্রয়োজন ছিল ফরিদপুরের মতো নির্জন ভূখন্ড। স্থাপত্যশিল্পের প্রকরণগত নিরিখে গোলবাগান ও বাগেরহাটের স্থাপনার তত্বতালাশ করলে দেখি বদলে যাওয়া মানসিকতার প্রতিচ্ছবি! ইট-কাঠ-পাথরের অট্টালীকার পাশাপাশি গোলবাগান অনেক বেশি নৈসর্গিক এবং আধুনিক মনস্কতার পরিচায়ক। ফরিদপুরের নির্জন প্রান্তরে রণগাজি বিশ্বাস যেনো এক বদলে যাওয়া সাধক; নয়ণের প্রান্তসীমায় বাঁক বদলের হাতছানি! একথা মিথ্যে নয় যে, নতুন জনপদ গড়ে ওঠার প্রধানতম পুর্বশর্ত হলো জলের প্রাপ্যতা- জলের প্রাপ্যতার জন্যই হয়তো পাঙ্গাসিয়ার তীরবর্তী এলাকা বেছে নেওয়া। উল্লেখ্য তৎকালীন সময়ে ফরিদপুরের পাশ ঘেঁষে পাঙ্গাসিয়া নামক খরস্ত্রোতা খাল বহমান ছিল। কালপরিক্রমায় পাঙ্গাসিয়ার অস্থিত্ব বিলুপ্তির পথে; ফরিদপুরের পাশ ঘেঁষে গোবিন্দপুর হয়ে আলমডাঙ্গা রেলস্টেশনের গাঁ বেয়ে সর্পিল গতিতে পাঙ্গাসিয়ার যে ক্ষীণ ধারা কামালপুর-কুমারী অভিমুখে বয়ে চলেছে তা দেখে আন্দাজ করার উপায় নেই, এই সেই পাঙ্গাসিয়া! রণগাজি বিশ্বাস নিজেও হয়তো পাঙ্গাসিয়ার জলে ভেসে ভেসে সঙ্গী-সাথীদের নিয়ে ফরিদপুরে উপস্থিত হয়েছিলেন; ইসলাম প্রচারের জন্য আশেপাশের গ্রামগুলোতে ছড়িয়ে পড়েছিলেন। তবে ইসলাম প্রচারের কাজটি সহজসাধ্য ছিল না। বিশেষত এলাকার মানুষের মধ্যে ধর্ম বিষয়ে বিশেষ আগ্রহ ছিল না বললেই চলে; সারাক্ষণ বৈরাগ্য ভাব, কাজেকর্মে অনীহা, গান-বাজনায় বিশেষ অনুরক্ত। ধর্ম প্রচারের ক্ষেত্রে রণগাজি বিশ্বাসও কৌশলী হয়েছিলেন, গান-বাজনাকে সিদ্ধি লাভের উপায় হিসেবে বিবেচনা করেছিলেন। সাধারণ জনগণকে আকৃষ্ট করতে এলাকাবাসীকে জমায়েত করে খাওয়া-দাওয়া ও গান-বাজনার আয়োজন করতেন; গানে গানে ছড়িয়ে দিতেন ইসলামের অমর বাণী।

রণগাজি বিশ্বাসের এমনতর পরিবর্তন যে আরোপিত, ঠিক তা নয়; বরং স্বতস্ফূর্ত- জন্মসূত্রে তিনি এই স্বতস্ফূর্ততা অর্জন করেছিলেন। পরিবারের মধ্যে ভিন্ন ভিন্ন ধর্মমত প্রচলিত ছিল। বাবা মুসলমান হলেও তাঁর আপন দুই চাচা সনাতন ধর্মানুসারী। জন্মস্থান ত্রিবেনীতে যেমন ভিন্ন ধর্মাবলস্বীদের মেলবন্ধন ছিল, তেমনি বন্ধন ছিল পারিবারিক পরিমন্ডলে; পারিবারিক সূত্রে বৈঞ্চব সম্প্রদায়ের ধর্মাচার প্রত্যক্ষ করার সুযোগ হয়েছিল। শুধু হিন্দু-মুসলমান নয় ত্রিবেনীর সাথে খৃস্টান সম্প্রদায়েরর যোগসূত্র রয়েছে। জাফর খান গাজি মসজিদ এখনো আমাদের ধর্মীয় ঐক্যের কথা স্মরণ করিয়ে দেয়। ইতিহাসের স্বাক্ষী হয়ে দাঁড়িয়ে থাকা মসজিদটি বাংলার প্রাচিনতম মসজিদ। ধারণা করা করা হয় ওই জাফর খান গাজি’ই রণগাজি বিশ্বাসের পুর্বপুরুষ। ইখতিয়ার উদ্দীন মুহাম্মদ বিন বখতিয়ার খিলজির বাংলা জয়ের অব্যবহিত পরেই জাফর খান গাজি হিন্দুদের তীর্থস্থান ত্রিবেনীতে হামলা চালায়; অসংখ্য মন্দির ভাংচুর করেন! জাফর খান গাজির নামে পরিচিত বিশেষ ওই মসজিদটি কোন এক মন্দিরের ধ্বংসস্তুপের উপর নির্মিত! মসজিদের একপাশের দেওয়ালে হিন্দু দেব-দেবীর মূর্তি আঁকানো রয়েছে! এ থেকে ধারণা করা হয়, বস্তুত জাফর খান গাজি ছিলেন সুফিবাদের অনুসারী। সম্ভবত সংক্ষুব্ধ হিন্দুদের ক্ষোভ প্রশমন করে শান্তিপুর্ণ সহাবস্থানের জন্য মসজিদের দেওয়ালে চিত্র অংকন করেছিলেন! তো, এমন একটি ধর্মীয় ও সাংস্কৃতিক পরিমন্ডলে জন্মগ্রহণের সূত্রে যে কেউ সুফিবাদের প্রতি ঝুঁকতেই পারে! কিন্তু আলমডাঙ্গা অঞ্চলে রণগাজি বিশ্বাস যে মত লালন ও প্রচার করেন তা সুফিবাদ থেকেও খানিকটা ভিন্নতর। এই ভিন্নতর বিষয়-আশয় এলাকার মানুষ স্বতস্ফূর্তভাবে গ্রহণ করেছিল। বলতে দ্বিধা নেই, সমকালে ওই বিশেষ মতের অনুসারীরা বাউল সম্প্রদায় হিসেবে পরিচিত। এ বিবেচনায় রণগাজি বিশ্বাস’ই অবিভক্ত বাংলায় বাউল সম্প্রদায়ের অন্যতম পথিকৃৎ! তাঁর অনুসরিত ধর্মাচার বৃহত্তর যশোর-কুষ্টিয়াসহ সারা বাংলায় ছড়িয়ে পড়েছে।

রণগাজি বিশ্বাস এবং ফরিদপুর নামটি অঙ্গাঅঙ্গিভাবে জড়িত। সাতশো ফকিরের (বাউল সাধক) গ্রাম হিসেবে খ্যাত ফরিদপুর গ্রামটি বাউল সম্প্রদায়ের নিকট তীর্থস্থান। সারা বাংলায় এমন গ্রাম আর একটিও পাওয়া যাবে না, যেখানে এতো অধিক সংখ্যক বাউল বসবাস করে! গ্রামের দক্ষিণ পাশে অবস্থিত গোলবাগানটি সাধকের স্মৃতিচিহ্ন বহন করে চলেছে। বাগানের প্রতিটি গাছ তাঁর স্বহস্তে লাগানো। রণগাজি বিশ্বাস যে কত উঁচু মানের স্থপতি ছিলেন, বাগান না দেখলে তা বিশ্বাস করা কঠিন! সাম্প্রতিক সময়ে বৃক্ষ বা লতাগুল্ম দ্বারা ভাস্কর্য্য নির্মাণের যে প্রবণতা লক্ষ করছি, একজন রণগাজি বিশ্বাস তা ৬০০ বছর আগে করে দেখিয়েছেন! নিদৃষ্ট দূরত্বে তেঁতুল গাছ লাগিয়ে তিনি একটি বৃত্ত রচনা করেছেন। বৃত্তের যেমন বৈজ্ঞানিক তাৎপর্য আছে, তেমনি আছে জগত-সংসার- এমন কী ধর্মাচারের মাহাত্মি! অর্থাৎ এখনও যা আমাদের ভাবনায় অনুপস্থিত, তা ওই বিশেষ বৃত্তাকৃতির বাগানে ইঙ্গিতময়! ইঙ্গিতের মর্মার্থ অনুধাবনে বাউল সাধকরা তৎপর; বহুকৌণিক দৃষ্টিতে একজন রণগাজি বিশ্বাসকে নিয়ে বাংলার বাউল সম্প্রদায় সাধনা করে চলেছেন! বৃক্ষ দ্বারা রচিত বৃত্তের ঠিক মাঝখানে এই মহান সাধকের মাজার। মাজারকে কেন্দ্র করেও রয়েছে অসংখ্য কিংবদন্তি! কথিত আছে বিশেষ ক্ষণে কালো কাপড়ে আবৃত হয়ে, ভক্ত পরিবেষ্ঠিত অবস্থায় তিনি ধ্যানমগ্ন হয়েছিলেন। গুরুর জন্য ভক্তকূল অপেক্ষারত- কখোন ধ্যানভঙ্গ হয়! কিন্তু নিদৃষ্ট সময় পেরিয়ে গেলেও গুরুর সাড়া না পেয়ে পর্দা সরিয়ে লক্ষ্য করেন, গুরু সেখানে নেই; একটা সুড়ঙ্গ মাটির গভিরে চলে গেছে! তাঁর ভক্তরা মনে করে, বাউল ধারার পথিকৃৎ রণগাজি বিশ্বাস এভাবেই অর্ন্তধাণ হয়েছেন! অর্ন্তধাণ বিষয়ে ব্যক্তিতে ব্যক্তিতে মতপার্থক্য রয়েছে; অধিকাংশের মত তাঁর স্বাভাবিক মৃত্যু হয়েছিল।

রণগাজি নামের আড়ালে পৈত্রিক নাম হারিয়ে গেলেও ফরিদপুর নামের সাথে সমার্থক হয়ে আছে ফরিদ খান গাজি। তাঁর নামানুসারেই যে গ্রামের নাম ফরিদপুর! বাউল সম্প্রদায়ের মানুষের কাছে তাঁর মাজারটি তীর্থ হিসেবে পরিগণিত। বিশেষ বিশেষ দিনে মাজারকে কেন্দ্র করে বিশেষ ওই (বাউল) বিশেষ সম্প্রদায়-সংশ্লিষ্ট আচার-অনুষ্ঠান পালিত হয়, দূর-দূরান্ত হতে ভক্ত-অনুসারীরা এসে সমবেত হয়; যেমনিভাবে একদা শিঁকড়ের সন্ধানে ছুঁটে এসেছিল বাউল সম্রাট লালন শাহ, সিরাজ শাহ, কুবির গোঁসাই, দুদ্দু শাহ, বেহাল শাহ, পাঞ্জু শাহ, খোদাবকশো শাহ, আবু বাক্কা শাহ, বনমালী শাহ, দুলাল শাহ-সহ অসংখ্য বাউল সাধক। একজন রণগাজি বিশ্বাস অন্য সবার চাইতে এজন্য আলাদা যে নিজের আঁখড়া কেন্দ্রিক নিজস্ব ঘরানার জনগোষ্টি তৈরিতে সক্ষম হয়েছিলেন। এমনটা কিভাবে সম্ভব হয়েছিল তা গবেষণার দাবী রাখে। তবে একথা নিশ্চিত যে বহু গুণে গুনান্বিত রণগাজি বিশ্বাস ছিলেন দূরদৃষ্টি-সম্পন্ন; সরল পথে ধর্ম প্রচারে বাঁধার সম্মুখীণ হয়ে ভিন্ন কৌশল অবলম্বন করেছিলেন, এবং সফল হয়েছিলেন। ফরিদপুর গ্রামের প্রান্তদেশে তাঁর মাজারের অবস্থান পর্যালোচনা করে অনুধাবন করতে পারি, লোকালয় হতে দূরে, নির্জনতায় পরিপুর্ণ অঞ্চলে ওই মহান সাধককে কেন্দ্র করেই গ্রামের পত্তন ও বিকাশ। বিকাশধারায় যুক্ত মানুষগুলো আশেপাশের এলাকার বাসিন্দা ছিল; রণগাজি বিশ্বাসের আধ্যত্ম সাধনায় প্রভাবিত ও বিশ্বাস স্থাপন করে নতুন নতুন বসতি স্থাপন করেছে- যে কারণে গ্রামটিতে সমমনা মানুষের আধিক্য লক্ষণীয়; সাতশো ফকিরের গ্রাম হিসেবে বিবেচিত। ফকির রণগাজি বিশ্বাসকে নিয়ে এলাকায় কিংবন্তির অভাব নেই, কাল পরস্পরায় কিংবদন্তিসমূহ উত্তরসূরীদের মাধ্যমে সমকাল পর্যন্ত বিস্তৃত। তাঁর নামের সাথে বিশ্বাস শব্দটি যুক্ত হওয়ার নিদৃষ্ট কোনো যুক্তি খুঁজে পাওয়া যায় না। গ্রামের বিশ্বাস গোষ্ঠির লোকজন নিজেদের রণগাজি বিশ্বাসের উত্তরপুরুষ হিসেবে দাবী করলেও আদতে তিনি ছিলেন অবিবাহিত! পালকপুত্রের বিষয়টি যেমন উড়িয়ে দেওয়া যায় না তেমনি বিশ্বাস; বিশ্বাসদের পুর্বপুরুষ হয়তো রণগাজি বিশ্বাসের পালকপুত্র ছিলেন। এমনও হতে পারে, কোন এক বিশ্বাস সাধকের খাদেম ছিলেন; বিশ্বাসের দ্বীপশিখা প্রজ্জ্বলন করতে করতে সমকালীন এই বিশ্বাস গোষ্ঠী! স্ত্রী ও সন্তান-সন্ততি না থাকার স্বপক্ষে বড় যুক্তি স্বয়ং ওই মাজার; যদি সন্তান-সন্ততি বা পরিবার-পরিজন পরিবেষ্ঠিত অবস্থায় তিনি ফরিদপুর গ্রামে বসবাস করতেন তবে একটি নয় উক্ত স্থানে একাধিক মাজার থাকার কথা! বাউল সম্রাট লালন শাহ’র ক্ষেত্রে আমরা লক্ষ্য করি তাঁর (লালন শাহ) কবরের ঠিক পাশেই পালকমাতা মতিজান নেছার কবর; আশে-পাশে রয়েছে আরো কিছু কবর- যে কবরগুলোতে তাঁর একান্ত অনুচরদের সমাহিত করা হয়েছে!

বাউল সম্প্রদায়ের নিকট সংগীতের আধ্যাতিকতা সর্বজনবিদিত। সহজ-সরল জীবনাচারে অভ্যস্থ বাউলরা গানে গানে সৃষ্টিকর্তার গুণকীর্তন করে। নানান প্রতিকুলতা পেরিয়ে বাউল মতবাদ সাধারণের অন্তরে ঠাঁই করে নেওয়ার অন্যতম কারণ সংগীত; বাউলদের রচিত গীত শুধু বাংলা নয় বিশ্ববাসীর কাছে এখন গবেষণার বিষয়! গবেষণা প্রয়োজন রণগাজি বিশ্বাসের গান নিয়েও! যে মানুষটা গানে গানে এলাকাবাসীর কাছে ধর্মের বাণী পৌছে দিয়েছেন, গানকে আশ্রয় করে ধর্মাচারের বিশেষ ধারা প্রচলন করেছেন, তার নিজের রচিত গান থাকবে না! না, এমনটি হতে পারে না; সংরক্ষণের অভাবে তাঁর গানসমূহ হয়তো হারিয়ে গেছে! সুখের কথা এই- গান না থাকলেও রণগাজি বিশ্বাস আছেন, আছে তাঁর স্মৃতিচিহ্ন; সাধারণ জনগণের মনে তিনি যেভাবে বিশ্বাসের শিঁকড় প্রোথিত করেছেন, তাতে এই মহান সাধক ভাবিকালে আরও বিশিষ্ট উচ্চতায় আলোচিত হবেন; তাঁর প্রচারিত মতবাদ বিশ্ব-মানবতার মুক্তির উপলক্ষ্য হিসেবে গণ্য হবে বলে আমাদের বিশ্বাস!

© পিন্টু রহমান

চলতি সংখ্যা