মগ্ন প্রচ্ছন্নতায় কবিতার স্থিতি সাহিত্যের একটি বিশেষ মাত্রিকতা

ইতিহাসের ক্রমান্বয়িক ধারাবাহিকতার পথ ধরে যদি কুয়াশাচ্ছন্ন ফেলে আসা ধূসর আরণ্যিক বিজনতার দিকে দৃষ্টিকে চালিত করা যায় তবে হয়ত দেখা যাবে সেই বিজন আরণ্যিক ধূসরতার মধ্যেও প্রাণ আছে, প্রাণের সজীবতা আছে। আরণ্যিক বিজনতা হলো অনন্ত অতীতের গর্ভে অন্ধকারাবৃত সেই অত্যাশ্চর্য বিস্ময় যা থেকে চূর্ণ, প্রক্ষিপ্ত হয়ে অতি ক্ষুদ্র থেকে ক্ষুদ্রতর বস্তুনিচয়ের উদ্ভব। সেই মহাবিস্ময়ের সার্বভৌম অস্তিত্বকে অস্বীকার করলে যেমন বর্তমানের নিজস্বতা বলে কিছু থাকে না তেমনি তাকে সিদ্ধ স্বীকৃত করলেও বর্তমান এক চরম অস্পষ্টতায় হারিয়ে যায়। কিন্তু হারিয়ে যাবার পর যে অনুরণনটুকু অবশিষ্ট থাকে তাই সেই অমিত বিস্ময়ের ধূসর আরণ্যিক বিজনতা। অতীত বর্তমানের জন্য অসম্ভব সম্ভাবনা প্রজ্জ্বলন করে। সেই উজ্জ্বলতার স্থিতিশীলতা মুহূর্তের যন্ত্রণায় কুঁকড়ে গিয়ে অতলান্তে আশ্রয় নেয়। অথচ অতীত বর্তমান হবার আগ পর্যন্ত যে সুনিশ্চিত অনিশ্চয়তা সেই অনিশ্চয়তা অবলম্বন করেই বর্তমানের জন্ম। আর অনিশ্চতার মধ্য দিয়ে যার জন্ম তা কোনোদিক দিয়ে স্থির নিশ্চিত নয়। যাই হোক সেই মুহূর্তকালীন উজ্জ্বলতা হারিয়ে যাবার পরক্ষণেই যে প্রতিক্রিয়ার জন্ম দেয় তাকে সহজে নশ্বর বলে মেনে নেয়া যায় না, কারণ ওই স্বল্প স্থায়িত্বকে আশ্রয় করে তার উৎসমুখ সন্ধানে অগ্রসর হলে এক অবিনশ্বর অস্বচ্ছতার অভিঘাতের সাক্ষাৎ মিলবে। আর এই অস্বচ্ছতাই সীমাহীন স্বচ্ছ উজ্জ্বলতার অবিনাশী প্রাণকেন্দ্র বা জন্মদাতা। নিজের অস্তিত্বের প্রশ্নও এর মধ্যেই অন্তরিত এবং এই অস্বচ্ছতাই অস্তিত্বের জন্য সর্বশেষ সমাধান। সন্দেহাতীতভাবে। স্রষ্টার নিগূঢ় মূল্যায়নও এই অস্বচ্ছতা থেকে বিচ্ছিন্ন নয়। কেননা যাকে অনুভব করা যায় অথচ প্রত্যক্ষ করা যায় না তাই যদি হয় অস্বচ্ছতার মৌলিকত্ব তবে ঈশ্বর কোনোক্রমেই এই অস্বচ্ছতা বহির্ভূত অথবা বিচ্ছিন্ন, স্বতন্ত্র কোনো সত্বার মর্যাদায় উন্নীত হতে পারেন না। বৈজ্ঞানিক দৃষ্টিকোণ থেকে বিশ্লেষণ করলেও এর স্বপক্ষে অকুন্ঠ সমর্থন পাওয়া যাবে।

বিজ্ঞান ঈশ্বরকে সমর্থন করে- ঈশ্বর বিজ্ঞান সমর্থিত। কিন্তু তাঁর প্রত্যক্ষতাব বিশ্বাসে নয়, প্রচ্ছন্নতার অনুভবে। যেমন জ্যামিতিক সংজ্ঞা। মেনে নিলে অনেক কিছুই উদঘাটিত হতে পারে, না নিলে সামান্যতম কিছুও সম্ভব হয় না। অস্তিত্ববাদের বেলায়ও একথা প্রযোজ্য। আমার অস্তিত্ব এক অভিনব শূণ্যবৃত্তের মহাশূণ্যতায় নিমজ্জিত। অথচ আমি আছি, আমার স্থিতি আছে। আমি আমার অস্তিত্বকে অনুভব করতে পারি। কিন্তু যখনই আমি আমার অস্তিত্বকে আত্মিকভাবে অবলোকন করতে যাব ঠিক তখনই এই প্রচ্ছন্নতা আমার অস্তিত্বের প্রশ্নে এক বিশাল সমস্যা হয়ে দাঁড়াবে। যে সমস্যার সমাধান শেষ পর্যন্ত আমার অনুভবে প্রতিভাত হবে এক মূর্তিমান অনিশ্চয়তার আকার নিয়ে। ফলস্বরূপ আমি ওই অনিশ্চয়তার কাছে সমর্পিত হয়ে যাব চূড়ান্তভাবে। কিন্তু এই অনিশ্চয়তার প্রচ্ছন্নতাই আবার আমাকে বিশ্বাসিত করবে আমার অস্তিত্বের সত্যতায়। তাহলে এই অনিশ্চয়তা নিশ্চয়ই সেই আরণ্যিক ধূসরতার দ্বিতীয় অভিধা যার গর্ভে নির্লিপ্ত অসংখ্য কল্পতরু, অসংখ্য প্রাণ যাকে অনুভব করা যায় বিস্ময়াহত এক অভিভূত সত্বার মত, উপলব্ধি করা যায় জীবনের অতি কাছাকাছি এক পরম সত্যের মত; কিন্তু প্রত্যক্ষ করা যায় না হৃদয়স্পর্শী এক প্রতিবেশীর মত, হৃদয়ের সংবেদনশীল আত্মীয়ের মত। অথচ প্রত্যক্ষ করা না গেলেও ঐ অনুভবই যেন আত্মার সমগ্র পিপাসা দিয়ে তাকে অন্তরের উর্বরতায় উপ্ত করবার জন্য আগ্রহী হয়ে ওঠে দারুন আত্মযন্ত্রণাকে সহ্য করেও। ফলতঃ ওই অনিশ্চয়তা তখন এক অনিঃশেষ অনুপ্রেরণার উৎস হয়ে দাঁড়ায় জীবনের জন্য, আত্ম-অস্তিত্বের জন্য। সাহিত্যের কল্পনা-তন্ময়তায় এই অনিশ্চয়তার মূল্য আরও বেশি। কেননা সৃজনশীল সাহিত্য সৃষ্টির কল্পনা প্রবাহে যদি অনিশ্চয়তার প্রচ্ছন্নতা না থাকে, যদি সৃষ্টির উপান্তে দাঁড়িয়ে তার উদগমকে অনিশ্চয়তার প্রচ্ছন্নতায় উদ্ধার করা না যায় তবে তার মহৎ মহিমা কতটা উৎকীর্ণ হবে তা প্রশ্নের অপেক্ষা রাখতে পারে। বিমূর্ত সৃষ্টির চিত্রকল্প যেমন সম্পূর্ণ সৃষ্টির শরীরে প্রলেপিত করে দেয় এক নৈর্ব্যক্তিক সুন্দর অসম্পূর্ণতাকে অথচ ওই অসম্পূর্ণতাই আবার গোটা সৃষ্টির মহিমা হয়ে দাঁড়ায় প্রকারান্তরে, ঠিক তেমনি প্রচ্ছন্নতাবিহীন সৃষ্টি প্রতিদিন নিয়মের শৃঙ্খলে রুদ্ধ উদিত সূর্যের মত স্বাভাবিক বৈচিত্র্যহীনতায় পর্যবসিত হয়ে যায় অবলীলাক্রমে। কল্পনাকে সুদূরপ্রসারী করতে, কল্পনাকে অস্থির চঞ্চল করে তুলতে সম্পূণরূপেই হয় ব্যর্থ। এবং এই ব্যর্থতা সৃষ্টির সৃজনশীলতায় এঁকে দেয় এক চরম স্থবিরতা, এক অসহ্য অচঞ্চলতাকে। আর এ স্থবিরতা, এই অচঞ্চলতা যখন সৃষ্টি সম্পর্কিত বিরাট অনুসন্ধিৎসাকে ব্যাহত করে অর্থাৎ যখন সৃষ্টিকে নিয়ে গভীর চিন্তার অবকাশ একেবারেই তিরোহিত হয়ে যায় তখন সৃষ্টির মূল্য সর্বাংশে অযৌক্তিক হয়ে পড়ে না কি?

বস্তুত সৃষ্টি যখন নতুন করে নতুন আঙ্গিক নিয়ে বার বার করে চিন্তার সীমায় প্রতিষ্ঠিত হতে ব্যর্থ হয় তখন আর তাকে পূর্ণাঙ্গ সৃষ্টির অসাধারণ মর্যাদা দিয়ে বিবেচনা করা যায় না। বরং অতি স্বাভাবিক সাধারণের মতো প্রতীয়মান হয় সব সময়। রবীন্দ্র বক্তব্যও বর্তমান বিশ্বাসে উচ্চকন্ঠ। তাঁর মতে- (বিশেষত কাব্যে) কবিতা অর্থগত প্রশ্নে সম্পূর্ণ না হলেও যদি কল্পনা প্রবাহে সামুদ্রিক তরঙ্গাবলির মত উচ্চকিত উচ্ছ্বাসের ক্ষুদ্ধতা দিয়ে কল্পনার শরীরকে বিক্ষত করতে না পারে তবে তা পুরোপুরিভাবে গৃহীত হ্বার দাবি করতে পারে না । তাঁর নিজের সৃষ্টিতেও এর প্রমাণ লক্ষ্যিত।

(১)
দেখিলাম অবসন্ন চেতনার গোধূলি বেলায়
দেহ মোর ভেসে যায় কালিন্দীর স্রোতবাহি-
নিয়ে অনুভূতি পুঞ্জু নিয়ে তার বিচিত্র বেদনা,
চিত্র করা আচ্ছাদনে আজন্মের স্মৃতির সঞ্চয়,
নিয়ে তাঁর বাঁশিখানি। দূর হতে দূরে যেতে যেতে
ম্লান হয়ে আসে তার রূপ; পরিচিত তীরে তীরে
তরুচ্ছায়া আলিঙ্গিত লোকালয়ে ক্ষীণ হয়ে আসে
সন্ধ্যা আরতির ধ্বনি, ঘরে ঘরে রুদ্ধ হয় দ্বার,
ঢাকা পড়ে দ্বীপশিখা, নৌকা বাঁধা পড়ে ঘাটে।
দুই তটে ক্ষান্ত হল পারাপার ঘনালো রজনী,
বিহঙ্গের মৌনগান অরণ্যের শাখায় শাখায়
মহানিঃশব্দের পায়ে রচি দিল আত্মবলি তার।
এক কৃষ্ণ অপরূপতা নামে বিশ্ববৈচিত্র্যের পরে
জলে জলে। ছায়া হয়ে বিন্দু হয়ে মিলে যায় দেহ
অন্তহীন তমিস্রায়। নক্ষত্রবেদির তলে আসি
একা স্তব্ধ দাঁড়াইয়া, উর্দ্ধে চেয়ে রহি জোড় হাতে-
হে পূষন, সংহরণ করিয়াছ তব রশ্মিজাল
এবার প্রকাশ করো তোমার কল্যাণতমরূপ
দেখি তারে যে পুরুষ তোমার আমার
               মাঝে এক।

প্রান্তিক/রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর  

(২)
সেই প্রভাতের স্নিগ্ধ সুদূর গন্ধ
আঁধার বাহিয়া রহিয়া রহিয়া আসে।
আকাশে যে গান ঘুমাইয়া নিস্পন্দ
তারা দীপগুলি কাঁপিছে তাহারি শ্বাসে।
অন্ধকারের বিপুল গভীর আশা।
অন্ধকারের ধ্যান নিমগ্ন ভাষা
বানী খুঁজে ফিরে আমার চিত্তাকাশে।।
জীবনের পথ দিনের প্রান্তে এসে
নিশীথের পানে গহনে হয়েছে হারা।
অঙ্গুলি তুলি তারাগুলি অনিশেষে
মাভৈঃ বলিয়া নীরবে দিতেছে সাড়া।
… যা কিছু পেয়েছি যা কিছু গেল চুকে,
চলিতে চলিতে পিছে যা রহিল পড়ে,
যে মনি দুলিল যে ব্যথা বিঁধিল বুকে,
ছায়া হয়ে যাহা মিলায় দিগন্তরে,
জীবনের ধন কিছুই যাবে না ফেলা-
ধুলায় তাদের যত হোক অবহেলা
পূর্ণের পদপরশ তাদের’ পরে

গীতাঞ্জলি/ রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর

দুটো কবিতার মধ্যেই চরম প্রচ্ছন্নতা, অস্বচ্ছতা। অথচ এই অস্বচ্ছতা, এই প্রচ্ছন্নতাই বার বার করে যেন কল্পনাকে ভাসিয়ে নিয়ে যায় কবিতা দুটোর গভীর অভ্যন্তরে। বিভিন্ন কোণ থেকে কবিতা দুটোর সম্পূর্ণ চরিত্রকে বিশ্লেষণ করবার চেষ্টা করে দারুন এক পিপাসা নিয়ে যেন। কিন্তু যতবারই বিশ্লেষিত হোক, যতবারই অর্থময় অথবা নিরর্থক হয়ে উঠুক, মুহূর্তের ব্যবধানে আবার যেন অন্তরকে নতুন করে ভাবিত করে তোলে নতুন করে মূল্যায়নের জন্য। আর এই বার বার করে অন্তরকে, কল্পনাকে আকর্ষিত করবার ক্ষমতা কবিতা দুটোর ব্যতিক্রমী স্বভাবের কথা মনে করিয়ে দেয় মুহুর্তেই এবং সঙ্গে সঙ্গে এও স্বীকৃত হয় যে, কবিতার ঐ ব্যতিক্রমী স্বভাব একমাত্র মুক্তবুদ্ধির চূড়ান্ত ফলশ্রুতি ছাড়া আর কিছুই নয়। যেখানে অর্থগত দিক থেকে- “মাভৈঃ” – বলিয়া নীরবে দিতেছে সাড়া।” লক্ষণীয় , মাভৈঃ – উচ্চারিত হলে নীরবতার কোনো প্রশ্নই থাকে না, তেমনি- “ মহানিঃশব্দের পায়ে রচি দিল আত্মবলি তার।” – অথবা- “ সেই প্রভাতের স্নিগ্ধ সুদূর গন্ধ- প্রভূতি। রবীন্দ্রনাথের মতেই ঐ পঙতিগুলো যদি এভাবেই ব্যবহার করা না হত অর্থাৎ যদি অস্পষ্টতায় আবৃত না রেখে সরাসরি স্পষ্টাকারে বিধৃত করা হত তাহলে তার আবেদন কোনোক্রমেই সমগ্রতা লাভ করত না। এ প্রসঙ্গে কবি জীবনানন্দ দাশের আরও দুটি কবিতা উদ্ধৃত করা হলো-

(১)
মনে হয় একদিন আকাশের শুকতারা দেখিব না আর;
দেখিব না হেলেঞ্চার ঝোপ থেকে একঝাড় জোনাকি কখন
নিভে যায়;-দেখিব না আর আমি পরিচিত এই বাঁশবন,
শুকনো বাঁশের পাতা-ছাওয়া মাটি হয়ে যাবে গভীর আধার
আমার চোখের কাছে;-লক্ষ্মীপূর্ণিমার রাতে সে কবে আবার
পেঁচা ডাকে জ্যোৎস্নায়;-হিজলের বাঁকা ডাল করে গুঞ্জরণ;
সারা রাত কিশোরীর লাল পাড় চাঁদে ভাসে-হাতের কাঁকন
বেজে ওঠে; বুঝিব না-গঙ্গাজল নারকোলনাড়–গুলো তার
জানি না সে কারে দেবে-জানি না সে চিনি আর শাদা তালশাঁস
হাতে লয়ে পলাশের দিকে চেয়ে দুয়ারে দাঁড়ায়ে রবে কিনা
আবার কাহার সাথে ভালোবাসা হবে তার-আমি তা জানি না,-
মৃত্যুরে কে মনে রাখে?… কীর্তিনাশা খুঁড়ে খুঁড়ে চলে বারো মাস
নতুন ডাঙ্গার দিকে-পিছনের অবিরল মৃত চর বিনা
দিন তার কেটে যায়-শুকতারা নিভে গেলে কাঁদে কি আকাশ?

জীবনানন্দ দাশ, কবিতা: মনে হয় একদিন

(০২)
খুঁজে তারে মরো মিছে-পাড়াগাঁর পথে তারে পাবে নাকো আর;
রয়েছে অনেক কাক এ উঠানে-তবু সেই ক্লান্ত দাঁড়কাক
নেই আর-অনেক বছর আগে আমে জামে হৃষ্ট এক ঝাঁক
দাঁড়কাক দেখা যেত দিন রাত-সে আমার ছেলেবেলাকার
কবেকার কথা সব; আসিবে না পৃথিবীতে সেদিন আবারঃ
রাত না ফুরাতে সে যে কদমের ডাল থেকে দিয়ে যেত ডাক,-
এখনো কাকের শব্দে অন্ধকার ভোরে আমি বিমনা, অবাক
তার কথা ভাবি শুধুএতদিনে কোথায় সে? কি যে হলো তার
কোথায় সে নিয়ে গেছে সঙ্গে করে সেই নদী, ক্ষেত, মাঠ, ঘাস,
সেইদিন, সেইরাত্রি, সেইসব ম্লান, ভিজে শাদা হাত
সেইসব নোনা গাছ, করমচা,শামুক, গুগ্লি কচি তালশাঁস
সেইসব ভিজে ধুলো বেলকুড়ি-ছাওয়া পথ ধোঁয়া-ওঠা ভাত,
কোথায় গিয়েছে সব? অসংখ্য কাকের শব্দে ভরিছে আকাশ
ভোর রাতে-নবান্নের ভোর আজ বুকে যেন কিসের আঘাত!’

জীবনানন্দ দাশ, কবিতা: খুঁজে তারে মরো মিছে

জীবনানন্দ দাশের কবিতা দু’টিও প্রচ্ছন্নতায় আবৃত। কিন্তু এই প্রচ্ছন্নতা কবিতা দু’টির ‘ভাব-নদীটি’তে যে ব্যঞ্জনা দান করেছে এক কথায় তা অতুলনীয়। এই ব্যঞ্জনাই যে ভাব-নদীটির জল দিয়ে মানুষের হৃদয়কে প্লাবিত করেছে- এটি বোধকরি র্নির্দ্বিধায় বলা যায়। কেননা কবি-কল্পনার ভাব প্রচ্ছন্নতার ভেতর দিয়ে যদি মানুষের চিন্তাকে স্থবিরতা থেকে উদ্ধার ক’রে ওই ভাবের নিগুঢ়ত্বের প্রতি আকৃষ্ট করতে ব্যর্থ হয় তাহলে কবির উদ্দেশ্য সিদ্ধ হয় না। আর কবির উদ্দেশ্য সিদ্ধ না হ’লে কবিতার উদ্দেশ্যও অসিদ্ধ থেকে যায়।

প্রথম কবিতাটিতে কবি তার ব্যর্থ প্রেমের স্মৃতিগুলিকে খুঁজে পাবার চেষ্টা করেছেন অপরূপ বাংলার পল্লী প্রকৃতিকে আঁকড়ে ধরে সে প্রকৃতিকেই ভালোবাসবার ভেতর দিয়ে। ‘মনে হয় একদিন আকাশের শুকতারা দেখিব না আর;’ এবং ‘শুকতারা নিভে গেলে কাঁদে কি আকাশ?’ কবিতাটির প্রথম এবং শেষ পঙতি দু’টিই কবির প্রেমিকার প্রতি নিদারুণ অভিমান এবং ব্যর্থ প্রেমের বিলাপ হাহাকার হয়ে ঝরে পড়ে প্রকৃতির হেলেঞ্চার ঝোঁপে, জোনাকির ঝাঁকে, পরিচিত বাঁশবনে, পূর্ণিমা রাতে লক্ষ্মীপেঁচার ডাকে, হিজলের বাঁকা ডালের গুঞ্জরণে, চাঁদে কিশোরীর শাড়ীর লাল পাড়ের ভেসে চলাতে, কীর্তিনাশা নদীর খুঁড়ে খুঁড়ে নতুন ডাঙ্গার দিকে এগিয়ে চলায়। অর্থাৎ আবার সামনের ডাঙ্গাকে ভাঙবে কীর্তিনাশা। অথচ এসব আর দেখা হবে না বলে কবির আক্ষেপ মানুষের চিন্তাকে গতিশীল করে কবির আক্ষেপের প্রতি মানুষকে সহানুভূতিশীল করে তোলে। এই যে মানুষের চিন্তাকে গতিশীল করে কবির আক্ষেপের প্রতি সহানুভূতিশীল করে তোলা- এ শুধু কবিতাটির শরীরে প্রচ্ছন্নতার গাঢ় প্রলেপ থাকার কারণেই। যদি প্রচ্ছন্নতা না থাকতো তাহলে মানুষের চিন্তাকে অবশ্যই নাড়া দিতে ব্যর্থ হতো কবিতাটি। কবির আক্ষেপের প্রতি সহানুভূতিশীল হবার কোনো প্রশ্নও উত্থাপিত হতো না। কবিতাটির শরীরে থাকা প্রচ্ছন্ন প্রলেপটির কৃতিত্ব এখানেই।

দ্বিতীয় কবিতাটিতে কবি যেন নগরীয় যান্ত্রিক পরিমন্ডলের ধূসর কৃত্রিমতা থেকে বেরিয়ে বাংলার অপূর্ব লাবণ্যময়ী ছন্দময় প্রকৃতির মাঠে, ঘাটে, পথে, প্রান্তরে বিরামহীন খুঁজে বেরিয়েছেন নিজেকে, নিজের অস্তি¡কে। তিনি নিজেই বলেছেন-‘খুঁজে তারে মরো মিছে-পাড়াগাঁর পথে তারে পাবে নাকো আর;’ এখন উঠানে অনেক দাঁড়কাক থাকলেও সেই ক্লান্ত দাঁড়কাকটি আর নেই। কখন যেন হারিয়ে গেছে এ পাড়া থেকে। এই দাঁড়কাকটিকে কবি একটি প্রতীক হিসেবে ব্যবহার করেছেন। যদি ধরে নেয়া হয়- দাঁড়কাকটির অবয়বে কবি নিজেই হারিয়ে গেছেন এ প্রকৃতির বিপুল রত্নরাজিকে ফেলে অন্য কোথাও কোনো শাহরিক পরিবেশে কোনো কারণে অথবা কোনো প্রলোভনে প্রলোভিত হয়ে- যা তিনি তখন বুঝতে পারেন নি। কিন্তু সে পরিবেশে জীবন থেকে অনেক দূরে, জীবনের সজীব ছোঁয়ার বাইরে মৃতের নগরে মৃতদের সাথে বসবাস করে অতিষ্ঠ হয়ে সেই জীবনকে অস্বীকার করে আবার ফিরে পেতে চাইছেন কবি তার নিজেকে প্রকৃতির কাছেই তার সেই শৈশব কালকে, শৈশব থেকে বর্তমান কালকে অবধি। যে প্রকৃতিতে নদী, ক্ষেত, মাঠ, ঘাস, সেই সব নোনা গাছ, করমচা, শামুক, গুগ্লি কচি তালশাঁস, সেইসব ভিজে ধুলো, বেলকুড়ি-ছাওয়া পথ, ধোঁয়া-ওঠা ভাত- কোথায় হারিয়ে গেছে এসব? সহস্র সহস্র কাকের কর্কশ শব্দে ভেসে যাচ্ছে শহরের ভোরের আকাশ। অথচ অঘ্রানের নবান্নের ভোর আজ- গ্রাম বাংলার মানুষের কাছে আজ এক নতুন সকাল। নতুন ধানের নতুন চালের নতুন অন্ন মুখে দেবে আজ নতুন শিশুটি। কিন্তু শহরে তো তা নেই- শুধু যেন কৃষ্ণবর্ন কাককুলের আরও ঘণকৃষ্ণ বুভূক্ষু নিনাদ, মহাচিৎকার আর আর্তনাদ- যেন দুর্ভিক্ষের পদধ্বনি। যা তিনি শুনতে চাননি, দেখতেও চান নি। যে কাককুল জঠরপূর্র্ণ খাদ্যে ভরপূর থেকে ছিলো গ্রামীণ প্রকৃতির শোভা সেই কাককুলই আজ শাহরিক পরিবেশে এসে হয়ে উঠেছে ক্ষুধাতুর, হিংস্র আক্রমনকারী- যা কবিকে ব্যথাতুর করে তুলেছে একই সাথে আতঙ্কিতও করেছে ভীষণভাবে- বিশেষতঃ যখন কবি বলেন-

অসংখ্য কাকের শব্দে ভরিছে আকাশ
ভোর রাতে- নবান্নের ভোর আজ বুকে যেন কিসের আঘাত!

– অথচ কবি নিজেই অতীতের কোনো এক সময় ‘ক্লান্ত দাঁড়কাক’- হয়ে তার গ্রাম থেকে হারিয়ে গিয়ে হয়তো কোনো শহরে আশ্রয় নিয়েছিলেন বলে তার যে অনুতাপ, যে অনুশোচনা তা তার মর্মাহত বেদনা এবং আতঙ্কের ভেতর দিয়ে প্রকাশ করেছেন তার কবিতার উদ্ধৃত শেষ পঙতি দু’টিতে।

এ কবিতাটিও প্রচ্ছন্নতায় মগ্ন। এই মগ্ন প্রচ্ছন্নতাই কবিতাটিকে দান করেছে অপরূপ সৌন্দর্য সুষমা এবং সীমানা ছাড়িয়ে যাওয়া ভাবানুষঙ্গতার মহিমা। আর এই মহিমাই প্রথম কবিতাটির মতোই মানুষের চিন্তাকে প্রচন্ডভাবে আকৃষ্ট করেছে কবিতাটির দিকে। এবং এই আকর্ষণই উদ্ধৃত কবিতা দুটির শরীরে প্রলেপিত প্রচ্ছন্নতার মৌলিক কৃতিত্ব এবং সার্থকতা যা- প্রথম কবিতাটির ক্ষেত্রেও বলা হয়েছে।

এ কবিতাটিতে কবি তার জীবনের সাথে জড়িয়ে থাকা কিশোরী পল্লী-প্রকৃতির মমতা জড়ানো মায়াবী সান্নিধ্য থেকে বিচ্ছিন্ন হয়ে কোন্ নাগরিক জঙ্গমতায় মিশে যাবার মর্ম-যাতনায় বিদ্ধ হ’য়ে আবার সেই প্রকৃতির মাঝেই নিজেকে খুঁজে পাবার আকুলতা প্রকাশ করলেও নিজের দেশ ত্যাগ করে তিনি ভিন্ন কোনো দেশে নিজেকে নির্বাসিত করেন নি যেখানে এই বাংলার আর একজন হতভাগ্য মহাকবি মাইকেল মধুসুদন দত্ত-

হে বঙ্গ, ভান্ডারে তব বিবিধ রতন;-
তা সবে, (অবোধ আমি!) অবহেলা করি,
পরধন লোভে মত্ত, করিনু ভ্রমণ
পর-দেশে, ভিক্ষাবৃত্তি কুক্ষণে আচরি।
কাটাইনু বহুদিন সুখ পরিহারি!
অনিদ্রায়, নিরাহারে সঁপি কায়, মনঃ,
মজিনু বিফল তপে অবরেণ্যে বরি;-
কেলিনু শৈবালে, ভুলি কমল-কানন!
স্বপ্নে তব কুললক্ষী কয়ে দিলা পরে,-
‘ওরে বাছা মাতৃকোষে রতনের রাজি,
এ ভিখারী-দশা তবে কেন তোর আজি?
যা ফিরি, অজ্ঞান তুই, যারে ফিরি ঘরে!’
পালিলাম আজ্ঞা সুখে; পাইলাম কালে
মাতৃ-ভাষা-রূপে খনি, পূর্ণ মণিজালে।।

‘বঙ্গভাষা’- নামীয় কবিতাটির উদ্ধৃত কয়েকটি পঙ্তিতে পরদেশে অবস্থান কালের শেষ দিকে নিজ মাতৃভূমিতে ফিরে আসবার অকুল আকুলতা ব্যক্ত করেছেন এবং বিদেশে অবস্থানের জন্যে অনুতাপ ও অনুশোচনা প্রকাশ করেছেন। নিজ মাতৃভূমির রত্ন ভান্ডারকে অবহেলা, অগ্রাহ্য করে ভিন্ন ধর্মে দীক্ষিত হ’য়ে-এখানে বিশেষভাবে উল্লেখ্য যে, কবি তাঁর কৈশোর জীবন থেকেই হিন্দু ধর্মীয় প্রথা, বিধি বিধান, আচার আচরণ এবং কুসংস্কারকে পছন্দ করতেন না এবং সেসবের প্রতি তিনি বীতশ্রদ্ধ ছিলেন এবং ইংরেজী সাহিত্যের প্রতি প্রবলভাবে আসক্ত ছিলেন। আর সে কারণেই কবি এক সময় খৃষ্টধর্মের প্রতি আকৃষ্ট হয়ে খৃষ্টধর্ম গ্রহণ করেন এবং নিজ দেশ ত্যাগ ক’রে লন্ডন গমন করে সে দেশেই বসবাস করতে শুরু করেন। ওই সময়ই তিনি সে দেশের সাহিত্য, সংস্কৃতিতে ইংরেজী কবিতা রচনার মাধ্যমে নিজেকে আবিস্কারের চেষ্টা করেন। কিন্তু সে চেষ্টা ফলবতী না হলে কবি তাঁর নিজ মাতৃভূমির প্রতি আসক্ত হয়ে পড়েন এবং মাতৃভূমির নদী, নদী তীরের বটবৃক্ষ, শিব-মন্দির, মাতৃভূমির পাখী, প্রকৃতি- এ সবের প্রতি দূর্বার আকর্ষণ অনুভব করেন এবং ভিন্ন দেশের সাহিত্য, সংস্কৃতির প্রতি নিদারুণ ক্ষুব্ধ হয়ে এবং পরিত্যাগ করে আপন মাতৃভূমিতেই ফিরে আসেন ১৮৪৮ সালে। এবং অন্তিমে নিজ দেশের সাহিত্যেই সার্থকতা লাভ করেন তার অসামান্য মহাকাব্য- ‘মেঘনাদ বধ’ রচনার মধ্যে দিয়ে। এর পর তিনিই প্রথম কবি যিনি তৎকালীন প্রাচীন সংস্কৃত নাটকের নিয়ম রীতি পরিত্যাগ করে পাশ্চাত্য রীতিতে নাটক- ‘শর্মিষ্ঠা’-রচনা করেন। পরবর্তীতে ১৮৫৯ সালে একটি গ্রীক উপাখ্যান অবলম্বনে রচনা করেন নাটক- ‘পদ্মাবতী’। কিন্তু ওই নাটকে তিনি গ্রীক দেব, দেবীদের চরিত্রে গ্রীক দেব, দেবীদের পরিবর্তে হিন্দু দেব, দেবীদেরকে অন্তর্ভুক্ত করেন। এতে অবশ্য কাহিনির মূল সৌন্দর্য ক্ষতিগ্রস্ত হয় নি বরং নতুনভাবে নবতর আঙ্গিকে অধিকমাত্রায় দ্যূতিমান হয়েছে। এর পরপরই তিনি দুটি সামাজিক প্রহসন রচনা করেন-‘একেই কি বলে সভ্যতা’ এবং ‘বুড়ো শালিকের ঘাড়ে রোঁ’। এসবসহ অন্যান্য রচনাবলীর ভেতর দিয়ে কবি বাংলা সাহিত্যে তাঁর অবস্থান সুদৃঢ় করে তোলেন। লন্ডনে অবস্থানকালে তাঁর একমাত্র ইংরেজী উপন্যাস- ‘Captive Lady’- রচিত হয়। কবি লন্ডন থেকে মাদ্রাজে আসেন ১৮৪৮ সালে। কিন্তু লন্ডন থেকে মাদ্রাজে আসবার পরের বছর অর্থাৎ ১৮৪৯ সালে কবির এই ইংরেজী উপন্যাসটি প্রকাশিত হয়। কিন্তু উপন্যাসটি পাশ্চাত্য ইংরেজী সাহিত্যে নিজের স্থান করে নিতে ব্যর্থ হয়। ইংরেজী ‘কবিতা-সাহিত্যে’- স্থান করে নিতে ব্যর্থ হবার পর থেকেই কবির মননের গভীর অভ্যন্তরে নিজ মাতৃভূমির প্রতি দুর্নিবার আকর্ষণ অনুভূত হতে শুরু করে। সেই অনুভবের তাড়না থেকেই তিনি তাঁর স্বদেশ প্রত্যাবর্তনে বাধ্য হন।

এখানে কবি মাইকেল মধুসুদন দত্তকে নিয়ে যৎকিঞ্চিৎ আলোচনা করা হলো এ কারণে যে, মাইকেল মধুসুদন দত্ত তাঁর জন্মভূমি বাংলার প্রমিত সংস্কৃতি এবং সাহিত্য সম্ভারকে অবহেলা করে পাশ্চাত্যের সংস্কৃতি এবং সাহিত্যকে নিজের মধ্যে ধারণ করে দেশান্তরী হয়েছিলেন এবং চেয়েছিলেন ইংরেজী সাহিত্যে পাশ্চাত্যের একজন উঁচু মাপের কবি এবং সাহিত্যিক হতে- যা কবি জীবনানন্দ দাশ কখনই চান নি এবং সে চেষ্টাও করেননি। নিজ দেশের সংস্কৃতি, সাহিত্যকেই নিজের মধ্যে ধারণ এবং লালন করে বাংলার বিশাল প্রকৃতির কাছেই তাঁর আত্মজিজ্ঞাসার উত্তর খুঁজে পাবার চেষ্টা করেছেন এবং বাংলার সংস্কৃতি, সাহিত্যকে সমৃদ্ধ করেছেন তাঁর লেখনীর মাধ্যমে জীবনের শেষ মূহুর্তটি পর্যন্ত। এর বিন্দুমাত্র ব্যত্যয় তিনি ঘটতে দেন নি তাঁর সারা জীবনে।

এখন মূল প্রসঙ্গ: কবিতার ক্ষেত্রে প্রচ্ছন্নতা কবিতার একটি বিশেষ অলঙ্কার। কবিতায় কবিতার চরিত্র অনুযায়ী সঠিক শব্দ সংযোজন, উপমা, উৎপ্রেক্ষা প্রয়োগ এবং নান্দনিক গঠন পদ্ধতি অবলম্বন যেমন কবিতার অলঙ্কার ঠিক তেমনি প্রচ্ছন্নতাও একটি বিশেষ অলঙ্কার বলে আমার বিশ্বাস। কারণ প্রচ্ছন্নতাই মানুষের চিন্তাকে গতিশীলতার উচ্চ মাত্রায় পৌঁছে দেবার একটি বিশেষ উপাদান। কবিতা ছাড়াও যদি সাধারণভাবেও বিবেচনা করা হয় তাহলেও দেখা যাবে যেখানেই প্রচ্ছন্নতা সেখানেই মানুষের কৌতূহলের উদ্ভব। এবং এই কৌতূহলই মানুষকে তার চিন্তাবৃত্তিকে প্রচ্ছন্নতার গভীরের বিষয়টিকে উন্মোচনের লক্ষ্যে প্রচ্ছন্নতার দিকেই ধাবিত করে। প্রচ্ছন্নতার এটি একটি সহজাত গুণ। একটি অখন্ড অথবা খন্ডিত ভাস্কর্যকে যদি কোনো অবগুন্ঠনে অবগুন্ঠিত করে রাখা হয় তখন মানুষের ভাবনা অস্থির হয়ে ওঠে ওই অবগুন্ঠনটিকে অপসারণ করে অবগুন্ঠনের ভেতর কি আছে তাকে প্রত্যক্ষ করবার। অবগুন্ঠনটি অপসারিত হবার পর মানুষ যখন পূর্ণাঙ্গ ভাস্কর্র্যটিকে অবলোকন করে তখন মানুষের ভেতর যে সুখসিক্ত উপলব্ধিটি অনুভূত হয় খন্ডিত ভাস্কর্যটি প্রত্যক্ষ করে সে ধরনের উপব্ধিটি না-ও অনুভূত হতে পারে। কিন্তু অবগুন্ঠন অপসারনের বিষয়টিই এখানে মূখ্য বিবেচ্য বিষয় হয়ে দাঁড়ায়। প্রত্যক্ষতার বিষয়টি তখন আর মূখ্যতার অবস্থানে থাকে না।

অনেকগুলি উদ্দেশ্যের মধ্যে মূলতঃ কবিতার দুটি উদ্দেশ্য মূখ্য-

প্রথমতঃ- কবিতার মর্মোস্থিত বার্তা মানুষের কাছে পৌঁছে দেয়া।

দ্বিতীয়তঃ- কবিতার মর্মমূলে মানুষের চিন্তাকে প্রবিষ্ট করানো।

এখানে দ্বিতীয় উদ্দেশ্যের সফলতাকেই প্রথম উদ্দেশ্য সিদ্ধির শর্ত হিসেবে উল্লেখ করা হয়েছে। এ প্রেক্ষিত বিবেচনায় এখানে একটি প্রশ্ন উত্থাপিত হওয়া অত্যন্ত স্বাভাবিক য়ে, তাহলে দ্বিতীয় উদ্দেশ্যটিকে প্রথম হিসেবে গ্রহণ করা হলো না কেন? এ প্রশ্নের উত্তর পেতে হলে আমাদেরকে আরও একটু গভীরে যেতে হবে। একজন শুদ্ধ কবি যখন কোনো একটি কবিতা লেখেন তখন তিনি তার কবিতার পলিতে মানুষের কল্যাণ সাধনের বাণীটির বীজটিকে রোপন করে দেন। কবির লক্ষ্য থাকে মানুষ যেন তার কবিতাটি থেকে তার মঙ্গলের বার্তাটি পেয়ে যান। আর একজন মানুষ যখন কবিতাটি পাঠ করেন তখন তার ভেতর আপনা আপনিই একটি কৌতূহলের সৃষ্টি হয় যে, কবিতাটির মাধ্যমে কবি কী বলতে চেয়েছেন? ঠিক তখনই তার চিন্তা-রশ্মি কবিতাটিকে আলোকিত করতে শুরু করে। এবং এই চিন্তা-রশ্মির তীক্ষ্ণতা দিয়েই শেষ পর্যন্ত তিনি কবিতাটির মর্মমূলে পৌঁছুবার চেষ্টা করেন এবং এক সময় হয়তো পৌঁছেও যান। আর এ কারণেই দ্বিতীয় উদ্দেশ্যটিকে প্রথম উদ্দেশ্য সিদ্ধির শর্ত হিসেবে উল্লেখ করা হয়েছে।

সেদিক থেকে এখন বোধকরি বলা অপ্রাসঙ্গিক এবং অসঙ্গত হবে না যে, প্রথম উদ্দেশ্যটিকে সিদ্ধ করবার জন্যে প্রয়োজন দ্বিতীয় উদ্দেশ্যটিকে সফল করে তোলা। কারণ দ্বিতীয় উদ্দেশ্যটি সফল না হলে প্রথম উদ্দেশ্যটি সিদ্ধ হবে না। যেহেতু মানুষের চিন্তা প্রবাহকে কবিতা তার নিজের দিকে আকৃষ্ট করতে ব্যর্থ হলে কবিতার বাণী মানুষের কাছে পৌঁছুবে না। এখানে অবশ্যই বিবেচ্য যে, সমগ্র সাহিত্যের গোটা কান্ডের সব শাখা প্রশাখার মধ্যে কবিতাই একমাত্র শাখা- যে শাখাটি মানুষের চিন্তার ভেতর প্রবল গতি সঞ্চারের একমাত্র শক্তিশালী উপাদান।  

‘কবিতার জন্য অভিজ্ঞতার প্রয়োজন- নীহারিকার মতো পরস্পর সংলগ্ন অনেকগুলো অনুভূতি। কবির অনুভূতি এমন প্রগাঢ় হবে যে তিনি তার প্রতিরূপ আবিস্কার করবেন শব্দে। আবিস্কার করবেন না বলে বলা যায় যে, স্বতঃসিদ্ধান্তে তিনি একটি বক্তব্যে উপনীত হবেন।’- সৈয়দ আলী আহসান।

‘কবিতায় প্রাথমিক পর্যায়ে যে সরলতা থাকে তা’ জীবন সম্পর্কে অভিজ্ঞতার অভাবের জন্য কিন্তু সর্বশেষের সরলতা অভিজ্ঞতার প্রগাঢ়তার জন্য। আমরা প্রথমে ভাষাকে পাই, কিন্তু অবশেষে তাকে আবিস্কার করি শাসনের মধ্যে এবং অস্তিত্বের বিচিত্র খেলায়। রুদ্ধবাক্ থেকে মুক্তবাক্ এবং অবশেষে সর্ব সঞ্চয়ের অভিজ্ঞতায় স্বল্পবাক্- যে কোনও প্রধান কবির কাব্য-জীবনের ক্ষেত্রে এ উক্তি চরমভাবে সত্য। যাকে ইংরেজীতে বলে Crystallization অর্থাৎ স্ফটিক-বন্ধন, আমাদের অভিজ্ঞতা যখন স্ফটিকের নিশ্চিত স্বচ্ছতায পরিণত হবে, তখন অনেক কথা বলার প্রযোজন করবে না। অতি অল্প কথায় আমরা আমাদের অভিজ্ঞতাকে বাঙ্ময় করবো। আমরা প্রতিদিন জীবনের অলিন্দে দাঁড়িয়ে অভিজ্ঞতার নিঃশ্বাস গ্রহণ করছি। আমাদের শ্বাস-প্রশ্বাসের মধ্যে জীবনের যে সঞ্চয়, অভিজ্ঞতার আহরণ নিয়ে একজন কবির জীবনে তা যেমন সত্য, অন্য কারও জীবনে তেমন নয।’- সৈয়দ আলী আহসান।

ওপরের উদ্ধৃতি দু’টির মধ্যে দিয়ে একটি বিষয় স্পষ্ট য়ে, একজন কবি তার অনুভূতির প্রগাঢ়তার প্রতিরূপ আবিস্কার করবেন শব্দের ভেতর এবং একজন কবির জীবনের সঞ্চয় সমৃদ্ধ তার অভিজ্ঞতার আহরণ দিয়ে। প্রকারান্তরে একজন কবির চিন্তাশীলতার প্রগাঢ়তার ঋদ্ধায়ন তার অভিজ্ঞতার প্রাচুর্যে। যে অভিজ্ঞতা নিয়ত তিনি তার নতুন নতুন সৃষ্টিতে প্রয়োগ করেন। এখানেই একজন কবি এবং একজন সাধারণ মানুষের মধ্যে পার্থক্য।

এখন কবি রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর এবং জীবনানন্দ দাশের উদ্ধৃত চারটি কবিতার পাশাপাশি রবীন্দ্রনাথের আর দু’টি কবিতার উদ্ধৃতি দেয়া যাক-

(১)
সুন্দর, তুমি এসেছিলে আজ প্রাতে
অরুণবরন পারিজাত লয়ে হাতে।
নিদ্রিত পুরী, পথিক ছিল না পথে
একা চলি গেলে তোমার সোনার রথে-
বারেক থামিয়া, মোর বাতায়ন পারে
চেয়েছিলে তব করুণ নয়ন পাতে।
স্বপ্ন আমার ভরেছিল কোন গন্ধে,
ঘরের আঁধার কেঁপেছিল কী আনন্দে;
ধুলায় লুটানো নীরব আমার বীণা
বেজে উঠেছিল অনাহত কী আঘাতে।।
কতবার আমি ভেবেছিনু উঠি উঠি,
আলস্য ত্যাজিয়া পথে বাহিরাই ছুটি।
উঠিনু যখন তখন গিয়েছে চলে-
দেখা বুঝি আর হল না তোমার সাথে

গীতাঞ্জলি /রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর

(২)
রূপসাগরে ডুব দিয়েছি অরূপ রতন আশা করি
ঘাটে ঘাটে ঘুরব না আর ভাসিয়ে আমার জীর্ণ তরী ।
সময় যেন হয় রে এবার ঢেউ খাওয়া সব চুকিয়ে দেবার,
সুধায় এবার তলিয়ে গিয়ে অমর হয়ে রব মরি।।
যে গান কানো যায় না শোনা সে গান যেথায় নিত্য বাজে
প্রাণের বীণা নিয়ে যাব সেই অতলের সভা মাঝে।
চিরদিনের সুরটি বেঁধে শেষ গানে তার কান্না কেঁদে
নীরব যিনি তাঁহার পায়ে নীরব বীণা দিব ধরি ।
রূপসাগরে ডুব দিয়েছি অরূপরতন আশা করি।

গীতাঞ্জলি /রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর

তুলনামূলকভাবে এই কবিতা দুটির মাঝে অনিশ্চয়তা, অস্পষ্টতা, প্রচ্ছন্নতা সবই যেন অত্যধিক শীর্ণ দৃশ্যমান। বিশেষ করে দ্বিতীয় কবিতাটি তো সর্বতোভাবে তাত্ত্বিকতা এবং ঈশ্বর-আরাধনার স্তুতির গভীরে নিমজ্জিত । প্রথম কবিতাটিও ঈশ্বর আরাধণায় মগ্ন। প্রচ্ছন্নতা নেই বললেই চলে। একবার পাঠ করলেই বোঝা যায় কবিতাটির মাধ্যমে কবি কী বলতে চেয়েছেন। কবিতাটিকে একবার কল্পনার সাথে সম্পৃক্ত করলে দ্বিতীয় বার আপনা আপনি কল্পনা থেকে বিচ্ছিন্ন হয়ে যায় । নতুন করে ভাববার আগ্রহকে উৎসাহিত বা প্রলুব্ধ করে না। একই সাথে কোনো প্রণোদনাও প্রদান করে না। চিন্তা প্রবাহে নতুন গতি সঞ্চার করতে পারে না।

এখন সঙ্গত যুক্তি এবং কারণেই সিদ্ধান্তে আসা যায় যে, সাহিত্যের চরিত্রে (বিশেষ করে কাব্যে) যদি অনিশ্চয়তার প্রচ্ছন্নতা, যে প্রচ্ছন্নতা মূলত মুক্তবুদ্ধির গর্ভজাত- তা না থাকে তবে অন্তর পরিধিতে সে সাহিত্য ঈস্পিত গুঞ্জন সৃষ্টিতে কোনোক্রমেই সফল হতে পারে না। এবং সে কারণে সৃষ্টিও সর্বকোণ থেকে মহত্ত্বের সাথে তুলিত হতে পারে না।

ইংরেজী সাহিত্যের চরিত্র নিরীক্ষণ করলে এর প্রমাণ দুর্লভ হবে না। (বিশেষ করে কবিতায়)। বিশেষত ইয়েটস ও কীটসীয় ভাবধারা ঐ প্রচ্ছন্নতার আলোকে পরিবৃদ্ধ- সম্ভবত এ সম্পর্কে সন্দেহের অবকাশ তিরোহিত। ইয়েটস এর The Scholars, The Wild swan at coole. He reproves the curlew, The wind among the reeds. John keats- এর  The eve of st. agnes, Happy is England প্রভৃতি কবিতা নিঃসন্দেহে অনিশ্চয়তা এবং প্রচ্ছন্নতাকে সমর্থন করে এক কথায়। আর এ সমর্থন তাদের প্রথম অর্থেই নির্দ্বিধায় মুক্তবুদ্ধির মৌলিক প্রতিনিধিত্বকারী কল্পনার উৎসারণ থেকে চরিত্রমন্ডিত। এবং এ চরিত্রের প্রতিফলন বর্তমানের অতি সাম্প্রতিক কাব্যসাহিত্যেও যথার্থভাবে প্রতিফলিত। যাদের মধ্যে সৈয়দ শামসুল হক, শামসুর রাহমান, আব্দুল মান্নান সৈয়দ, নির্মলেন্দু গুন, রফিক আজাদ- এর কিছু কিছু কাব্যসৃষ্টিকে প্রচ্ছন্নতার আলোকে স্বার্থক বললে মোটেই অত্যুক্তি করা হয় না বলেই আমার প্রতীতি।

এখন এ সব সংক্ষিপ্ত বিশ্লেষণ থেকে কিছুটা নিশ্চয়তা খুঁজে পাওয়া যায় যে, কবিতায় অনিশ্চয়তা, প্রচ্ছন্নতা প্রভূতি নিতান্তই প্রয়োজেনের অপেক্ষা রাখে মানুষেরই চিন্তাশীলতার গতিশীলতা এবং গভীরতা বৃদ্ধির একান্ত আপনার প্রশ্ন-রোহিত মহৎ স্বার্থে এবং মুক্তবুদ্ধি চর্চার যথার্থতার জন্যেই- যে মুক্তবুদ্ধির মৌল ধর্মই প্রতিশ্রুত শীত-সন্ধার কুয়াশাচ্ছন্ন নিস্তব্ধ, নিঃপ্রাণ অরণ্যের রুদ্ধ আকুতিকে জীবনের উন্মাদনায় রূপান্তরিত করতে সক্ষম হবে । 

– সরদার মোহম্মদ রাজ্জাক

চলতি সংখ্যা