মুকতার লুবিস ফোবিয়া ও শুদ্ধ সংস্কৃতি চর্চাকেন্দ্র

তখন মাধ্যমিকের নাইন/ টেন ক্লাসে পড়ি। মাসিক নতুন ঢাকা ডাইজেস্ট, রহস্য পত্রিকা আর ত্রৈমাসিক সাহিত্যপত্র নিয়োমিত পড়ি। সম্ভবত ঢাকা ডাইজেস্টে ভারতের বিখ্যাত সাংবাদিক ও ঔপন্যাসিক খুশবন্ত সিং’র একটা উপন্যাসের ধারাবাহিক অনুবাদ পড়ি।ব্যাস, হয়ে পড়ি খুশবন্ত সিংহ ‘র অনুরক্ত পাঠক। অত:পর রুদ্রশ্বাসে পড়ে ফেলি তার ট্রেন টু পাকিস্তান, দিল্লি, অবিস্মরণীয় নারী, দ্য কোম্পানি অব ওম্যান, ট্রুথ লাভ এন্ড এ লিটল ম্যালিস, দ্য সানসেট ক্লাব, ম্যালিসিয়াস গসিপ, ভিনটেজ সর্দার, দ্য পট্রেট অব এ লেডি। সৃষ্টি হল সাংবাদিক ও সাংবাদিকতার উপর সমীহ দৃষ্টিভঙ্গি।

এরই মাঝে মাধ্যমিকের গন্ডি ডিঙ্গিয়ে উচ্চ মাধ্যমিকে উঠেছি। পশ্চিমা সাংবাদিক ভিক্টর চোর্যার ধারাবাহিক পড়ে পড়ে অনাস্বাদিত ভূবনের স্বাদ উপলব্ধি করছি। সৌভাগ্যক্রমে ভারতের আরেক দিকপাল সাংবাদিক কুলদীপ নায়ারের গল্পগ্রন্থ লাভ লেটার দুলাভাইয়ের হাত ঘুরে আমার হাতে আসে। আমি যেন ভিন্নগ্রহের অনাস্বাদিত কিছু পেয়ে গেলাম। হয়ে গেলাম উপমহাদেশের দিকপাল রাজনৈতিক ভাষ্যকারের চরমতম ভক্ত। একে একে কিনে ফেলি তাঁর বিটুইন দ্য লাইন, দ্য ক্রিটিক্যাল ইয়ার ১৯৭১,সুপ্রিশন অব জার্জেস, দ্য জাজমেন্ট।

ইন্টার পাশ করেছি। জানেমন দোস্ত শাহীন বুয়েটে ভর্তি। স্বাভাবিকভাবে ঢাকায় অবস্থান বেড়ে গেল। নীলক্ষেত আর নিউ মার্কেটের বই’র দোকানগুলি যেন বশীকরণ করল। সেখানেই আকস্মিকভাবে পরিচয় ঘটল ইন্দোনেশিয়ার সাংবাদিক মুকতার লুবিসের সাথে। অবশ্য সাক্ষাৎ পরিচয় না, তাঁর গ্রন্থের সাথে। উর্দ্ধশ্বাসে পড়ে ফেলি তার রোড উইথ নো এন্ড, টোয়াইলাইট অব জাকার্তা।
এই বই দুটি সংগ্রহ করা ছিল আরেক ইতিহাসের গ্রন্থি উন্মোচনের মত। গ্রন্থ দুটির অনুবাদক ফজলে রাব্বি। প্রকাশ করেছে ইউপিএল। আমি মার্কেটে না পেয়ে ইউপিএল ( ইউনিভার্সিটি প্রেস লিমিটেড) গেলাম। সেখানেও নেই। আমার ভেঙ্গে পড়া মানসিক অবস্থা বুঝতে পেরে ঢাকা ইউনিভার্সিটির এক বয়স্ক শিক্ষক অনুবাদকের নাম্বার দিলেন। পরিচয়ও জানালেন। সম্ভবত সৈয়দ আলী আহসানের ভাগ্নে অনুবাদক। থাকেন গ্রীনরোডে। প্রায় দিনব্যাপী গ্রীনরোড খুজে বের করার পর অনুবাদকের বাসায় উপস্থিত। সব জেনে তিনি তো রীতিমত অবাক। অনেকটা জোর করে খাওয়ালেন, সঙ্গে বিনে টাকায় ২টি বই উপহার দিয়ে কৃতজ্ঞতা পাশে আবদ্ধ করেছেন।

বাড়ি ফিরে ২ রাত জেগে প্রথমে রোড উইথ নো এন্ড এর অনুবাদ ভয় পড়লাম। আমি তো রীতিমতো উত্তেজিত,পুলকিত। বিরতি না দিয়ে আরও ২ রাত জেগে এক নিশ্বাসে শেষ করলাম টোয়াইলাইট অব জাকার্তা বা জাকার্তায় গোধূলী। অবাক হই এই ভেবে যে স্বাধীনতার পর পর ইন্দোনেশিয়া আর বাংলাদেশের রাজনীতির সিমিলারিটি নিয়ে। নীতিহীন রাজনীতির পৈশাচিকতার কী নির্দয় দংশন! অবস্থা এমন হয়েছে যে, শুধুমাত্র অর্থের জন্য মন্ত্রির বউ ধনী দেশের কুটনীতিকের বিছানায় যাচ্ছে অবলীলায়। বিষয়টি আমার সাঙ্ঘাতিকভাবে মর্মাহত করে। নীতি নৈতিকতার এমন শোচনীয় নিমজ্জন, মানবিকতার এমন বিশ্রি অবমাননায় যারপরনাই ব্যাথিত হয়ে উঠি। অস্থির হয়ে উঠি সাংবাদিক মুকতার লুবিসের বিষয়ে আরও তথ্য জানতে।

জানতে পারি মুকতার লুবিসের জীবনের বিশেষ মিশন সম্পর্কে। তিনি পৃথিবীর বিভিন্ন দেশ ভ্রমণ করে প্রচার করেছেন তার বিশেষ অভিজ্ঞান। তা হল – এই পৃথিবী যতটুকু বাসযোগ্য, যতটুকু সুন্দর রয়েছে তা শুধু মধ্যবিত্ত শ্রেণির মানুষের প্রযত্নে। এখানে উচ্চবিত্ত ও নিম্নবিত্তের তেমন কোন অবদান নেই। এই পৃথিবীকে আরও বেশি বাসযোগ্য ও সৌন্দর্যমন্ডিত করতে মধ্যবিত্তকেই দায়িত্ব নিতে হবে। সে দায়িত্ব পালনের সামর্থ অর্জনের জন্য মধ্যবিত্ত শ্রেণিকে বুদ্ধিবৃত্তিক চর্চা ও মানসিকভাবে সামর্থ অর্জন করতে হবে।

মুকতার লুবিসের এই বোধ; এই দৃষ্টিভঙ্গি আমাকে তুমুলভাবে আলোড়িত করে। ভালবেসে ফেলি সাংবাদিকতাকে। আরও পরে এক ঝাঁক প্রতিশ্রুতিশীলকে নিয়ে সৃষ্টি করি শুদ্ধ সংস্কৃতি চর্চাকেন্দ্র। মুকতার লুবিসের সেই ভিশন -মিশন শুদ্ধ সংস্কৃতি চর্চাকেন্দ্রেরও অন্যতম ভিশন-মিশন। আসুন- বাসযোগ্য পৃথিবী গড়ে তোলার সংগ্রামে নির্দ্বিধায় হাত মেলাই; কাধ মেলাই।

© রহমান মুকুল

চলতি সংখ্যা