হুজুকে বাঙালী

রবীন্দ্রনাথ একটা কবিতায় লিখেছিলেন- “সাত কোটি সন্তানেরে, হে মুগ্ধ জননী, রেখেছ বাঙালী করে, মানুষ কর নি” রবীন্দ্রনাথও বাঙালী ছিলেন। কিন্তু তিনি কেনো নিজের স্বজাতের বিরুদ্ধে এধরনের কথা লিখেছিলন, এটা নিয়ে প্রায়ই বাঙালীদের মধ্যে মতভেদ তৈরি হয়। কারো মতে- এটা একটা গুজব, কারো মতে আত্মঘাতি কথা আবার কারো কারো মতে হুজুকে বাঙালী । রবীন্দ্রনাথ নিজেও আত্মঘাতি বাঙালী ছিলেন। ইংরেজদের সাথে মিশেছেন, তাদের মতো আচরণ করেছেন, তাদের পক্ষে কথা বলেছেন আর বদনাম করেছেন নিজেদের বিরুদ্ধে। তাই তিনি এধরনের কথা লিখতেই পারেন। কিন্তু এক শ্রেণির বাঙালী এটাকে পুরাপুরি সত্য বলে মনে ধারণ করতে লাগল। আসলেই বাঙালী মানুষ হয়ে উঠতে পারেনি।

এ ধরনের কথার উপর ভিত্তি করেই দু’ধরনের বাঙালী পাওয়া গেলো। একটি পক্ষ এটাকে গুজব মনে করে উড়িয়ে দিতে লাগল। তাদের মতে- গুজবে কান দেবেন না। আর এক পক্ষ- যারা এটাকে সত্য হিসেবে মনে করে- মনে মনে অপমানিত, লাঞ্ছিত এবং নিজেদের স্বজাতকে মনে মনে গালি গালাজ করতে লাগল।

তবে আমরা এখন অনেক আধুনিক হয়েছি, শিক্ষিত হয়েছি, প্রযুক্তিতে নিজেদের অনেকদূর এগিয়ে নিয়েছি। তবুও সেই কথাটা এখনো কানে বাজে- ‘মানুষ কর নি’। আচ্ছা আমরা যদি একবার অতীত থেকে ঘুরে আসি, তাহলে কী দেখতে পাই? বাঙালী কি মানুষ ছিল? যদি মানুষই থাকবে, তাহলে ব্রিটিশরা এদেশ দখল করল কীভাবে? সিরাজউদ্দৌলার করুণ মৃত্যু হলো কেনো? কেনো বাংলাকে বিভক্ত করা হলো?

দেশ স্বাধীনের পর বঙ্গবন্ধু একবার ভাষণে বলেছিলেন- ‘আজ থেকে কবিগুরুর ওই কথাটি মিথ্যা হয়ে গেল। আমার বাঙালী আজ মানুষ হয়েছ।’ আচ্ছা, বঙ্গবন্ধুর এই কথাটি যদি সত্য হয় অর্থাৎ বাঙালী যদি মানুষ হয়ে যায়- তাহলে বঙ্গবন্ধুর হত্যাকারীরা কি অবাঙালী ছিল? কেনো তাকে স্বাধীন বাংলার বুকে মরতে হলো? আচ্ছা, এ কথাও বাদ দিলাম, ধরলাম তিনি রাজনৈতিক কারণে মরেছেন। তাহলে গঙ্গাতে কেনো বাঁধ দেওয়া হলো? ফেলানির লাশ কেনো কাটাতারে ঝুলল? রানা প্লাজায় কেনো ধ্বস নামল?

বাংলাদেশ এখন অনেকদূর এগিয়েছে। নিজেদের অর্থে পদ্মা সেতু করছে। যাতে উত্তর-পশ্চিমাঞ্চলের সাথে যোগাযোগ ব্যবস্থা আরও উন্নত হয়। আর এটাকে কেন্দ্র করে আমরা আবার দেখতে পেলাম- বাঙালী কতটা মানুষ হয়েছে। কয়েকদিন ধরে তারা কয়েকটি ছেলেধরাকে পিটিয়ে মেরেছে। বাহ্ বেশ না? স্বাধীন বাংলায় ছেলেধরা? তাকে তো পিটিয়েই মারা উচিত। আসলে এটাও একটা গুজব।

বেশ কয়েকদিন ধরে শোনা যাচ্ছে- পদ্মা সেতু বানাতে মানুষের মাথা লাগবে। এই কথা আমিও শুনেছিলাম ছোটবেলায়। আমাদের শহরে একটা লালব্রীজ আছে। ছোটবেলায় মানুষের মুখে শুনতাম- লালব্রীজ নাকি মানুষের মাথা দিয়ে বানানো। তাই তার রং লাল। আজ এত বছর পর আবার যখন শুনলাম পদ্মা সেতুতে মানুষের মাথা লাগবে, তখন বিষয়টা কেমন যেন লাগল। এক ইঞ্জিনিয়ার বন্ধুকে ফোন দিলাম। সে বলল- এটা গুজব, গুজবে কান দিও না। আমি তো অবাক, আবার গুজব! বাঙালীর এই হুজুকেপানা কবে যাবে?

চারিদিকে যখন এই গুজব ছড়িয়ে পড়ল। সারা বছরের ছেলেধরা তখন বাইরে এলো। আর বাঙালীর প্যাদানি খেলো মনভরে। যখন বাঙালী কাউকে ছেলেধরা বলে পিটিয়ে মেরে ফেলছে, তার কিছুক্ষণ পর শোনা যাচ্ছে- আসলে তিনি ছেলেধরা ছিলেন না। এটা একটা গুজব ছিল। সন্দেহের বসে গণপিটুনি দিয়েছে বাঙালী। এভাবে যে কত ঘর খালি হচ্ছে তার অবকাশ নেয়। আমার ভাবতে অবাক লাগে- এই একবিশ্ব শতাব্দিতে এসেও বাঙালী মনে করে- সেতু বানাতে মানুষের মাথা লাগে। হায়রে হতভাগা বাঙালী। তবে কি তোরা আজো মানুষ হলিনি!

আবার এই দুই দিন চলছে প্রিয়া সাহা। তিনিও বাঙালী। তিনি কয়েকদিন আগে মার্কিন প্রেসিডেন্ট ডোনার্ড ট্রামকে বলেছেন- ‘বাংলাদেশ থেকে ৩ কোটি ৭ লাখ হিন্দু-বৌধ্য-খ্রিষ্টানকে গুম করে দেওয়া হয়েছে।’ এখন এটা নিয়েও বাঙালীর উত্তাপ।

এসব ভেবে এখন কিছুটা হলেও আন্দাজ করতে পারছি- রবীন্দ্রনাথ কেনো বাঙালীদেরকে এই কথা বলেছিলেন, কেনো রবীন্দ্রনাথের কাছে বাঙালী মানুষ ছিল না। এই বাঙালী অনেকদুর এসেছে, শিক্ষিত হয়েছে, তথ্য প্রযুক্তিতে নিজেকে এগিয়ে নিয়েছে। তবুও আধুনিক হতে পারেনি। এখনো কুসষ্কারাচ্ছন্ন হয়ে আছে। এই বাঙালীকে কি আপনি মানুষ বাঙালী বলবেন? নাকি রবীন্দ্রনাথের মতো বলবেন- বাঙালী কখনো না মানুষ হয়েছে, না কখনো ছিল বা কখনো হবে।

– আতিকুর রহমান ফরায়েজী

চলতি সংখ্যা