ঋদ্ধিমান মননের প্রকীর্ণতা : কবি-কল্পনার একটি বিশেষ মাত্রিকতা

দ্ধিধাদীর্ণ চিত্তসত্ত্বা ঋদ্ধ মনের প্রকীর্ণতাকে মৃত্যুত্তীর্ণ করে স্বীয় সত্ত্বায় শ্রদ্ধাশীলতার প্রশ্নে বিশ্বাসী থাকতে পারে না বিশেষ করে। যেহেতু দ্বিধা প্রথম অর্থেই দুর্বলতার রূপান্তরন এবং দুর্বলতা সর্বক্রমেই সন্দেহ প্রবণ আর তাকে অন্তরায়তনে আশ্রয় দান সত্ত্বার নির্লজ্জ্ব কাপুরুষতা। সাহিত্যকে কেন্দ্র করে এর প্রাসঙ্গিকী নির্মাণ করা সম্ভব হতে পারে। এ প্রসঙ্গেই বিবেচনা করা যাক-

এসব কবিতা আমি যখন লিখেছি বসে নিজ মনে একা;
চালতার পাতা থেকে টুপ টুপ জ্যোৎস্নায় ঝরেছে শিশির;
কুয়াশায় স্থির হয়েছিল ম্লান ধান সিঁড়িটির তীর;
বাদুড় আঁধারে ডানা মেলে হিম জ্যোৎস্নায় কাটিয়াছে রেখা
আকাক্সক্ষায়; নিভু দ্বীপ আগলায়ে মনোরমা দিয়ে গেছে দেখা
সঙ্গে তার কবেকার মৌমাছির- কিশোরীর ভীড়
আমের বউল দিল শীত রাতে;- আনিল অতীব হিম ক্ষীর;
মলিন আমি তাহাদের দেখিলাম,- এ কবিতা লেখা
তাহাদের ম্লান চুল মনে করে 
তাহাদের কড়ির মতন ধূসর হাতের রূপ মনে করে;
তাহাদের হৃদয়ের তরে।
সে কত শতাব্দী আগে তাহাদের করুণ শঙ্খের মতো স্তন
তাহাদের হলুদ শাড়ী ক্ষীর দেহ তাহাদের অপরূপ মন
চলে গেছে পৃথিবীর সব চেয়ে শান্ত হিম সান্তনার ঘরে;
আমার বিষন্ন স্বপে- থেকে থেকে ঘুম ভেঙে পড়ে।

এসব কবিতা আমি, জীবনানন্দ দাশ।

অথবা,

একদিন মনে হতো জলের মতন তুমি।
সকাল বেলার রোদে তোমার মুখের থেকে বিভা – 
অথবা দুপুর বেলা বিকেলের আসন্ন আলোয় –
চেয়ে আছে, চলে যায়- জলের প্রতিভা।
মনে হতো তীরের উপরে বসে থেকে আবিষ্ট পুকুর থেকে সিঙ্গারার ফল।
কেউ কেউ তুলে নিয়ে চলে গেলে নিচে তোমার মুখের মতন অবিকল 
নির্জন জলের রং তাকায়ে রয়েছে;
স্থানান্তরিত হয়ে দিবসের আলোর ভিতরে
নিজের মুখে ঠান্ডা জলরেখা নীড়ে
পুনরায় শ্যাম পরগাছা সৃষ্টি করে;
এক পৃথিবীর রক্ত নিপাতিত হয়ে গেছে জেনে
এক পৃথিবীর আলো- দিকে নিভে যায় বলে
রঙিন সাপকে তার বুকের ভেতরে তুলে নেয়;
অপরাহ্নে আকাশের রং ফিকে হলে ।
তোমার বুকের পরে আমাদের পৃথিবীর অমোঘ সকাল ;
তোমার বুকের পরে আমাদের বিকেলের রক্তিম বিন্যাস;
তোমার বুকের পরে আমাদের পৃথিবীর রাত
নদীর সাপিনী, লতা, বিলীন বিশ্বাস

তোমাকে, জীবনাননদ দাশ।

 এ কবিতা দুটোর কথা। প্রথম কবিতাটির সম্পূর্ণ শরীর মিলিয়েই যেন স্রোষ্টার সচলমান কল্পনার অমিত শক্তিশালী দয়িতার এক স্বপ্ন প্রচ্ছন্ন অথচ স্পষ্ট বিজড়ন। নিভু দ্বীপ আগলায়ে মনোরমা দিয়ে গেছে দেখা- যেন কল্পনার রক্তে হঠাৎ সমুদ্র পাতের মতো । আবার সে কত শতাব্দী আগে তাহাদের করুন শঙ্খের মতো স্তন, তাহাদের হলুদ শাড়ী- ক্ষীর দেহ তাহাদের অপরূপ মন- স্রষ্টাকে যেন ভাসিয়ে নিয়ে গেছে সুদূর  স্বপ্নলোকের গভীর অতলান্তে- যে কল্পলোকে স্বচ্ছন্দ বিচরণ করেই তিনি কল্পনা করতে পেরেছেন- করুণ শঙ্খের মতো স্তন। কেননা সঙ্খের রং সাধারণতঃ শুভ্রই হয়ে থাকে এবং শুভ্র রংটিকে ক্ষেত্র বিশেষে করুণতার প্রতীক হিসেবেও বিবেচনা করা হয়ে থাকে। কবি সম্ভবতঃ এ কারণেই তাঁর নিজের কল্পনার অনুভবে তার পরম আরাধ্য স্তন দু’টিকে সফেদ সঙ্খের করুণতার সাথে তুলিত করতে চেয়েছেন- এ কারণে যে, স্তন দু’টি কবির সান্নিধ্য কামনা করলেও কাছে আসবার সামর্থ হয়তো সেই মুহূর্তে তাদের ছিল না।

দ্বিতীয় কবিতাটিতে এ কল্পনাস্রোত আরো দূর্বার, অপ্রতিহত। ’সকাল বেলার রোদে তোমার মুখের বিভা অথবা দুপুর বেলা বিকেলের আসন্ন আলোয় চেয়ে আছে, চলে যায় জলের প্রতিভা।  এ জলের প্রতিভা যাকে স্রষ্টা সুতীব্র অনুভূতি দিয়ে অবলোকন করেছেন- তীরের উপরে বসে থেকে- নির্মল জলের মতো সচ্ছ তার একান্ত মনের মনিকোঠায়- সে যেন আর কেউই নয় তার একমাত্র অনুপম দয়িতা ছাড়া। আবার- অপরাহ্নে আকাশের রং ফিকে হলে- রঙীন সাপকে তার বুকের ভেতরে টেনে নেয়- এ যেন তার নিজেরই অসম্ভব সকরুন অসহায় অন্তরার্তির ফুটিত রূপ। যেখানে- এক পৃথিবীর আলো নিভে যায়- বলে সে নিভন্ত আলোর অস্বচ্ছতায় তার কল্পিত দয়িতার অস্তিত্ব (নিজের মত করে) বিলীন বিশ্বাসের মতো সমর্পিত হয়ে যায় রাতের অন্তরে বলে স্রষ্টা ক্রন্দিত হয়েছেন অনায়াসেই। অথচ আবার- স্থানান্তরিত দিবসের আলোর ভিতরে- প্রত্যক্ষ করে উদ্বেলিত হয়েছেন বিকেলের রক্তিম বিন্যাসের সুখময়তায়।

এখন ধারণা অনিবার্যভাবে বিশ্বাসিত হতে পারে যে, বর্তমান আলোচিত কবিতা দুটোর প্রতিটি শাব্দিক রন্ধের মধ্যেও যে ঋদ্ধ মনের প্রকীর্ণতা তার নিজেরই ব্যবহৃত জ্যোৎস্নার শিশিরের মতো ব্যাপৃত হয়ে গেছে সারা দেহ মনে। এবং এ না হলে নিশ্চিত করে কখনই করুণ শঙ্খের মতো স্তন, জলের প্রতিভা- প্রভৃতি তার আকাক্সক্ষার প্রতিরূপ হতে পারতো না। আর প্রসঙ্গতই তার প্রচুর মনের উন্মাত্তাল ব্যপ্তির অন্তর্লোকে দ্বিধা-দীর্ণতার প্রশ্নও সেই অর্থে গ্রাহ্যতার অপেক্ষা রাখে না। কিন্তু দ্বিধাদীর্ণতাই অবশ্যম্ভাবী আকার নিয়ে মূর্তিত হতো, যদি উন্মুক্ত মনের ঋদ্ধতার উৎসমুখকে বিরুদ্ধতার আর্বতে নিপাতিত করবার প্রয়াস পেত। আর তাহলে কি কল্পনার সচলমানতা নিঃসন্দেহেই স্রষ্টার অনুভুতিকে বস্তু সত্ত্বার মর্মের অতলে পৌঁছে দিতে সক্ষম হতো? কল্পনা কি পারতো সেই স্বাপ্নিক প্রতিবেশে বিচরণ করতে- যে প্রতিবেশের সাথে আত্মস্থতাকে অস্বীকার করেও শুধু তার চিত্রাঙ্কনই সাধারণ দৃষ্টিকোণ থেকে সরাসরি অসম্ভবই নয় একেবারে অলীককেও ছাড়িয়ে যাবার মতো যুক্তিগ্রাহ্য দুঃস্বপ্নের সমধর্মী এবং সেক্ষেত্রে কি কল্পনা সহজেই ঈশ্বর নির্ভরতায় উন্মুখ হয়ে পড়তো না?

অনেক মেনেছে বলে আর কিছু হয় না মানে কি;
দিন-রাত্রি-গ্রহ তারা পৃথিবীর আকাশ ধরে ধরে
অনেক উড়েছে যারা অধীর পাখির মতো করে,
পৃথিবীর বুক থেকে তাহাদের ডাকিয়া আনিতে
পুরুষ পাখির মতো,- প্রবল হাওয়ার মতো জোরে
মৃত্যুও উড়িয়া যায়! অসাড় হতেছে পাতা,
হৃদয়ে কুয়াশা আসে,- জীবন মেতেছে তাই ঝ’রে!-
পাখির মতন উড়ে পায় নি যা পৃথিবীর কোলে
মৃত্যুও চোখের পড়ে চুমো দেয় তাই পাবে ব’লে।

প্রেম,জীবনানন্দ দাশ

সকল ক্ষুধার আগেই তোমার ক্ষুধায় ভরে মন
সকল শক্তির আগেই প্রেম তুমি,- তোমার আসন
সকল স্থলের পরে, – সকল জলের প’রে আছে !
যেইখানে কিছু নাই সেখানেও ছায়া পড়িয়াছ
হে প্রেম তোমার!  অঙ্কুরের মত তুমি,- যাহা ঝরিয়াছে 
আবার ফুটাও তারে!  তুমি ঢেউ হাওয়ার মতন !
আগুনের মত তুমি আসিয়াছ অন্তরের কাছে!
আশার ঠোঁটের মতো নিরাশার ভিজে চোখ তুমি
আমার বুকের পরে মুখ রেখে ঘুমায়েছে তুমি!

প্রেম, জীবনানন্দ দাশ।

অলীক অপিচ সত্য , বাস্তব ধারণায় অলীক থচ কবিতা রস ধারণায়- সত্য, এই হচ্ছে কবিতা সত্য। কবির মনোভূমিতেই কবিতা সত্যেও জন্মাস্থান। – প্রকৃত অর্থে কবিতা বিশ্লেষণে এই যদি হয় চূড়ান্ত উলঙ্গ সত্য তবে অভিজ্ঞানের রক্ত সিঞ্চনে অবশ্যই স্রষ্টাকে মাত্রাধিক শক্তির সাথে তুলিত করতে হবে। সামগ্রিক নিসর্গীকতায় আত্মার সংযোগ সাধন সম্ভব করে তুলতে হবে- (যেমনটি হয়েছে আলোচিত প্রথমোক্ত কবিতাদুটিতে) নইলে কবিতায় প্রযোজ্য ঐ কবিতা সত্য হবে অসাঢ় প্রমাণিত।

দ্বিতীয়োদ্ধৃত কবিতাটির স্তবক দুটিও ঐ কবিতা সত্বের গ্রন্থীভুক্ত। মনোভূমির পরিচর্যা করতে গিয়ে স্রষ্টা যেন অতি মাত্রায় আত্মমুখী হয়ে উঠেছেন, যেমন আশাার ঠোঁটের  মতো নিরাশার ভিজে চোখ তুমি- বাস্তব সত্যে কখনই হৃদয় স্পর্শিক নয়। অথবা মৃত্যুর চোখের ’পরে চুমো দেয় তাই পাবে বলে।- কিন্তু তবুও গ্রাহ্য । এবং শুধু গ্রাহ্যই নয় প্রশংসিতও। কেননা ঐ কবিতা-সত্যই যথার্থভাবে প্রমাণিত করে দেয় । আবার এক কথায় ঋদ্ধ মনের প্রকীর্ণতাকে, সত্যতাকে এবং নিরৎসাহিত করে দ্বিধাদীর্নতার অন্তর্জাত সন্দেহপ্রবণতাকে। সাহিত্যেও অন্যান্য শাখা প্রশাখাকে বিসর্জন দিয়ে শুধুমাত্র কাব্যকে কেন্দ্র করে অগ্রসর হলেই সম্ভবত এর স্বপক্ষ- যুক্তি আরও বলিষ্ঠ হয়ে উঠবে।

কবি অভাবনীয়কে দর্শন করতে চান । পৃথিবীতে সর্বত্রই একটি অভাবনীয় আছে, একটি বিপুল রহস্যে পৃথিবীর জীবন যেন সমাচ্ছন্ন- এমন একটি বোধ স্বল্প বয়সে সবার মনেই জেগে উঠে। বড় হয়ে বিজ্ঞান ও বিবেচনা যখন আমাদের জীবনকে ক্রমশ শাসন করতে থাকে তখন বুদ্ধির রাজত্বে এসে আমরা অভাবনীয়কে হারিয়ে ফেলি।

শিশু বয়সে আমাদের মনে একটি আদিম পবিত্রতা থাকে, একটি নিস্কলুষ বিস্ময়ের জাগরণ থাকে। একমাত্র কবিই এ বিস্ময়কে জাগিয়ে রাখেন । কবির স্পর্শকাতর সংবেদনশীল মন হৃদয়ের জন্যে চিরকাল রাজ্য বিস্তার করে, যে রাজ্যে শুধু অভাবনীয়ের প্রতিষ্ঠা, যে অভাবনীয় প্রকৃতিতে, মানুষের কর্মে, সম্পর্কে এবং আনন্দ বেদনায় দ্বীপান্বিত প্রতিটি মুহুর্তে।

কবিতার কথা: সৈয়দ আলী আহসান।

পৃথিবীর এ অভাবনীয়ই কবির অবিষন্ন হৃদয় রাজ্যের অনন্ত আকর্ষন- অসীম প্রেরণা নির্যাস। আর সেখানে এ নির্যাস আহবানের প্রধানতম অবলম্বনই নির্বাধ দ্বিধাহীন কল্পনাগামিতা- যেখানে ঈশ্বর নির্ভরতা ঐ কল্পনাগামিতার লজ্জাহীন অসম্মান এবং এ অসম্মানের সর্বশেষ প্রতিরোধী সত্ত্বাই হলো ঋদ্ধ মনের প্রকীর্ণতা।