দিনের শেষে

তিহান কে আমি বললাম থাপ্পড় খাবি?
তিহান বললো, “হ্যা খাবো। তবে বেশি করে ঝাল মরিচ মাখিয়ে দিস। জানিস ই তো আমি মিষ্টি জিনিস খেতে পারি না।”
রাগে আমার গা কিড়মিড় কিড়মিড় করছে।
তিহান আমার কাজিন। বয়সে সপ্তাহ খানিকের বড়। মাঝে মাঝে এমন ভাব নেয় যে আমার কত গুরুজন ও। যদিও আমি তেমন পাত্তা দিই না।
আজ যেমন ছুটতে ছুটতে চলে আসছে। বলে কি, “স্পৃহা দেখ দেখ আমাদের বাসার ছাদে একটা হুনুমান এসেছে একদম তোর মত দেখতে। একসাইডে সিঁথি করে দুইটা ক্লিপ মেরে দিলে হুবহু তুই।”
আমি রাগে দাঁত কটমট করতে করতে ওকে জব্দ করার উপায় খুঁজতে লাগলাম।
অবশ্য বেশি দেরি করা লাগলো না। বিকাল নাগাদই অস্ত্র পেয়ে গেলাম। রান্নাঘরে একটা ইঁদুর মরে ছিলো। গন্ধে টেকা যাচ্ছিলো না। কাজের মেয়ে ঝাড়ু দিয়ে বাইরে বের করে আনতেই ওর সাথে প্ল্যান করতে বসে গেলাম। মাগরিবের নামাজের পর ওর সাথে চুপিচুপি মই নিয়ে গিয়ে তিহানের জানালার নিচের ওয়ালে স্কচটেপ দিয়ে ভালোমতো ইঁদুর টাকে এঁটে দিয়ে আসলাম।
আমার সাথে বাদঁরামি। নে এইবার সারা রাত ইঁদুরের গন্ধ খা

স্পৃহাকে রাগাতে এত ভালো লাগে আমার। অল্পতেই রেগে যায় মেয়েটা। আর রাগলেই নাকের পাটা ফুলে যায়। চোখ দিয়ে মনে হয় আগুনের ফুলকি বের হচ্ছে। এত কিউট লাগে দেখতে। এজন্যই ওকে এত বেশী রাগাই। অবশ্য আজ মনে হয় একটু বেশী বেশীই হয়ে গেছিলো। যেভাবে হাতের মুঠি পাকিয়ে ছিলো আরেকটু হলেই মনে হয় ঘুষি খেতাম।
কিন্তু আমার ঘরের ভিতর এমন বিদঘুটে গন্ধ আসছে কোথা থেকে। সারাঘর আতিপাতি করে খুঁজেও কিছু পেলাম না। নাকমুখ গুঁজে লাইট অফ করে ওর ভিতরেই শুয়ে পড়লাম। কিন্তু রাত দুইটা নাগাদ আর সহ্য করতে পারলাম না। ঘুমের ভিতরেও যেন নাকে গন্ধ ধাক্কা দিচ্ছে। শেষমেশ কাঁথা বালিশ নিয়ে ড্রয়িংরুমের সোফায় শুয়ে রাত কাটালাম। সকালে উঠতেই দেখি মাথা একপাশে ঘুরাইতে পারছিনা। ঘাড়ে চরম ব্যাথা। বুঝলাম সোফায় শোয়ার জন্যই এই অবস্থা। রুমে ঢুকতেই আবার সেই বিকট গন্ধ। আম্মু আমি আর তিতুন মিলে দু’ঘন্টা ধরে সারা রুমের আনাচে-কানাচে,তোষক বালিশ উল্টিয়ে পাল্টিয়েও গন্ধ বের হবার মত কিছু খুঁজে পেলাম না। শেষে দুই বোতল এয়ার ফ্রেশনার, বডি স্প্রে দিয়ে গন্ধ তাড়াতে চেষ্টা করলাম। তিতুন তো ভয়ে ভয়ে বলছে, “ভাইয়ার ঘরে নিশ্চয় জ্বিন ঢুকছে। এটা জ্বিনের গায়ের গন্ধ।

বদটার উপযুক্ত শাস্তি হয়েছে। এখন নাকি ঘাড় ঘুরাইতে পারছে না। তিতুনের কাছ থেকে সব কিচ্ছাকাহিনী শুনে খুশিতে আমি বাকবাকুম। আমার সাথে মামদোবাজি করার ফল এখন বুঝুক।তিতুনের হাত ধরে লাফাইতে লাফাইতে ওদের বাড়ি যেয়ে বললাম, “কিরে তিহান ভূতে নাকি তোর ঘাড় মটকায়ে দিছে?”
তিহান ম্লান হেঁসে বললো, “আর বলিস না, রাত থেকে কি উৎপাত ই যে শুরু হইছে, দুচোখের পাতা এক করতে পারছি না।”
তিহানের ম্লান মুখের দিকে তাকিয়ে হঠাত করেই আমার বুকের ভিতর ধ্বক করে উঠলো। খুশিতে আত্মহারা হওয়ার বদলে আমার কেমন যেন কষ্ট কষ্ট একটা মিশ্র অনূভুতি হচ্ছে। আমি ছলছল চোখে তিহানের দিকে তাকিয়ে রইলাম

স্পৃহা ইদানীং আমার সাথে কেমন যেন ছাড়া ছাড়া একটা আচরণ করছে। ঠিক বুঝে উঠতে পারছি না। গত সাতদিনে তো ওর সাথে এমন কোন অন্যায় করিনি। তাহলে হইলো কী ওর? নাহ একবার ভেবে দেখতে হচ্ছে।

-কিরে স্প্রিং কি করিস?
-আমাকে স্প্রিং বলবি না কিন্তু।
-আচ্ছা যা বলব না। কিন্তু আমাদের বাড়ির ছাদে তুই কী করিস? তোদের ছাদ নাই, যা।
-যাচ্ছি। থাক তুই তোর ছাদ নিয়ে।
-বাপরে! একবার বলতেই চলে যাচ্ছিস। তুই এত ভদ্র হলি কবে থেকে?
স্পৃহা কোন উত্তর না দিয়ে নিচে নেমে এল। ইদানীং তিহানের তুচ্ছ করে বলা যেকোন কথাতেই হুটহাট করে ওর চোখে পানি চলে আসে।

তিহান ভ্যাবলার মত কিছুক্ষণ একলা ছাদে দাঁড়িয়ে থাকল। অন্য কোনদিন হলে স্পৃহাকে তো বকে বকেও নিচে পাঠানো যেত না। আজ কয়দিন কি যে হয়েছে ওর একেক সময় একেক আচরণ করছে। তিহান কিছুই বুঝে উঠতে পারছে না

বড় খালার বাড়িতে এ কয়দিন খুব মজা হলো। তিহানের মনটা আজ বেশ ভালো। বড়খালু সৌদি থেকে দেশে ফিরেছে, সবার জন্যই কমবেশি জিনিসপত্র নিয়ে এসেছে। খালা তাই খবর পাঠিয়েছিলো। তিহানের সবচেয়ে পছন্দ হয়েছে ওর হাতঘড়িটা। তিতুনের জন্য ফোন নিয়ে এসেছে একটা। তিহান অবশ্য সুযোগে আছে তিতুনকে পটিয়ে ফোনটা নিজের করে নেওয়া যায় কিনা। অবশ্য তিতুন যে বজ্জাত মেয়ে, নাও দিতে পারে। তবে এজন্য স্পৃহাকে পটাতে হবে। তিতুন আবার স্পৃহা বলতে পাগল। স্পৃহা যা বলে তিতুন তাই শোনে। বাস থেকে নেমে এইসব হাবিজাবি ভাবতে ভাবতেই তিহান বাড়ির কাছে পৌছে গেল।
.
বাসায় ঢুকে আম্মু আম্মু বলে ডেকেও যখন কাউকে পাওয়া যাচ্ছে না তখন ব্যাগটা নামিয়ে রেখে ‘গেলো কোথায় সবাই’ বলে নিচে নেমে স্পৃহাদের ওখানে আম্মুকে খুঁজতে যাচ্ছি। উঠানেই ছোট চাচ্চুর সাথে দেখা। আমার হাতে পাঁচশো টাকার একটা নোট দিয়ে বললো, ‘তাড়াতাড়ি বাজারের থেকে দই নিয়ে আয়। বড়ভাই ভুল করে টকদই নিয়ে চলে আসছে। মেহমানদের সামনে বেইজ্জতের একশেষ।’
কিসের মেহমান কিসের কি শোনার আগেই ছোট চাচ্চু উধাও। তাড়াতাড়ি করে দই আনতে ছুটলাম।

দই নিয়ে চাচীদের ড্রয়িং রুমে ঢুকতেই দেখি একগাদা মানুষ। আম্মু তাড়াতাড়ি আমার হাত থেকে দই নিয়ে পিরিচে পিরিচে বাড়তে শুরু করে দিয়েছে। কারা এসেছে কিসের কি হচ্ছে এটা যে কারো কাছে শুনব সেই সুযোগও নেই। সবাই মহা ব্যস্ত। বিরক্ত হয়ে সাবিতের রুমে ঢুকলাম, দেখি আমার ছোট স্পাই কোন খবর দিতে পারে কিনা। স্পৃহা আমাকে যতটা অপছন্দ করে ওর ছোটভাই সাবিত আমার ঠিক ততটাই ভক্ত। এ বাড়ির সব খবরাখবর আমি সাবিতের কাছ থেকেই পাই।

ঘরে ঢুকে দেখি স্পৃহা খুব সেজেগুজে বসে আছে।
‘কিরে ভূতনী এত সাজছিস ক্যান? তোর বিয়ে নাকি?’ হাসতে হাসতেই জিজ্ঞাসা করলাম।
স্পৃহা উত্তর দিলো, ‘ওদের দেখে পছন্দ হলে আজই বিয়ের ডেট ফাইনাল করে যাবে।’
-তোকে সত্যি সত্যি দেখতে আসছে?
-কেন তুই জানিস না?
-জানব কিভাবে। তুই কি বলছিস আমাকে?
-তুই যে খালার বাসায় বেড়াতে গেছিস সেটা বলছিস আমাকে?
-আমি খালার বাসায় তোকে বলে যাইনি তাই তুই বিয়ে করে ফেলবি?
-আমি কি বলেছি আমি বিয়ে করব?
-বিয়ে করবি না তাইলে এত সাজগোজ করছিস কেন?
-আমি সাজছি তাতে তোর সমস্যা কী?
– আমার সমস্যা থাকবে কেন?
-তিহান শোন আমার মেজাজ খারাপ করবি না।
-তুই ই আমার মেজাজ খারাপ করছিস।
-তুই যা এখান থেকে।
-তুই যা।
স্পৃহার সাথে ঝগড়াঝাঁটি করে ঘরে এসে শুয়ে থাকলাম।স্পৃহাকে ছেলেপক্ষ দেখতে আসছে অথচ দুইবাড়ি মিলে কেউ আমাকে জানাতে পারল না। অন্তত স্পৃহার তো উচিত ছিলো আমাকে একটা ফোন দিয়ে জানানো। বাড়ির সবার প্রতি চাপা একটা অভিমান নিয়ে রাত্রে না খেয়েই ঘুমিয়ে পড়লাম।
সকালে ঘুম থেকে উঠেই আম্মুর রুমে গেলাম।
আম্মু তখনও নামাজের পাটিতে। কোরআন শরীফ পড়বে বোধহয়। আমি কোন ভূমিকা না করে সরাসরি বললাম, ‘আম্মু আমি স্পৃহাকে বিয়ে করব।’
ঘরের ভিতর একটা বাজ পড়লেও মনে হয় আম্মু এতটা অবাক হত না যতটা অবাক আমার কথা শুনে হল।
আমার নিজের কণ্ঠই আমার কাছে অপরিচিত শোনা যাচ্ছিলো।মনে হচ্ছিলো আমি না কেউ যেন আমার কণ্ঠ দিয়ে কথা বলিয়ে নিচ্ছে।
পরপর কয়দিন এটা নিয়ে বাড়ির সবাই মিলে একসাথে বসাবসি করে খুব গ্যাঞ্জাম আর কথা কাটাকাটি হল। অবশেষে সবাই মেনে নিল। ঠিক হল এখন শুধু বিয়ে পড়িয়ে রাখা হবে, আর আমি চাকুরি পাবার পর স্পৃহাকে এবাড়িতে তুলে আনা হবে।
কিন্তু বেঁকে বসল স্পৃহা। আমাকে নাকি সে কখনো ওইভাবে দেখেনি। আমাকে নাকি তার কাছে বর বর লাগে না। এটা কোন কথা হইলো! স্পৃহা যে পুরো ব্যাপারটা এভাবে ভন্ডুল করে দিবে এটা আমার ধারণাতেও আসেনি। স্পৃহাকে সবাই যখন আরো বোঝাতে গেলো ও আরো বেঁকে বসল। সব মিলিয়ে ব্যাপারটা এমন ভজগট পাকিয়ে গেল যে আব্বু বড়চাচার সামনে আর চাচী আম্মুর সামনে কথা বলতে অস্বস্তিতে ভোগে। আর স্পৃহার সাথে তো আমার এরপরে আর দেখাই হয় না। ও আমাদের এখানে আসা একেবারে বাদ দিয়ে দিয়েছে।আমিও আর লজ্জায় ওই বাড়িমুখো হই না।

ঈদের আগেরদিন রাত্রে চাঁদ দেখার জন্য সবাই ছাদে উঠেছে। পিচ্চিপাচ্চারা সব হৈচৈ গ্যাঞ্জাম করছে। স্পৃহা দেখি রেলিং এ ভর দিয়ে এককোণায় দাঁড়িয়ে আছে। আমি কাছে এগিয়ে গেলাম। ও একটু চমকে উঠে আমার দিকে ঘাড় ঘুরিয়ে তাকালো।
আমি বললাম, ‘তুই আমাকে বিয়ে করবিনা কেন স্পৃহা?’
স্পৃহা বলল, ‘তুই যে আমাকে বিয়ে করতে চাস এটা আমাকে বলেছিস কখনও?
আমি মিনমিন করে বলার চেষ্টা করলাম, ‘আমি যে তোকে ভালোবাসি তাইতো আমি সেদিনের আগে পর্যন্ত জানতাম না।’
স্পৃহা দেখি রাগে গজগজ করছে আর বলছে, ‘সারাদিন স্প্রিং স্প্রিং করার কথা মনে থাকে আর ভালোবাসার কথা বলতে মনে থাকে না মানুষের। যা তোর কিচ্ছু বলা লাগবে না।’

স্পৃহার সাথে আমার বিয়ের ছয় বছর পূর্ন হল আজ। অবাক করা বিষয় হচ্ছে আমি আজও ওকে কখনো মুখে ভালোবাসি বলি নাই

ভালোবাসা কি শুধু বলার বিষয়? কখনও কখনও ভালোবাসা শুধু উপলব্ধির। একে ধারণ করতে হয় বুকের মধ্যিখানে। হারিয়ে যেতে দিতে নেই। তাই মুখে হাজারবার ভালোবাসি বলার থেকে স্পৃহার মুখে হাসি এনে দিতেই আমি বেশি ভালোবাসি। কিন্তু আমার পাগলি বউটা এটা বোঝে না, সে সারাদিন শুধু কানের কাছে মেশিনের মত বলতেই থাকে আমি তাকে ভালোবাসি না। আমি আর কি করব আপাতত তার কথা এক কান দিয়ে শুনি আর আরেক কান দিয়ে বের করে দিই। ভেবেছি আমাদের বিয়ের দশম বর্ষ পূর্তিতে তার কানে একশবার ভালোবাসি বলব। দেখি সে এতে কত সুখ পায়।

© তামান্না স্নিগ্ধা

চলতি সংখ্যা