নীলডুমুর

ফুলের মাধুর্য্য কুঁড়িতে বিনষ্ট হলে; অনাদরে ঝরে গেলে; ম-পে দলিত-মথিত হলে ফুল বিষয়ে ভুল হয়। অবশ্য কারো মতে ডুমুরের ফুল হয় না ফল হয়- কিন্তু আমি ফুল দেখেছি! না, ফুল তার নাম নয়; খুকিও নয়। তবে বাবার মুখে তাকে আমি খুকি ডাকতে শুনেছি। মা আমায় জিজ্ঞেস করেছিল, নুনু, আমাদের জন্যি তোমার কি কষ্ট হচ্ছে?
বিনয়ের অবতার হয়ে আমি কাঁধ ঝাঁকায়, না না খালা, আমার কোনো সমস্যা হচ্ছে না; আপনি নিশ্চিন্তে ঘুমান।
নিশ্চিন্ত না হলে মানুষের ভীড়ে খুকিকে রেখে কি ঘুমাতে পারতো! পরম নির্ভরতায় ঘুমায় ওরা। মাঝে মাঝে নাক ডাকার আওয়াজ শুনতে পাই; অস্পষ্ট স্বরে কি সব বলাবলি করে- সম্ভবত সংসারের জটিল হিসেব নিকেষ। খুকি মনে মনে বিরক্ত। চতুর্দিক ঘুরে এসে মায়াবী চোখ দুটো আমার চোখের ওপর স্থির হয়ে যায়। প্রতিক্রিয়া বুঝতে অপলক দৃষ্টিতে তাকিয়ে থাকে। মেয়েটির চোখেমুখে দ্বিধা, সংকোচ। বাবা-মার ঘুমন্ত মুখের পানে তাকিয়ে বিচলিত হয়। তার নিজেরও ঘুম প্রয়োজন। ইচ্ছে করলে বিছানার বেদখল স্থানে দিব্যি শুয়ে পড়তে পারে। বালিশ নেই; আমার মাথার নিচে কিছু বইপত্র। খুকি চাইলে বইগুলো আজন্মের মতো দিয়ে দিতাম। কেননা রাশিয়ান লেখকের বইগুলো তখন অপ্রয়োজনীয়! শুধু রাশিয়ান কেনো, যে কোনো প্রকারের বই অচ্ছুত! আমি মানুষ ঠকানোর বিদ্যা আয়ত্ব করেছি। লোন দিয়ে কিভাবে কিস্তি আনতে হবে; টাকা না পেলে জুলুম করতে হবে; ছ্যার ডাক আদায় করতে কি কি কারসাজি প্রয়োজন; কথার মারপ্যাচে কিভাবে সাধরন জনগনকে ঘায়েল করতে হবে; প্রভাবশালীদের সাথে কিরুপে সখ্যতা গড়তে হবে; একে অন্যকে গালাগালি করতে হবে; ঘরের চালা; হাতের বালা কিভাবে নিলামে চড়াতে হবে- এসব বিদ্যা আমার অস্থিমজ্জায়!
মৌসুমি বৌদিকে আমি ঠকিয়েছে!
আহা, মহারাজপুরের ওই বৌদিকে কত অকথ্য ভাষায় গালাগালি দিয়েছি। বৌদি কি জানতো, তার এই ঠাকুরপো এমন রুদ্রমূর্তি ধারণ করতে পারে! আমি নিরুপায়; সাধারণ সৌজন্যতা ভুলে রুগ্ন শরীরের বউটিকে যা বলার নয় তাই বলেছিলাম। কিস্তির বদলে শাঁড়ি দিতে চাইলে, আমি হাতের বালা দাবি করেছিলাম। বৌদি জলভরা কণ্ঠে বলেছিল, বালা দিলে স্বামীর অমজ্ঞল হয়।
আমি উপহাস করেছিলাম, স্বামী; যে স্বামী সংসারের খোঁজ রাখে না, সন্তানের ভাবনা ভাবে না; মাঝে মাঝে নিখোঁজ থাকে তার বেঁচে থেকে লাভ কি!
লাভ-লোকসান খুব ভালো বুঝি। মানবিকতার শেষ বিন্দুটুকুন ট্রেনাররা নিংড়ে ফেলেছে। বড় ছ্যার আচমকা একদিন জিজ্ঞেস করে, কি কবি সাহেব, কেমন চলছে লেখালেখি?
কবি!
পাঠশালার জীবন থেকে লেখালেখি করি বটে তবে কবি নয়; গদ্য লেখক- পারিপার্শ্বিক সমাজব্যবস্থা ও নিজের সুখ-দুঃখ লিপিবদ্ধ করি। কিন্তু জীবনের ওই গোপন অধ্যায়ের কথা তো ছ্যারের জানার কথা নয়! লেখালেখি করা যেনো গর্হিত অপরাধ! শিক্ষিত লোকেরা নাসিকা কুঞ্জন করে; সুযোগ পেলে টিপ্পনী কাটে; ভবিষ্যত বিষয়ে হতাশার ব্যঞ্জণা, বুঝলেন পিন্টু সাহেব, কবিতা-টবিতা লিখে ভাত হবে না, উচ্ছন্নে যাবেন; তার চাইতে চাকরিতে মন দিন, অনেক বড় হতে পারবেন।
বড় হওয়া নিয়ে ছ্যারদের প্রচ- মাথাব্যথা। কলিগরা হাসাহাসি করে। তামাশার দৃষ্টিতে তাকায়। তামাশার কি দেখলো! লেখালেখির কথা বেমালুম চেপে যাই। ক্রেডিট অফিসার হিসেবে খুলনা থেকে নীলডুমুরগামী লঞ্চই বরং আমার জন্য নিরাপদ!
আহ, চর্তুদিকে নিরাপদ জীবনের সুঘ্রাণ!
ঘুমজড়ানো চোখে লঞ্চের অভ্যন্তরে প্রথম আমি খুকিকে আবিষ্কার করি। মেয়েটি গুটিসুটি মেরে বসা। চোখে চোখ পড়লে ভয় ও লজ্জা যুগপৎ তাকে গ্রাস করে। ভয় অমুলক নয়। ক্ষুধার্ত নেকড়ের সম্মুখে শিকার কতক্ষণই বা নিরাপদ! তার চারপাশে অসংখ্য নেকড়ে। কেউ কেউ হা-পিত্যেশ করে; ঘোলা চোখে পূর্ণিমার চাঁদ খোঁজে। আমি ভাবি নিজের কথা। ঘুম ও বিছানার ইতিহাস খুব বেশি গৌরবের নয়। আজন্মের ঘুমকাতুরে। চোখ বুজলে দুনিয়া অন্ধকার! উত্তরের মাথা দক্ষিণে পৌছে; লুঙ্গি মাথায় ওঠে। বালিশ আকড়ে চোখ বন্ধ করে আরো কিছুক্ষণ ঘুমের ভ্যান করে শুয়ে থাকি। কেউ ডাকাডাকি করলে বিরক্ত হই। পাশে বসে আদর করে মা যখন চুলে বিলি কাটে তখন খুব ভালো লাগে; নিবিড় ভাবে দু’হাত দিয়ে মা’কে জড়িয়ে ধরি।
খুকিকেও কি তাহলে আঁকড়ে ধরেছিলাম!
চেষ্টা করেও মনে করতে পারি না। ধড়ফড় করে উঠে বসি। দু’হাত দিয়ে চোখ কচলায়; বুনো ফুলের গন্ধমাখা বাতাস ছুঁয়ে যায়। যাত্রীদের নিরীক্ষণ করি। অদুরেই ক’জন বখাটে। ভিডিও প্লেয়ারের বাংলা সিনেমার গানের চাইতে খুকির প্রতি তারা অধিক আগ্রহী। আগ্রহভরে আমাকে লক্ষ্য করে। মিনারেল ওয়াটারের বোতলে মুখ লাগিয়ে ঢকাঢক পানি পান করি। খুকি আঁড়চোখে তাকিয়ে। পানির বোতল এগিয়ে ধরতে মন চায়; সাহসে কুলোয় না। জীবনের নথিঁপত্র ঘাটতে শুরু করি; নদী ও নারীর উপস্থিতি অনুসন্ধান করি। ঝাপসা কিছু ছবি আসে বটে; ওই ছবির নিদৃষ্ট কোনো আদল নেই; কারো সাথে বিশেষ কোনো সংযোগ নেই। স্বপ্নের ঘোরে কারো কারো সংস্পর্শে পুলকিত হলেও বাস্তবে কেউ নেই- নিরস মরুভুমি! মরুর বুকে মরিচিকা দেখতে দেখতে ক্লান্ত আমি। অবশেষে সমুদ্রের কাছে; পূবালী বাতাসে ফসলের সম্ভার অনুভুত হয়! রাতের বুক চিরে লঞ্চ এগিয়ে চলে। মাঝে মাঝে ঝাঁকি ওঠে; ঝাঁকি সামলাতে না পেরে খুকির শরীরের ওপর হুমড়ে পড়ি কিংবা খুকি আমার ওপর। পর মূহুর্তেই চকিত হয়ে উঠি দুজন। সরে বসার চেষ্টা করি। চারদিকে মানব প্রাচির। তীল ধারনের ঠাঁই নেই! যুদ্ধুক্ষেত্রে ছড়িয়ে ছিটিয়ে থাকা লাশের মতোই যাত্রিরা ছড়িয়ে ছিটিয়ে। রাতের লঞ্চ এমনই হয়! স্থান দখলের প্রতিযোগিতা চলে। বিছানা, কাঁথা বা চাঁদর পেতে ঘুমানোর আয়োজন করে। আমিও ঘুমিয়ে পড়েছিলাম। হয়তো খুকির সংস্পর্শে ঘুমের দৈর্ঘ্য সংকুচিত হয়েছে! স্মৃতির দৈর্ঘ্য ক্রমশ লম্বা হয়। আমি তখন দশম শ্রেনীর চৌকাঠে। রাতের পড়া শেষ করে মাত্রই চোখ বন্ধ করে শুয়েছি। নদীর ওপার থেকে বাঁশির সুর ভেসে আসে; কলতলায় রাখালের কণ্ঠধ্বনী; গোয়াল পালানো বাছুরের খোঁজে ব্যতিব্যস্ত সে। ঠিক তখনি ধীরপায়ে কেউ একজন আমার পাশে এসে বসে; চোখে চোখ রাখে। আহা, কি মায়াবী চোখ! অপলক দৃষ্টিতে চেয়ে থাকি; সে চোখে সমুদ্রের গভিরতা। একটু একটু করে সমুদ্রের অতলে তলিয়ে যেতে থাকি। মনে হয়, স্বপ্ন দেখছি! রাখালের কথা স্মরণ করি; বাঁশির সুর আগের মতোই উজানের পথে; বটশাখায় হরিয়ালের জ্যান্তব কাঁচর-ম্যাচর! মেয়েটি আমায় হাতছানি দিয়ে কাছে ডাকে। ছুঁয়ে দেখার সাধ জাগে। কিন্তু চোখ মেলে তাকাতেই সে হারিয়ে যায়; একখ- আলোর ঝলকানি অনুভব করি!
পরী মেয়ে!
অনেকদিন পরে খুকি হয়ে পরী মেয়েটি ফিরে এসেছে! সেই চোখ, সেই নাক, হাতে সোনার বালা, কানে ঝুমকো লতা। আজও মায়ার কাজল পরে এসেছে! ভিতরে ভিতরে উসখুস শুরু হয়। চিমটি কাঁটতে ইচ্ছে করে। না, অলিক নয়; রক্ত-মাংসের খুকি আমার পাশে বসা! ইচ্ছে করলে শুতে পারি; তবে ঘুম আসবে না উপরন্ত মেয়েটির সংকোচ বাড়বে।
লঞ্চের ছাদে এসে দাড়াই। দুপাশে সুন্দরবন; মাঝ বরাবর নৌযান এগিয়ে চলেছে। পানি কেটে ভাগ হয়ে যাচ্ছে। ইঞ্জিনের শব্দের সাথে জলের স্রােত মিলেমিশে একাকার। তন্ময় হয়ে সম্মুখে তাকাই। বৃষ্টিমাখা বাতাস। বনের গভীরে ঘোর অন্ধকার। তীর ঘেঁষে মাঝে মাঝে আলোর দিশা চোখে পড়ে। মাছের প্রতিক্ষায় জেলেরা অপেক্ষা করছে। ভাটির টান শুরু হলে খালের পানি নিচে নেমে আসবে; তখন অসংখ্য মাছ তাদের জালে আটকা পড়বে। চন্দ্র-মেঘের খেলা চলে। মেঘের আড়ালে চাঁদ ঢাকা পড়লে আঁধারের ঘনত্ব বেড়ে যায়। খুকির চোখেমুখেও আঁধার। আলোর পরিবর্তে আমি কী তাকে আঁধার দিয়েছি! ইস, জড়িয়ে ধরলে আজন্মের মতো মেয়েটি আমায় ক্ষমা করবে না। অন্য দশজনের মতো আমাকেও একপাল্লায় ওজন করবে।
দুর থেকে ভেসে আসে বন্যপ্রাণীর হুংকার! দৃশ্যপট বদলে যায়। রহস্যে ঘেরা সুন্দরবন। বাঁকে বাঁকে বিপদের আশংকা তথাপি জীবন ও জীবিকার টানে মানুষ এখানে না এসে পারে না। রায়মঙ্গল নদীর মোহনায় রক্ত হীম হয়ে আসে। লঞ্চের গায়ে বড় বড় ঢেউ এসে ছলাত ছলাত আছাড় খায়। নৌযান দুলে ওঠে। আমি ও খুকি দুলতে থাকি; দুলতে থাকে আমার পৃথিবী। খুকির গরম নিঃশ্বাস মুখে লাগলে বুকের মধ্যে তোলপাড় শুরু হয়। আহা, কাছে থেকেও মেয়েটি কত দুরে! মনে মনে তাকে কামনা করি। কামনার আগুণে আমার ভিতর-বাইরে দগ্ধ হই। আগুনপাখি হয়ে খুকিকে নিয়ে দূর আকাশে উড়াল দিই। মেঘের গালিচায় একে-অন্যকে আলিঙ্গণ করি। আহা কি মায়াবি চোখ! দেবী দূর্গার মতোন মায়ার কাজল পরানো! কিছুতেই চোখ ফেরানো যায় না। শরীরের সাথে শরীর মিশিয়ে দু’হাত দিয়ে গলা জড়িয়ে নিবিড়ভাবে চাঁদের পানে তাকিয়ে থাকি; খুকিও! তখন মনে হয় একজীবনে চাঁদ দেখার তৃঞ্চা শেষ হওয়ার নয়।
বাস্তবের মাটিতে ফিরে এলে মরে যেতে ইচ্ছে করে। রায়মঙ্গলের জলে লঞ্চটি ডুবে গেলে খুকি আর আমার মধ্যে কোনো বিভেদ থাকবে না; কথা বলতে না পারার আক্ষেপ থাকবে না!
নাম কি!
বাড়ি কোথায়!
কোথায় নামবে সে!
খুকির চোখে কাতরতা। মুখের উপর লেপ্টে থাকা চুল আলগোছে সরিয়ে দেয়। দাঁতে ক্লিপ চেপে ধরে শক্ত করে চুল বাঁধে। হতাশাময় দৃষ্টিতে দুরের আকাশ পানে তাকায়। দীর্ঘশ্বাস আড়াল করে। বখাটেদের চোখে চোখ পড়তেই ভ্রুঁ জোড়া কুঁচকে যায়। তখন আমার পানে তাকায়। খুকির মনের ভিতরটা পড়ে দেখতে চেষ্টা করি। তার ভিতরেও কি ভাঙাগড়ার খেলা চলছে?
দহন ক্রমশ ঘণীভুত হয়। গন্তব্য নিকটবর্তী হতে থাকলে বিষণœতার মাত্রা উর্ধ্বমুখী হয়। দিনের আলো জেগে উঠলেও আমার মধ্যে গাঢ় অন্ধকার। খুকি নির্বিকার। আনত চোখে পায়ের পাতায় চোখ রাখে; আনমনে দাঁত দিয়ে নখ কাটে। জগত-সংসার তাকে আর আমাকে বিচ্ছিন্ন করে দিচ্ছে! এ জীবনে হয়তো দেখা হবে না; কিংবা হতেও পারে! মনের মধ্যে নানাবিধ ভাবনা; চিনচিনে ব্যথার অনুভুতি। ইচ্ছে হয়, খুকির মাথায় হাত রাখি; তার গন্তব্য সম্পর্কে জিজ্ঞেস করি। নাহ, পারিনি; কাপুরুষের মতো নেমে এসেছিলাম। নারায়নপুর লঞ্চঘাটে পাথর চোখে অনেকক্ষণ তাকিয়ে ছিলাম; খুকিও! মনের ভিতরটা সেদিন ঠিকঠাক পড়তে না পারলেও আজ বুঝতে পারি, মেয়েটি তার জীবন নাটকে আমায় প্রত্যাশা করেছিল; হাতে হাত রেখে পথ চলতে চেয়েছিল।
চলার পথে অসংখ্য মানুষের দেখা পেয়েছি; কারো সাথে সখ্যতা হয়েছে; হাসাহাসি করেছি, আড্ডা দিয়েছি, ঠাট্টা করেছি কিন্তু খুকির জন্য যা হয়েছে তা আর কারো জন্য হয়নি। দৃষ্টির আড়ালে হারিয়ে না যাওয়া পর্যন্ত তাকিয়ে ছিলাম। জল ভরা নয়নে মেয়েটিকে কাঁদতে দেখেছি; ওড়নার আঁচলে মুখ লুকাতে দেখেছি!
কেনো কেঁদেছিল খুকি!
কি বলতে চেয়েছিল সে!
ভুল; সব ভুল। চোখের জল না দেখলে হয়তো এভাবে ভুলের মাসুল দিতে হতো না; অসুস্থ সজ্জায় প্রহর গুনতে হতো না।

দুই
ওই চোখে নিবেদনের ভঙ্গি ছিল; নির্ভরতা ছিল- তা না হলে সারারাত্রি আমার সংস্পর্শে বসে থাকবে কেনো! কেনোই বা ঘনঘন দীর্ঘশ্বাস আড়াল করবে! আমার দীর্ঘশ্বাস বেড়ে চলে। কয়রার জীবন কিছুতেই মানিয়ে নিতে পারছিলাম না। একজোড়া চোখ অহর্ণিশ কাছে ডাকে; বুকের মধ্যে হাহাকার জাগে। অফিসের কাজে আমাদি, মদিনাবাদ, গোবরা, হরিনখোলা, বেতকাঁশি, কাঠমার চর, মহারাজপুর-সহ প্রত্যন্ত অঞ্চল চষে বেড়াই; কিস্তির ফাঁকে ফাঁকে খুকিকে অনুসন্ধান করি। কারনে অকারনে দুরের রাস্তায় পাড়ি জমাই; খুলনা থেকে নীলডুমুর, নীলডুমুর থেকে খুলনা- নাহ, খুকি নেই!
কিস্তিজীবন ভালো লাগে না, অল্পতেই হাঁপিয়ে উঠি। মাঠের কিনারে দাঁড়ালে শূন্যতা আরো বাড়ে। ফসলহীন বিস্তির্ণ মাঠ। মাঝে মাঝে চিঙড়ির ঘের। গুমোট অন্ধকার ভালো লাগে না। ভোরের আলোয় কপোতাক্ষের তীরে এসে দাঁড়াই। চর্তভুজ আকৃতির জাল নিয়ে ছেলে-বুড়ো-মেয়ে রেনু সংগ্রহ করে। গারস্থ্য জীবনের চিত্রও ভিন্ন। সুন্দরবনকেন্দ্রিক জীবন চরাচর। কাঠ কাটা, গোলপাতা সংগ্রহ, মধু আহরণ, মৎস্য শিকার, জাল বোনা- বিচিত্র পেশা! পান-সুপারি ছাড়া এক মূহুর্ত চলে না! অবসর মুহুর্তে ঘরের দাওয়ায় টাঙানো দোলনায় দোল খায়। আমিও দোল খাই। খুকির দোলনায় দুলে দুলে হয়রান। টাকা-পয়সার হিসেব কষতে গেলে মাথার মধ্যে চক্কর পাড়ে। খুব সকালে ঘুম থেকে উঠলে থরথর করে শরীর কাঁপে। মনে হয়, এই বুঝি পড়ে যাবো! প্রশান্তির লাগি ৪ নং কয়রায় ছুঁটে যাই। সুইচ গেটের ওপর দাঁড়িয়ে থাকি। পাশে কাশিয়াবাদ ফরেষ্ট রেঞ্জ। ডিঙি নৌকাগুলো সারি সারি ঘাটে বাঁধা। বাতাসের দোলায় হঠাৎ হঠাৎ দুলে ওঠে। ভাড়া নৌকায় বনের অভ্যন্তরে প্রবেশ করি। ভয়ার্ত পরিবেশ। কীটপতঙ্গের নিরবিচ্ছিন্ন চিৎকারে অপার্থিব আবহ সৃষ্টি হয়েছে। ভয়ে গা ছমছম করে। দুপাশ থেকে ঘন ডাল ঝুকে পড়ে আলো-আঁধারীর সৃষ্টি হয়েছে। বাঁধের ওপর দাঁড়ালে হরিনের দেখা মেলে। ভাটা আরম্ভ হলে বুড়ো বানরগুলো কাঁদার মধ্যে গড়াগড়ি খায়। কালেভদ্রে বাঘের দেথা মেলে। কয়রাবাসীর জীবনে ঘুব বেশি বাঘের উৎপাত। মাছ ধরতে গিয়ে কেউ কেউ লাশ হয়ে ফিরে আসে। তবুও বনের ওপর রাগ করে থাকতে পারে না। বাঘ বিষয়ে বিস্তর আলোচনা- নাম মুখে আনে না, মামা বলে সম্মোধন করে। শুক্রবার নাকি মামার জন্মদিন! কেউ সেদিন বনে যায় না; হাত-পা গুটিয়ে ঘরের দাওয়ায় বসে থাকে; আকাশের পানে মুখ করে হাঁ-পিত্যেশ করে। একদিন জঙ্গলে না গেলে তাদের চলে না; পরিবার পরিজন অভুক্ত থাকে তথাপি জঙ্গলের পথে পা রাখতে বুক কাঁপে।
কুসংস্কার!
আমি হাসাহাসি করি। মানুষগুলো আহত হয়। কে কবে বাঘ দেখেছে; কেমন করে গলা ফুটো করে রক্ত খেয়েছে; বিড়াল পায়ে কেমন করে চলাফেরা করে- বহুমাত্রিক সব জল্পনা-কল্পনা। অথচ মানুষগুলো জানে না, বাঘের চেয়ে কিস্তি অনেক বেশি ভয়ংকর! বাঘের হাত থেকে কেউ কেউ হয়তো প্রাণ নিয়ে পালাতে পারে, কিন্তু কিস্তির কবলে পড়লে বিপদ অনিবার্য; মৃত্যুর পরেও রেহাই মেলে না! রক্তচোষা বাদুরের মতো জনগণকে তারা রক্তহীন করে চলেছে। আমি নিজেও যেন বাদুর! বাদুরের মতো আঁধার পছন্দ করি। কিস্তির টাকা পরিশোধ করতে ব্যর্থ হলে রক্তঠোটে হামলে পড়ি। রাগে-ক্ষোভে ফুঁসতে থাকি। কাঁদাজল মাথায় করে রক্তের নেশায় ছুটতে থাকি। মালি বাড়ির বীনা বৌদি দেনার দায়ে পালিয়েছিল। তাতেও রক্ষা মেলেনি; দলবল সাথে নিয়ে দুরের পথ পাড়ি দিয়ে বাবার বাড়ি হাজির হয়েছিলাম! বৌদি সেদিন ভুত দেখার মতোই চমকে উঠেছিল; অনুনয়-বিনয় করে দুদিন সময় প্রার্থণা করেছিল; বাবা-মার সামনে অপমান না করার জন্যে কাকুতি মিনতি করেছিল; আমি শুনিনি, গায়ের ঝাল মেটাতে যা বলার নয় তাও বলেছিলাম!
বৌদির জন্য দুঃখ হয়। গলায় দড়ি নিয়ে মেয়েটি মরেছে! বীনা বৌদির মৃত্যুর জন্য আমিই দায়ী! আমিই তার বাঁচার পথ রুদ্ধ করে দিয়েছি; আমার কারনেই জীবনের প্রতি ঘৃণা জন্মিয়েছে; বেচে থাকা অর্থহীন মনে হয়েছে! শুধু বীনা কিংবা মৌসুমি নয় অসংখ্য দায় আমার; অনেক অপকর্মের দোসর আমি। ভার কাধে নিয়ে মাঝে মাঝে ঘুম হয় না। নিশাচর পাখির সঙ্গি হয়ে জেগে থাকি। জীবনের হিসেব মেলাতে ব্যতিব্যস্ত! হায়, বাদুর না হয়ে মানুষ হলে হয়তো খুকির দেখা মিলতো; হয়তো ফুলের গন্ধে আকুল হয়ে জীবন ও যৌবন উপভোগ্য হতো! মাঝে মাঝে এও মনে হয়, খুকির সাথে দেখা না হলে ভালো হত! অর্জিত বিদ্যা পুঁজি করে সাফল্যের সিঁড়ি ভাঙতে পারতাম! মানুষ ঠকানোর বিদ্যা বেশ তো রপ্ত করেছিলাম! অথচ খুকির ছোয়ায় জীবনের সমিকরণ বদলে গেল। হারিয়ে ফেলা বিবেক নতুন করে জাগ্রত হলো; ছাঁইচাপা আগুন জ্বলে উঠলো। মনে মনে সংসারের ছবি আঁকি। সমিতিতে আগত মানুষগুলোকে দেখে ভুল হয়। ছাত্র ইউনিয়নের খ- খন্ড মিছিল স্পষ্ট হয়ে ওঠে। ব্যানার, ফেস্টুন, মিছিল, পোষ্টার, লিফলেট- নির্যাতিত মানুষের মুক্তির লক্ষ্যে অসংখ্য আয়োজন। নিজের মধ্যে অর্ন্তদ্বন্ধ¦। নিরন্তর ভাঙাগড়ার খেলা। আমার হাতে মৃত্যুর পরোয়ানা। স্বাক্ষরের মাধ্যমে মৃত্যু নিশ্চিত হয়; পরিবার ক্ষয়ে যায়; সমাজ ধ্বংস হয়। বীনা বৌদির সন্তান দুটো অসহায়। মায়ের জন্য কেঁদে কেঁদে চোখের জল শুকিয়ে গেছে; কতদিন না খেয়ে রাত্রে ঘুমিয়ে পড়ে। মন্টুদা পুনরায় বিয়ে করেছে। রমজান আলীর কুঁড়েঘর নিলামে উঠেছে! এক টুকরো আকাশ তার নিত্য সঙ্গি। জাল হারিয়ে গগন মাঝি দিশেহারা! মৌসুমি বৌদির বুকে দীর্ঘশ্বাস বাজে। স্বামীর ফিরে আসার ক্ষণ কেবলই দীর্ঘ হয়! হাতে শাখা থাকলে বোধহয় এমনটা হত না!
একজন খুকি নিরন্তর আমাকে তাড়া করে। কখনো বীনা কখনো মৌসুমি কখনো নামহীনা ফুল হয়ে চোখ পাকায়। চোখে আঙ্গুল দিয়ে ভুলগুলো দেখিয়ে দেয়; শুধরানোর তাড়না অনুভব করি। উৎভ্রান্তের মতো পথ চলি। রঙিন ফুলের পাশে নিজেকে অন্ধকার মনে হয়। ছাদের উপর এসে দাঁড়ালে হুঁ হুঁ করে বাতাস খেলা করে; প্রকৃতির সৌন্দর্য্য স্পষ্ট হয়ে ওঠে। খুকির শূন্যতা অনুভব করি তখন। জীবনের কারবার অর্থহীন মনে হয়। গভীর রাতে চোরাকারবারিরা আসে; হরিণের মাংস দিয়ে যায়। কলিগরা মজা করে খায়। কেওড়ার ফলের মৌসুমে মাংস যেমন টক হয় আমার অনুভুতিও টকযুক্ত; কিছুতেই মাংস খেতে পারি না; একজোড়া হরিণচোখ আমার গলা আটকে ধরে।
ভুল করেছিলাম আমি।
আরো কিছুদিন নীলডুমুরের পথে পথে ঘুরতে চেয়েছিলাম; লবন-জলের সংস্পর্শে বসত করতে চেয়েছিলাম কিন্তু নিয়তী সে পথ রুদ্ধ করে দিয়েছে। অসুস্থ দেহে শিকড়ের কাছে ফিরে এসেছি। কুমার নদের ধারে, বাঁশ বাগানের ছায়ায় সারাক্ষণ শুয়ে থাকি। সুস্থ জীবনের স্বপ্ন দেখি। অথচ স্বপ্ন পূরণ হওয়ার নয়। শরীরময় অসুখের জীবানু। বিষন্নতায় মগজের পানি কমতির পথে। তীল তীল করে ক্ষয়ে যাচ্ছি। মাঝে মাঝে যন্ত্রণা প্রকট হয়। শ্বাস-প্রশ্বাস দ্রুত ওঠানামা করে। দাঁতে দাঁত চেপে তখন শুয়ে থাকি। চোখ বন্ধ করলে পরকালের রাস্তা দেখতে পাই। মনে হয়, এই বুঝি নিঃশ্বাস থেমে যাবে; থেমে যাবে জীবনের কোলাহল। ডাক্তারের চোখে সরষেফুল। কবিরাজ অবশ্য ডুমুরফুলের কথা বলে; ওই ফুলের ছোঁয়ায় পুনরায় নাকি কক্ষপথে ফিরতে পারি আমি!


ওই চোখে নিবেদনের ভঙ্গি ছিল; নির্ভরতা ছিল- তা না হলে সারারাত্রি আমার সংস্পর্শে বসে থাকবে কেনো! কেনোই বা ঘনঘন দীর্ঘশ্বাস আড়াল করবে! আমার দীর্ঘশ্বাস বেড়ে চলে। কয়রার জীবন কিছুতেই মানিয়ে নিতে পারছিলাম না। একজোড়া চোখ অহর্ণিশ কাছে ডাকে; বুকের মধ্যে হাহাকার জাগে। অফিসের কাজে আমাদি, মদিনাবাদ, গোবরা, হরিনখোলা, বেতকাঁশি, কাঠমার চর, মহারাজপুর-সহ প্রত্যন্ত অঞ্চল চষে বেড়াই; কিস্তির ফাঁকে ফাঁকে খুকিকে অনুসন্ধান করি। কারনে অকারনে দুরের রাস্তায় পাড়ি জমাই; খুলনা থেকে নীলডুমুর, নীলডুমুর থেকে খুলনা- নাহ, খুকি নেই!
কিস্তিজীবন ভালো লাগে না, অল্পতেই হাঁপিয়ে উঠি। মাঠের কিনারে দাঁড়ালে শূন্যতা আরো বাড়ে। ফসলহীন বিস্তির্ণ মাঠ। মাঝে মাঝে চিঙড়ির ঘের। গুমোট অন্ধকার ভালো লাগে না। ভোরের আলোয় কপোতাক্ষের তীরে এসে দাঁড়াই। চর্তভুজ আকৃতির জাল নিয়ে ছেলে-বুড়ো-মেয়ে রেনু সংগ্রহ করে। গারস্থ্য জীবনের চিত্রও ভিন্ন। সুন্দরবনকেন্দ্রিক জীবন চরাচর। কাঠ কাটা, গোলপাতা সংগ্রহ, মধু আহরণ, মৎস্য শিকার, জাল বোনা- বিচিত্র পেশা! পান-সুপারি ছাড়া এক মূহুর্ত চলে না! অবসর মুহুর্তে ঘরের দাওয়ায় টাঙানো দোলনায় দোল খায়। আমিও দোল খাই। খুকির দোলনায় দুলে দুলে হয়রান। টাকা-পয়সার হিসেব কষতে গেলে মাথার মধ্যে চক্কর পাড়ে। খুব সকালে ঘুম থেকে উঠলে থরথর করে শরীর কাঁপে। মনে হয়, এই বুঝি পড়ে যাবো! প্রশান্তির লাগি ৪ নং কয়রায় ছুঁটে যাই। সুইচ গেটের ওপর দাঁড়িয়ে থাকি। পাশে কাশিয়াবাদ ফরেষ্ট রেঞ্জ। ডিঙি নৌকাগুলো সারি সারি ঘাটে বাঁধা। বাতাসের দোলায় হঠাৎ হঠাৎ দুলে ওঠে। ভাড়া নৌকায় বনের অভ্যন্তরে প্রবেশ করি। ভয়ার্ত পরিবেশ। কীটপতঙ্গের নিরবিচ্ছিন্ন চিৎকারে অপার্থিব আবহ সৃষ্টি হয়েছে। ভয়ে গা ছমছম করে। দুপাশ থেকে ঘন ডাল ঝুকে পড়ে আলো-আঁধারীর সৃষ্টি হয়েছে। বাঁধের ওপর দাঁড়ালে হরিনের দেখা মেলে। ভাটা আরম্ভ হলে বুড়ো বানরগুলো কাঁদার মধ্যে গড়াগড়ি খায়। কালেভদ্রে বাঘের দেথা মেলে। কয়রাবাসীর জীবনে ঘুব বেশি বাঘের উৎপাত। মাছ ধরতে গিয়ে কেউ কেউ লাশ হয়ে ফিরে আসে। তবুও বনের ওপর রাগ করে থাকতে পারে না। বাঘ বিষয়ে বিস্তর আলোচনা- নাম মুখে আনে না, মামা বলে সম্মোধন করে। শুক্রবার নাকি মামার জন্মদিন! কেউ সেদিন বনে যায় না; হাত-পা গুটিয়ে ঘরের দাওয়ায় বসে থাকে; আকাশের পানে মুখ করে হাঁ-পিত্যেশ করে। একদিন জঙ্গলে না গেলে তাদের চলে না; পরিবার পরিজন অভুক্ত থাকে তথাপি জঙ্গলের পথে পা রাখতে বুক কাঁপে।
কুসংস্কার!
আমি হাসাহাসি করি। মানুষগুলো আহত হয়। কে কবে বাঘ দেখেছে; কেমন করে গলা ফুটো করে রক্ত খেয়েছে; বিড়াল পায়ে কেমন করে চলাফেরা করে- বহুমাত্রিক সব জল্পনা-কল্পনা। অথচ মানুষগুলো জানে না, বাঘের চেয়ে কিস্তি অনেক বেশি ভয়ংকর! বাঘের হাত থেকে কেউ কেউ হয়তো প্রাণ নিয়ে পালাতে পারে, কিন্তু কিস্তির কবলে পড়লে বিপদ অনিবার্য; মৃত্যুর পরেও রেহাই মেলে না! রক্তচোষা বাদুরের মতো জনগণকে তারা রক্তহীন করে চলেছে। আমি নিজেও যেন বাদুর! বাদুরের মতো আঁধার পছন্দ করি। কিস্তির টাকা পরিশোধ করতে ব্যর্থ হলে রক্তঠোটে হামলে পড়ি। রাগে-ক্ষোভে ফুঁসতে থাকি। কাঁদাজল মাথায় করে রক্তের নেশায় ছুটতে থাকি। মালি বাড়ির বীনা বৌদি দেনার দায়ে পালিয়েছিল। তাতেও রক্ষা মেলেনি; দলবল সাথে নিয়ে দুরের পথ পাড়ি দিয়ে বাবার বাড়ি হাজির হয়েছিলাম! বৌদি সেদিন ভুত দেখার মতোই চমকে উঠেছিল; অনুনয়-বিনয় করে দুদিন সময় প্রার্থণা করেছিল; বাবা-মার সামনে অপমান না করার জন্যে কাকুতি মিনতি করেছিল; আমি শুনিনি, গায়ের ঝাল মেটাতে যা বলার নয় তাও বলেছিলাম!
বৌদির জন্য দুঃখ হয়। গলায় দড়ি নিয়ে মেয়েটি মরেছে! বীনা বৌদির মৃত্যুর জন্য আমিই দায়ী! আমিই তার বাঁচার পথ রুদ্ধ করে দিয়েছি; আমার কারনেই জীবনের প্রতি ঘৃণা জন্মিয়েছে; বেচে থাকা অর্থহীন মনে হয়েছে! শুধু বীনা কিংবা মৌসুমি নয় অসংখ্য দায় আমার; অনেক অপকর্মের দোসর আমি। ভার কাধে নিয়ে মাঝে মাঝে ঘুম হয় না। নিশাচর পাখির সঙ্গি হয়ে জেগে থাকি। জীবনের হিসেব মেলাতে ব্যতিব্যস্ত! হায়, বাদুর না হয়ে মানুষ হলে হয়তো খুকির দেখা মিলতো; হয়তো ফুলের গন্ধে আকুল হয়ে জীবন ও যৌবন উপভোগ্য হতো! মাঝে মাঝে এও মনে হয়, খুকির সাথে দেখা না হলে ভালো হত! অর্জিত বিদ্যা পুঁজি করে সাফল্যের সিঁড়ি ভাঙতে পারতাম! মানুষ ঠকানোর বিদ্যা বেশ তো রপ্ত করেছিলাম! অথচ খুকির ছোয়ায় জীবনের সমিকরণ বদলে গেল। হারিয়ে ফেলা বিবেক নতুন করে জাগ্রত হলো; ছাঁইচাপা আগুন জ্বলে উঠলো। মনে মনে সংসারের ছবি আঁকি। সমিতিতে আগত মানুষগুলোকে দেখে ভুল হয়। ছাত্র ইউনিয়নের খ- খন্ড মিছিল স্পষ্ট হয়ে ওঠে। ব্যানার, ফেস্টুন, মিছিল, পোষ্টার, লিফলেট- নির্যাতিত মানুষের মুক্তির লক্ষ্যে অসংখ্য আয়োজন। নিজের মধ্যে অর্ন্তদ্বন্ধ¦। নিরন্তর ভাঙাগড়ার খেলা। আমার হাতে মৃত্যুর পরোয়ানা। স্বাক্ষরের মাধ্যমে মৃত্যু নিশ্চিত হয়; পরিবার ক্ষয়ে যায়; সমাজ ধ্বংস হয়। বীনা বৌদির সন্তান দুটো অসহায়। মায়ের জন্য কেঁদে কেঁদে চোখের জল শুকিয়ে গেছে; কতদিন না খেয়ে রাত্রে ঘুমিয়ে পড়ে। মন্টুদা পুনরায় বিয়ে করেছে। রমজান আলীর কুঁড়েঘর নিলামে উঠেছে! এক টুকরো আকাশ তার নিত্য সঙ্গি। জাল হারিয়ে গগন মাঝি দিশেহারা! মৌসুমি বৌদির বুকে দীর্ঘশ্বাস বাজে। স্বামীর ফিরে আসার ক্ষণ কেবলই দীর্ঘ হয়! হাতে শাখা থাকলে বোধহয় এমনটা হত না!
একজন খুকি নিরন্তর আমাকে তাড়া করে। কখনো বীনা কখনো মৌসুমি কখনো নামহীনা ফুল হয়ে চোখ পাকায়। চোখে আঙ্গুল দিয়ে ভুলগুলো দেখিয়ে দেয়; শুধরানোর তাড়না অনুভব করি। উৎভ্রান্তের মতো পথ চলি। রঙিন ফুলের পাশে নিজেকে অন্ধকার মনে হয়। ছাদের উপর এসে দাঁড়ালে হুঁ হুঁ করে বাতাস খেলা করে; প্রকৃতির সৌন্দর্য্য স্পষ্ট হয়ে ওঠে। খুকির শূন্যতা অনুভব করি তখন। জীবনের কারবার অর্থহীন মনে হয়। গভীর রাতে চোরাকারবারিরা আসে; হরিণের মাংস দিয়ে যায়। কলিগরা মজা করে খায়। কেওড়ার ফলের মৌসুমে মাংস যেমন টক হয় আমার অনুভুতিও টকযুক্ত; কিছুতেই মাংস খেতে পারি না; একজোড়া হরিণচোখ আমার গলা আটকে ধরে।
ভুল করেছিলাম আমি।
আরো কিছুদিন নীলডুমুরের পথে পথে ঘুরতে চেয়েছিলাম; লবন-জলের সংস্পর্শে বসত করতে চেয়েছিলাম কিন্তু নিয়তী সে পথ রুদ্ধ করে দিয়েছে। অসুস্থ দেহে শিকড়ের কাছে ফিরে এসেছি। কুমার নদের ধারে, বাঁশ বাগানের ছায়ায় সারাক্ষণ শুয়ে থাকি। সুস্থ জীবনের স্বপ্ন দেখি। অথচ স্বপ্ন পূরণ হওয়ার নয়। শরীরময় অসুখের জীবানু। বিষন্নতায় মগজের পানি কমতির পথে। তীল তীল করে ক্ষয়ে যাচ্ছি। মাঝে মাঝে যন্ত্রণা প্রকট হয়। শ্বাস-প্রশ্বাস দ্রুত ওঠানামা করে। দাঁতে দাঁত চেপে তখন শুয়ে থাকি। চোখ বন্ধ করলে পরকালের রাস্তা দেখতে পাই। মনে হয়, এই বুঝি নিঃশ্বাস থেমে যাবে; থেমে যাবে জীবনের কোলাহল। ডাক্তারের চোখে সরষেফুল। কবিরাজ অবশ্য ডুমুরফুলের কথা বলে; ওই ফুলের ছোঁয়ায় পুনরায় নাকি কক্ষপথে ফিরতে পারি আমি!

© পিন্টু রহমান

চলতি সংখ্যা