আর্য পূর্ব বাংলা: এক

প্রকাশিত পর্ব সমূহ
* আর্য পূর্ব বাংলা: সূচনা
* আর্য পূর্ব বাংলা: এক
* আর্য পূর্ব বাংলা: দুই

সহজভাবেই বলা যায় যে সুপ্রাচীন কাল থেকেই বাঙলার জনবসতি স্থাপন হয়েছিল। প্রসঙ্গেক্রমে উল্লেখ আবশ্যক বর্তমানে বাঙালি বলতে বাংলা ভাষী ও বাংলাদেশীকে বুঝায়। যদি ও

“বাঙলা নামটি মুসলমানের অধিকার কালের দিকেই চলিত হইয়াছিল। ”

– ড. সুকুমার সেন – পূবোক্ত পৃঃ ১

মূলত: বঙ্গ শব্দ থেকে বাঙলা হয়েছে যার অর্থ জলাভূমি। আবুল ফজল তার ‘আইন ই আকবরী’ গ্রন্থে লিখেছেন যে, বঙ্গ শব্দের সাথে আলযুক্ত হয়ে- হয়েছে বাঙ্গালা। আল শুধু ক্ষেত্রের (জমির) আল নয়, ছোট বড় বাঁধ অর্থেও ব্যবহৃত। প্রাচীনকালে রাজাগণ ১০ গজ প্রশস্ত উঁচু ২০ গজ বিশাল আকার আল নির্মাণ করতেন (Enbankment)। বর্তমানেও বৃহত্তর বরিশাল ও ফরিদপুরের অনেক স্থানে “বাঙলা” দেয়া শব্দটি জলা ভূমিতে বাঁধ দেয়া অর্থে ব্যবহৃত হয়। বাংলা বন্যা ও বাদলের দেশ, বাংলার সাথে তাই আল (বাঁধ) ঘনিষ্ঠে অনুষঙ্গ। কেউ কেউ বলেন বাঙ্গলা সংস্কৃত শব্দ, এর সাথে আল প্রত্যয় যুক্ত। এ বক্তব্য যুক্তিগ্রাহ্য কি? মুসলমান আমলে যা বাংলা নাম ধারণ করেছে তা শুধু বঙ্গ নয় বাংলা ভাষা-ভাষী ভূ-ভাগ। প্রাচীন যুগে এর বিভিন্ন অঞ্চল ভিন্ন ভিন্ন নামে পরিচিত ছিল। যেমন বঙ্গ, পুন্ড, রাঢ়, বরেন্দ্র, গৌড়, লক্ষানাবর্তী, সমতট, হরিকেল প্রভৃতি। ইতিহাস বলে-

“বঙ্গ একটি অতি প্রাচীন জনপদ ছিল। আরণ্যক ব্রাক্ষণে ইহার উল্লেখ পাওয়া যায়। বৌদ্ধ ধর্ম গ্রন্থগুলিতে যে ষোলটি জনপদেরউল্লেখ করা হয়েছে ইহাদের মধ্যে বঙ্গ জনপদের নাম আছে। ”

– ড. মুহম্মদ আব্দুর রহিম, ড. আব্দুল মমিন চৌধুরি, ড. এ বি এম মাহামুদ, ড. সিরাজুল ইসরাম- বাংলাদেশের ইতিহাস, নওরোজ অষ্টম সংস্করণ ১৯৯৯, পৃঃ ১৪

শুধু বঙ্গ নয়, সমগ্র বাঙালির (বর্তমানে যাদের ভাষা বাঙলা) প্রাচীন অবস্থান সুস্পষ্ট ভাবে প্রমাণিত।

বাংলার প্রাচীনতা নির্ণয়ে গবেষকগণের বক্তব্য স্মরণ করা যেতে পারে। ভূ-তত্ত্ব জরিপে ড. তোফায়েল আহমদ

“১০ লক্ষ বছর আগে প্লোইস্টোসিনযুগে বাংলাদেশে প্রথম মানুষের আগমন ঘটে…। ”

– ড. তোফায়েল আহমেদ – যুগে যুগে বাংলাদেশ, নওরোজ কিতাবিস্তান, ১ম সংকলন- ১৯৯২ পৃঃ ১৪

বাঙালীর অস্তিত্ব অনুসন্ধানে রাম শরণ শর্মা

“খ্রীষ্ট জন্মের পাঁচ লক্ষ বছর আগে থেকেই ভারতীয় উপমহাদেশে মানুষের বসবাস শুরু হয়েছিল। প্রায় একই সময় থেকে এই এলাকার মানুষ জীবিকার সঙ্গে পরিচিত ছিল। ”

– রাম স্বরণ শর্মা – প্রাচীন ভারত, পরঙ্গ রাজ্য পুস্তক পরিষদ, কলিকাতাম ১৮৮৯, পৃঃ ২৬-২৭

আবিস্কৃত নিদর্শন সমূহ নিরীক্ষে অজয় কর বলেন

“প্রত্ন প্রস্তর যুগ থেকেই উপমহাদেশের অন্যান্য অঞ্চলের মতোই বাংলাদেশে যে মানুষের বসবাস শুরু হয়েছিল এ থেকে তা বুঝা যায়। ”

– অজয় কর – বাঙলা ও বাঙালি – খান ব্রাদার্স, ১ম সংখ্যা ১৩৩৬ ঢাকা, পৃঃ ১৪

এরুপ অসংখ্য বক্তব্য উস্থাপন করা সম্ভাব, ভূ-তাত্ত্বিক শ্রেনী বিশ্লেষণে এসব বক্তব্যের পক্ষে অজস্র যুক্তিদ্বার করানো যায়। যেমন টারশিয়ারী যুগে সৃষ্ট শিলা বর্তমান চট্টগ্রম, সিলেট, ময়মনসিংহ, পশ্চিম বঙ্গের রাজমহল, মেদিনিপুর দার্জিলিং প্রভৃতি অঞ্চল সৃষ্টির প্রমাণ মেলে। প্লাইন্টোসিন কালের পলি- পশ্চিমবঙ্গ, বরেন্দ্র ভূমি, ভাওয়াল, মধুপুরগড় ও কুমিল্লা অঞ্চল সৃষ্টির মূল উপযোগ, বিবিধ নিদর্শন ও যুক্তিযুক্ত বক্তব্যের আলোকে অনুমান করা হয় লক্ষাধিক বছর পূর্বে ও এ অঞ্চল ছিল মানুষের পদচারণায় শরব। প্রাচীন সমাজ কেন্দ্রীক নির্বাহের জন্য বাংলা অঞ্চল ছিল উপযোগী। সমুদ্র তীরবর্তী পলিযুক্ত উর্বর সমতল মাটি চাষাবাদের সূচনায় সহজ সহায়ক ছিল। এছাড়াও বাংলার সমতল বনভূমিতিতে অসংখ্য পশু পাখির বসবাস ছিল। শিকারের তাগিদে বাংলাদেশীকে তাই তাদের কালের আবিস্কৃত হাতিয়ার তৈরীতে পারদর্শী হতে হয়েছে। পাথর শীশা, তামা, লোহা ও ব্রঞ্জ ব্যবহারে পারদশীতার নিদর্শন বাংলায় প্রাপ্ত হয়েছে বহুস্থানে। পান্ডু রাজার চিবিতে প্রাপ্ত নিদর্শনের আলোকে ঐতিহাসিকগণ মনে করেন প্রাচীন দক্ষিণ পশ্চিম বাংলার মানুষেরা ধানচাষ, নীলগাই ও সম্বরের মতো পশু শিকারে পারদর্শী ছিল। শুধু প্রাচীন কাল আলোচ্য বিষয় নয়; সভ্যতার সাথে তালমিলিয়ে বাঙলার মানুষ এগিয়ে এসেছে সভ্যতার পরিপূর্ন পর্যায়। বিশ্ব সভ্যতার যাত্রালগ্নে খ্রীষ্ট জন্মের ৭০০০ বছর পূর্বে নীলনদের তীরে মিশরীয় সভ্যতা, টাইগ্রিসের তীরে মেস্ট্রোপটেমিয়া, সিন্ধুনদের তীরে সিন্ধুসভ্যতা এবং হোয়াংহো নদীর তীরে হোয়াংহো নদীর তীরে উর্বর ভূখন্ড সমূহে যখন গড়ে উঠেছে ঐশ্চর্যশালী নগরায়ন। তখন বঙ্গোপসাগর তীর ঘেঁষে বাঙলাদেশে ও গঙ্গা নদীর তীরে গড়ে উঠেছে ভিন্ন ধরণের সভ্যতা। বিশ্বের ইতিহাসে সুস্পষ্ট কোনো উল্লেখ না থাকলেও অনুমান করা যায় জীবন যাপনের উপযোগিতা ও সম্পদের দিক থেকে এ সভ্যতা ছিল অন্যদের চেয়ে সমৃদ্ধ। আধুনিক গবেষণায় এ সভ্যতার অস্কুট অস্থিত্ব স্কীকৃত হলেও এর সঠিক কোন নামকরণ হয়নি। তবে সমুদ্রের নামানুসারে এবং জনপদের প্রাচীনতা বিচারে এ নগরায়নকে ‘বঙ্গ সভ্যতা’ নাম করণ করা যৌক্তিক।

প্রত্ন তাত্ত্বিক যুগ বিভাজন পূর্বক প্রাপ্ত ভূ-তাত্ত্বিক নিদর্শন সমূহের ব্যাখ্যা দানের পূর্বে বাংলার সীমানা অনুমান আবশ্যক। পূর্বে যে ষোলটি অঞ্চল বা ভিন্ন সীমারেখায় জনপদের উল্লেখ করা হয়েছে বর্তমান বাঙলায় তার অধিকাংশের অবস্থান। উল্লিখিত জনপদ সমূহের সীমানা স্থায়ী ভাবে নির্ধারণ সম্ভব হয়নি কখনো। প্রাচীন কালে বঙ্গ নামক যে অঞ্চলের কথা বলা হচ্ছে তার সুনির্দিষ্ট ভৌগোলিক সীমার কোনো প্রমাণ মেলে না। বর্তমান বাঙলাদেশের দক্ষিণ পশ্চিম অঞ্চল বৃহত্তর ফরিদপুর, বরিশাল এবং বিক্রমপুর নামে যা পরিচিত ছিল (বর্তমানে অন্য নামে পরিচয়) বঙ্গের অর্ন্তগত। সমগ্র উত্তর বঙ্গ বরেন্দ্র নামে পরিচিত ছিল, বর্তমান রাজশাহী বগুড়া অঞ্চল। ঐতিহাসিক বিশ্লেষণে বরেন্দ্রের সাথে পুন্ড্রের পৃথকীকরণ কঠিন রংপুর, রাজশাহী, দিনাজপুর বগুড়াকে প্রাচীন পুন্ড্র জনপদ বলা যায় যার রাজধানী ছিল পুন্ড্রনগর।

গৌড় ও লক্ষণাবতীর অবস্থান অভিন্ন অনুভূত হয়। গৌড় রাজের সময় এর রাজধানী হয় কর্নসূবর্ন বর্তমানে যা ভারতের মুর্শিদাবাদে। প্রাচীন বঙ্গের নিকট বসতি জনপদ সমতট। চীনা পর্যটক হিউয়েন সাঙ এর ভাষ্য মতে সমতট বর্তমান কুমিল্লা নোয়াখালী ও চট্টগ্রাম অঞ্চল। হরিকেল বাঙলার পূর্বপ্রান্ত, আধুনিক সিলেট যা তখন বঙ্গ জনপদের আওতাভূক্ত ছিল। প্রাচীন সীমানা অনুসন্ধানে দেখা যায় উল্লিখিত জনপদ সমূহের আলাদা রাজধানী এবং শাসনকর্তা ছিল তা সত্ত্বেও সমগ্র ভূ-ভাগের নাম “বাংলা” করণের কারন বঙ্গের সম্পদ, ঐতিহ্য, বঙ্গরাজের আধিপত্য এবং ভাষার নির্দিষ্ঠ করণ বলে মনে করা যেতে পারে। কেননা জনপদ সমূহের আলাদা রাষ্ট্র ভাষা ছিল বলে কোনো সু-নির্দিষ্ট প্রামাণিক দলিল পাওয়া যায়নি। ড. নিহার রঞ্জন রায় প্রাচীন বাঙালীর বসতি সীমা নির্ধারণ করেছেন এভাবে “উত্তরে হিমালয় হইতে নেপাল সিকিম ও ভোটান রাজ্য। উত্তর পূর্ব দিকে ব্রহ্মপুত্র নদ উপত্যকা, উত্তর পশ্চিম দিকে দ্বার বঙ্গ পর্যন্ত ভাগীরথীর উত্তর সমস্তরালবর্তী সমভূমি, পূর্ব দিকে গাড়ো খাসিয়া ত্রিপুরা-চট্টগ্রাম শৈলশ্রেণী বাহিয়া দক্ষিণে সমুদ্র পর্যন্ত। পশ্চিমে রাজমহল-সাত্ততাল পাটনা -ছোটনাগপুর মালভূমি ধলভূম কেওঞ্জর মৈয়ুরভঞ্জের শৈলময় অরণ্যময় মালভূমি; দক্ষিণে বঙ্গোপসাগর। ” বাঙলা ভাষার বিকাশ পূর্বে ড. রায়ের উল্লিখিত অংশের অবদান স্বীকৃত হলেও বাঙালীর প্রচীনতা নিরুপনে তা সর্বাংশে গৃহিত নয়। আর্য পূর্ব বাঙলা বা প্রাচীন বাঙালি বলতে বর্তমানে বাংলাদেশসহ যে সব অঞ্চলের ভাষা বাংলা আর্থাৎ বাঙালি বসতি অঞ্চলসমুহকে বোঝানো হচ্ছে।

© হারিস মিজান

চলতি সংখ্যা