মুখোশের দোকান ও আয়নাওয়ালা

মানুষটা এক শরীর রোদের গন্ধ নিয়ে ফিরতো। এখনও আচানক রোদের গন্ধ পেলে ভীষণ মনে পড়ে ওকে। এঙ্গেলসের দাড়ির কাৰ্বন কপি, ছেঁড়া জুতো, ছেঁড়া মোজার ফাঁকে খরগোশের লেজের মতোন সাদা গোড়ালি। ভাবতাম আগাপাশতলা আওলা ছাওলা বুড়ো মানুষ। মুখোশের দোকান খুঁজে বেড়ায়। কোন কোনদিন কবরের মুনকার নাকীর হয়ে পথ আটকাতাম।

– তোমার বৃত্তান্ত কি? মুখোশের দোকান খুঁজো ক্যান? 

– পাপ ক্ষয় করতে চাই। 

– আসছে আমার ঈমানদার। দুই রাকআত নামাজ পড়তে দেখলাম না। পাপ মারাও। পাকসাফ হয়ে মসজিদে আসো। আল্লাহর কাছে চাইলে এতদিনে স্বয়ং দোকান আইসা সামনে হাজির হইতো। 

– পাপ নিয়ে মসজিদে যাব?  আহারে, লোকে পাপ জমায়ে পূণ্য নিতে নিতে, পাপ ক্ষয়ে ক্ষয়ে মসজিদ  হয়ে গেছে পাপের গুদাম।

ব্যাস, লাগাতাম দু-তিন ঘা। আমাদের বাঘ-বাঘ খেলতে ইচ্ছে হলেই আমরা মুনকার নাকীর হতাম, নাক কুঁচকে- শ্বাস চেপে রোদের ঘ্ৰাণ উপচানো বুড়োটাকে ধরতাম, পেটাতাম, গরম চা ঢেলে দিতাম গায়ে, ধরাধরি করে মসজিদের পুষ্কুনিতে ফেলতাম। উল্টে সেও বড়ো বড়ো নখে আঁচড়ে দিত, ঢিল ছুঁড়তো। এইটুকু প্ৰতিরোধ ছিল বলেই বাঘ-বাঘ খেলাটা কখনোই পানসে, একঘেয়ে মনে হতো না। 

আমাদের আবু বকর, যাকে আমরা ইবনে বতুতা ডাকি, সেবার ফিরে এসে শুনিয়েছিল- মানুষটা নড়িয়ার মুখোশওয়ালা। মুখোশের দোকান ছিল তার।  এত এত মুখোশ দেশের আর কোথাও হয়নি। বড়ো মুখোশ পাগল মানুষটা পুরুলিয়ায় থেকেছিল শুধু ছৌ নাচের মুখোশ বানানো শিখবে বলে। মানুষটা ভালো ছৌ নাচও নাচতে জানে। পৃথিবীর সবথেকে বড়ো মুখোশের উৎসবেও গিয়েছিল ও। কি করে ভেনিসে পৌঁছেছিল, বিজয়ী হয়েছিল সেরা মুখোশ প্ৰতিযোগিতায় সেও তো এক রূপকথা। টিভিতে, পত্রিকায় ওঁরে নিয়ে কতো প্রতিবেদন হলো। নড়িয়ার সুন্নীরা খ্যাপা ছিল এক সময় তাঁর উপর। মহররমে শেরে আলীর মুখোশ বানিয়েছিল বলে। অথচ ওরাও

 এমন গুনীকে প্রশ্রয় দেয়ার মতো সহনশীল ছিল। আর তোমরা লোকটারে এমন নাজেহাল করতেছো? নদীর ভাঙনে সব গেছে ওঁর। এমনিতেই পাগল কিসিমের ছিল, দোকান হারিয়ে মাথা পুরো গেছে। 

আবু বকরের বয়ানের জন্যই হয়তোবা বুড়ো মানুষটার জন্য ঝুমকো ঝুমকো সমীহ জমতে থাকে আমাদের। যে সমীহ আমাদের তৰ্জনীকে বিনীত করে, মানুষটাকে আপনিতে নিয়ে আসে, আসমাউলের বাড়িতে দুবেলা ভাতের ব্যবস্থা করে। মানুষটা যখন বলে- মুখোশ ছাড়া বড়ো কষ্ট কিংবা মুখোশ ছাড়া কী অসহায় মানুষ – আমাদের তখন কলিজা পুড়ে।

আমরা ঠিক করি আসছে বৈশাখের মেলায় মুখোশের দোকান তুলে দেব তাঁকে। এ শহরে মুখোশের উৎসব হবে। একদিন হয়তো ছৌ নাচও হবে। আমরা দেখবো বিবি সখিনার বীরত্বগাঁথা। 

অথচ এক চৈত্ৰের সকালে মুখোশওয়ালাকে আমরা খুঁজে পাই না। আমাদের ব্যস্ততা-আগ্ৰহ-পরিকল্পনা এক ফুঁয়ে নিভিয়ে দিয়ে হারিয়ে গেল মানুষটা। বুড়ো মানুষটার বদলে আমাদের বিকেলে ভিড়তে থাকে বুড়ো মানুষটার গল্প, আমাদের করুণ আহারে। এমনই বিকেলে আসমাউল এক আয়নার গল্প শোনায়। যে গল্প চৈত্ৰ মাসের জ্যোৎস্নায় ভাত মুখে দিতে দিতে বলেছিল নিখোঁজ মানুষটা। 

 সে অনেককাল  আগে, বাহারী এক আয়না ছিল মানুষটার। যে আয়নায় নজর পড়েছিল সিতারা বাঈজির। এক মূহুৰ্তেই হতে পারতো বেঁচাকেনা অথচ মানুষটা গল্প ফাঁদে- এ আয়না বিক্ৰি হবে না। মানুষটা বুঝি চেয়েছিল যুবতী প্ৰতিদিন আসুক, আয়নার সামনে দাঁড়িয়ে থাকুক। ছিটকে পড়া অধরা স্বৰ্গের ফুল নিয়ে ও তখন বাঁধতে চেয়েছিল স্বপ্নের মালা। এমনই তো বয়স তখন। হাতে বাঁশি, মনে উথল কাঁচা রঙ। মানুষটা গল্পের তোড়া সাজায়- এই আয়না এক রাজকুমারীর; এই আয়না এক রাজরাণীর। সংসার ছিল তার, ভালোবাসা ছিল, সুখ তার মোহর দানার মতো ছিল। সুখ উপচানো ঘরে প্ৰিয় এক আয়নাও ছিল।

হঠাৎ অসুখে মরে যায় রাজকুমারী। লোকে বলে মরে গেলে বাড়ির সব আয়না ঢেকে দিতে হয়। নচেৎ আত্মা মিশে যায় আয়নায়। শেষে ভূত কাটাতে আয়নাকেই কবর দিতে হয়। বুঝি তাই সে আয়নায় তখনও রাজকন্যা থাকে। সিতারা বাঈজিও  ঠিক যেন দেখতে পায় আয়নায় এক রাজকুমারীর মুখ, এক গৰ্ভবতী বেগমের মুখ। গল্প গড়ানোর দিনে আরও সে জানে এ আয়না পরিবিবির আয়না। নেশা ধরা ভয় তারে ধরে। আয়নাওয়ালারে কখনো সে ডাকে, কখনো নিজেই ছুটে যায়, আয়নার গল্প শুনে, আয়নাওয়ালার সাথে কবুতরের ওম মেখে মেখে আয়না কামনা করে। আয়নাওয়ালা ততদিনে মন্দিরা, দেশে দেশে ঘুরে, রঙ শেখে, শেখে মুখোশ। একদিন ফিরে এসে জানে সিতারা কোথাও নেই। জমিদারবাবু কর আদায় করতে না পেরে ইংরেজের ভয়ে সব ছেড়ে পালিয়েছে। ছেড়ে গেছে করুণ জঞ্জালের মতো গৰ্ভবতী সিতারা বাঈজিকেও। যে সিতারা মুখোশের দোকানের দরজায় অপেক্ষায় থেকে থেকে হারিয়ে যায় নিভৃতে একদিন।

একবার প্ৰশ্ন রেখেছিল মানুষ- ভালোবাসো আমারে? 

আয়নায় চোখ রেখে সিতারা উত্তর বুনেছিল- আয়নার খোঁজ করো, জেনে যাবে। 

একবার প্ৰশ্ন রেখেছিল মানুষ- হারিয়ে গেলে? 

আয়নায় চোখ রেখে সিতারা উত্তর বুনেছিল- আয়নার খোঁজ করো, জেনে যাবে। 

মুখোশওয়ালা সেদিন থেকেই আয়না খুঁজে। পরিবিবির আয়না। সিতারা বাঈজির আয়না। একে ওকে জিঞ্জেস করে একদিন জানে অমন বাহারী গা ছমছমে আয়না দেখেছিল ঝড়ের রাতে এক গরুর গাড়িতে আশ্ৰয় পাওয়া কানাই ময়রা। মুখোশওয়ালা তারপর গাড়িয়ালকে খুঁজে চলে। এভাবেই তেইশ হাজার সাতশ পঁচাশি বৰ্গকিলোমিটাৱ পেরিয়ে ও যখন কবুতরভৰ্তি এক বাড়ির দরজা ধাক্কায়, দরজা খুলে এসে দাঁড়ায় অবিকল ওরই মতো আরেকটি আয়নাওয়ালা।

এখানে আমরা ধাক্কা খাই। ধাঁধায় ঘুরতে ঘুরতে খুঁজে বেড়াই আয়না। পরিবিবির আয়না। সিতারা বাঈজির আয়না। হয়তো কোন মুখোশের ধাঁধায় আয়না অপেক্ষায় থেকে থেকে, ক্লান্ত হয়ে তলিয়ে গেছে কিছু মৃত্যুহীন কংকালে। যেখানে জল আছে, স্থির আছে মুখোশের দোকান। 

শুধু হাজার মুখোশে সাঁতরে গেছে চাঁছাছোলা পৃথিবী আমার।

© প্রজ্ঞা মৌসুমী

চলতি সংখ্যা