মেঘলাকাশে শুভ্র শেফালী পর্ব-২

দুই

ধরলা ও ব্রহ্মপুত্র পেরিয়ে মেঘনীল গ্রাম। নির্জন প্রকৃতি গ্রামটিকে দান করেছে অনন্য বিশিষ্টতা। বিস্তীর্ণ চরাঞ্চল হওয়ায় এখানকার অর্থনীতি অত্যন্ত দুর্বল। অধিকাংশ লোকই ভাটি অঞ্চল থেকে উঠে এসে বসতি গড়েছে। দু’বেলা দু’মুঠো ভাতের সংস্থান করতেই একেকটি পরিবারের প্রাণান্তকর অবস্থার সৃষ্টি হয়। প্রতিমুহূর্ত সংগ্রাম করতে হয় মানুষজনদের। চার বৎসর যাবৎ এ গ্রামেই চাকরি করতেন মেঘলা। একটি বিদেশী এন.জি.ওতে। শাখা ব্যবস্থাপক হিসেবে। মূল কাজ ছিল শিশুশিক্ষা ও পুষ্টি নিয়ে। যাতায়াত করতেন সুবর্ণগ্রাম শহর থেকেই। দূরত্ব কম ছিল। তবে অনুন্নত যোগাযোগ ব্যবস্থার কারণে দুর্ভোগ পোহাতে হতো। মেঘনীল মাধ্যমিক স্কুলেই পড়তো শেফালী। ৬ষ্ঠ শ্রেণিতে। ওর প্রতিভা সম্পর্কে অবগত ছিলেন মেঘলা। ওই বয়সেই বিয়ে দিতে উদ্যত হয়েছিলেন শেফালীর বাবা। মেঘনীল গ্রামে অল্প বয়সী মেয়েদের বিয়ে দেবার প্রচলন দীর্ঘদিনের। পল্লী এলাকার নিয়মানুযায়ী দশ পেরুলেই শুরু হয়ে যায় কন্যাকে নিয়ে অভিভাবকের বিয়ের চিন্তা। শুধু চিন্তা বলা যাবে না কতকটা দুশ্চিন্তা যেন! প্রচলমান এই কুসংস্কারটি সেই অস্থিরতার মাত্রাটিকে তীব্র থেকে তীব্রতর করে তোলে। স্বাভাবিকভাবেই বিষয়টি সংক্রমিত হয় সকল মেয়ের মাঝে। প্রতিভাবান হলেও কিছু করার থাকে না। সেই সংক্রমনের শিকার হতে যাচ্ছিলো শেফালী। নিষ্পাপ একটি কুঁড়ি ফুটবার আগেই ঝরে পড়বে-মেনে নিতে পারেননি মেঘলা। স্বল্প বয়সে বিয়ের কারণে শারীরিক প্রতিবন্ধকতার পাশাপাশি মানসিক অসুস্থতার বিষয়টি প্রবল ভাবনার বিষয় হয়ে দাঁড়িয়েছিল তার কাছে। বাল্যবিয়ের কুফল ও কুসংস্কারগুলি শেফালীর বাবাকে বুঝিয়ে বিয়ে বন্ধের উদ্যোগ নিয়েছিলেন। এ উদ্যোগটি সফল করতে যথেষ্ট প্রতিদ্বন্দ্বিতার মুখোমুখি হতে হয়েছিল। অবশ্য সকল প্রতিদ্বন্দ্বিতাকে অগ্রাহ্য করে উদ্যোগটিকে সফল করেছিলেন মেঘলা। খুশী হয়েছিলেন খুবই। মেঘলার কর্মস্থলের পাশেই ছিল শেফালীদের বাড়ী। চার ভাইবোনের মধ্যে শেফালীই জ্যোষ্ঠ। দুটি মাত্র খড়ের ঘরে গাদাগাদি হয়ে বাস করতো সবাই। সামান্য দূরত্বেই ছিল চটের বস্তা দ্বারা আবৃত কাঁচা ল্যাট্রিন। শূন্য উঠোনেই চলতো রান্নার কাজ। শেফালীর বাবাকে বুঝিয়ে নিজের কাছে রেখেছিলেন মেঘলা। পড়াশুনা যতদূর পর্যন্ত করাক না কেন বিশ বছরের মধ্যে বিয়ে দেবেন, পাশাপাশি প্রতি মাসে একটি মোটা অংকের অর্থ প্রদান করবেন শেফালীর পরিবারকে এই শর্তে।

তারপর থেকেই সুবর্ণগ্রামে থাকতো শেফালী। পরিপাটি ছোট্ট বাসা। পরিবার বলতে শুধুই মেঘলার মা। কাজের মহিলাই সব করতেন। ছোটখাটো কাজের মধ্যে সীমাবদ্ধ থাকতে হতো শেফালীকে। শেফালীকে ছোট বোনের মতো স্নেহ করতেন মেঘলা। সুবর্ণগ্রাম স্কুলে যখন সুযোগ পেয়েছিল শেফালী, উচ্চমাত্রায় গর্বিত হয়েছিলেন তিনি। পাশাপাশি একটি আনন্দজাত উৎফুল্লতা অনুভব করেছিলেন ভেতরে ভেতরে। আন্তরিকভাবে ওর প্রতিভাটিকে বিকাশে উদ্যোগী হয়েছিলেন। শেফালীর পড়াশুনায় আশাতীত সাফল্যে অবাক হতো সবাই। মন থেকে উৎসাহ দিতো ওকে। মেঘলা আপার মহানুভবতার পাশাপাশি সবার ইতিবাচক আচরণে আপ্লুত হতো শেফালী। স্ব-দায়িত্বের প্রতি সজাগ থাকতো সবসময়। সেবা করতো মন দিয়ে মেঘলার বৃদ্ধ মায়ের। পাশাপাশি আত্মীয় স্বজনরা আসলে স্ব-প্রণোদিত হয়েই অতিরিক্ত কাজ করতো। বর্তমানে সুবর্ণগ্রাম শহরেই অফিস করেন মেঘলা। চার বৎসরের মধ্যেই পদোন্নতি পেয়ে পদায়ন পেয়েছেন এখানে।

চলতি সংখ্যা