মেঘলাকাশে শুভ্র শেফালী পর্ব-১

এক

বিমুখ আকাশ। বিস্তীর্ণ কালো মেঘ। অমানিশার চাদরে অবরদ্ধ প্রকৃতি। সকাল হতে অঝোর ধারায় ঝরছে ঝমঝম বৃষ্টি। বৃষ্টির বিরামহীন শাব্দিক তীব্রতা। তবুও কোথাও নেই পিনপতন নীরবতা। দৃশ্যটি অভাবিত। ক্রমাগত বাড়ছে শিক্ষার্থী ও অভিভাবকদের পদচারণা। প্রকৃতির বৈরি আবহ তাদের আবেগে চিড় ধরাতে পারেনি। সকল ব্যস্ততাকে দূরে ঠেলে উপস্থিত হয়েছেন তারা। পিচ ঢালা পথ, সবুজাভ মাঠ, স্কুল বারান্দায় অপেক্ষমাণ সবাই। শিক্ষার্থীসহ সবার হৃদয়ের গহীনে প্রোথিত প্রত্যাশার প্রদীপটি জ্বলবে আজ। কিছুক্ষণের মধ্যেই প্রকাশিত হবে মাধ্যমিক পরীক্ষার ফল। সুবর্ণগ্রাম সরকারি স্কুলের অতীত ফলাফল মোটামুটি সন্তোষজনক। তবে স্টার মার্ক প্রাপ্তির সংখ্যা শূন্যের কোঠায়। এ লক্ষ্যে কঠোর পরিশ্রম করেছেন এবার শিক্ষকবৃন্দ। অতিরিক্ত ক্লাসেরও ব্যবস্থা করেছিলেন প্রধান শিক্ষক। ইতোমধ্যে ফলাফল এসে পৌঁছেছে। নিয়মানুযায়ী ফল প্রকাশের পূর্বে সংক্ষিপ্ত আলোচনার আয়োজন করা হয়। এবারও হয়েছে। মূল ভবনের বারান্দায় প্রস্তুতকৃত মঞ্চে। সময় প্রবাহের সাথে পাল্লা দিয়ে বেড়ে চলেছে উৎকণ্ঠা। পরিস্থিতি বুঝতে পেরে বক্তৃতা সংক্ষেপ করলেন প্রধান শিক্ষক। চেয়ার থেকে উঠে দাঁড়ালেন সহকারি প্রধান শিক্ষক। হাতে রেজাল্ট শিট। তার মুখের দিকে তাকালেন সবাই। তিনিও সবার আবেগীয় আবহটিকে অনুধাবনের চেষ্টা করলেন। সবাইকে শান্ত থাকবার আহ্বান জানিয়ে শুরু করলেন ফল ঘোষণা। সম্পূর্ণ ফলাফলটি ঘোঘণা করে হস্তান্তর করলেন প্রধান শিক্ষকের কাছে। নিমিষেই হাসি কান্নার শব্দে ভারী হয়ে উঠলো স্কুলের আকাশ বাতাস।

স্কুলটি সুবর্ণগ্রাম শহরের শ্রেষ্ঠ বিদ্যাপীঠ হিসেবে পরিচিত। ১৯৮০ খ্রিস্টাব্দে প্রতিষ্ঠিত হয়ে টানা কুড়ি বছর যাবৎ শীর্ষস্থান ধরে রেখেছে। পড়াশুনার পাশাপাশি সহ-শিক্ষা কার্যক্রমে স্কুলটির ভূমিকা অনন্য। একটি আদর্শ স্কুলে যে ধরনের ইতিবাচক দিক থাকবার প্রয়োজন তার সবগুলিই রয়েছে এখানে। সবার লক্ষ্যই থাকে এই স্কুলে ভর্তি হবার। তাছাড়া সরকারি বলে খরচের পরিমাণটিও কম। শিক্ষকবৃন্দের আন্তরিক পাঠদানের কারণে বাইরে কোথাও পড়বারও প্রয়োজন হয় না। এই স্কুলে ভর্তির পর থেকেই সব ধরনের সুযোগ প্রদানে ন্যূনতম কার্পণ্য করেন নি মেঘলা। শেফালীও কঠোর অধ্যবসায়ের মাধ্যমে নিজেকে প্রস্তুত করছিলো। সাফল্য নিশ্চিত আসবে ধরে নিয়েই এগুচ্ছিলো সামনের দিকে। কিন্তু রোল নম্বরটি ঘোষিত না হওয়ায় অবাক হলো ও। চাপা কষ্ট নিয়ে দাঁড়িয়ে রইলো। পুতুলের মতো বুকের নরম হাড়গুলি ভেঙে যাবার উপক্রম হলো। নীল রঙের ছাতাটি হাত থেকে পড়ে গেলেও টের পেল না। বুঝতে পারলো উত্তীর্ণ হতে পারেনি। তবুও সুউচ্চ পরিমাণ আত্মবিশ্বাস সেই সরল সত্যটিকে মেনে নিতে অস্বীকৃতি জানালো। নিজের জন্য তো বটেই, মেঘলা আপার কথা ভেবেও মুষড়ে পড়লো শেফালী। আড়াল করতে চাইলো নিজেকে তার কাছ থেকে। উত্তীর্ণ হতে পারবে না এটি ওর কল্পনারও বাইরে। রেজাল্ট শিট নিজ চোখে দেখতে উদ্যত হলো। ভেজা শরীরেই এগিয়ে গেল সামনের দিকে । পেছন পেছন এগুতে থাকলেন মেঘলা আপাও। স্যারের একদম কাছাকাছি চলে আসলো দুজনই।

হেড স্যারের তুষারশুভ্র হাসোজ্জ্বল মুখখানি দেখে আরও বেশী করে আঁধারে আচ্ছন্ন হয়ে গেল শেফালী। মাত্রাধিক স্নেহ করেন স্যার তাকে। সেও সর্বোচ্চ সম্মান করে এসেছে স্যারকে। ‘স্কুলের মুখ উজ্জ্বল করলে একমাত্র তুইই করবি শেফালী।’ অনেকবারই ওকে উদ্দেশ্য করে বলেছিলেন কথাটি। কিন্তু এই মুহূর্তে স্যারের তাকানোর ভঙ্গিটি সহ্য করতে পারছে না শেফালী। ধবধবে সাদা বর্ণের পাঞ্জাবী পড়েছেন স্যার। নিয়ত তাই পড়েন। তবে আজকের পরিহিত পাঞ্জাবীটি একেবারেই নতুন। নতুন পাঞ্জাবীতে উজ্জ্বল বর্ণের মুখখানি দ্বিগুণ উজ্জ্বল দেখাচ্ছে। ঠোঁট দুটিতে লালচের আভাটিও বৃদ্ধি পেয়েছে। হাসির কারণটি কোনোভাবেই অনুমান করতে পারছে না শেফালী। হাসিটিকে তিরস্কার হিসেবেই গ্রহণ করলেও কোনোভাবেই সহ্য করতে পারছে না। রাজ্যের অমানিশা এসে ভর করছে ওর আবেগের মধ্যবিন্দুতে। ‘এমন হতেই পারে, তাই বলে মন খারাপের কিছু নেই।’ শেফালীর এমন বিধ্বস্ত অবস্থা প্রত্যক্ষ করে অনবরত বোঝাতে থাকলেন মেঘলা আপা। তবুও তার কোনো কথাই শেফালীর হৃদয়ে প্রবহমান ঝড়কে রোধ করতে পারলো না। শ্বাস প্রশ্বাসের মাত্রা কমে দম বন্ধ হয়ে আসতে থাকলো ওর। স্যারের সাথে কথা বলবে এমন সময় সহকারি প্রধান শিক্ষক মাউথ পিসটি হাতে দিলেন প্রধান শিক্ষকের কাছে। মুহূর্তেই বুকের ভেতরটা মোচড় দিয়ে উঠলো শেফালীর। স্যারের কাছে যাবার আর সুযোগটি মিললো না। দিক পরিবর্তন করলো। দ্রুতই সবার অলক্ষ্যে পা পিছিয়ে মঞ্চ থেকে সরে আসলো। দাঁড়িয়ে রইলো পুকুর পাড়ে। অনবরত ভিজতে থাকলো, একমাত্রিক শব্দ তরঙ্গের ঝিমঝিমে বৃৃষ্টিতে। ভিজেই চলেছে। জামাকাপড় ভিজে শরীরের সাথে লেপ্টে গেছে। বিরতিহীন সান্তনা দিয়ে চলেছেন মেঘলা আপা। ‘শিক্ষকদের সম্মিলিত প্রচেষ্টায় এবার আমরা সফল হয়েছি। ছয়টি লেটারসহ স্টার মার্ক পেয়ে উত্তীর্ণ হয়েছে শেফালী।’ শেফালী শব্দটির উপর সর্বোচ্চ জোর প্রয়োগ করলেন প্রধান শিক্ষক। মাউথ পিসে হেড স্যারের এই ঘোঘণাটি শুনবার পর আকস্মিকভাবে অশ্রুসিক্ত হয়ে মেঘলা আপুর চোখের দিকে নিস্পলক তাকিয়ে রইলো শেফালী। বাসি ফুলের মতো নেতিয়ে পড়া শেফালী শক্ত করে জড়িয়ে ধরলো মেঘলা আপাকে। অবলীলায় দু’চোখের পাতা বেয়ে অশ্রু ঝরতে থাকলো ওর। আবেগকে সংবরণ করতে না পেরে মেঘলা আপাও কেঁদে ফেললেন। বারবার শেফালীকে মঞ্চের কাছাকাছি যাবার জন্যে আহ্বান করছেন প্রধান শিক্ষক। অহর্নিশ অশ্রুসিক্ত অবস্থায়ই দ্রুত মঞ্চের কাছাকাছি চলে এলো শেফালী। মঞ্চের সামনেই দাঁড়িয়ে রইলেন মেঘলা আপা। প্রধানশিক্ষকসহ সবাই তৃষিত মুগ্ধতা নিয়ে অভিনন্দন জানাতে থাকলো ওকে। মুগ্ধতার আবেশগুলি এক একটি স্ফটিক স্বচ্ছ ঝিলিক হয়ে ওর বৃষ্টিস্নাত মলিন মুখখানিকে স্বর্ণের মতো উজ্জ্বল করলো। চারদিক থেকে আসা ছন্দোবদ্ধ করতালি পুরো আবহটিকে করে তুললো অধিকতর আনন্দঘন।

চলতি সংখ্যা