পাললিক ঘ্রাণে নিয়তি নির্ভর নারীরা
আতিকুর রহমান ফরায়েজী

পাললিক ঘ্রাণে নিয়তি নির্ভর নারীরা

বইয়ের নাম: পাললিক ঘ্রাণ
লেখক: পিন্টু রহমান
প্রকাশ: ২০১৪ বইমেলা
প্রকাশনী: প্রিয়মুখ

বাংলা সাহিত্যে সার্থক ছোটগল্পের আগমন রবীন্দ্রনাথের হাত ধরে হলেও পরবর্তীতে বিভিন্ন গল্পকারের স্পর্শে তা বিভিন্ন মাত্রায় রূপায়িত হয়েছে। মনের মাধুরী মিশিয়ে বিভিন্ন গল্পকার পাঠকের সামনে তার গল্পটিকে উপস্থাপন করেছেন। কোনো কোনো গল্পকারের গল্পের মধ্যে কতকটা সার্থক হয়েছে আর কতকটা স্বার্থকতার গণ্ডি অতিক্রম করতে পারেনি। তাই বলে যে সেগুলো গল্প নয় তা কিন্তু নয়। অস্বার্থকতার মধ্য দিয়েও এসব ছোটগল্পগুলো সাহিত্যে এক নতুন মাত্রা যোগ করেছে। আর যার প্রয়োজনীয়তাও অপরিসীম। তবে অস্বার্থক গল্পের তুলনায় সার্থক গল্পের পরিমাণই বেশি যা পাঠককে করে অনুপ্রাণিত; অনুরণিত। পাঠকদ্বয় তা গ্রহণ করেছে বিমুগ্ধচিত্তে। এমনই এক গল্পগ্রন্থ ‘পাললিক ঘ্রাণ’।

শূন্য দশকের সাহিত্যের পথ চলায় তরুণ লেখকদের সাড়িতে এসে দাড়িয়েছিলো পিন্টু রহমান। সাহিত্য চর্চার প্রথম থেকেই গল্পে মনোনিবেশ করেন তিনি। গ্রাম বাংলার সংগ্রামী জীবন, বৈষম্য, নির্যাতনে জর্জরিত গ্রামের খেটে খাওয়া সাধারণ মানুষের দুঃথ-দুর্দশা, অভাব-অনটন এবং নীরবে কষ্ট সহ্য করার পাশাপাশি সক্রিয় এবং নীরব বিদ্রোহের প্রতিচ্ছবি অঙ্কিত হয়েছে তার প্রথম গল্পগ্রন্থ্য ‘পাললিক ঘ্রাণে’। এখানে জীবন সংকীর্ণ, বাস্তবতা প্রকট, আশা ধোঁয়াশা, আবেগ দগ্ধ, ভালোবাসা এখানে নীরবে কাঁদে। এই অন্ধপুরি থেকে মুক্ত হওয়ার পথ এদের জানা নেই। যদিও মাঝে মধ্যে কিছু চরিত্রের মধ্য দিয়ে আলোর সন্ধ্যার করতে দেখা গেছে প্রখ্যান্তরে কিছুপথ এগুতেই আবার নীরব তমসায় আচ্ছাদিত হয়েছে সে পথ। অশিক্ষা এবং কুসংস্কারে আবৃত্ত এ সমাজ থেকে কেউ কোনোদিন বেড়াতে পারেনি। শেষ অবধি তাকে আবার ফিরে আসতে হয়েছে অন্ধপুরিতে। যদিও অন্যায়ের বিরুদ্ধে ধাবিত হতে দেখা গেছে কিছু চরিত্রকে। পুরুষের তুলনায় নারী চরিত্রগুলোর এ ব্যাপারে সক্রিয়তা বেশি বলে মনে হয়। তাদের বিদ্রোহও শেষ পর্যন্ত চলমান নিয়মের কাছে মাথা নত করেছে। কালের স্রোতে গা ভাসিয়েছে। এমনই কয়েকটি চরিত্রের মধ্যে ‘অপেক্ষার দিনরাত্রি’র শাহানারা, শিউলি গাছ ও একটি পাঠশালা’র মমতা, উজান গাঙে’র মালা, কালচক্রে’র আম্বিয়া, ও আঁধারের দিনলিপি’র বিজলীর কথা মনে দাগ কেটে যায়। এদের সৃজনশীল মানসিকতা থাকা সত্ত্বেও পারেনি তার বিকাশ ঘটাতে।

অপেক্ষার দিনরাত্রি’র শাহানারা: আজীবন স্বপ্নলালনকারী চরিত্র হিসেবে শাহানারার চরিত্রটি একটি উজ্জ্বল দৃষ্টান্ত। ভালোবাসায় ভরপুর তার হৃদয়। আশায় আশা বেঁধে থাকা তার চরিত্রের অন্যতম গুণ। আবেগও তার আছে কিন্তু বাস্তবতার কাছে সে আবেগ কোনো স্থান করে নিতে পারেনি। যার ফলে তার অপেক্ষার পরিসমাপ্তি হয়নি। নিয়তির কাছে মাথা নত করতে হয়েছে। নিয়তির ক্রন্দনের ভার এসে পড়েছিলো সেদিন তার হৃদয়াকাশে। তাই অপেক্ষার দিনরাত্রি শেষ করে তার স্বামী বাড়িতে আসলেও তাকে আবার পরিয়ে দিয়েছে আমরণ অপেক্ষার মালা।

শিউলিগাছ ও একটি পাঠশালা’র মমতা: মমতা সম্ভ্রান্ত পরিবারের অর্ধশিক্ষিত পুত্রবধূ। নিয়তি তার স্বামীকে কেঁড়ে নিয়েছে। তবুও তাকে টলাতে পারেনি। বার বার স্বপ্ন ভঙ্গের দুঃস্বপ্নেরও বসিভূত হয়নি সে। নতুন করে স্বপ্নের জাল বুনে চলেছে। শেষ পর্যন্ত তার কোন স্বপ্নই সার্থক হয়নি বটে তবে আজও সে কোন এক পথিকের স্বপ্ন বুঁনে চলেছে যার হাত ধরে এই অন্ধকার সমাজটাকে আলোকিত করবে।

উজান গাঙে’র মালা: যৌবনে পদার্পনে মালার জীবনে নতুন আবহ সৃষ্টি হয়। পৃথিবীকে নতুন লাগে। সবকিছু আপন মনে হয়। কিন্তু নিয়তি চরমপন্থি। সে তার আপন প্রবাহে প্রবাহিত হয়। এই নবযৌবনার জীবনে দাগ কেটে যেতেও সে দ্বিধাবোধ করেনি। বরং সমাজের কাছে ছোট, হীন বিপন্ন করার মাঝে চরম সার্থকতা উপলব্ধি করতে পেরেছে। সময়ের স্রোতে এবং প্রাকৃতিক নিয়মে কোমলমতি এ যৌবনা হয়েছে কঠোর ব্রতী সাধক। প্রয়োজনে জীবননাশী অস্ত্র তুলে নিতেও বাধ্য হতে দেখা গেছে তাকে।

কালচক্রে’র আম্বিয়া: স্বপ্নময়ী নারী চরিত্রগুলোর মধ্যে আর একটি আম্বিয়া। বারবার স্বপ্নে রঙিন দড়িতে হোঁচট খায়। পুনরায় আবার কোন নতুন স্বপ্ন। পুনঃপুন স্বপ্ন বোনার মাঝে এ মহিলার কি যেন আনন্দ আছে তা বোঝানো সম্ভব নয়। এতসব আনন্দের মাঝে ব্যর্থতাও আছে প্রায় পুরোটা জুড়েই। পুরো জীবনে একটি স্বপ্নও সমাপ্ত করতে পারেনি সে। কোন না কোন পিছু টানে তাকে ভাটির দিকে ফিরে আসতে হয়েছে। শেষ পর্যন্ত তাকে দেখা যায় সব মায়ার বাঁধন ছিন্ন করে মজু ব্যপারীর হাত ধরে নিরুদ্দেশ্যে পাড়ি জমাতে। তাও শেষ পর্যন্ত পূর্ণতা লাভ করতে সক্ষম হয়নি। কোন এক অজানা শক্তি তাদের মাঝে বাঁধা হয়ে দাঁড়ায়। দুজনে বেঁধে থাকে কালচক্রে।

আঁধারের দিনলিপি’র বিজলী: দুরন্ত টববগে এক যুবতী বিজলী। ঘুরে বেড়াতে তার সীমাহীন আনন্দ। ধরণীমাতা তার মুঠিতলে যেন কাঠের পুতুল। সময়ের নিষ্ঠুর স্রোত তাকে অচঞ্চল করতে পারেনি সত্য, তবে নিষ্ঠুরতা উপলব্ধি করাতে সক্ষম করে তুলেছে। স্রোতকে সাথে দিয়ে নয় বরং স্রোতের বুকে মাথা দিয়ে সময়ের গণ্ডি অতিক্রম করাতে এখন সে ব্যস্ত। জীবন তার কাছে খেলনা সমতুল্য বৈ কিছু আর মনে হয় না।

নামহীন ফুলের মাদকতা’র দিপিকা: দিপিকা এক রহস্যময়ী নারী। খুব ছোট বেলায় তার বিয়ে হয় অনিমেশের সাথে। যখন সে সংসার সম্পর্কে কিছুই জানেনা, বরং তখন প্রতিবেশীদের সাথে তার ঝগড়ার ব্যাপকতা আছে। তাকে নিয়ে অন্যরকম সম্ভাবনার উন্মেষ দেখা দিলেও পরবর্তীতে এই চঞ্চলা রমণীয় নিয়তি নির্ভর হয়ে পড়ে। গল্পের শেষে নিরুদ্ধেশের যাত্রায় সেও বেড়িয়ে পড়ে। গল্পকারের নিপুণ দক্ষতায় যে এই বইটি একটি নারীর নিয়তি নির্ভরতা সম্পন্ন গ্রন্থ হয়েছে সেটি আরও ভালোভাবে বোঝা যায় যখন দেখি দিপিকাও নিয়তির কাছে নিজেকে সঁপে দিয়েছে। তবে আমার দেখা মতে দিপিকা গ্রন্থটির শ্রেষ্ঠ নায়িকা চরিত্র। তার মধ্যে যে সব বৈশিষ্ট্যগুলো আমার চোখে ধরা পড়েছে তা অন্য কোনো নারী চরিত্রের মধ্যে খুব একটা ধরা পড়েনি। তাই নিয়তি নির্ভর হলেও দীপিকাকে গ্রন্থটির কর্ত্রী বলা চলে।

শুধুমাত্র আলোচিত বিষয়গুলোই নয় ‘পাললিক ঘ্রাণে’ আরো কিছু নারী চরিত্র আছে যেগুলো কমবেশি নিয়তি নির্ভর। মূলত গ্রাম বাংলার অতিসাধারণ মাটিবর্তী মানুষের অধারণ প্রতিচ্ছবি গল্পকার অঙ্কন করেছেন যা আমাদের অনুধাবনের বাইরে প্রতিনিয়ত প্রত্যক্ষিত হচ্ছে। আর সেগুলোই ‘পাললিক ঘ্রাণে’র মূল সারাংশ।

menu-circlecross-circle