অভিশপ্ত যৌবন

চৌত্রের তাপদ্বাহে উতপ্ত প্রাঙ্গন সাথে মৌ, মৌ গন্ধে সুবাসিত সোনালি ধানের উষর প্রান্তর। বৌশাখের আগমনী উপলক্ষে ইতোমধ্যেই বর্ষার ধারাতে বহরমপুরের মেটে রাস্তায় হাটুপানি। রসিক পথচারী কোমর প্রযন্ত কাপড় গুটিয়ে আসা যাওয়া করে।

মেহেজাবিনের স্কুলে যাওয়া খুবই দুরুহ হয়ে পড়েছে। মেয়েটি সবে এ বছর ছয় ক্লাসে উঠেছে, যেমনি রুপ তেমনি পড়াশোনায় মনোযোগী। সকলেই জাফর ব্যাপারীকে ডেকে বলতো- তোমার এই মেয়ে একদিন তোমার নাম উজ্জ্বল করবে, দেখে নিও। বৈশাখ কেটে রাস্তা, ঘাট শুকিয়ে মুসা মিয়ার ভাটার ইটের মতন অবস্থা হয়েছে। এখন আর কোমর পর্যন্ত কাপড় উঠানো লাগেনা, দিব্যি নাচতে নাচতে চলাফেরা করা যায়। স্কুলে যাওয়ার পথে মোল্লা বাড়ির ছেলেরা কি বিশ্রী ভাষায় যৌবনের খিস্তি ছড়ায় সে কথা সভ্য মানুষের সামনে বলতে গেলে গায়ে কাটা লাগে, শিহরিত হয় মস্তিষ্কের রক্তপ্রবাহ।

স্কুল থেকে বাড়ি ফিরে মেহেজাবিন নিজের অঙ্গ দেখে দেওয়ালের আরশিতে কি আছে আমার শরীরে যে আমাকে এতো কটু কথা শুনতে হয় । আয়না যেনো ঈশারায় শিষ দিয়ে মেহেজাবিনকে কিছু বলতে চায়। দিন, দিন মেহেজাবিনও উৎফুল্ল হয় এসব কটু কথায় আনন্দ লাগে নিজের যৌবনের বাঁধভাঙ্গা রূপের বর্ণনা শুনতে। সেদিন মোল্লা বাড়িতে গানের দল এসেছিলো নাটোরের সিংড়া থানার কলম ইউনিয়ন থেকে। গ্রামের সবাই যখন গান শোনাতে একপ্রাণ তখন মোল্লা বাড়ির ছেলেগুলো হিড়হিড় করে মেহেজাবিনকে টেনে নিয়ে গিয়েছিলো ধানের মাঠে মুখ, চোখ বেঁধে। মেহেজাবিনের নড়াচড়া-কথাবার্তার কোনো জো ছিলোনা। মোল্লাবাড়ির বদমাশগুলো শরীরের এ-প্রান্ত, ওপ্রান্ত হাত দিয়েছিলো । ভাগ্যিস সেদিন বিল থেকে মাছ ধরে নগেন ফিরছিলো নতুবা ঘটে যেতো অনাকাঙ্ক্ষিত কিছু। রাতে বাড়ি দিয়ে যায় নগেন কাকা কাউকে কিচ্ছু বলেনি। সমগ্র রাত ভাবনায়, ভয়ে কেটে যায় মেহেজাবিনের আবার উৎসুক যৌবনের কামূকীয়তায় দৌলা দিয়ে যায় শরীরে। আজকাল গার্লস স্কুলের সামনেও অনেক বখাটে সিটি মারে, চোখ মারে তাতে মেহেজাবিনের বরং আনন্দ লাগে। গরীব ঘরের একজন মেয়ে শহরে পড়াশোনা করতে এসে আজকাল পুরুষ শিকারী হওয়ার পথে ইদানিং রাসেল নামের এক ছেলের মোটরসাইকেলে অন্তরঙ্গভাবে মেহেজাবিনকে দেখা যায়। ক্লাস নাইনের বার্ষিক পরিক্ষা শেষে মেহেজাবিন খালার বাড়িতে বেড়াতে যায় ঝিনাইদহের ডাকবাংলো শহরে। খালাতো বোনদের সাথে ঘুরতে, ঘুরতে একদিন নজর পড়ে যায় ইয়াবা জাহিদের চোখে ঘুরঘুর করতে থাকে খালার বাড়ির চারপাশে। নগদ টাকা দেখায় সোনার চেইন, আংটি দেখায় মেহেজাবিন নিজেকে আর ধরে রাখতে পারেনা ঘুরতে যায় ইয়াবা জাহিদের সাথে দর্শনা বর্ডার এলাকায়। ইয়াবা জাহিদের বন্ধুরা ইয়াবা খেয়ে মেহেজাবিনের উপর বাঘের ন্যায় হামলা করে বসে ৮-১০ নেশাগ্রস্থ ছেলে। সেদিন একযোগে হারাতে হয় সর্বস্ব ধন সেখান থেকে রবীন নামে একটি ছেলে মেহেজাবিনকে উদ্ধার করে নিজের ঘরে নিয়ে রাখে এক সপ্তাহ সেখানেও একই অবস্থা। পরে বিয়ে করার নাম করে নিয়ে যায় গোয়ালন্দ দৌলৎদিয়ার পতিতালয়ে সেখানে এক খালার কাছে রেখে হারিয়ে যায় রবীন। এক সপ্তাহের ভিতরে মেহেজাবিন বুঝতে পারে সে বিক্রি হয়ে গেছে ৭০ হাজার টাকায় একজন পতিতা হিসাবে। তাকে পাঠানো হয় পতিতালয়ের সভাপতির কাছে তিনি উদ্বোধন করবেন তারপর পণ্য পাবেন বাজারের সাধারণ আম জনতা। সভাপতি বাজার থেকে আসতে দেরী হওয়ায় তাকে সভাপতির ছেলের ঘরে ঢুকিয়ে দেওয়া হয়।

মেহেজাবিন এখন মৃত্যু হওয়া একটা লাশ তাকে পতিতালয়ের টিনের ঘরের পাশে খদ্দের ডাকতে শোনা যায় আর রাতের চাপা কান্নার গুমরে মরার আওয়াজ শোনা যায়। পতিতালয়ে জীবন নামের এক তরুণ আসে যশোরের ঝিকরগাছা থেকে তার সাথে অল্পদিনেই ভাব জমে যায় মেহেজাবিনের। তারপর একদিন পালিয়ে যায় ঢাকার বাইপাইল-আবদুল্লাহপুরের এক গার্মেন্টসের কাজে সংসার বাঁধার এক বুক স্বপ্ন নিয়ে। গার্মেন্টসের সুপারভাইজার বাহারুলের নজর পড়ে মেহেজাবিনের শরীরের উপর নানাভাবে ছলাকলা দেখিয়ে মেহেজাবিনকে নিয়ে ভেগে যায় দিনাজপুরের কয়লাখনি এলাকায়। সেখান থেকে এক ট্রাকের ড্রাইভার মেহেজাবিনকে ভাগিয়ে নিয়ে আসে মেহেরপুরে। কিছুদিন ঘর সংশার করার পর পাশের বাসার এক বিজিবির জওয়ান প্রেমে ফেলে মেহেজাবিন কে নিয়ে কুষ্টিয়া মিরপুরের এক বাসায় উঠিয়ে নেন।

মেহেজাবিন এখন ক্লান্ত এই ছুটোছুটির খেলায়। সে বিশ্রাম নিতে চায় যৌবনের এই অভিশপ্ত জিবন থেকে। বিজিবি জওয়ান তাকে ছেড়ে দিয়েছে আবার মেহেজাবিনের গন্তব্যে হয়ে যায় গোয়ালন্দের পথে সে এই মুখ নিয়ে বহরমপুরে ফেরত যাবেনা বলে ঠিক করেছে। খবর নিয়েছে তার বাবা মারা গিয়েছে মেয়ে হারানোর শোকে। মায়ের অবস্থাও ভালো না।

মেহেজাবিন ভাবতে থাকে তার যৌবনের উত্তাল পাত্তাল ঢেউয়ের সেই উপচে পড়া নদীর কথা, পিতার তাকে নিয়ে সুনামের কথা। সুনাম হয়েছে তার ঠিকই কিন্তু সোজা পথে নয় উল্টো পথে। গত মাসে ন্যাশনাল জিওগ্রাফি চ্যানেলের রিপোর্টাররা এসেছিলো এ পল্লীতে তারা কিছু নারীকে ট্রেনিংয়ের মাধ্যমে বিশ্বের বিভিন্ন পতিতালয়ে পাঠাতে চান যৌন রোগ সম্পর্কে মানুষকে অবহিত করার জন্য। মেহেজাবিন সেখানে চান্স পেয়েছে তাকে থাইল্যান্ডের পোখেট শহরে পাঠানো হবে তারই প্রস্তুতি চলছে…

– মাহামূদুল হাসান

চলতি সংখ্যা