একটা হলুদ গোলাপের গল্প

শুনবেন নাকি স্যার

,,,আচমকা এমন কথায় বেশ অবাক হলাম।

একজন বৃদ্ধ লোক,,, পড়নে কালো কুচকুচে চাদর মুড়ি দিয়ে আমার পাশে বসা।

কিন্তু হঠাৎ এমন একটা কথা আমার মতো অচেনা একটা মানুষকে বলার মানে কি?বেশ কৌতূহল নিয়ে কিছু বলতে যাবো তার আগেই বৃদ্ধ বলে উঠলো

-যার জন্য অপেক্ষা করছো সে আর আসবে না।

মেজাজটা পুরো বিগড়ে গেল

আজ আমার সাথে পিয়ালীর বাড়ি থেকে পালানোর কথা…

-আপনাকে কে বললো,,যে আমি কারো জন্য অপেক্ষা করছি।

বৃদ্ধ আবার বলে উঠলো 

মাঝরাতে গোটা প্ল্যাটফর্মে আপনি একা? শেষ ট্রেন অনেকক্ষণ আগেই স্টেশন ছেড়ে বেরিয়ে গিয়েছে৷ পরের ট্রেন সেই ভোরে৷ ভাবছেন বাকি রাতটা কোনও ক্রমে স্টেশনের ওয়াটিং রুমেই কাটিয়ে দেবেন৷

-হুম সেইটাই ভাবছি,,কিন্তু আপনি কিভাবে বুঝলেন,,।

-লোকটার দিকে ভালো করে তাকিয়ে দেখি,,তার মুখটা বেজায় ফ্যাকাসে,,কেমন যেন সারা শরীর সব রক্ত শুষে নিলে যেমন লাগে।

-ভুলেও,,এখানে একা রাত কাটাবেন না,,, রাত ৩.০৩ মিনিটে এখানে ভয়ংকর তাণ্ডব চালায় তেনারা।

-তেনারা মানে,,,বুঝলাম ?

-আরে,,স্যার তেনারা মানে বুঝেন না,,আত্মারা।অতৃপ্ত আত্মারা এহানে আসে।

-হা,হা,হা,,,কিহ,,বলো যত্তসব গুজরুটি,,এসব আত্মা-ভূত বলে কিছু নেই সবই মানুষের বানানো গল্প।

-আচ্ছা,, আপনি,, জানি তখন কি গল্প বলতেছিলেন?

-ওহ,,স্যার গল্প কইয়েন না,,হেলে তেনারা রাগ করবো,,এইডা তেনাগো সত্যি ঘটনা।

-আচ্ছা,, শুনাও তোমার তোনাগো কাহিনী। 

-আইজ থেইকা ২০ বছর আগের কথা,,তহন এই স্টেশন কেবল বানানো শুরু হইছে,,তো এই এলাকার জমিদার খান সাহেব নিজে দায়িত্ব নিয়া কাজ করাইতে লাগলেন,,স্টেশন যহন চালু দিব তহন,,বড় শহর থেইকা এক স্টেশন মাস্টার আইলো,,,বয়স বেশি না একদম আমনের মতন,,কেবল নতুন পোস্টে চাকরিতে আইছে,,যুয়ান এক্কেরে তাজা পোলা,, তারে আবার জমিদার নিজের বাড়ি থাকতে দিসে,,কিন্তু কি আর কমু পোলাডা আকালে ঐ জমিদারে লইগা মারা গেল।

-মারা গেল মানে?

-আরে আগে পুরাডা হুনেন,,ঐ জামিদার তারে,,স্টেশনে বলি দিবার লইগা আনছিল,,বুঝানেনা এই স্টেশন কি এমনে এমনে চালু হইছে,,রক্ত চায় অনেক,,রক্ত না দিলে তো চালু হইতো না স্টেশন,, জমিদারের এক খাস পীর ছিল,,হে যা কয় হেইয়া মিলা যায়,,কিন্তু জমিদারের মাইয়া রুমনা এক্কেরে সারা পরীর নাখান মাইয়া,,হে সব জাইনা গেছিলো,,আবার ঐ স্টেশন মাস্টারের লগে প্রেম টেম ছিল হের,, তাই হে সব পোলাডারে জানাইয়া দেয়,,আর হেরা প্রত্যেক দিন রাত ৩.০৩ মিনিটে এই স্টেশনে দেহা করতে আইতো,,আর রুমনার লইগা প্রত্যেক রাইতে,,হে একটা হলুদ গোলাপ লাইয়া আইত,,এই স্টেশনের দক্ষিণ দিকে একটা বড় হলুদ গোলাপের গাছ আছে,,কিন্তু এহন আর ফুল হয় না,,

জমিদার সাবের পোলাপান,, হের মাইয়ার লগে ঐ পোলার সম্পর্কের কথা জানলে হের মাইয়ারে বাড়িতে আটকাইয়া কার লাগে জানি বিয়ে দিতে লাগছিলো,, কিন্তু হেয় পলাইয়া স্টেশন মাস্টারের কাছে চইলা আয়,,কিন্তু জামিদার জাইনা গেছিলো সব আগে থেইকা তাই হে দলবল আর ঐ পীররে লাইয়া,,ঐ স্টেশন মাস্টাররে দবাই দেয়,,আর হের লাশের মাথাডা তিনদিন স্টেশনে ঝুলাইয়া রাখছে,,

হেরপর যেদিন স্টেশনে ট্রেন চালু দিছে ঐ দিন জমিদারের মাইয়া ট্রেনের সামনে ঝাপ দিয়া মইরা যায়,,

-কয়দিন আবার ঐ জমিদার আর পীরের মাথা কাটা লাশ এই স্টেশন ঝুলতে দেহা যায়,,পুলিশ টুলিশ আইছিয় কিন্তু কোন কি করতে মা পাইরা সব বন্ধ কইরা দেয়,,কিন্তু রাইত ১০ পর কেউ আর এই স্টেশনে থাকে না,,একবার এক পিয়ন এহানে আইসা ছিল পরদিন সকালে হে ট্রেনের তলে পইরা মারা যায়।

-আচ্ছা,, আপনি এত কিছু কিভাবে জানলে? আপনি কে?

-হঠাৎ করেই স্টেশনে বাতিগুলো বন্ধ হয়ে গেল,,চারিদিকে ঘুটঘুটে অন্ধকারে,,মোবাইলের ফ্লাস জ্বালিয়ে তাকিয়ে দেখি আমার পাশে বৃদ্ধ লোকটা আর নেই সেখানে একটা হলুদ গোলাপ পড়ে আছে,,

অবাক হলেও সত্যিই পুরো স্টেশনে আমি ছাড়া আর কেউ নেই,,আর বৃদ্ধ লোকটা এত তাড়াতাড়ি কোথায় চলে গেল,,

সামনে কিছু একটার মৃদু আলো দেখতে পাচ্ছি,,হলুদ গোলাপটা নিয়ে সমানে এগিয়ে যেতে লাগলাম,, হঠাৎ চারদিকের সবকিছু স্পষ্ট দেখতে পাচ্ছি,, মনে হচ্ছে পূর্ণিমার চাঁদনি রাত কিন্তু কিছুক্ষণ আগে তো চাঁদে কোন না গন্ধ ছিল না,,

হঠাৎ দেখি লাল বেনারসি পড়া এক রমণী এগিয়ে যাচ্ছে,, 

-কে ওখানে দাঁড়িয়ে আছেন?

এই যে শুনুন,,কিন্তু কোন উত্তর দিচ্ছে না।

-আমি যে ওনার কাঁধে হাত রাখব ওমনি কেউ যেন আমাকে পেছন থেকে টেনে ছিটকে আনে,,ভালো করে তাকিয়ে দেখি পিয়ালী আমাকে শক্ত করে জড়িয়ে ধরে আছে,,আর স্টেশনে এখন আগে মতোম চাঁদ আলোও নেই সব কিছুই আগের মতো স্বাভাবিক,, 

পিয়ালী উঠে আমাকে বলতে লাগলো,, 

-তুমি কি পাগল হয়ে গেছো,,সামনে এত বড় ট্রানের সমনে মরতে যাচ্ছিলে কেন?

-তাকিয়ে দেখি,,হ্যা সত্যিই তো ট্রেন আমার সমনে,,আথচ আমি এতক্ষণ কিছুই টের পাইনি,, এটা কিভাবে সম্ভব,, আর সেই হলুদ গোলাপ আর লাল বেনারসি সেই রমনি কই কিছুই তো নেই,,

-হঠাৎ, উপরে তাকিয়ে দেখি একটা কাটা মাথা ঝুলছে আর রক্ত পড়ছে,,, মাথার চোখগুলো আমার দিকে তাকিয়ে আছে,,, 

ভয়ে চিৎকার দেয়া কথাও,, পিয়ালীর হাতটা কোনমতে ধরি,, তারপর আর কিছুই মনে নেই,,

সকালে যখন জ্ঞান ফিরে তখন নিজেকে ওয়েটিং রুমে আবিষ্কার করলাম আর পাশে বসে পিয়ালী কাঁদছে,, এবং স্টেশন মাস্টার দাঁড়িয়ে আছে,, 

আমাকে উঠতে দেখি তিনি বলতে লাগনেন,

– আপনার কপাল,,খুব ভালো ছিল,,তাই এ যাত্রায় প্রাণে বেঁচে গেছেন,,না হলে অন্য সবার মতো আপনিও আজ সকালে ট্রেনের নিচে কাটা পরা লাশ হয়ে থাকতেন,,

-কিছু মারা যাবার পরও থেকে যায় তাদের অতৃপ্তি জন্য,,

পিয়ালী ভয়,পাবে বলে পিয়ালীকে আর কিছু জানাই নি,,তবে স্টেশনে মাস্টারের থেকে জেনেছি,,এর আগেও অনেকের সাথে একই ঘটনা ঘটেছে,,তবে তার কেউ বেচে ফেরেনি,, 

আমিই প্রথম,,

-পিয়ালীকে নিয়ে জয়পুরে জন্য ট্রেন উঠব,,

ঠিক তখনই আবার সেই বৃদ্ধ লোকটা এসে আমার হাতে একটা হলুদ গোলাপ দিয়ে চালে,,,

আমি অনেকবার তাকে ডাকলাম কিন্তু সে কোন জবাব দিল না,,

শুধু একটা রহস্যময় হাসি দিয়ে ভিড়ের মধ্যে হারিয়ে গেল,,

পিয়ালী আর আমার বিয়ের আজ তিন বছর হতো কিন্তু আজও সেই হলুদ গোলাপের রহস্যটা জানতে পারলাম,,এই তিন বছরে গোলাটা একদম অক্ষত আছে,,একটুও মুরশে পড়েনি কিংবা শুকিয়ে যায়নি,,প্রতিদিনই মনে হয় তাজা,,

আচ্ছা,,এটা কি ঐ অতৃপ্ত আত্মারা কোন চিহ্ন 

নাকি তারা নতুন জীবনের শুভকামনা,,

জানালো,,,

আত্মারা কি শুভকামনা ও জানাতে পারে?

চলতি সংখ্যা