পরাজিত সৈনিকের অতৃপ্ত চাহনী

সবুজ, শ্যামল, নিবিড় ছায়াঘেরা গ্রামটির নাম বন্দরভিটা। এর পাশ দিয়ে বয়ে গেছে মাথাভাঙ্গার শাখানদী। গ্রাম্য পরিবেশের মতো এখানে কৃষকেরা মাঠে কাজ করে, ব্যবসায়ীরা ব্যবসা করে এবং গৃহিনীরা গৃহকর্মে ব্যস্থ থাকে। গ্রামের বুক চিরে বয়ে গেছে পাকা রাস্তা। এর দুই পাশে বিভিন্ন গাছের সমারহ। নিত্যদিনের মানুষগুলো কাজের সন্ধানে একটি নির্দিষ্ট স্থানে অপেক্ষা করে, সেখান থেকে প্রয়োজন অনুযায়ী লোক সকল শ্রমিক খুঁজে নেয়।

সতের মে দিনটি কেমন ভিন্ন প্রকৃতির। চারপাশে কাকের ডাকাডাকি, গুড়ি গুড়ি বৃষ্টি হচ্ছে। ভারি কান্নায় পরিবেশের সদস্যরা স্তব্ধ হয়ে আছে। পাখির কলকাকলি নেই, তবে মানুষের কান্নার ধ্বনিতে ভিড় জমে আছে। চির বিদায়ের পালকী দেখে বুঝতে আর বাকি রহিল না।

সাইফকে বাবা-মা খুব ভালবাসে। ওকে নিয়ে অনেক স্বপ্ন। স্বপ্ন বুননের প্রথম ধাপে ছেলেকে গ্রামের প্রাথমিক বিদ্যালয়ে ভর্তি করে দিলেন। বিদ্যালয়ে নিয়মিত পড়াশোনা করে ভালো ফলাফল করে। শিক্ষকবৃন্দ ও সহপাঠিদের সাথে সাইফের ভালো সম্পর্ক গড়ে ওঠে। এছাড়া গ্রামের সকলে ওকে খুব ভালোবাসে। প্রাথমিক শিক্ষা শেষে মাধ্যমিক শিক্ষার জন্য স্থানীয় বিদ্যালয়ে ভর্তি হয়। বাবা-মায়ের ভালবাসায় লালিত-পালিত ছেলেটি লাউয়ের ডোগার মতো বেড়ে ওঠে। বাবা কৃষি খামারে কাজ করে ফিরে এসে ছেলের মুখের দিকে তাকালে সকল ক্লান্তি ভুলে যায়।

বিদ্যালয়ের বিভিন্ন প্রতিযোগিতায় ভালো করতে থাকে সাইফ। পড়াশোর পাশাপাশি সে অন্য জগতের সন্ধান খুঁজে বেড়াই। পারিপার্শ্বিক পরিবেশ তাকে ধ্বংসের মুখে ঠেলে দেওয়ার চক্রান্ত করলেও মনুষ্যত্ব তাকে ফিরিয়ে আনে। লেখাপড়ায় মনোযোগ দিতে কিছু বিলম্বের জন্য এস. এস. সি পরীক্ষায় ভালো ফলাফল করতে পারেনা। তবুও উচ্চশিক্ষার জন্য কলেজে ভর্তি সুযোগ হয়। এভাবে লেখাপড়া চলতে থাকে। কলেজে ভর্তির পর সাইফের ভালো ছেলেদের সাথে বন্ধুত্ব গড়ে ওঠে। পড়াশোর ব্যস্ত সময় আতিবাহিত হয় ওদের। এইচ. এস. সি পরীক্ষায় ভালো ফলাফল করে। এখন সাইফ এবং ওর বন্ধুরা স্থির করে বিশ্ববিদ্যালয়ে ভর্তি হয়ে মা-বাবার মুখে হাসি ফোটাবে। উদ্যাম ও পরিশ্রম একত্রে চলতে থাকে। বিশ্ববিদ্যালয়ে হিসাব বিজ্ঞানে লেখাপড়ার সুযোগ পাই।

বিশ্ববিদ্যালয়ের জীবন খুব আনন্দের কথাটি শুধু শোনা যেত। এখন সাইফ সেই জীবনের একজন সদস্য। সাইফ এ পর্যন্ত যা চেয়েছে তাই পাওয়ার জন্য সর্বোচ্চ চেষ্টা করে সফল হয়েছে। যা পাওয়ার আশা কম তার নিকট যেতেও ভয় পাই। অডিটোরিয়ামে অনুষ্ঠান দেখতে এসেছে সাইফ। একুশে ফেব্রুয়ারি রচনা প্রতিযোগিতায় ও প্রথম হয়েছে। এখানে পুরস্কার বিতরনি ও আলোচনা সভা হবে। অনুষ্ঠান শুরু হয়েছে এরই মাঝে এক মেয়ের সাথে সাইফের পরিচয় হয়। সাইফ মেয়েদের দেখলে খুব ভয় পাই । কারণ এস. এস. সি পরীক্ষায় পূর্বে সমস্যায় পড়েছিল।

মেয়েটি খুব আগ্রহ নিয়ে সাইফের সাথে কথা বলছে। পূর্বে সাইফ সম্পর্কে ওর একটা ভালো ধারণা ছিল। কথা প্রসঙ্গে মনের গভীরে মেয়েদের যে কথাটি সুপ্ত থাকে তা প্রকাশ করে। কথাটি সাইফের ভালো লাগলেও এড়িয়ে যাওয়ার চেষ্টা করে। দীর্ঘ আলাপ শেষে সাইফ বলে, “আমি যা চাই তা আমাকে পেতেই হবে, আর যা আমি পাবো না তার দিকে চাইনা”।

মেয়েটি বলে আমাকে নিয়ে তুমি কখনো হতাস হবেনা। আমি শুধু তোমার, তোমাকে ছেড়ে কোনদিন চলে যাব না। এভাবে কিছুদিন অতিবাহিত হয়। চাঁদ ও সূর্যের উদয় ও অস্তের খেলায় মানুষের মনেরও পরিবর্তন হয়। মেয়েটির মুখের হাসি এখন আর সাইফের না, তা এখন প্রবাসী কোন এক ছেলের।

কেউ কথা রাখেনি, জীবনের রঙ্গিন স্বপ্নগুলো এখন সাইফের গোলক ধাঁধার মতো। বাবা মা স্বপ্ন দেখে ছেলেকে নিয়ে, ছেলে স্বপ্ন দেখে কোনো এক প্রতারক মেয়েকে নিয়ে। ঘুম, খাওয়া এবং গোসলের অনিয়ম ঘটতে থাকে। নেশায় জড়িয়ে পড়ে সাইফ। এভাবে বিশ্ববিদ্যালয়ে লেখাপড়ার বারটা বেজে যায়।

পরাজিত সৈনিকের মত সাইফ বাড়িতে ফিরে আসে। মা-বাবা ওর চেহারা দেখে কেঁদে ওঠে সাইফ স্থির দৃষ্টিতে তাকিয়ে আছে। ডা. বলেছে- ওর ব্লাড ক্যান্সার হয়েছে। বৃদ্ধ বাবা-মা কি সাইফের পাশে দাঁড়াতে পারবে? এখন সাইফকে ওদের পাশে দাঁড়ানোর কথা।

সব কিছু ভুলে সাইফ তার আপন জগতে ফিরে গেছে। সাইফ কি মা-বাবার হৃদয়ের বৃক্ষ থেকে ঝরে গেছে? না এই সমাজের চক্রান্তে হেরে গেছে? সাইফ মৃত্যুর পূর্বে বালিশের নিচে একুটি চিরকুট রেখে গেছে, তাতে লেখা ছিল- “আমি চলে যাচ্ছি, তবে একটি কথা এই পৃথিবীর সকল বন্ধুদের বলে যেতে চাই। ছাত্রজীবনে যেন অন্তরের প্রয়োজন মেটাতে বাবা মায়ের হাসি আনন্দ কেড়ে না নেয়। আমি চাই আমার মতো যেন আর একটা ছেলে মেয়েও ঝরে না পড়ে”।

ঘনকালো মেঘ পশ্চিম আকাশে গর্জে ওঠে। এক পশলা বৃষ্টিতে পেরিবেশ সজীব হয়ে ওঠে। সাইফের লেখা চিরকুটটি উপন্যাসের কভার পৃষ্ঠায় স্থান করে নেয়। পূর্ব আকাশে নতুন সূর্য ওঠে। সূর্যের আলোর মতো সাইফের চিরকুটের লেখাটি তরুণ প্রজন্মের মাঝে ছড়িয়ে পড়ে। মাথাভাঙ্গা নদী তার যৌবন হারিয়ে সাইফের সাথে গভীর মিতালি গড়ে তোলে…

© শাহীন আলম

চলতি সংখ্যা