পাখিবিলাস

জানালায় ঠক ঠক শব্দে ঘুম ভেঙে যায়। বিছানার সাথে সাক্ষাৎটা শেষ রাতেই হয়েছিল। তাই এই সাত-সকালে চোখ খুলতে একদমই ইচ্ছে হচ্ছিল না।

গতকালকে যখন কুড়িগ্রাম থেকে ঢাকার উদ্দেশ্যে রওয়ানার প্রস্তুতি নিচ্ছি, তখন আকাশ উজ্জ্বল। মনটাও চনমনে আর ফুরফুরে ছিলো। প্রিয়তমার হাসিখুশি মুখের আড়ালের কষ্ট আর মায়ের গম্ভীর মুখের ছবি আমাকে দুই মেরুর ভাবনায় ডুব দিতে বাধ্য করলেও সময়টাকে বেশ উপভোগ করি। হালকা খাবার খেয়ে বিছানায় শরীর রাখতেই আকাশ ভেঙে বৃষ্টি শুরু হলো, সেই সাথে প্রচন্ড গর্জন ও শিলাবর্ষণ। বাড়িতে মিস্ত্রিরা ঘরের কাজ করছে। সাজুও ঢাকা যাওয়ার সঙ্গি আমার। ঘড়ির কাটা নয়টা পেড়িয়ে গেলো। অথচ প্রকৃতির কোনো পরিবর্তন নেই। বাস কাউন্টারে সাড়ে নয়টায় উপস্থিত হওয়ার কথা। ইতোমধ্যে কাউন্টার থেকে জানানো হয়, বাস ছাড়তে আরও আধাঘন্টা দেরি হবে। বাসবিলম্বের খবর পেয়ে একটু ভালোই লাগল। দরজা-জানালা বন্ধ করে বাড়ির সবাই একঘরে বসে আছি। শিলাবৃষ্টি ও বাতাসের তা-ব বৃদ্ধি পাচ্ছে। বড় ভাইয়ের তিন বছরের বাচ্চা ইমন আকাশের গর্জনে তার মায়ের বুকে লীন হয়ে আছে।

ভয়ঙ্কর তা-ব চালিয়ে দশটার দিকে বাতাস ও শিলাবৃষ্টি থেমে গেলো। কিন্তু বৃষ্টি সমান তালেই চলছে। কাউন্টার থেকে ফোন আসে দ্রুত কাউন্টারে যেতে হবে, বাস ছাড়বে। আব্বু আমাদের রেডি হতে বলে ছাতা নিয়ে বাজারে চলে যায় রিক্সা আনতে। বাইরে শিলা দেখে হতবাগ হয়ে যাই, এমন শিলা আগে কখনো দেখিনি। যতদূর চোখ যায় সাদা আর সাদা। আশ্চর্য হয়ে তাকিয়ে থাকি। মাত্র কয়েক মিনিটের শিলাবৃষ্টিতে সমস্ত গ্রামটাকে অচেনা লাগছে। বৃষ্টি কমে গেলো, চারিদিক থেকে কান্নার শব্দ। বাহিরে বের হয়ে দেখি- শিলার আঘাতে গৃহস্থের হাঁস-মুরগি মারা গেছে, বাগানেও মরে পড়ে আছে বেশ কিছু পাখি। স্কুল মাঠে দুই-তিনটি ছাগল, একটি গরু শিলাবৃষ্টির আঘাতে ক্ষত-বিক্ষত হয়ে পড়ে আছে।

একটি কুকুর হাঁপাচ্ছে। আমাকে সামনে যেতে দিচ্ছে না। বারবার তাগাদা দিচ্ছে সামনে না যেতে। তবুও এগিয়ে গিয়ে দেখি মালেকা বেগমের নিথর দেহ ব্যঙ্গ করছে আমার দিকে চেয়ে। চারিদিক থেকে একটা কান্নার ধ্বনি বাতাসে মিশে পরিবেশকে ভারি করে তুলছে।

সময়টা ফসলের না। কিন্তু রঙিন ও হলুদ আমগুলো শিলার উপর শুইয়ে আছে পরম মনবেদনায়।

এত কিছু ভাবার সময় কই? সাজু ও আমি এমন পরিস্থিতিতেও ভিজে বাস কাউন্টারে যাই। ছোট-বড় শিলাগুলো চাকার তলে পিষ্ট করে বাস সামনের দিকে এগুচ্ছে। আমাদের কাপড় পুরোই ভিজে শরীরের সাথে লেপ্টে আছে। সাজু কান্না করছে। বাসের বেশ কিছু সিট খালি পড়ে আছে- বাস জার্নি করা তো দূরের কথা অনেকেই পরিস্থিতিই সামলে উঠতে পারেনি। যারা এসেছে তাদের সকলের অবস্থাও বেশ শোচনীয়।

ঢাকায় পৌঁছাতে রাত এগারোটা প্রায়। নব্বই ছুঁই ছুঁই ভাষাসৈনিক আমার ল্যান্ড লেডি আমার অপেক্ষা করতে করতে অবশেষে খাবার খেয়ে নিয়ে আমার অপেক্ষায় বসে আছেন। বাসা পৌঁছে ল্যান্ড লেডিকে সালাম দিয়ে কুশল বিনিময় করে পোশাক পরিবর্তন করেই সাজুকে ফোন দিলাম। কারণ পথিমধ্যে সাজু ওর বাসা উত্তরায় নেমে গেছে, আর আমি বনানীতে চলে আসলাম।
সাওয়ার শেষে ফোনে চার্জ দেবো এমন সময় ল্যান্ড লেডি কল। কল পেয়ে তার রুমে গিয়ে দেখি একটি চড়–ই পাখি উড়াউড়ি করছে। জানালা, দরজা খুলে দিলেও বের হতে পারছে না। সমস্ত ঘরময় সে উড়াউড়ি করছে। রুম থেকে পাখিটাকে বের করে দেওয়ার চেষ্টা করেও ব্যর্থ হয়ে অবশেষে ল্যান্ড লেডিকে গুড নাইট জানিয়ে নিজের বিছানায় এসে শুইয়ে পড়লাম।

ঠক ঠক শব্দে যখন ঘুম ভাঙল তখন পৃথিবী উজ্জ্বল। চোখ খুলে দেখি, জানালায় একটি কাক ঠোঁট দিয়ে শব্দ করছে। আরেকটি কাক তাকে উৎসাহ দিচ্ছে। আমি ঘুমের ভান করে শুইয়ে থাকি। কাকটি আমাকে জাগাতে না পেরে নারিকেল গাছের ছায়ায় গিয়ে বসে। মনে হচ্ছে- তখন সঙ্গে কাকটি আবারও তাকে বুঝিয়ে পাঠায়। এভাবে প্রায় পাঁচ মিনিট চেষ্টা করেও উপায় না পেয়ে দু’জনেই আমার জানালায় এসে বসে।

আমি বিছানা থেকে উঠে ছাদে ভাত ও চাউল ছিটিয়ে দেই। মনের আনন্দে খেয়ে চলে যায়। একটু পর পর বিভিন্ন পাখি খাবার খেতে আসে। গতকালকের কথা ভুলে যাই সব। মানুষ হয়ত এমনি, নিজে নিরাপদে থাকলে অতীত বেমালুম ভুলে যায়। তবে ভুলতে পারে না স্থায়ীভাবে।

গতবছর যখন বাড়ির ছাদে এই রুমটি করে থাকার ব্যবস্থা হয়। তখন থেকেই অক্লান্ত পরিশ্রম করে ছাদের একাংশে বিভিন্ন রকম ফল ও ফুলের গাছ লাগিয়ে বাগান করেন ল্যান্ড লেডি। তাকে সব ধরণের সহযোগিতা করি। ঢাকা শহরের অধিকাংশ নার্সারি থেকে গাছ সংগ্রহ করে আনতাম। বিদেশ থেকেও গাছ আনা হতো। তুলসি, পুদিনা, কারীসহ বিভিন্ন ঔষধি গাছের সমাহার রয়েছে বাগানে। গাছ লাগানোর প্রাথমিক কাজ শেষ করেই আমরা মনোযোগ দেই পাখিদের অভয়ারণ্য সৃষ্টিতে। প্রতিদিন সকালে এবং বিকালে পাখিদের জন্য নানা ধরণের খাবার ছিটিয়ে দেই। কিন্তু পাখি আসে না। সারাদিন ছাদে চোখ রাখি কখন একটা পাখি আসবে আর খাবার খাবে। এভাবে প্রায় দশ বারো দিন পর দেখা গেলো দুইটি চড়–ই পাখি। কিছুক্ষণ পরে ছয়-সাতটি। পরেরদিন সকালে ঘুম থেকে জেগেই দেখি একঝাঁক চড়–ই।

ল্যান্ড লেডি ও আমি লুকিয়ে লুকিয়ে পাখিদের খাবার খাওয়া দেখি। খুশিতে আত্মহারা হই। এমন খুশি মনে হয় কখনো হইনি। গাছের যত্ম ও নতুন একটি ফুল এলেও যেনো খুশিতে নাচতে ইচ্ছে করে। শিশুসুলভ আচরণে একজন আরেকজনকে ডেকে দেখাতাম। ধীরে ধীরে প্রায় অনেক জাতের পাখির আনাগোনা ছাদের উপর এখন। সকালে খাবার দিতে দেরী হলেই শুরু হয় পাখিদের চিৎকার। প্রায় প্রতিদিন সকালেই পাখিদের চিৎকারে ঘুম ভেঙে যায়।

সকাল সকাল ঘুম ভেঙে গেলো তাই ফজরের নামাজ পড়ে গাছের যত্ন নিয়ে পাখিদের খাবার দেই। দেখতে দেখতে সকাল কেটে গেলো। কিন্তু কোনো পাখির শব্দ নেই ছাদে। বারবার রুমে যাই আর ছাদে আসি। কোনো পাখির দেখা মেলে না। কাজে বাইরে বের হই, সারাদিন ব্যস্ত থাকি। মন পড়ে থাকে ছাদের উপর। ভাবতে থাকি নিশ্চয়ই পাখিগুলো এসে খাবার খাচ্ছে। কিন্তু কাজের ব্যস্ততায় দেখতে পাচ্ছি না। মনটা বিষন্ন হয়ে যায়। বাসা ফিরতে ফিরতে রাত হয়ে যায়। ক্লান্ত শরীর নিয়ে রাতের খাবার খেয়ে ঘুমিয়ে পড়ি।

সকালে ঘুম ভাঙে না। কাক দুটোও জানালায় শব্দ করে না। বিছানায় পড়ে থাকি। সকাল নয়টা বাজে তবুও বিছানা ছাড়তে মন চায় না। বাইরে বের হয়ে দেখি গতকালের সব খাবার এখনও পড়ে আছে। আরো খাবার ছিটিয়ে দেই। চেয়ার নিয়ে বসে থাকি পাখিদের অপেক্ষায়। অপেক্ষার পালা শেষ করে একসময় কাজে বেরিয়ে যাই। কোথাও মন বসে না। কাজে ভুল হয়। ফোনে প্রিয়তমার সাথে সাধারণ কথায়ও বিরক্ত হই। মায়ের সাথেও কথা কম বলি পাছে খারাপ ব্যবহার করে ফেলি এই ভয়ে। এভাবেই বেশ কয়েকদিন কেটে যায়।
সকাল সকাল ঘুম থেকে উঠে ল্যান্ড লেডির দেখভাল করার মেয়েকে বলি-
কয়েকদিন ধরে কাক ও কোনো পাখিকেই দেখি না। কারণ কি হতে পারে বলতে পারো?
সে উত্তর দেয়-
সেদিন রাতে আপনি অনেক কাজ করে ঘুমালে?
হ্যাঁ।
আমি সকালে ঘুম থেকে উঠে দেখি, কাক আপনার জানালায় ঠোঁট দিয়ে শব্দ করছে। আবার কা কা করে বাড়ি মাথায় তুলছে। তাই আমি লাঠি নিয়ে তাড়িয়ে দিয়েছি। জানেন, কতো কষ্ট করে ফুলের বিজ লাগিয়েছি। পাখিগুলো সব গাছ ঠোঁট দিয়ে উপড়ে ফেলছে। কিছু কিছু অবশ্য খেয়েছেও। কার গায়ে জ্বর না আসে বলেন?
আমি স্থির হয়ে বোবার মতো সব শুনতে থাকি। ল্যান্ড লেডির এই আয়য়া যে আমাকে অনেক স্নেহ করে সেটা জানি। কার উপর রাগ করবো? এই অল্পশিক্ষিত আয়য়াই তো আমার অসুস্থতার সময়ে সেবা করেছে।

কিছু না বলে, বাসা থেকে বের হলাম। বনানী বাজারে বিদ্যুৎ লাইনের তারে অসংখ্য কাক জমা হয়ে কা কা ধ্বনিতে বাতাসকে মাতাল করে দিচ্ছে। এক এক করে সবগুলোর দিকে তাকিয়ে থাকি। সবগুলো কাক যেনো নিজের কাজে ব্যস্ত।

রাস্তায় বের হলেই কাক দেখতে পাই অসংখ্য। সব কাকের ভীড়ে আমি সেই দু’টো কাককে খুঁজতে থাকি। কাক দুটো যেনো আমার সন্তান।

কয়েকদিনের মধ্যে অন্য পাখিরা ধীরে ধীরে ফিরতে শুরু করলো। কিন্তু সকালের ঘুম ভাঙাতে আর…

© এনাম রাজু

চলতি সংখ্যা