সোহেলি

সোহেলি স্কুল থেকে এসেই প্রায়ই দেখতে পায় ওর মা আর অমিত পাশাপাশি বসে থাকে। আর কি সব বিষয় নিয়ে হো হা হা হা করে হাসে..

ওকে দেখলেই হাসি থেমে যায়। দুজনেই একে অপরের কাছ থেকে দূরে যাওয়ার চেষ্টা চালায়। অমিত সোহেলি দিকে তাকিয়ে হাসতে হাসতে বলে।

কি মা?

স্কুল ছুটি হয়ে গেলো। নাকি ফাঁকি দিয়ে চলে এলি…

না আঙ্কেল স্কুল ছুটি হয়ে গেলো। সোহেলি, তোমার জন্য ক্যাটবেরি চকলেট নিয়ে এনেছি। মা এবার হাসতে হাসতে বলে; সবকিছু তোর টেবিলে রাখা আছে।তোর আঙ্কেল কি যে করে না…

অমিত সোহেলিকে যতেষ্ট স্নেহ করে। কিন্তু ওর কাছে অমিত আঙ্কেলের স্নেহ বিষাক্ত মনে হয়। ওর যতেষ্ট বুঝার বয়স হয়েছে। ওর শরীরেও যৌবনের ছাপ পরিপূর্ণ। সোহেলির বাবা মিনহাজ, বিদেশে যাওয়ার পর থেকেই বাবার বন্ধু অমিত নিয়মিত হলো ওদের বাড়িতে। সোহেলির বিষয়টা খারাপ লাগলেও ওর মা বিষয়টা নিয়ে তেমন ভাবে না।

সোহেলি ঘরে যেতেই দুজনেই কাছাকাছি হওয়ার চেষ্টা করল। আবার ফিসফিসি কথা আর হাসি ধ্বনি ঘর পর্যন্ত শোনা গেলো।

কি যে বলো না অমিত।

প্লিজ অসভ্যতা করো না, সোহেলি দেখে ফেলবে। না দেখবে না।

সোহেলি সবকিছু শুনতে পায়। আবার অসহ্য হয়ে কানে আঙ্গুল দিয়ে রাখে। চোখ রক্ত বর্ণ হয়ে ওঠে। হিংস্রতার অনলে জ্বলতে থাকে। একসময় নিভে যায় সে আগুন। কিন্তু অমিত আঙ্কেল আর মায়ের প্রতি ঘৃর্ণা হতেই থাকে ওর।

রাঁত দশটা বাজে। সোহেলির মাথায় মায়ের হাত পরল। ওর চোখ দিয়ে দুকূল ভেঙে জল বয়ে চলার চেষ্টা করল। কি্ন্তু সোহেলি চোখ দিয়ে জল ঝরতে দিল না। কি হয়েছে মা?

কিছুইনা…

বেশি রাঁত জাগিস না। শুয়ে পর।

মায়ের এমন নিয়মিত বাণী সোহেলির কাছে আজ ভালো লাগছে না। মায়ের সব কথাই যেন কুসিৎ শুনাচ্ছে। মায়ের সবকিছুই যেন ছলাকলা নাটক মনে হচ্ছে ওর কাছে।

সকাল সকাল সোহেলির মা নাস্তার টেবিলে। সোহেলি এই সোহেলি…

তাড়াতাড়ি নাস্তা করে নে। স্কুলের সময় হয়ে গেলো যে। সোহেলি ব্যস্তময় ভঙ্গি নিয়ে নাস্তা করছে। গতকালের ঘটনাটা কিছুই যেন মনে নেয়। প্রতিদিনের মতো আজও সোহেলির মা সোহেলিকে নিয়ে ব্যস্ত। সেও মায়ের কাছে আদরে আটখানা। মা আমার বড্ড দেরি হয়ে যাচ্ছে। আমি স্কুলে চললাম।

সোহেলি আজ স্কুলে না গেলে হয় না। কেন কি হয়েছে? আজ মন ভালো নেই। বুকের মধ্যটাও তীব্র ব্যাথা করছে। কি হয়ছে মা?

তোর বাবা বিদেশে সাদা চামড়ার ম্যাডামকে বিয়ে করেছে। সোহেলির মা এসব কথাগুলো বলতেই হু হু করে কেঁদে উঠল। ওর চোখেও জল গরিয়ে পরতে লাগল। মা এসব কি কথা বলছ? বাবা এমন কাজ করতেই পারে না। বাবা তোমাকে আমাকে কত ভালোবাসে।

আমাদের সুখের জন্যই তো বাবা বিদেশে। সোহেলির মা কাঁদতে কাঁদতে বলতে লাগল…

তোর বাবাকে তুই চিনিস না। ওর পশমে পশমে শয়তানি।

সোহেলি চোখ মুছতে মুছতে রাস্তায় বেড়িয়ে পরল। আজ কিছুই ভালো লাগছে না স্কুল কিংবা খোলা মাঠ। শ শ গাড়ির ভিড়ের রাস্তা। লাল নীল সিগন্যাল। কিছুই ভাল লাগছেনা। সবকিছুই যেন আজ অসহ্য।শহরের বাইপাস রোড ধরে সোহেলি হাঁটতে লাগল। এই রোডে আগেও হেঁটেছে বাবার সাথে। সোহেলির কথাগুলো মনে পরছে। ওর কাছে মনে হচ্ছে বাবার স্পর্শ নিয়ে রোডটিতে হাঁটছে। বাবা তুমি কি আরেকটি বিয়ে করেছো? 

কোন উত্তর এলো না..

সোহেলি উত্তর না পেয়ে অবাক হলো না। সোহেলির কাছে নিজেকেও প্রাণহীন রোডের মত মনে হল। এই পথ শুধু লম্বা হতে শিখেছে। কিন্তু নিজের কোন শান্তি নেই। সবাই কেমন ব্যাথা দিয়ে যায়…

দুপুরের রোদ উতপ্ত হয়ে উঠছে।শান্তি আসলে কোথাও নেই। মনের ভিতর কিংবা শহরের ছোট্র অলিগলিতেও না।শান্তি শুধু ছুটে বেড়ায় এ শহর থেকে অন্য শহরে।এ দেশ থেকে অন্য দেশে। শুধু শুধু অলস মন দাহ করে দিয়ে যায়।শান্তিকে কখনো বলব না কাছে এসো। শুধু শুধু জ্বালা ধরায়।লোভী মন আরো লোভী করে তোলে…

শহরের দক্ষিণ দিকে বড় রাস্তাটিতে সোহেলি হাঁটছে। কাঁধে এখনো স্কুল ব্যাগ।সোহেলির কাছে জীবন মানে এখন অদ্ভুত সময়। জীবন মানে নোংরামি আর মুখোশের অদ্ভুত বেড়াজাল।

সোহেলি কিছুতেই এই বেড়াজাল ভেঙ্গে ফিরতে পারছে না। সবাই শুধু কেমন করে দূরে দূরে চলে যায়। সোহেলির প্রতিটা নিঃশ্বাসের প্রতিধ্বনিতে কষ্ট আর হতাসার ব্যাঞ্জনা। এ সময়ে সামান্য ওজনের স্কুল ব্যাগ ওর কাছে অনেক ভারী মনে হচ্ছে। সোহেলি স্কুল ব্যাগ ছুরে ফেলে দেয় ময়লা আবর্জনার মধ্যে।

সোহেলি অজানার পথে হাঁটতে শুরু করেছে।আর বিরবির করে বলতে লাগল। যা তোরা কুকুরের মত যৌনতায় মগ্ন হ…

পতিতালয় গিয়ে শরীর বিক্রি কর। যা যা যা…

ততক্ষণে অন্ধকারের ছায়া পরেছে শহরে। ল্যাম্পপোষ্টের বাতিগুলো জ্বলে উঠেছে। সেডিয়ামের লাল নীল বাতিতে এ শহর বিচিএ লাগছে। সেই সাথে মানুষের রূপ বিকৃত দেখাচ্ছে। সত্যিই মানুষ বড় বেশিই বিকৃত হয়ে উঠেছে। মানুষের মুখে আজ হৃদয়ের তীক্ষ্ন কালিমা।

সোহেলি ওভারব্রীজের উপর দাড়িয়ে রাঁতের শহর দেখছে।প্রচন্ড বাতাসে গায়ের লোম শিউরে উঠছে। রাঁত যত বাড়ছে। এই শহর তত অদ্ভুত হয়ে উটছে। রহস্যময় একটা অন্ধকার ঘিরে ধরছে শহরকে। গাঁজা মদ আর হিরোইনের আসর জমে উঠল ওভারব্রীজের উপর।

সোহেলির চারপাশে অজানা এক বিপদ ঘিরে ধরেছে তাকে। এ শহরে কোথাও শান্তির আশ্রয় নেই। মানুষই মানুষের ভয়। আজ মানুষ মানুষের জন্য বিপদ।

কিছু বখাটে সোহেলিকে খাবলে খাওয়ার চেষ্টা করছে। এক হামলে গিলে খেয়ে ফেলবে।

মদের বোটকা গন্ধে দম বন্ধ হয়ে উঠছে ওর। সাপের মত বখাটেরা ছোবল দিতে শুরু করেছে। কুসিৎ সব শব্দ ব্যাবহার করছে…

কিরে মাগি কত নিবি? ঘন্টায় কত নিয়ে থাকিস? না বাবা আজ কিন্তু ফ্রি তে দিতে হবে।

পকেট একদম খালি। বখাটেরা সোহেলির শরীরের উপর ঝাপিয়ে পরল। সোহেলির চিৎকারে আরো ক্ষেপে উঠছে বখাটেরা। এই বেশ্যা মাগি এই মাগি আরেও চিল্লা আরেও চিল্লা। ওর চিৎকার কেউ শুনতে পেল না কিংবা শুনেও এলো না।

সোহেলির শরীর থরথর করে কাঁপতে শুরু করেছে। একেবারে হাঁটতে পারছেনা। ওর মাথার মধ্যে এলোমেলো হতে শুরু করেছে। আমি কি বেশ্যা, নাকি ওরা?

ওরা আমাকে বেশ্যা কইলো ক্যান? হয়তে আমি বেশ্যাই…

সোহেলি রাস্তার ধারে বসে পড়ল। সোহেলির পাশ কেটে হন বাঁজাতে বাঁজাতে গাড়ি চলে যাচ্ছে। হঠাৎ সোহেলির সামনে একটি সাদা রঙের মাইক্রো থামল। কিরে আজ কাস্টমার জুগাইতে পারিসনি। আয় উঠে আয়…

সোহেলি ওখান থেকে উঠে আবার হাঁটতে লাগল। কিরে কি হলো মাগি?

বেশ্যাগিরি ছেড়ে দিলি নাকি? সোহেলির নিজের কাছে নিজেকেই বেশ্যা মনে হলো। আর মনে হলো এ এক বেশ্যাগিরির শহর।

– শাহরিয়ার জাহাঙ্গীর

চলতি সংখ্যা