আহমেদ শিপলু
বার পড়া হয়েছে
প্রকাশিত :
ফেব্রুয়ারি ১, ২০১৯
শেয়ার :
পয়স্তিতে যারা লিখেছেননির্দেশিকাশর্তাবলী
আহমেদ শিপলু

দেহ

এক

পান্থপাদপেরা পাখা মেলে দাঁড়িয়ে থাকে, যেনো নরম অতীত; বিকেলের শান্ত আলোয় দেখা সেই কিশোরী চিবুক! অতীতেরা সাধারণত একান্নবর্তী। দুঃখরা সংসারী হলে চুম্বনেরা চলে যায় বনবাসে।

চুম্বনের কথা উঠলে চোখের মাদকতায় জলকেলি খেলে কমলা সুন্দরী, প্রেমিক মন তবু সংশয়ী। অন্য পুরুষের ঠোঁটে স্ত্রীকে চুমু খেতে দেখা সেতারবাদকের সুরে দুঃখ গড়ালে, শিখে নিই উপেক্ষার মন্ত্র।

তোমাকে উপেক্ষা করেছিলাম বলে ভ্যাসলিনের কাটতি বেড়ে গিয়েছিলো বাজারে; আমরা রেখে এসেছি এইসব সম্ভাবনা। গলির মোড়ে, দেয়ালে দেয়ালে; বৈদ্যুতিক খুটির দূরত্বে রেখে এসেছি আমাদের স্পর্শ।

বৈদ্যুতিক তারে লটকে থাকা বাদুড়ের জীবন নিয়ে কি করে এগোই বলো! বরং এসো আমাদের গোপন গল্পের জন্য শ্মশানে চণ্ডালের কাছে যাই, আত্মাদের আড্ডায় বসে কাঠ আর ঘিয়ের অনুপাত নির্ণয় করি।

দুই

তাকাও আমার দিকে, কেননা আমি তোমার চোখের দিকে তাকিয়ে পার করে দেবো সৌরচক্র। তাকাও অপলক, যেনো কোনোভাবেই আমার চোখ অন্যকিছু না দেখে; কেননা সেইসব বিষ-দৃশ্য আমাকে হত্যা করবে বার বার! আমি বাঁচতে চাই!

দোহাই, তোমার ওই চোখ থেকে আমাকে সরতে দিও না, তাহলে সর্বনাশ হয়ে যাবে! কেননা আমি তাহলে দেখে ফেলবো মানুষের ভয়ানক রূপ! অথবা মুখোশের আড়ালে কিরকম বীভৎস বাসনায় লিপ্ত!

তাকাও আমার দিকে, দেখো এই চোখে কোনো পাপ নেই; কেবল আগুন পাবে এখানে। হে সুন্দর, তোমার চোখ থেকে আমাকে বঞ্চিত করো না; আমি যে দেখতে চাই না কোনো অসুন্দর! আমাকে আশ্রয় দাও, আমাকে ভস্ম করো! পবিত্র করো!

তিন

তোমার চোখে কিছুই লেখা ছিলো না হয়তো, তবু আমি পড়তে চাইতাম। তোমার গালে, ঠোঁটে কোনো অলৌকিকতা ছিলো কি না জানি না; অপার রহস্যময়তায় হারাতাম বারবার!

এভাবে একদিন পাখির মৃত্যুকে বীভৎস ভেবে তোমার বুকে চোখ বুজেছিলাম। ওখানে কোনো ধর্মশালা না থাকলেও পবিত্রতার প্রলেপে একটা প্রেমময় আকাশ ছিলো হয়তো! না হলে এমন উড়লাম কী করে!

আমাদের সেইসব জড়াজড়ি বিকেল, আর সন্ধ্যাগুলো আলোচ্য হয়েছিলো যাদের টেবিলে, আড্ডায়; চায়ের কাপে কিংবা মদের গেলাসে চুমুক দিতে দিতে তাঁরা কোনোদিন ভাবতেই পারেনি আমাদের যৌথযাপনের রহস্য! জানতে পারেনি আমি তোমার পুরুষ, অথবা তুমি আমার নারী। অথবা আমরা বিসর্জন দিয়েছিলাম পরস্পরের দূরত্ব!

চার

নাভি থেকে নেমে গেছে চাঁদ, চোখের চৌবাচ্চায় ঘুমের সাঁতার, চুমুরা গেছে নক্ষত্রপাড়ায়; আমাদের রাতগুলো দেহ ছেড়ে অন্য কোথাও চলে গেছে হয়তো। নইলে বালিশ কেন আলাদা!

আমাদের আঙুল থেকে একদিন চুইয়ে নামতো রোদ, উত্তাপে উত্তাপে দুমড়ে যেতো হাড়ের বসতি! রোমশবনে নেচে নেচে হাঁপাতো ‘বনিএম’! কোরাসে কোরাসে গেয়ে যেতো ‘রাশপুটিন’!

একদিন আমাদের ত্বক থেকে ত্বকে প্রবাহিত হতো বিদ্যুৎ! দূর থেকেই টের পেতাম রক্তের যাতায়াত! ঘামের গন্ধ কী তা জানতামই না, নাসারন্ধ্রে কেবল চুলের সৌরভ, ঠোঁটের ঘ্রাণ!

এখন আমাদের পিঠজুড়ে কেবল শীতের আবাস, বুকের কপাটে নেই সেই জলের উল্লাস! এখানে এখন বয়সী বৃক্ষের স্থবিরতা। শুকনো নদীর পারে যেমন সারি সারি নৌকার উপুর শুয়ে থাকা!

পাঁচ

আঙুলের নৈঃসঙ্গ টের পায় করতল, কনুইয়ে ভর করে অপেক্ষা করে বাহু, একটা আস্ত সাহারা লেপ্টে আছে বুকজুড়ে! তুমি জানোনি কোনোদিন।

যে রাস্তায় তুমি হেঁটে যেতে রোজ, দাঁড়াতে, অপেক্ষা করতে; সে রাস্তার ধুলোরাও প্রিয় ছিলো খুব! ল্যাম্পপোস্ট, দেয়াল, ছেড়া পোস্টার, ম্যানহোলের ভাঙা মুখ; মুখস্থ সব!

তুমি জানোনি এইসব অপচয়, পায়ে পায়ে হেঁটে যাওয়া ঘুরপথের গল্প বলিনি তোমায়; কারণ সব কথা বলে দিলে হৃৎপিণ্ড ফাঁকা হয়ে যায়। তাহলে আমার আর কিছুই থাকে না।

তুমি তো ছিলে না কোনোদিন, অথবা যদি না থাকো, তবে ওই রাস্তার রহস্যগুলো অন্তত থাক; সব দেহ মজে না দেহের খোলসে, কোনো কোনো দেহে থাকে মনের প্রাসাদ।

ছয়

বাইরে ঝড়! বাইরে রোদ! বাইরে হিমশীতল! বাইরে মেঘলা আকাশ! বাইরে যেও না। এখন আর বলে না কেউ।

রাতের তারারা থাকে বুকের কাঁপনে! মিটিমিটি জ্বলে দুঃখ! সহজে হয় না সহজ কাজ; হারানো প্রহর ফেরে না কখনো, কচুর পাতায় এখন আর জলেরা দাঁড়াতে চায় না।

দেহ থেকে মন আলাদা হলে দেহে আর কোনো প্রেম থাকে না; তখন দলিতমথিত প্রত্যঙ্গরা অহেতুক হাঁপায় শুধু!

বাইরে প্রেমিক, বাইরে পুরুষ, বাইরে ধার্মিক, বাইরে মানুষ! বাইরে যেও না।

সাত

কালো মেয়ের নাকে নোলোক
কালো মেয়ের চোখে কাজল
কালো মেয়ের ঠোঁটে হাসি
এইসব চিন্তার উঠোনজুড়ে দুর্ভাবনারা বসে থাকে।

ও মেয়ে তুমি কেঁদো না
ও মেয়ে তুমি ভেবো না
ও মেয়ে তুমি জেগো না
একদিন কেউ এসে বলে যাবে
এই অপেক্ষায় কাটানো বেলা শেষে
সকলেই বলে গেলো: রঙটা আরেকটু উজ্জ্বল হলে কেটে যেতো মেঘ।

একটা উজ্জ্বল চকচকে রিং
সোনার হোক, রুপার হোক
একটা নিবিড় আংটির জন্য
অপেক্ষা করে অনামিকা
অপেক্ষা করে কালো দেহের অভিশাপে দগ্ধ কালো মেয়ে!

আর ওইদিকে দুনিয়া মাতিয়ে গেলো ‘বনি এম’
কালো মানুষের গলায় সুর মেলালো নাচলো, গাইলো, সাদা সাদা মানুষেরা!

পল রোবসন, মাইকেল, বব মার্লে
কালো কালো দেহ নাচিয়ে গাইলো জীবনের গান, মানবতার গান।
আর পৃথিবীর সকল রাজপথ আর জেলখানায় পৌঁছে গেলো সেইসব মানুষের খবর! যেখানে লেখা ছিলো কালো কালো অক্ষরে কালো কালো মানুষের নাম---মার্টিন লুথার কিং, নেলসন ম্যান্ডেলা…

আট

একটা অদ্ভুত সুর বেজে গেলো চিরকাল… হাড়ের গিটারে, শিরার তারে তারে টুং টাং… টুং টাং…

সেই সুর বাজাতে চাইলাম বারংবার! যে সুর অবিরাম মরুভূমির মতো বিশুষ্ক প্রান্তরে প্রান্তরে ফোটাতে পারতো সবুজ পাতা, হলুদ ফুলের মতো উজ্জ্বল দুপুর; প্রেয়সীর হাসির মতো বৈকালিক উদ্যানে মেলা বসাতে পারতো যে সুর।

খুঁজলাম সেই বাদকের ঘরবাড়ি, পেলাম না কোথাও। কেবল কান পেতে শুনলাম সেই সুর! অন্তর্গত বেদনার মতো একাই বাজালাম, একাই গাইলাম। কেউ শুনলো না সেই সুর, জানলো না কেউ কোনোদিন।

নয়

তোমার দিকে ধেয়ে এলো নদী
তোমার দিকে ছুটে এলো সড়ক
তোমার দিকে নেমে এলো চাঁদ
তবু তুমি গুটিয়ে যেতে থাকলে নিজের দিকে!

একটা বিষণ্ন সাপের সাথে খেলছিলো ঝগড়াটে রোদ
একটা রাগি বেজির সাথে হাসছিলো বৃষ্টির জল
আর আমি পান করে নিলাম বিষের গেলাস!

একটা দৃশ্য বদলে দিতে পারে এইসব আখ্যান
একটা চাহনি পালটে দিতে পারে চলার গতি
আর আমিও পেরিয়ে যেতে পারি লোকালয়
ফেলে আসতে পারি সকল সম্ভাবনা।

তোমার উপস্থিতিই কেবল খুলে দিতে পারে সকল সম্ভাবনার দ্বার, পূর্ণ করতে পারে সকল আয়োজন।

menu-circlecross-circle