খনা-পুরুষতন্ত্রের ঈর্ষার বলি এক নারী

বাংলা সাহিত্যে বহু প্রবাদ-প্রবচন রয়েছে, যেগুলো শুধু শুধুমাত্র সাহিত্য নয় বরং দর্শন এমনকি বিজ্ঞানসম্মত বা বাস্তবসম্মতও বটে। এক সময় এগুলোর চর্চা ছিল। এখন এই চর্চাটা কমে গেলেও মানুষের ভেতর থেকে একেবারে হারিয়ে যায়নি। এর মধ্যে উল্লেখযোগ্য হল খনার বচন।

“পৌষ গরমি বোশেখ জাড়া
প্রথম আষাঢ়ে ভরে গাড়া”

-অর্থাৎ, পৌষ মাসে গরম থাকলে এবং বৈশাখ মাসে ঠা-া থাকলে আষাঢ়ের প্রথমেই খুব বৃষ্টি হবে- ডোবা গাড়া জলে ভরে যাবে।
এরকম অসংখ্য প্রবাদ বা বচন এ অঞ্চলে প্রচলিত রয়েছে। এগুলোর বক্তা একজন বিদুষী নারী যার নাম খনা। তাই এগুলো খনার বচন নামে পরিচিত। যদিও অনেকেই খনার বচনের অনেক শ্লোককে কুসংস্কার বলে আখ্যা দিতে পারেন, বিশেষ করে এই আধুনিক যুগে। কিন্তু আমাদেরকে বুঝতে হবে খনার বচন সৃষ্টির সেই সময় ও প্রেক্ষাপটকে। তাছাড়া পুরোটাই যে কুসংস্কার নয় এবং অধিকাংশই বাস্তবসম্মত তা বলার অপেক্ষা রাখে না।

কিন্তু খনার বচনকে অবহেলা করার কোন কারণই নেই। কারণ খনার বিজ্ঞানভিত্তিক বচনগুলো এ অঞ্চলের জলবায়ু ও মহাকাশের গ্রহ-নক্ষত্রসমূহের গবেষণা থেকে প্রাপ্ত। অবশ্য কখনও এগুলো সংরক্ষণের ব্যবস্থা নেয়া হয়নি। অথচ গ্রামের মানুষগুলো এখনও এই বচনগুলো মেনে চলে। নিঃসন্দেহে খনার বচনকে কেবল লোকবচন না বলে বিজ্ঞান হিসেবে আখ্যায়িত করা যায়।

খনার নাম প্রায় আমরা সবাই জানি। বিশেষ করে গ্রামের মানুষের কাছে খনা অধিক পরিচিত। কৃষি, আবহাওয়া ও সংসার জীবনের নানা বিষয় নিয়ে খনার বচনগুলো এখনও মানুষের মুখে মুখে রয়েছে এবং তার বচন বা শ্লোকগুলো নির্ভুলভাবেই প্রতিফলিত। ফলে বাংলাদেশের শতকরা ৯০ জন কৃষকই খনার বচন সম্পর্কে অবহিত। কিন্তু বেশিরভাগই মুখস্ত আওড়াতে পারে না। ফলে অনেক বচনই সংরক্ষণের অভাবে হারিয়ে গেছে এবং নতুন করে সংগ্রহ করাও প্রায় অসম্ভব। বাংলা পঞ্জিকায় কিছু সংখ্যক খনার বচন দেয়া আছে। কিন্তু তার সংখ্যা একদমই কম। একারণেই সহস্রারাধিক বচনের মধ্যে আমারা পাই বেশি হলেও দুইশত।

কে ছিল এই খনা? এটাও অধিকাংশ বাঙালি জানে। খনা সম্পর্কে বাংলা ও উড়িয়া এই দুই ভাষাতেই কিংবদন্তি রয়েছে। খনা যার প্রকৃত নাম লীলাবতী ছিল লংকা দ্বীপের রাজকুমারী। লংকা দ্বীপবাসী তথাকথিত রাক্ষসগণ একদিন সবংশে তার পিতা মাতাকে হত্যা করে এবং শিশু রাজকুমারী লীলাবতীকে হস্তগত করে। ঠিক একই সময়ে, উজ্জয়িনীর মহারাজ বিক্রমাদিত্যের নবরত্ন সভার অন্যতম জ্যোতির্বিদ পণ্ডিত বরাহ ভুল গণনাবশত জানতে পারলেন যে তাঁর পুত্র অকালে মারা যাবে। তাই তিনি শিশু সন্তানকে একটি বাক্সে ভরে নদীতে ভাসিয়ে দেন। বাক্সটি ভাসতে ভাসতে লংকা দ্বীপে পৌঁছালে দ্বীপবাসী শিশুটিকে উদ্ধার করে এবং লীলাবতীর সাথেই লালন-পালন করতে থাকে। দ্বীপবাসী শিশুটির নাম রাখে মিহির। উভয়েই দ্বীপবাসীদের নেতার আশ্রয়ে বড় হতে থাকে এবং শিক্ষা-দীক্ষা ও জ্যোতিষবিদ্যা আয়ত্ত করতে থাকে। এক সময় লীলাবতী ও মিহির জ্যোতিষশাস্ত্রে পারদর্শী হয়ে উঠল। লীলাবতী ও মিহির দুজন দুজনের প্রেমে পড়ে যায় এবং বিয়েও করে তারা।
তখন লীলাবতী ও মিহির দ্বীপবাসীদের বন্দিদশা থেকে পালাবার পথ খুঁজতে থাকে। একদিন গণনা করে নিরাপদ দিন দেখে সাগর পাড়ি দিয়ে তারা চলে আসে ভারতবর্ষে। লীলাবতী জানতে পেরেছিল মিহির ভারতবিখ্যাত জ্যোতির্বিদ বরাহের পুত্র। সুতরাং উভয়েই উজ্জয়িনী নগরে এসে নিজেদের পরিচয় দেয়। মিহিরের পিতা তাদের সানন্দে গ্রহন করেন।

এদিকে লীলাবতীর জ্যোতিষশাস্ত্রে অগাধ জ্ঞানের কথা চারিদিকে ছড়িয়ে পড়ে। মহারাজ বিক্রমাদিত্য লীলাবতীকে রাজসভায় প-িত হিসেবে আসন দান করেন। ফলে লীলাবতী অন্যান্য প-িতদের ঈর্ষার কারণ হতে থাকে। ঈর্ষান্বিত হতে থাকে বরাহ এবং মিহিরও। একদিন পিতা-পুত্র মিলে পরামর্শ করল লীলাবতীর জিহবা কেটে নেবার। পিতৃ আদেশে মিহির লীলাবতীর জিহবা কেটে নেয়। কিন্তু মাত্রাতিরিক্ত রক্ত ক্ষরণে লীলাবতী মারা যায়। জিহবা কেটে নেবার আগে লীলাবতী মিহিরকে অনুরোধ করেছিল কিছু কথা বলার সুযোগ দেবার। মিহির সে সুযোগ দিলে লীলাবতী তখন কৃষি, আবহাওয়া তত্ব, জ্যোতিষশাস্ত্রীয় তথ্য এবং মানবজীবনের বিভিন্ন কথা বলে যায়। যা পরবর্তীকালে বোবার বচন বা খনার বচন (খনা অর্থ হল বোবা) নামে পরিচিত।
এটাকে সাধারণভাবে নেবার সুযোগ নেই। বরং বলা চলে চিরকাল ধরে টিকে থাকা পুরুষতন্ত্রের নোংরা আঘাত যা একজন নারীর সমৃদ্ধি মেনে নিতে পারেনি। সমাজ চিরকাল নারীকে অধস্তন করতে চেয়েছে, খনার ক্ষেত্রেও তার ব্যতিক্রম ঘটেনি। নারীর গৌরব বা খ্যাতি যেন পুরুষের কাছে অসম্মানের হয়ে দাঁড়িয়েছে এবং পুরুষতন্ত্র দমিয়ে রাখতে চেয়েছে নারীকে।

খনার মত আরও একজনের নাম উঠে আসে, তার নাম হাইপোশিয়া। মিশরের এই নারী গণিতসহ নানা বিষয়ে এতটাই পারদর্শী ছিলেন যে আলেকজান্দ্রিয়া লাইব্রেরিতে তার বক্তৃতা শুনতে দূর-দূরান্ত থেকে মেধাবীরা ভীড় করতো। কিন্তু পুরুষতান্ত্রিক সমাজব্যবস্থা একজন নারীর এই সমৃদ্ধি সহ্য করতে পারেনি। তাকে নগ্ন করে কয়েক টুকরো করে হত্যা করা হয়।

বলে রাখি- নারীর প্রতি এরকম বৈষম্য আরোপ করতে আশ্রয় নেয়া হয় ধর্মের। ফলে দেখা যায় কোনো ধর্মই নারীকে যোগ্য সম্মান দিতে পারেনি। এক জায়গায় তাকে দেবি রূপে উপস্থাপন করা হয়েছে, অন্যখানে তাকে ভোগ্যপণ্য বানানো হয়েছে। এ প্রসঙ্গে উল্লেখ করা যায়- নারীকে দমিয়ে রাখতে একসময় নারীর সংবেদনশীল অঙ্গ ক্লাইটোরিস বা ভগাঙ্কুর কেটে দিয়ে নারীর খৎনা করানো হত। এবং পুরুষতন্ত্র দীর্ঘদিন এই বিভৎস প্রথা চালু রেখেছিল যাতে নারী যৌন ক্ষমতা অনুধাবন না করতে পারে।

আমরা গার্গীর কথা জানি। ব্রহ্মজ্ঞানে সে সবাইকে পরাজিত করলেও তাকে দেয়া হয় দ্বিতীয় স্থান। কারণ সে নারী, বিশ্বামিত্রের মতন বাঘা বাঘা তাত্ত্বিকেরা তার নীচে থাকা যে বেমানান। আসল ব্যাপারটা হল পুরুষতন্ত্র।

কিন্তু খনার মত এখনও নারী আপন যোগ্যতায় উঠে আসছে এবং চ্যালেঞ্জ ছুঁড়ে দিচ্ছে পুরুষতন্ত্রের বিরুদ্ধে এটাই বড় কথা। ফলে ধর্মের শাসন আর পুরুষতন্ত্রের গ-ি ডিঙিয়ে নারী বাইরে বের হয়েছে। সাহিত্য থেকে শুরু করে বিজ্ঞান চর্চা কোনোটাতেই নারী পিছিয়ে নেই। তাছাড়া সভ্যতার শুরুতে নারীর হাত ধরেই চালু হয়েছিল পৃথিবীর কৃষি ব্যবস্থা যা আমরা ভুলে যাই। সেই প্রাচীন পৃথিবীতে নারী-পুরুষে কোনো বৈষম্য ছিল না। অথচ সভ্যতা যত এগিয়েছে নারীকে ততই আবদ্ধ করে রাখার প্রয়াস চালিয়েছে পুরুষতন্ত্র। পুঁজিবাদী ও ভোগবাদী সমাজের বিকাশে নারী হয়ে পড়েছে আরও অসহায়। কিন্তু মেরি ওলস্টানক্রাফট বা বেগম রোকেয়ার মত নারীরা প্রথা ভেঙ্গে এগিয়েছেন। ফলে নারী নানা ক্ষেত্রে নোবেল পুরস্কারও জিতছে, রাষ্ট্রও পরিচালনা করছে। এ যেন যুগে যুগে খনাদের বিজয়। পুরুষতন্ত্রের যূপকাষ্ঠে সেদিন খনার আত্মাহুতি নারীকে থামিয়ে দিতে পারেনি। সভ্যতার ক্রমবিকাশে নারী বার বার প্রমাণ করেছে নারী কেবল পুরুষের সেবাদাসী বা ভোগ্যপণ্য নয়, এমনকি কেবল গৃহে আবদ্ধ থেকে গৃহিনীর কাজ বা শিশুপালন করার জন্যও নয়, বরং সমাজের যেকোনো কিছুতে সে অবদান রাখতে সক্ষম।

তথ্যসূত্র: বাংলা পঞ্জিকা, খনার বিজ্ঞান-অরূপ রাহী।

© সুদেব চক্রবর্তী

চলতি সংখ্যা