দেবী

দীর্ঘদিন ধরে ফাইল কেবিনেটে জমে থাকা অগোছালো কাগজপত্র গোছগাছ করতে গিয়ে ভাঁজ করা একটি কাগজের দিকে চোখ গেল মামুনের। কৌতুহলী চোখে এক নিঃশ্বাসে চিঠি পড়া শেষে গুম হয়ে বসে থাকলো। এরই মধ্যে সে স্মৃতির তরী বেয়ে চলে গেল দূর অতীতে। এই তো সেদিনের কথা। অথচ পেরিয়ে গেছে চল্লিশ বসন্ত। যৌবনরাজ্যে সদ্য অভিষিক্ত ষোল বসন্তের এক টগবগে তরুণ প্রেমে পড়েছিলো সমবয়সী ভিন্ন ধর্মের একটি তরুণীর। বেশ কেটে যাচ্ছিলো দিন হাসি আর আনন্দে। মনুষ্যত্বের কাছে ধর্মের বৈপরীত্য কোন বাঁধা হতে পারে না। কিন্তু বাঁধ সাধলো নিষ্ঠুর সমাজ।
ক্লাস ফাঁকি দিয়ে একদিন রমনা পার্কে ঘুরতে গিয়েছিল মামুন আর মিতালী। ব্যাস! আর যাবে কোথা? পড়বি তো পড় মালির ঘাড়ে! মিতালীর এক দূর সম্পর্কের দাদার চোখে পড়ে গেল দুজনে। ব্রাক্ষ্মণ কন্যার সাথে বিজাতি মুসলিম ছেলের মেলামেশা অবিশ্বাস্য, মহাপাপ। জাত গেল, জাত গেল বলে হুলস্থূল পড়ে গেল মিতালীদের বাড়িতে। 
মিতালীর বাবা নারায়ণ ভট্টাচার্য টেলিফোন এন্ড টেলিগ্রাফ বোর্ডের রমনা অঞ্চলে সহকারী প্রকৌশলী হিসেবে কর্মরত। মামুনের বাবাও পোস্ট এন্ড টেলিগ্রাফ বিভাগের রমনা অঞ্চলে সেকশন অফিসার পদে কর্মরত। একই কম্পাউন্ডে দুই পরিবারের বসবাস। নিবিড় সখ্য রয়েছে দুই পরিবারের মধ্যে। 
প্রায় এক সপ্তাহ হয়ে গেল মামুন ও মিতালীর পরস্পর মুখ দর্শন ঘটেনি। কথা বলা তো দূরের কথা। মামুন ছটফটিয়ে ওঠে। বুকের ভেতর মোচড় দিয়ে ওঠে। ডিসেম্বরের তীব্র শীতের মধ্যেও শরীর ঘামে ভিজে চুপচুপে হয়ে যায়। কম্পাউন্ডের ভেতরে মিতালীদের কোয়ার্টারের এ প্রান্ত ও প্রান্ত ঘোরাঘুরি করেও কারো দেখা মেলে না। জানালা দরজা বন্ধ। আঁৎকে ওঠে মামুন। তবে কি মিতালীরা কেউ নেই কোয়ার্টারে?
রমনা পার্কে লেকের ধারে বেঞ্চিতে পাশাপাশি বসে কত কথাই না সেদিন বলেছিলো মিতালী।বাদাম চিবোতে চিবোতে গলা জড়িয়ে ধরে বলেছিলো-‘এই শোন, তুমি তো বিজ্ঞানের ছাত্র, তোমাকে কিন্তু বুয়েটে চান্স পেতেই হবে। আমার কথা ভেবে ভেবে পড়াশোনা মাথায় তুলবে না একদম। আমি তোমারই আছি, আমৃত্যু তোমারই থাকবো।মামুন মিতালীর মুখের দিকে অপলক তাকিয়ে থেকে আকাশের দিকে মুখ তুলে বললো-আমার ভীষণ ভয় করে। তোমাকে হারানোর ভয়। তোমার আমার সম্পর্ক তোমার পরিবার কখনোই মেনে নেবে না।’মিতালী মামুনের ঠোঁটের ওপর হাত চাপা দিয়ে বলে-কেন মিছে ভয় পাচ্ছো! সেরকম অবস্থা হলে আমি তোমার সাথে অজানার পথে পাড়ি জমাবো।মিতালীর মুখের কথা শেষ হতে না হতেই  ওর খুড়ততো দাদা রাতুল বেঞ্চির পাশ ঘেঁষে পার্কের গেটের দিকে চলে গেল। মিতালী ও মামুনকে অনেকক্ষণ আগেই দেখেছে সে। তার হাঁটার নির্বিকার ভঙ্গি বলে দিচ্ছে যে, তোমাদের আমি অনেকক্ষণ ধরে লক্ষ্য করছি। পাশ ঘেঁষে জানান দিয়ে গেলাম আমি তোমাদের দেখেছি।
ঘাম মোছার জন্যে হিপ পকেটে রাখা রুমাল বের করতে গিয়ে ছোট নোটবুকটা হাতে উঠে এলো। রুমাল হাতে রেখে নোটবুক পকেটে রাখতে গিয়ে হাত থেকে ছিটকে মাঠের ঘাসের ওপর পড়ে গেল আর ভেতরে রাখা একটা ভাঁজ করা কাগজও বেরিয়ে এলো। নোটবুক পকেটে রেখে কাগজটা নিয়ে মামুন ল্যাম্প পোস্টের নীচে এসে দাঁড়ালো। ভাঁজ খুলে চোখের সামনে এনে পড়তে লাগলো। রাত বারোটায় ঢাকা-২ থেকে ১৩ আগস্ট চিঠিটা লেখা। এখন যে এলাকা ঢাকা-১০০০ পোস্টকোড যুক্ত, সেটাই ১৯৮৪ সাল পর্যন্ত ঢাকা-২ ছিলো। অর্থাৎ মিতালী চিঠিটা কম্পাউন্ডের কোয়ার্টারে নিজ ঘরে বসেই লিখেছিল সাড়ে তিন মাস আগে। ১৪ আগস্ট সকালে একটা বইয়ের ভেতরে ভরে চিঠিটা একটা লাল গোলাপ ও এক কপি ছবি সমেত মামুনের ঘরে মিতালী রেখে গিয়েছিল। ১৪ আগস্ট মামুনের জন্মদিন। মামুনকে মিতালী ‘সুজন’ বলে ডাকতো আর মিতালীকে মামুন ‘দেবী’ বলে ডাকতো।
অনেক বার পড়া চিঠিটা আবারও পড়তে শুরু করলো মামুন-
সুজন,আমার শুভেচ্ছা ও ভালোবাসা জেন।কাল তোমার জন্মদিন, তাই না? তাই এ দিনে তোমায় আমার এক কপি ফটো উপহার দিলাম। এ ছবিটা আমি নবম শ্রেণীর প্রথম দিকে তুলেছিলাম। আর যে লাল গোলাপটা দিয়েছি সেটার সৌরভের সাথে আমার হৃদয় নিঙড়ানো ভালোবাসা দিয়েছি। তোমার হৃদয়ের গভীর যত্নে রেখ।তোমার পড়াশোনা কেমন হচ্ছে? খুব খাটতে হচ্ছে, তাই না? দুলাভাই ও আপারা সব কেমন আছেন? আজ আর নয়। এখানেই ইতি টানছি কেমন। ভালো থেকো।ইতি-তোমারই,দেবী
সকালে কম্পাউন্ডের বাইরে বাজারের পথে মামুনের সাথে মিতালীদের পাশের কোয়ার্টারে বসবাসরত সহপাঠী শরীফের সঙ্গে দেখা হলো। জরুরী কথা আছে বলে শরীফ মামুনকে নিয়ে মোড়ের মাথার আমিন রেস্টুরেন্টে ঢুকে চায়ের অর্ডার দিয়ে বললো, ‘দোস্ত, তুই কি জানতিস মিতালীর পরিবারের সবাই গত সপ্তাহে কোলকাতায় আত্মীয় বাড়ীতে গিয়েছিল?’কই নাতো! আমি তো কিছুই জানি না। মামুন দৃঢ়তার সাথে মাথা ঝাঁকিয়ে জবাব দিলো।’মিতালীকে ঘরে আটকে রেখে ওর বাবা ও  মা মিলে ওকে খুব মারধর করেছে। আমি কাল রাতে মায়ের কাছ থেকে সবই জানলাম। এ ঘটনার সাথে তোরও একটা যোগসূত্র আছে মায়ের মুখ থেকে এমনটাই আভাষ পেলাম। তাই তো তোকে এখানে নিয়ে এলাম এ কথাগুলোই বলতে। গতকাল রাতে মিতালীর বাবা, মা, ভাই ও বোন সবাই কোলকাতা থেকে ফিরে এসেছে। কিন্তু মিতালীকে ওরা কোলকাতায় রেখে এসেছে।’
কথাটা কানে যাওয়া মাত্রই দেবীঈঈঈঈঈঈ বলে বিকট চিৎকারে মামুন চেয়ার ছেড়ে লাফিয়ে উঠলো আর হাত থেকে গরম চায়ের কাপ ফ্লোরে পড়ে শত টুকরো হয়ে গেল। ঘটনার আকস্মিকতায় রেস্টুরেন্টের অভ্যন্তরে  থাকা খদ্দেররা বিহ্বল দৃষ্টিতে মুখ চাওয়া চাওয়ি করতে লাগলো। শরীফ কিছু বলতে চাইলো, ঠিক সেই সময় মামুন হঠাৎ উন্মাদের মত চেঁচাতে চেঁচাতে দৌড়ে রেস্টুরেন্ট থেকে বেরিয়ে গেল। শরীফ তাল সামলে নিয়ে মামুনের পিছে পিছে ছুটতে লাগলো। আর চারপাশ জুড়ে একটি ধ্বনি প্রতিধ্বনি হয়ে ফিরতে লাগলো- দেবীঈঈঈ, দেবীঈঈঈঈ, দেবীঈঈঈঈঈ…

চলতি সংখ্যা